Rima Goswami

Tragedy Others

3  

Rima Goswami

Tragedy Others

এক মৃতের জবানবন্দি

এক মৃতের জবানবন্দি

6 mins
314


আমি আর নেই ,নেই মানে আর কি ? ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছে আর কি । মরে গিয়েও কি ভাবে যেন আমি সব কিছুই শুনতে পাচ্ছি , বন্ধ দুটো মৃত চোখ দিয়েও সেই সব কিছু দেখতে পাচ্ছি যা জীবন কালে দেখতে পাইনি । কি ভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে সত্যি জানা নেই আমার কারণ পরলোকে আমি একেবারেই আনকোরা নতুন মেম্বার । দুদিনের জ্বরে যে এভাবে আমি মরে যাব বিশ্বাস করুন সত্যি ভাবতে পারিনি । এখন আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে আমারই বেডরুমের মেঝেতে । একটু পড়ে আমার বোন আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিলেই বাইরে তুলসী মঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে । আমার বোন তার তো সামনেই বিয়ে ! কত দায়িত্ব ছিল আমার । আমি ওকে কনে সাজিয়ে ছাতনাতলা দিয়ে কোথায় নিয়ে যাবো ? ওই এখন কাঁদতে কাঁদতে দু চোখ জবা ফুলের মতো লাল করে আমাকে কনে সাজিয়ে দিচ্ছে । সধবা মৃত নারী যে শাস্ত্র মতে পুণ্যবতী । কিছুদিন আগেই আমার কেনা লাল বেনারসিটা আমাকে পরিয়ে দিয়েছে ও । যদিও অনেকেই ওজর আপত্তি জানিয়ে ছিলো । যে কি হবে পরিয়ে ? চিতায় তোলার আগে তো ডোম নিয়ে নেবে অত ভালো শাড়িখানা ? আসলে বোন জানত আমি আলমারির চাবি কোথায় রাখতাম তাই এক প্রকার জেদ করে চাবি খুলে শাড়িটা বের করে আমাকে পরিয়ে দিয়েছে । আমার আর এই ক্ষনিকের জন্য পৃথিবীতে থাকা শরীরে বেনারসির প্রয়োজন ছিলো না তবুও ভালো লাগছে বোনের কাজটা । আসলে ব্যাপারটা খুলেই বলি তা হলে । আমার বিয়ের সময় আমার কিন্তু একটা বেনারসি জোটেনি । আচমকাই পালিয়ে ছিলাম তো ওর সাথে ! যাক ডোমের যদি বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকে সে তো পরনের একটা বেনারসি পাবে ? আমি ওসব কুসংস্কার মানিনা যে মরা ছোঁয়া জিনিস বিয়েতে ব্যবহার করা যায় না । আমার কান থেকে সোনার কানেরটা কে যেন টুক করে খুলে শাশুড়ির হাতে দিলো । বোনের কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে । সোনার পলাটা খুলতে বলছে একজন । বোন খুলতে দিচ্ছে না । অসহায় মা বাধ্য হয়ে বললো , সোনার পাতটা পলা থেকে কাউকে ছাড়িয়ে নিতে । কি আর করবে মা , আসলে আমার বিয়েতে তো সোনা দিতে পারেনি । তাই জোর গলায় বলার ও অধিকার নেই যে তার মেয়ের শরীর থেকে পলাটা কেউ খুলবে না । বাবা কেমন যেন আচমকাই বুড়ো শীর্ণ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে নত মুখে । বাবা কাঁদছে.. ভিতরে কান্নার ঢেউ গুলো বাবার পাঁজরে ধাক্কা দিচ্ছে । প্রকাশ্যে কাঁদার অনুমতি যে পুরুষের নেই ! মা কেমন গুটিয়ে গেছে ! কাঁদছে সমানে তবু কেমন কুন্ঠিত যেন ! মেয়ে যে বিবাহিতা তাই তার মৃত শরীরটা এখন শশুর বাড়ীর দখলে । পিসি , মাসি সকলে ভিডিও কল করে আমার মৃত শরীরটা দেখতে চাইছে । আসলে ওদের দুঃখের থেকে কৌতূহলটাই বেশি বুঝতে পারলাম । আমার মরা শরীরটা আদতে কেমন দেখতে লাগছে সেটাই ওদের প্র্যাওরিটি । ননদ এসেছে গাড়ি ভাড়া করে অনেক দূর থেকে । খুব কাঁদছে আমাকে ঘিরে । তবে এখন যে রায়বাঘিনী ননদিনী আমি মনে পড়তে পাড়ি । তাই বুঝছি আংশিক দুঃখ হলেও যতটা দেখাতে চাইছো তত দুঃখ তোমার হচ্ছে না । এর মধ্যে টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হলো বলে নন্দাইকে হাজার বার বলেছো তুমি , ' বউদির আর সময় জ্ঞান নেই , দুম করে মরতে হলো ওনাকে !'


