Sucharita Das

Abstract Classics Fantasy

4  

Sucharita Das

Abstract Classics Fantasy

এক টুকরো আশ্রয়

এক টুকরো আশ্রয়

10 mins
173



"হ্যালো সমীর, তুই কখন গাড়ি পাঠাবি?" অমর জানতে চাইলো তার ভাইকে।


"ভাবছি বিকালের দিকে , দুপুরে একটা নিমন্ত্রণ আছে ।" অপর প্রান্ত থেকে সমীরের উত্তর।


অমর আবার বললো,"সময়টা একটু আগে করলে হয় না? আসলে আমাদের ও একটা নিমন্ত্রণ আছে সন্ধ্যেবেলা তো ,তাই বলছিলাম।" 


অপর প্রান্ত থেকে সমীরের উত্তর,"আচ্ছা দেখছি দাঁড়া। যদি একটু আগে ফিরতে পারি, তাহলে তোর বাড়ি হয়েই ফিরবো একেবারে।"


অমর আবার বললো, "দেখিস একটু তাড়াতাড়ি যদি আসতে পারিস।"


সমীর "দেখছি" বলে ফোনটা কেটে দিলো।


দুই ভাইয়ের ফোনে কথোপকথন বিমলা দেবী নিজের জন্য বরাদ্দ এ বাড়িতে তার রান্নাঘরের লাগোয়া ছোট্ট স্টোর রুমটায় বসে সবই শুনতে পাচ্ছিলেন। সত্যি বুড়ো বয়স অবধি বেঁচে থাকার এতো অশান্তি।সবার ওপর কেমন যেন বোঝার মতো হয়ে গেছেন। দুই ছেলে ছমাস ছমাস করে ভাগাভাগি করে বিমলা দেবীকে রাখে।কেমন যেন ভাগের মা মনে হয় নিজেকে বিমলা দেবীর। অথচ তিনি তো বারবার বলেছিলেন, স্বামীর পৈতৃক ভিটেতেই থাকবেন। তখন দুই ছেলেই বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির অনুষ্ঠানের সময়ই জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা এই অজ গ্ৰামে এসে মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে না। বিমলা দেবী বারবার বলেছিলেন , দেখাশোনা করবার জন্য তো ওখানে অনেকেই আছে আত্মীয়স্বজনরা। গ্ৰামের লোকজন শহরের লোকজনের মতো নয়, তাদের আন্তরিকতাও বেশী। তাই তাঁর কোনো অসুবিধাই হবে না। কিন্তু দুই ছেলেই তাঁর কথা শোনেনি। আসলে এর মধ্যেও যে ছেলেদের প্রচ্ছন্ন স্বার্থ ছিলো, সেটা বিমলা দেবী তখন বুঝতে পারেননি। বুঝেছেন , কিন্তু অনেকটাই পরে। আসলে তখন দুই ছেলেরই ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার জন্য একজন আয়ার খুব দরকার ছিল। আর ঠিক সেকারণেই দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তও নিয়ে নিয়েছিল ,যে মা ছমাস ছমাস ভাগাভাগি করে দুই ভাই মাকে রাখবে। 



বিমলা দেবীর মনে আছে এখনও, চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন গ্ৰামের বাড়িতে।একান্নবর্তী পরিবারের বড়ো বউ বিমলা দেবী সবাইকে নিয়ে সুখে, দুঃখে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর যে এই পরিণতি হবে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তিনি যখন গ্ৰাম থেকে শেষবারের মতো চলে আসছিলেন, বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক তাঁর সুখ, দুঃখের সঙ্গী অল্প বয়সের স্বামীহারা ননদ গিরিবালা অনেকবার বলেছিলো, "বৌদি এই আশ্রয় ছেড়ে যাস না। শেষ জীবনটা স্বামীর ভিটেতেই কাটিয়ে দে। এর থেকে সম্মান কিছুতেই পাবি না।" সত্যি আজ গিরিবালার কথাগুলো বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে বিমলা দেবীর। ‌সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটা সত্যিই খুব প্রয়োজন। একটু মাথা গোঁজার আশ্রয়ের জন্য, এভাবে ভাগের মা হয়ে বেঁচে থাকা যে কি অসম্মানের তা আজ তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানে না। এ বেঁচে থাকা সত্যিই বড়ো কষ্টের।



বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বিমলা দেবী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন ছোট্ট চৌকিতে রাখা গোপালের কাছে। ছোট্ট ঘরটায় তো জিনিসপত্র ভরা। তাও ওরই মধ্যে একটু জায়গা বের করে নিয়েছিলেন নিজের গোপালের জন্য। বিয়ে হয়ে যখন গ্ৰামের বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলেন, তখন দিদি শাশুড়ি এই সোনার ছোট্ট গোপাল দিয়েছিলেন। গ্ৰামের বাড়ি ছেড়ে যখন বড় ছেলের এখানে প্রথম আশ্রয় হয়েছিল তাঁর, নিজের এই ছোট্ট ঘরে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গোপালেরও আশ্রয় জুটেছিল ঠিকই, কিন্তু গোপালের নিত্য ভোগের ব্যবস্থা এখানে তিনি করতে পারেননি। বৌমাকে যখন বিমলা দেবী ভোগের কথা বলতে গিয়েছিলেন, তখন বৌমা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, মিছরি না তো বাতাসা দিয়ে পুজো করতে। এর বেশি এখানে সম্ভব না। বিমলা দেবী ধীরে ধীরে ছোট্ট চৌকির উপর রাখা গোপালকে উঠিয়ে নিলেন। আর এক হাতে নিজের জামাকাপড়ের ছোট ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। নাতির কাছে গিয়ে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন," ভালোভাবে থাকবে তুমি। একটুও দুষ্টুমি করবে না। ঠিক করে খেয়ে নেবে"। নাতি জড়িয়ে ধরে বললো, "কেন ঠামি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ।" বিমলা দেবীর চোখগুলো জলে ভরে গেল। মনে মনে ভাবলেন, তোকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে তো আমারও করছে না, কিন্তু আমি অসহায়। 




 ছোট ছেলের বাড়িতে যখন পৌঁছোলেন তখন প্রায় সন্ধ্যে। ছোট ছেলের বাড়ি বেশ বড়ো। এখানে বিমলা দেবীর নিজের একটা ঘর আছে, এই ঘরেরই এক পাশে ঠাকুরের সিংহাসন। ঘরে ঢুকে বিমলা দেবী সবার প্রথমে , নিজের গোপালকে ঠাকুরের সিংহাসনে বসালেন। আজ থেকে আবার ছ মাস এই ঘরেই বিমলা দেবীর এক টুকরো আশ্রয়----

বড় ছেলের বাড়িতে যেমন নাতিটি তাঁর বড়ো প্রিয়জন, ছোটছেলের এখানে নাতনি। যদিও সেও খুবই ছোট এখন। তাও ঠামিকে কাছে পেলে সে বড়ো খুশি হয়। ঠামির কাছে রাজা, রানী, রাজকন্যা, রাজপুত্রের গল্প শুনতে সে ভীষণ ভালোবাসে। এখানে এলে বিকালে যখন নাতনির দেখাশোনা করার মেয়েটি তাকে নিয়ে বিকালে সামনের পার্কটায় যায়, বিমলা দেবীও ওদের সঙ্গে যান ।বাইরের খোলা হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়াও হয়, আর তার সঙ্গে একটু হাঁটাহাঁটি করলে শরীরও ভালো থাকে। আজও যখন নাতনিকে নিয়ে মেয়েটি বেরোবে ,তখন বিমলা দেবীকে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি," ও মাসিমা তুমিও যাবে তো পার্কে হাঁটতে হাঁটতে?" বিমলা দেবী বললেন,"হ্যাঁ চল্ একটু হেঁটে আসি।" 

