এইটুকুই আশা
এইটুকুই আশা


শিক্ষক দিবস নিয়ে কিছু বলতে গেলেই আগে একজন শিক্ষিকা হিসেবে আমাকে আমার নিজস্ব ভাবনা ও অভিজ্ঞতা সম্বলিত মতামত প্রকাশ করতে হবে।
শিশুরা হলো জাতির ভবিষ্যৎ। কবির কথায়, "ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে...", বড্ড দামি কথা, সর্বকালীন প্রেক্ষাপটে। বেশ কিছু বছর আগেকার একটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান ছিলো, "ছোটা বাচ্চা জানকে না কোই আঁখ দিখা না রে... আকল কে কাচ্চা সমঝকে হামকো না সমঝানা রে... ভোলি সুরত জানকে হাম সে না টকরানা রে..."! সাধারণভাবে মানুষের মনে হতেই পারে যে এটা তো চটুল একটা হিন্দি সিনেমার গান মাত্র। আদতে তা কিন্তু নয়, এই গানটির লাইন কয়টির মধ্যেই অত্যন্ত কঠিন এক সত্যকে সহজ সরল হালকা ছন্দে বলা আছে। একটি শিশু আসলে তো একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ... এই চেতনাটি আমাদের মানে তথাকথিত বড়দের মনে যত তাড়াতাড়ি আসবে ততই সমাজের পক্ষে মঙ্গল।
শিশু একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ... সুতরাং তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা দিতে হবে। তাতেই শিশুর দায়িত্ববোধ, সহনশীলতা, সমাজসচেনতা, সহমর্মিতা, কর্মক্ষমতা এবং সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার শিশুর মনোজগতে বাস্তব জ্ঞানের ধারণা গড়ে উঠবে। শিশু সুস্থ মানসিকতায় বিকশিত হবে।
সুতরাং সব থেকে প্রথম প্রয়োজন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও একটি শিশুকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু অবশ্যই দেবেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। সুদীর্ঘ ২৫ বছরে স্কুল কোঅর্ডিনেটরের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি... শিশুদের দুই বছর থেকে ছয় বছর... এই বেস্ট টিচেবল্ মোমেন্টের মধ্যেই শিশু সব ভালো মন্দ যাকিছু শিখে নেবার, বোঝার এবং সেই বোধজ্ঞান কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখে। ন্যায় অন্যায় বোধ শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষা... মানে নিজের যাবতীয় কাজ নিজে হাতে করার পাঠ পেলে শিশুরা অনেক উল্লেখযোগ্য কিছু করে ফেলতে পারে। বড়দের মেন্টালিটি ও এটিটিউড বদলাতে হবে শিশুদের হ্যান্ডলিং করার ক্ষেত্রে। বড়রা সর্বক্ষণ যে ভাবেন... ছোট তো, পারবে কি? ছোট তো বুঝবে কি? সত্যি বলতে কী ছোটদের ওপরে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে দেখলে দেখা যায় বড়দের থেকে অনেক ভালো করে বুঝেশুনে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে পারে।
শিশুরা কপিক্যাট, বড়রা যা করে দেখাদেখি ছোটরাও তাই হুবহু নকল করে। আদর্শ শিশু তখনই তৈরী হবে সমাজে যখন অভিভাবক আদর্শ বজায় রাখতে পারবেন শিশুর সামনে। বড়রা নিজেরা জীবনযাপনে সচেতন এবং সৎ না হলে শিশুরাও সচেতনতা ও সততার পাঠ পাবে না। বড়রা ভুল কাজ করলে অনুকরণ করে শিশুরাও ভুল কাজ করতে শিখবে। আবার বড়রা যদি সৎভাবে ভালো কাজ করেন, তবে অনুকরণ করে করে শিশুরাও কিন্তু নিজেদের ঠিক তেমনটা করেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে।