যতদিন বেঁচে ছিলাম আমাকে ব্যবহার করে গেছো তুমি ননদিনী । বাজার করো , রান্না করো , পার্লার চলো এসব করার পরও তোমার আমাকে জড়িয়ে অনেক অভিযোগ ছিলো । এদিকে এই মাত্র আমার শশুর মশাই এলেন তার শশুর বাড়ী থেকে । যেদিন আমার ধুম জ্বর এলো উনি বেড়াতে গেলেন নিজের শশুরের বাড়ি । ওনার নাকি বাড়িতে অসুস্থ মানুষ ভালো লাগেনা । সেই উনি আজ আমার মরার পর এসে আছাড় পাছার দিয়ে কাঁদছেন । শুনছি উনি নাকি ফিট হয়েও যাচ্ছেন ! শাশুড়ি বললেন , শশুর মশাই নাকি নিজের মেয়ের থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসতেন তো তাই আমি নাকি নিজে ওনার মায়া কাটাতে ওনাকে শশুর বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে ছিলাম । কে জানে কখন বলেছিলাম ওনাকে ? আমি যে আর প্রতিবাদ করতে অপরাগ তাই চুপচাপ মেনে নিতে হলো । যে বয়স্ক মানুষকে আমি দিনরাত বাবার মতো আগলে রেখে দিয়ে ছিলাম সে কি করে আমার অসুস্থতার সময় বেড়াতে চলে গেলেন ? আচ্ছা বলুন তো নিজের মেয়ে হলে এটা করতে পারতেন ? আমার বরকাকী এলো আর তার কি কান্না আমাকে জড়িয়ে ধরে । এই বরকাকীই জানেন ! একদিন আমার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় আমাকে বলেছিলেন , এই তুই গলায় দড়ি দিতে পারিস না ?


আজ ভাবছি ভগবান যদি আমাকে সেকেন্ডের জন্য আমার কন্ঠস্বর ফিরিয়ে দিতেন আমি কাকীর কানে ফিসফিসিয়ে বলতাম , কাকী আমাকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুললে কেমন লাগে তোমাকে দেখাবো এবার , দেখবে গো ?


আমার তিন বছরের মেয়েটা এদিক ওদিক ঘুরছে । ও কিছুই বুঝতে পারছে না । একবার করে মা মা করে এসে আমার পাশে বসে আবার উঠে যায় খেলা করতে । ও ভাবছে আমি ঘুমাচ্ছি । আমি জানি এর পর আমাকে যখন দেখতে পাবে না আর ও , তখন কাঁদবে । তার পর হয়ত ভুলে যাবে মাকে কিন্তু বড় হয়ে সারাজীবনের জন্য ওর মনে একটা ক্ষতর সঞ্চার হবে যে ও মাতৃহীন । আমি থাকলে বড় হয়ে আমাকে পাত্তা দিত কি না জানি না তবে আমার না থাকাটা ওকে কষ্ট দেবে । খুব কষ্ট হচ্ছে আমার মেয়ের জন্য । আমার স্বামী , আমাকে যে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আজ একা হয়ে গেছে । বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে , চোখে শুন্যতা । তবে যে কষ্টটা ওর আগে হচ্ছিলো সেটা এখন ক্ষয়ে যাচ্ছে শারীরিক ক্লান্তির কাছে । ও চাইছে সব মিটিয়ে একটু রেস্ট নিতে । আমার মরা শরীরটা নিয়ে এই তামাশা ওর আর ভালো লাগছে না । শরীরের ক্লান্তির কাছে ভালোবাসা আর আবেগ সব যেন ফিকে হয়ে যায় দ্রুত । শাশুড়ি মা খুব বলছে , আমি কত লক্ষি মেয়ে ছিলাম । অথচ এই উনিই আমাকে রাতদিন অলক্ষুনে বলতে পিছপা হতেন না । আমার এক দেওর দিনরাত আমাকে হাতি , মুটকি বলতো । তার বউয়ের মতো সুন্দরী নয় বলে সুযোগ পেলেই আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখাতে চাইত । আশ্চর্য হলাম আজ সেই দেবরটি আমার লোককে বলছে আমার মতো সুন্দর মেয়ে নাকি পৃথিবীতে দুটো হয়না ! আচ্ছা এই যে আমার বডিটা পড়ে আছে এখনও কারোর কি সত্যি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে ? এ ও ফিসফাস করে আমার বরের পুনর্বিবাহ নিয়েও জোর ডিবেট শুরু করেছে । কবে , কতদিন পর বিয়ে দেওয়া যায় বা কি রকম পাত্রী চাই সেটাও মোটামুটি ডিসাইড করেই ফেলেছে । আমার পায়ে কে যেত আলতা পরিয়ে দিলো ? আরে তোমরা জানো না ? আমি জীবনকালে কোনদিন আলতা পড়তাম না ? আমার এলার্জি হয় ?


ও সরি সরি এখন আমার আর কিছুই হবে না । ভুলে গেছি , দুম করে মরেছি একে তার পর এত অনেক্সপেক্টেড ভালোবাসার নাটক সব মিলিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে ভাই । আমার গয়না গুলোর দিকে ধূর্ত শিয়ালের মত চোখ ননদের । আলমারির চাবিটা বোনের কাছ থেকে চাইছে । বোন চাবিটা আমার স্বামীকে দিলো । ও ওটা নিয়ে আবার আমার শাশুড়িকে দিলো । ওরে বোকা , ওটা রাখো নিজের কাছে গুছিয়ে । আমার মেয়েটার ভবিষ্যত তো আছে রে বাবা ? আর পারিনা চাপ নিতে প্রভু তুমি আমার শ্রবণ ও দর্শনের ক্ষমতাটুকু কেড়ে নিয়ে আমাকে বাঁচাও ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy