এক সমুদ্র ভালোবাসা
এক সমুদ্র ভালোবাসা
ঝুমার স্বপ্ন শ্যামলের রানী হবার। কিন্তু ওকে শ্যামল বিয়ে করবে কেন ? ওতো নষ্ট মেয়ে। কিন্তু ওর মন বলে শ্যামল ওকে বোধহয় ভালোবাসে। শ্যামল প্রথম দিন যখন ঢুকে ছিলো ওর ঘরে। পুচকিটাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য লাইট বন্ধ করে রেখেছিলো। শ্যামল আলো জ্বালাতে গেলে, ও না করেছিলো। বলেছিলো ওদের জীবন তো অন্ধকার আলো জ্বালিয়ে কি হবে। আর মনে আছে শ্যামলকে ও অনুরোধ করেছিলো পাঁচ মিনিট সময় দিতে , পুচকিকে ঘুম পাড়িয়ে ও আসছে। পুচকিকে ঘুম পারানোটা ও চুপ করে দেখে ছিলো। সেইদিন শ্যামল ওকে কিছু করে নি। কিন্তু পয়সা দিয়ে গেছিলো । সেইদিন কেন কোনদিন কিছু করে নি।এখন ও মাঝেমধ্যেই আসে ওর ঘরে। কিন্তু কিছু করে না ওর সাথে। পুচকিকে আদর করা দেখে, ঘুম পারানো দেখে, খাওয়ানো দেখে , পড়ানো দেখে। শ্যামল ওকে টাকা দিয়ে ওর দুই তিন ঘন্টা কিনে নেয় , বলে ঐ দুই তিন ঘন্টা যেনো ও পুচকিকে সময় দেয় মন দিয়ে।
ঝুমা মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। যদিও নষ্ট মেয়েদের ভালোবাসতে নেই কখনও। তবু বুদ্ধি করে ও শ্যামলকে বলে দিয়েছে পুচকি ওর কেউ নয়। ঝুমার কোন ছেলেকে ভালবাসা উচিত নয় যদিও। সল্প শিক্ষিত ঝুমা রহিমকে ভালোবেসে ছিলো। ঝুমারা পাঁচ বোন ও সবার ছোট। ওর বাবা ব্রাহ্মন ছিলো। ধর্ম ভিরু তাই বংশের পূর্ব পুরুষেরা যাতে জল বাতি পায় তাই একটা ছেলে প্যায়দা করতে গিয়ে পাঁচ পাঁচটি মেয়ের জন্ম দিলো। কিন্তু মেয়েরাতো বোঝা। তাই পন ছাড়া বিয়ে দিতে কি কষ্ট করতে হয়েছিল ওর বাবাকে ও তা ঝুমা দেখে ছিলো। দুই দিদিকে বিয়ে দিতে গিয়েই ওর বাবা ফতুর হয়ে গিয়েছিল। ওর বিয়ে দিতে পারবে না বাবা "ও" জানতো। রহিম ওকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলো। বলেছিলো বড় শহরে গিয়ে দুইজনে কাজ করে সুখে সংসার করবে। কিন্তু কে জানত তখন রহিম ওকে ঠকাবে। মুম্বাই পৌঁছেতে ওকে স্টেশানে বসিয়ে,ওর গহনা গাটি নিয়ে সেই যে ও গেলো রহিম আর ফিরলো না। ওর বাড়ি ফেরার মুখ ছিলো না। ও আত্মা হত্যা করতে চেয়েছিল। তখন রেশমি দিদি ওকে বাঁচায়। আজ আর রেশমি দিদি বেঁচে নেই। পুচকিকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। পুচকিকে বাপের ঠিক নেই, তাই ঝুমা ওর মা হলো।
শ্যামল ওর গল্পটা শুনতে চাইনি। তবুও ও শ্যামলকে ওর গল্পটা বলেছে। ঠিক সমুদ্রটা সমুদ্র সৈকতকে যেমন গল্প শোনায় অনর্গল তেমনি। সমুদ্রের সবচেয়ে আপন কাছের মানুষ সমুদ্র সৈকত। কিন্তু সমুদ্র তো সৈকতকে ছুঁয়েতে পারে। সৈকত তাকে প্রত্যাখান করলে অভিমানে ফিরে যায় সে নিরবে। কিন্তু ঝুমার ভালোবাসা হয়তো সমুদ্রটার চেয়ে বড় , সমুদ্রটার চেয়ে গভীর। কিন্তু তার ভালোবাসার কথা সে শ্যামলকে বলতে পারেনি। ওতো একটা রেন্ডি। ওর লজ্জা কিসের রোজ পর পুরুষের সামনে জামাকাপড় খুলে শুয়ে পড়েছে কতবার কয়েকটা টাকার বিনিময়ে। তবু শ্যামলকে ছুঁতে লজ্জা লাগে ওর। ও সমুদ্রের মতো ভালোবাসার নোনা জলের ভেজাতে চায় শ্যামলকে। সমুদ্রের বালু কনার মতো চিপকে থাকতে চায় ওর শরীরের।সমুদ্রের মতো ছোটবেলার গল্প , বড়বেলার গল্প অনর্গল বলে গেছে ও শ্যামলকে । কিন্তু ও যে শ্যামলকে ভালোবাসে সে কথা জানতে পারিনি কখনো।