বর্তমানে অভিভাবকদের ভাবনা থাকে শিশুর পড়াশোনা পরীক্ষা প্রাপ্ত নম্বর ইত্যাদি নিয়ে। তবে অভিভাবককে খুব গভীরভাবে বুঝতে হবে... যে পরীক্ষায় কিছু বেশি বেশি নম্বর পাওয়া আর জীবনে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে আকাশ আর পাতাল পার্থক্য। আর শিশুকে সত্যিকারের মানুষ তৈরী করে একটি সুস্থ ও সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে হলে, বড়দের চূড়ান্ত সহনশীল হতে হবে এবং শিশুদের প্রতি এবং শিশুদের সঙ্গে বড়দের ব্যবহার আমূল পাল্টে ফেলতে হবে। শিশুকে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ কিন্তু শিশুকে অহেতুক প্রশ্রয় দেওয়া নয়। শিশুর মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের চেতনা জাগ্রত করে তোলাই বড়দের আসল কাজ... বা শিক্ষাদান। সেই শিক্ষাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বাড়িতে বাবা এবং মা, এমনকি বাড়িতে উপস্থিত অন্যান্য বড়রাও... যেমন ঠাকুমা দাদু দিদা কাকা পিসি মামা মাসি... এনারাও। আর অবশ্যই স্কুলে সেই কাজটি করবেন শিক্ষক/শিক্ষিকারা।
গত ২৫ বছর ধরে স্কুলের পেরেন্টাল ওরিয়েন্টেশনে সারা বছরই অভিভাবকদের এই কথাটাই প্রাণপণে বুঝিয়ে চলেছি। ব্যবহারিক শিক্ষা সম্পূর্ণ না হলে পুঁথিগত শিক্ষা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
আজ শিক্ষক দিবসের পুণ্যলগ্নে একজন শিক্ষিকা হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে সামান্য একটি ঝলক ভাগ করে নিলাম। আর এই বাস্তববোধের ব্যবহারিক জ্ঞানটুকু অর্জন করতে আমাকে যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদের কাছে আমি চিরঋণী। তাঁরা আমার বাবা মা, ঠাকুমা দাদু বড়মা, দিদা দাদুভাই, মাসিমণিরা, পিসিমারা, কাকা, জ্যেঠু, মেসোমশাই, পিসেমশাই, কাকিমা, জ্যেঠিমা, শাশুড়িমা, শ্বশুরমশাই, বড়ভাশুর। আমার শিক্ষাগুরুদের লম্বা তালিকা। আর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিশুশ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষিকার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার বন্ধুরা, আমার সহকর্মীরা এবং আমার স্বামী ও কন্যা... এদের কাছেও আমি শিখে চলেছি প্রতিনিয়ত। আজ আমার সমস্ত শিক্ষাগুরুকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধাবনত অভিবাদন।
ধন্যবাদ পাঠক পাঠিকাবৃন্দ, অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও নমস্কার জানাই আপনাদেরও। প্রতিটি লেখার শেষে আপনাদের মতামত ও প্রতিক্রিয়া আমাকে শেখায় প্রতিদিন আরো নতুনভাবে ভাবতে, নতুন কিছু লিখতে, অন্যরকম করে উপস্থাপন করতে। আপনারাও আমার লেখকজীবনের চরম শিক্ষক।
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা মিশ্রিত শ্রদ্ধা জানাই আমাদের এডিটোরিয়াল টিমকে। তাঁরাও শিখিয়ে চলেছেন প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কীকরে লেখার পরিধিকে প্রসারিত করতে হয় এবং ডেডলাইনের মধ্যে কীকরে কাজটি শেষ করতে হয় সময়মতো। সদাসর্বদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁরাও আমার লেখকজীবনের ধৈর্য্যশীল শিক্ষক।
শুভ হোক শিক্ষক দিবস। সার্থক হোক। আর বিশ্বের সব শিক্ষক তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পান... এইটুকুই আশা।