পার্কে একটু খোলামেলা জায়গায় যেখানে ওনার বয়সী অনেকেই হাঁটাহাঁটি করেন, বিমলা দেবীও সেখানেই একটু পায়চারি করছিলেন। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ 'সখী বৌদি' বলে ডাকলো বিমলা দেবীকে। এই নামে তো একজনই ডাকতো বিমলা দেবীকে। বিমলা দেবী এপাশ ,ওপাশ তাকিয়ে দেখলেন। কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছেন না। তাহলে মনে হয় মনের ভুল। সত্যিই তো এখানে এই নামে তাঁকে ডাকবার কেউই নেই। আবার কেউ ডাকছে ওই নামেই । না এটা তো মনের ভুল না। বিমলা দেবী দেখলেন, তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে পৃথুলা চেহারার এক ভদ্রমহিলা। তাঁরই বয়সী হবে মহিলা। কাছে আসতেই ভদ্রমহিলাকে চিনে নিতে এত বছর পরে হলেও বিমলা দেবীর এত টুকুও অসুবিধা হলো না। সেই দুর্গা প্রতিমার মতো মুখশ্রী, সেই মাখনের মত ফর্সা গায়ের রং, তাঁরই খুড়তুতো ননদ বেলা। বিয়ে হয়ে গ্ৰামের বাড়িতে যাবার পর এই বেলা ই তাঁর সবথেকে প্রিয় বন্ধু হয়েছিল। এক বয়সী বলে দুজনের মধ্যে মনের মিল খুব হয়েছিল। বিমলা দেবীর আজও মনে আছে, দুজনে কতো গল্প করতেন। তারপর তো দুবছর পর বেলারও বিয়ে হয়ে গেল। দুই সখীতে সেই ছাড়াছাড়ি। এরপর বেলা খুব কমই বাপের বাড়িতে আসতো। ওর শ্বশুরবাড়িতেও বড়ো পরিবার ছিলো।আর ও একমাত্র ছেলের বউ ছিলো। এতদিন পরে হলেও বিমলা দেবীর মনে আছে, কোলকাতার এপাশেই কোথাও বেলার শ্বশুরবাড়ি ছিলো। দুই সখী একে অপরকে এতো বছর পর দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। 



দুজনের কতো মনের কথা জমে আছে এত বছরের। বেলা জিজ্ঞেস করলো,"সখী বৌদি তুমি এখানে ?" বিমলা দেবী বললেন নিজের কথা। আর তার সঙ্গে এটাও জানলেন যে বেলার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। এখন কেউই নেই সেখানে। ওর স্বামী তো অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। ছেলে মেয়েরা সব বিয়ে থা করে বাইরেই থাকে। তারা এখানে বেড়াতে আসে বছরে একবার। মায়ের জন্যে সবকিছু ব্যবস্থা তারা করে দেয় ,যা দরকার হয় ।আর তাই আপাতত ঐ বাড়িতে বেলা একা থাকে, আর থাকে দুজন কাজের লোক। বেলা তো আজই তার সখী বৌদিকে নিয়ে যেতে চাইছিল নিজের বাড়ি। কিন্তু ওদিকে নাতনিকে নিয়ে মেয়েটি এসে গেছে। আজ তাই আর দাঁড়ালো না কেউই। কিন্তু বিমলা দেবী বেলাকে কথা দিলো যে আগামীকাল নিশ্চয়ই যাবে বেলার বাড়ি।

                       


বিমলা দেবীকে নিয়ে বেলা দেবী আজ নিজের বাড়ি গেলেন। কাজের মেয়েটিকে বিমলা দেবী বলে দিলেন সে যেন নাতনিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যায় বৌমা ফেরবার আগেই। তিনি একটু পরে আসবেন। বিমলা দেবী বেলাদেবীর সঙ্গে তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখলেন, বিশাল পুরোনো আমলের বাড়ি। বড়ো গেট খুলে যখন ওঁরা দুজনে ভেতরে ঢুকলেন, তখন বাড়ির পুরোনো কাজের লোক দরজা খুলে দিল। এতো বড়ো বাড়িতে বেলা একা থাকে। তাও দুটো পুরোনো কাজের লোক আছে সঙ্গে, এটাই নিশ্চিন্ত। বেলা দেবী পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর সখী বৌদিকে। উনি তো নীচের ঘরেই থাকেন, হাঁটুতে ব্যথা তাই দোতলায় উঠতে পারেন না। কিন্তু আজ বেলাদেবী তাঁর সখী বৌদিকে দোতলায় নিজের আগেকার ঘরে নিয়ে গেলেন। দুই ছোটবেলার সাথী একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী হলো কত বছর পর। ওঁদের দুজনের কথার মাঝে কাজের মাঝ বয়সী মেয়েটি চা, একটু জলখাবার নিয়ে এলো। বিমলা দেবী এইসময় সচরাচর কিছু খান না। তাই শুধুমাত্র চা খেলেন। 



গল্প করতে করতে কতো সন্ধ্যে হয়ে গেল। বিমলা দেবী তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। বেলা দেবীকে বলে বেরিয়ে পড়লেন ছোট ছেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘরে ঢুকতেই বৌমা জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় ছিলেন এতো সন্ধ্যে পর্যন্ত।আমরা কতো চিন্তা করছিলাম জানেন।" বিমলা দেবী বললেন,"একটু দেরী হয়ে গেল বৌমা, অনেকদিন পর এখানে তোমার পিসি শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল গতকাল। আজ ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম একটু। কিছুতেই ছাড়লো না।" ওনাদের কথার মাঝেই ছোট ছেলে সমীর ঘরে ঢুকলো। বিমলা দেবী উৎসাহিত হয়ে বললেন,"জানিস সমু গতকাল পার্কে তোর বেলা পিসির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আজ ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কি বড়ো পুরোনো আমলের বাড়ি বেলাদের, অথচ ও একা থাকে। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে থাকে। তারা বছরে একবার আসে বেড়াতে।" ছোট ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,"এখানে সবাই এরকমই করে মা। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকে। বৃদ্ধ বাবা ,মা হয় একা থাকে ,না হলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়ে যায়।" কথাটা শুনে বিমলা দেবীর মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। ছেলে কি আভাসে ইঙ্গিতে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো শোনালো। কই একবারও তো এটা জানতে চাইলো না যে, বেলা পিসি কেমন আছে। 



বিমলা দেবী নিজের ঘরে চলে গেলেন আর কোনো কথা না বলে। ছেলের কথায় মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল বিমলা দেবীর। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন, এতো বছর পর বেলার সঙ্গে মন খুলে কতো গল্প করলেন। দুজনে দুজনকে কতো সুখ দুঃখের কথা বললেন, এটাই তো অনেক। ভগবানের ইচ্ছায় এত বছর পর তাঁর গল্প করার একটা সঙ্গী তো হলো। তাও আবার তাঁর ছোটবেলার সঙ্গী। মনের মধ্যে একটা আলাদা খুশির অনুভব হচ্ছে আজ অনেকদিন পর। বেলা বলেছে রোজ বিকালে পার্কে দুজনে খুব গল্প করবে। কখনও ওর বাড়িতে। এই নিঃসঙ্গ জীবনে এই বয়সে একজন সঙ্গী পেয়েছেন, এটাই অনেক।

                          


    