আজ ঝুমা সত্যিই নিজের সমুদ্র মতো ভাবতে পারে। নদী যেমন বহিতে বহিতে ক্লান্ত হলে সমুদ্রের কাছে এসে আত্মসমর্পন করে। শ্যামল আজ ঝুমার কাছে করলো।ঐ সমুদ্র ছাড়া কেউ জানেনা শ্যামল কে? কোথা থেকে এসেছে এই বস্তিতে। শুধু সমুদ্রটা জানে আর আজ ঝুমা জানলো। ঝুমা বুঝতে পারলো কেন ওতো পাষান ও? পাথরের মতো শক্ত কেন ওর হৃদয়। ঝুমা মনে মনে বললো যতবার প্রত্যাখ্যান করুক। সমুদ্রের ঢেউ মতো ও বারবার ওর ভালোবাসা নিয়ে যাবে শ্যামলের কাছে।
শ্যামলের দুঃখটা সাগরের চেয়ে গভীর। তবু ও সাগর মতো আবেগী হতে পারে না। এক আকাশ স্বপ্ন দেখতে পারে না। ওর কোন স্বপ্ন নেই শুধু লক্ষ আছে। সাগরের বুকে গা ভাসিয়ে "ও" দিশাহীন হতে পারে না। ছোটবেলায় ওর বাবাকে হিরো হিসাবে দেখাতো। বিঘা তিনেক জমিতে ফসল ফলিয়ে ওদের তো বেশ ভালোই কাটতো দিন। ও ভাবতো ওর বাবা সবচেয়ে পরিশ্রমী শক্তিশালী বাবা। কিন্তু পরে ও বুঝতে পারলো, এ সমাজে শক্তিশালী তারা যারা ধার দেয়। কারণ একটা মানুষ সমাজ বাঁচবে না মরবে সেটা ঠিক করে ওরাই।
ওদের সবকিছুই ঠিক ঠিক ছিলো। উচ্চ ফলনশীল বীজ , রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু করলো ওর বাবাও অন্যদের মতো। দুই একবার ভালো ফসল হলো। কিন্তু পরে জমি নাকি নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করলো। যদিও ওই বীজটা পরে বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছিলো ঠিকই। কিন্তু ততো দিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ফেলেছিলো ওর বাবা। সেবার আবার কিটনাশক নাকি ওর বাবা বেশি ব্যবহার করে ফেলেছিল। তাই ফসল নষ্ট হয়ে গেলো।
খবরের কাগজে দেখা যায় প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা কর্পোরেট লোন মুকুব হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক হাজার টাকা দিতে না পারায় নিলাম নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছিলো ব্যাঙ্ক থেকে ওদের। নিলাম মানে কি সেদিন বুঝতে পারেনি ও। ওর বাবা মা বলেছিলো নিলাম মানে সরকার চোখে ওদের কতটা বেশি মূল্য দেওয়া যায়। ওর বাবা মা বড়ো নিষ্ঠুর ছিলো।ও যখন ঘুমিয়ে ছিলো ওকে রেখে একা একা আত্মহত্যা করে নিয়েছিলো। সেইদিন সবাই ওর বাবা মার লাশ সহ ঘরবাড়ি মুল্য নির্ধারন করেছিলো মাত্র পোনের হাজার টাকা।
শ্যামল আজ ভীষণ খুশি ছিলো। ও ওর বাবার জমি বাড়ি সব ফিরে পেয়েছে । নগদ পয়সা কিনেছে ও সব কিছু । শেষ বার সমুদ্র যাচ্ছে মাছ ধরাতে । ঝুমাও এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করবে । ঝুমা পুচকিকে নিয়ে ওর সাথে ফিরে যাবে ওদের গ্রামে। ঝুমা যখন খুব ছোট ছিলো তখন তো শ্যামলের বৌ হয়ে খেলনা বাটি খেলতো ওর সাথেই।,,,,,
