এক কাপ চা হোক
এক কাপ চা হোক
শ্রাবন মাস। সন্ধ্যা হতে না হতেই গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। এক আকাশ মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
--সজল রুমের বাইরে বারান্দায় এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-- একটু পরেই সজলের মনে হয় ওর শরীর কেমন যেন ভার শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিতে উদাস ছেয়ে যাচ্ছে। কোন
দূরে তাকিয়ে আছে অথচ কিছুই দেখছে না।
-- এক ঝাঁক বক সারি বেঁধে সন্ধ্যে হয়েছে ভেবে আসছে ফিরে নীড়ে। মনে হচ্ছে কালোর মাঝে সাদা রেখা আকাশ ভাগ করছে।
-- সজল ভাবে আমার জীবনেও তো এই রকম এক রেখা সুখকে চিরতরে আটকে রেখেছে।
-- এই রকম এক শ্রাবণী মেঘে ঢাকা আকাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল বিকালে। একটু পরেই তড়তড় নেমে পড়েছিল বৃষ্টিও।
-- বাসস্ট্যান্ডে পাশে এসে দাঁড়ালো এক মহিলা। আধ ভিজে অবস্থায়।
-- দুজনেই ভিজছি বাস্পের মতো উড়ে আসা বৃষ্টির ছাঁটে।
-- আর ভিজে ভারী বাতাসের বয়ে নিয়ে আসা মহিলা
শরীরের পারফিউমের গন্ধে আমার মন ভিজে তখন স্যাতস্যাতে।
-- ইচ্ছা হলেও অপরিচিত মহিলার সাথে বলতে পারছি না। যদি পাত্তা না দেয়,যদি ভাবে হ্যাংলা।
-- বৃষ্টির তোড়ে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটু দূরে একটা চায়ের দোকানের মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে।
-- চায়ের দোকানে কয়েকটা ছেলে আগে থেকে আটকে আছে। ওরা বেশ চা খেতে খেতে হাসাহাসি করছে। বোঝা যাচ্ছে ওরা কলেজ পড়ুয়া বন্ধু।
-- হটাৎ করে প্রচন্ড একটা আলোর ঝলকানি,নিমেষের মধ্যে বিভৎস শব্দ।
-- কখন যে ওই মহিলা আমায় জড়িয়ে ধরেছে ও নিজেও যেমন টের পায়নি, আমিও বুঝতে পারিনি।
-- অনেকক্ষণ পরে যখন আমাদের সম্বিত ফিরলো তখন
মহিলা এক পরশ মাখা লজ্জাবতী লতা।
-- এখন সাহস পেয়ে বললাম বজ্রপাতে ওরকম সবার হয় লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আপনি তো ইচ্ছা করে করেন নি।
--না, মানে আমি ভীষণ ভয় ওটা করে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না।
-- না না,আমি কিছু মনে করিনি। আপনি যে ভয় পেয়ে এমন করেছেন সে তো বোঝা যাচ্ছে।
-- বৃষ্টি যে কখন ছাড়বে, কখন যে বাড়ি ফিরবো?আগে ছুটি নিয়ে কি আর লাভ হলো মহিলা তখন বিড় বিড় করছে।
-- আপনি কি চাকরি করেন ?
-- হ্যা,ওই যে বেসরকারি হাসপাতাল টা দেখছেন ওখানের নার্স। আপনি?
-- আমি হাসপাতালের পাশে স্টেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চে সপ্তাহ খানেক হলো ট্রান্সফার হয়ে এসেছি।
-- আমি সপ্তাহ খানেক চাকরিতে জয়েন করেছি।
-- কি নাম আপনার? যদি আপত্তি না থাকে তাহলে বলতে পারেন।
-- আপত্তি করে লাভ কি? কয়েক দিন মধ্যেই একাউন্ট খুলতে হবে তখন তো জেনেই যাবেন। আমার নাম শ্রিলা,
মানে শ্রিলা বোস।
-- আপনার নাম?
-- আমার নাম সজল মিত্র।
-- ইতি মধ্যেই বৃষ্টি একটু হলেও ধরেছে। তাই আমি প্রস্তাব দিলাম 'এক কাপ চা হোক' শ্রিলা দেবী।
-- এমন বৃষ্টি মুখর দিনে আধ ভিজে অবস্থায় এক কাপ চা পেলে তো ভালো হতো। কিন্তু,'' লাউ তো বটে,আনবে কে?''
-- কেন আমি আনবো।
-- আরে না না আপনি ভিজে যাবেন।
-- শ্রিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ছুটে চা দোকানে পৌঁছে গেছি। চা নিয়ে আসার সময় অবশ্য বেশ ভিজে গেলাম।
-- এবার বাসস্ট্যান্ডে বসার জায়গায় মুখোমুখি বসে চা ভাগ করে খাচ্ছি। আমি চা নিয়ে ছিলাম পাঁচ কাপ তাই দোকানদার একটা স্টিলের পাত্রে চা দিয়ে একটা ঢাকাও দিলেন যাতে জল না মিশে যায়।
-- আপনি কতো চা এনেছেন? চা খেয়েই তো পেট ভরে গেল। আর চাকরি পাওয়ার পর প্রথম জন্মদিনের পার্টি বেশ ভালোই টিপার্টি হলো।
-- ও আজ আপনার জন্মদিন?
-- সন্ধ্যা বেলায় বন্ধুদের সাথে কেক কাটবো বলে তো আগে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। ভগবান আজ আপনার সাথে জন্মদিন কাটানোর কথা ভাগ্যে লিখে রেখেছেন। তাই আপনার সাথেই ---।
-- সজল মনে মনে বলে ওঠে সারাজীবন কাটানোর কথা লিখে রাখলে ভালো করবেন। শ্রিলা দেবী আপনার বাড়ি?
-- আমার বাড়ি এখান থেকে ঘন্টা খানেক বাসে গিয়ে একটা গ্রামে।
-- আপনার বাড়ি?
-- এখান থেকে একটা স্টপেজ পরে নেমে একটা আবাসনে আমি থাকি।
-- আপনি থাকেন মানে? আপনার বাবা-মা আত্মীয় স্বজন।
-- আমার বাবা-মা আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। আমি মামার বাড়ি তে ছোট থেকে বড়ো হয়েছি।
-- আপনার বাড়িতে?
-- আমার বাড়িতে বাবা-মা ও ছোট একটা ভাই আছে।
-- বাহ, তা হলে তো আপনি খুব সুখী। বাবা-মা আদর পাচ্ছেন, ভাই দুষ্টুমি পাচ্ছেন। আপনাদের দেখলে আমার হিংসে হয়।
-- একটা বাসের হর্ণ শুনে ওরা চমকে ওঠে।
-- সজল বাসে শ্রিলাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে চায়ের দাম মিটিয়ে পরের বাসে বাড়ি ফিরে যায়।
-- তারপরে সজল ও শ্রিলা প্রায়ই সময় ঠিক করে দেখা করে। ওদের মধ্যে প্রথম দেখাতে যা ছিল অঙ্কুর আজ তা মহীরুহ।
-- ফাগুনের এক গোধূলি তে ওদের ধুমধাম করে বিয়ে হয়।
-- বিয়ের চার বছর পর শ্রিলার বাচ্চা হবে ওই হাসপাতালে সজল ভর্তি করে। কিন্তু, বাচ্চা হতে গিয়ে মা ও বাচ্চা কাউকেই ডাক্তার বাঁচাতে পারে না।
-- সেই থেকে এই ফ্ল্যাটে সজল একাই থাকে। এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দূরে যাবে না বলে ও ম্যানজার পোস্টে প্রমোশন নেইনি। ও নাকি এই ফ্ল্যাটে শ্রিলার কথা শুনতে পায়।
-- বারান্দার গ্রিল ধরে কালো মেঘের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সজল। দেখতে দেখতে বৃষ্টি নেমে এলো। উত্তরোত্তর বৃষ্টির তোড় বেড়ে যাচ্ছে।
-- বাস্পের মতো বৃষ্টির ছাঁট সজলের সারা শরীরে পড়ছে। সজল ভিজছে,আরো ভিজতে চাইছে।
-- হটাৎ ভিজে হাওয়ায় ভেসে সজলের নাকে আসছে মহিলার গায়ের সেন্ট। এই সেন্ট যে সজলের ভীষণ চেনা চেনা ঠেকছে।
-- সজল চিৎকার করে বলে ওঠে," এক কাপ চা হোক'।
-- সজল পিছন ফিরে দেখে বারান্দায় ঘরের দিকের জানালায় কে এক কাপ রেখে গেছে। কাপের চা থেকে তখন ও ভাপ উঠছে।