  যেদিন থেকে বেলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, বিমলা দেবী অপেক্ষা করে থাকেন রোজ কখন বিকাল হবে। আজ আবার বেলা দেবীর বাড়িতে পুজো হয়েছে, তাই বেলাদেবী একবার যেতে বলেছেন। বিমলা দেবী বেলা দেবীর বাড়ি গিয়ে দেখলেন, আরোও অনেকেই আছেন ওনাদের বয়সের। বেলাদেবী বললেন, সবাই এই আশেপাশেই থাকেন। সবাই প্রসাদ নিয়ে চলে গেলে ,বেলা দেবী বললেন,"জানো সখী বৌদি এদের নিয়েই আমার এত বছর সময় কেটেছে। এরা আছে বলেই আমি বুঝতে পারিনি এতদিন যে একা আছি। এদের কারুর ছেলে বউ বাইরে থাকে, কারুর বা একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কারুর ছেলে মেয়ে আবার মা, বাবার বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে ,মা বাবার শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নিতে চাইছে। কোনো ছেলেমেয়ে আবার দায়িত্ব নিতে হবে বলে , মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগই কমিয়ে দিয়েছে। বুঝলে সখী বৌদি, এই হচ্ছে আমাদের বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের জীবন। বিমলা দেবী তাঁর বন্ধুটিকে বললেন," জানিস বেলা কাল সমু ও আমাকে ঠেস দিয়ে কথা শোনালো। বললো নাকি এখনকার ছেলেমেয়েরা মা, বাবাকে জেনেশুনেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। কেউই দায়িত্ব নিতে চায় না আজকাল।" বিমলা দেবী বেলা দেবীকে আরোও বললেন," কতো ভালো হতো বলো ঠাকুরঝি, যদি আমাদের বৃদ্ধ ,বৃদ্ধাদের এই বয়সে একটা শান্তির নীড় থাকতো। এক টুকরো আশ্রয়ের জন্য কারুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো না তাহলে আমাদের।"



বিমলা দেবীর কথা শুনে বেলা দেবী বললেন,"বড়ো ভালো কথা বলেছো তো সখী বৌদি। এক টুকরো শান্তির আশ্রয় এই বয়সে তো সবাই চায়। শেষ বয়সটায় নিজের মতো করে একটু বাঁচার অধিকার তো সকলেরই আছে।" সেদিনের মত বিমলাদেবী ছেলের বাড়ি ফিরে গেলেন। বেলা দেবী কিন্তু সেই থেকে একটা কথাই ভেবে যাচ্ছেন, তাঁর সখী বৌদির কথাগুলো কিন্তু বেশ দামি কথা। এই বয়সে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের এক টুকরো শান্তির আশ্রয়। পরদিন বিমলা দেবী আসতে বেলা দেবী বললেন, "সখী বৌদি একটা কথা মনে মনে ভেবেছি। তুমি কাল বলেছিলে, আমাদের বয়সী বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের শান্তির আশ্রয়ের কথা। আমি ভাবছি , আমার এই এতো বড়ো বাড়িটা তো তোমাদের জামাই দাদা আমারই নামে লিখে দিয়ে গেছেন। এই বাড়িটাকেই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের শান্তির নীড় বানাবো। আমি আর তুমি তো থাকবই। আর থাকবে আমার দুই পুরোনো কাজের লোক।" বিমলা দেবী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, "সত্যি বলছো ঠাকুরঝি। তোমার এই বাড়িতে তুমি আমাকেও রাখবে? আমাকে আর দুই ছেলের সংসারে ভাগের মা হয়ে থাকতে হবে না।" আনন্দে বিমলা দেবীর চোখ থেকে জল ঝরে পড়লো। বেলাদেবী ওনার সখী বৌদির চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, " সখী বলে ডেকেছি তোমাকে, আর সখীর সুখে দুঃখে থাকবো না তা কি করে হয়? আর একটা কথা সখী বৌদি, তুমি কিন্তু কালই তোমার জিনিসপত্র নিয়ে আমার এখানে চলে আসবে। অনেক কাজ করতে হবে তো আমার এই বাড়িকে শান্তির আশ্রয় করে তুলতে হলে। সমু কে বলে দিও, তুমি কাল থেকে তার পিসির এখানেই সারা জীবন থাকবে।"




রাত্রিবেলা বিমলা দেবী ছেলেকে বললেন,"সমু তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।" ছেলে খেতে খেতে বললো," বলো কি বলবে।" বিমলা দেবী শান্ত গলায় বললেন, "কাল থেকে আমি তোর বেলা পিসির ওখানেই থাকবো। যে কটা দিন বাঁচবো, নিজেদের মতো করে বাঁচার রাস্তা খুঁজে নেব আমরা। তোর বেলা পিসির ইচ্ছে ,ওর অতবড় বাড়িটাকে আমরা দুজন মিলে ,আমাদের বয়সী বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের শান্তির আশ্রয় বানাই।" বিমলা দেবী আরো বললেন, "আমি তোর কাছে ওখানে থাকবার অনুমতি চাইছি না। তোকে আমার সিদ্ধান্ত টা জানিয়ে দিচ্ছি। তোর দাদাকেও জানিয়ে দিস কথাটা। আর এটাও বলে দিস তার সঙ্গে, তোদের মা আর ভাগের মা হয়ে থাকতে চাইছে না। মা হিসেবে এটাই আশীর্বাদ করবো, তোরা সবসময় সুখে থাক, আনন্দে থাক।আর আমার মতো শেষ জীবনে তোদের যেন ভাগের মা, বা ভাগের বাবা হয়ে বেঁচে থাকতে না হয় কখনও। আর আমার জন্যে তোদের ভাবতে হবে না আর। তোদের বাবার পেনশনের টাকায় আমার আর আমার গোপালের ঠিক চলে যাবে"। কথাগুলো বলে বিমলা দেবী নিজের ঘরে চলে গেলেন। অনেক কাজ আছে তো। সব গুছিয়ে নিতে হবে।



বিমলা দেবীর কথায় সমীর আর ওর বৌ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। তারা কখনও এটা ভাবতে পারেনি যে তাদের মায়েরও একটা এরকম আশ্রয় জুটে যেতে পারে এই শহরে। পরদিন সকালে বিমলা দেবী নিজের গোপালকে সঙ্গে নিয়ে, বেলা দেবীর বাড়িতে চলে গেলেন। বেলা দেবী সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁর সখী বৌদিকে। এখানে বেলা দেবীর পুজোর ঘরে গোপাল এতদিন পর তাঁর নিশ্চিত আশ্রয় পেল। এবার থেকে গোপালের নিত্য পুজো আর নিত্য ভোগ দেবেন বিমলা দেবী।



দুই সখীতে মিলে ঠিক করলেন, দুর্গা পূজোর আগেই যে সমস্ত বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা থাকতে চান এখানে, তাঁদের থাকা, খাওয়ার সব ব্যবস্থা করবেন। বেলাদেবী বিমলা দেবীকে বললেন,"জানো তো সখী বৌদি, তোমাদের জামাইদাদা আমার জন্য যে এত টাকাপয়সা , সম্পত্তি রেখে গেছেন, এতদিন পর তার যথাযোগ্য ব্যবহার হবে। সবার আগে পুরোনো কাজের লোক জগন্নাথকে বলে, একটা সুন্দর নামসহ ব্যানার লাগাতে হবে বাড়ির মেন গেটে। তবে তো পাঁচজন বৃদ্ধ বৃদ্ধারা জানবে এই বাড়ি সম্পর্কে। দুই সখীতে মিলে ঠিক করলো এই বাড়ির নতুন নামকরণ হবে, 'এক টুকরো আশ্রয়'। যে আশ্রয় হবে অগণিত বৃদ্ধ, বৃদ্ধার শেষ জীবনের পরম নির্ভরতার আশ্রয়স্থল।







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract