দূর্গাপূজা ও বাংলার স্বাধীনতা
দূর্গাপূজা ও বাংলার স্বাধীনতা
আধুনিক কালে কিছু মানুষ বলে থাকেন ইংরেজদের বিজয় উৎসব হলো বাঙালির দূর্গা উৎসব। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে হাত মেলায় বাংলার কয়েকজন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার এ কথা সকলের জানা। মাঝখানে থেকে মির্জাফরকে লোকজন বিশ্বাস ঘাতক বলেন। তারা যুদ্ধে ইংরেজদেরকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছিলো বলে শোনা যায়। যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে অভিনন্দন করে এ কারণে বাঙালি অভিযুক্ত করার কারণ নেই । বাংলার শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় কোলকাতা হয়ে ওঠে পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। আসলে এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি ফিরে পায় তার পুরোনো মর্যদা। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বাংলা সব সময় আলাদা ছিলো। এবং উন্নত ছিলো। মঙ্গলকাব্য গুলো খুলে দেখতে পাবেন বাংলার বানিজ্য তরী বিদেশে পাড়ি দিতো একটা সময়। কিন্তু ইসলামী সুলতানদের কিছু কিছু পদক্ষেপ বানিজ্য পিছিয়ে দিচ্ছিলো বাঙালিকে। বিশেষ করে পর্তুগিজদের ( মগদুস্যু) বারবারন্ত বাঙালি জাতিকে আরো বিপদে ফেলে।
যুদ্ধে সহায়তার কারণে সেসব জমিদারের অনেকেই কোম্পানির সাথে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশীদার হয়ে যায়, হয় তাদের এজেন্ট এবং তারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। বলা যায় ইংরেজদের প্রভাবে সমাজে হিন্দু জমিদারদের অনেকেরই প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। এক শ্রেণির মানুষ জমিদার নাহলেও ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে।
ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক বজার রাখার জন্য, তাদের কৃপাদৃষ্টি অক্ষুণ্ন রাখতে এবং সমাজে নিজেদের বিত্তবৈভব দেখানোর জন্য সেসব ধনীদের কাছে দূর্গা পূজা হয়ে ওঠে প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ধনীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দূর্গা পূজার সংখ্যাও। এই পূজাকে ঘিরে তাদের মধ্যে শুরু হয় খরচ করার একটা প্রতিযোগিতা।
মনে রাখবেন সিরাজের পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় হিসেবে কেউ তখন দেখে নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় হিসেবে দেখা হয়নি । সিরাজউদ্দৌলার মাতৃভাষা যেমন ফার্সি ছিলো । এবং তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের চোখে ঘৃণার পাত্র ছিলেন।সিরাজউদ্দৌলাকে যখন ইংরেজ সেনা বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তার দুপাশের অসংখ্য কৃষকেরা নিশ্চিন্তমনে জমি চাষ করছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুশিতে হাতেতালিও দিচ্ছিলেন। বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার 'মৃদুভাষণ' নামক প্রবন্ধ গ্রন্থে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন:
"২৬ মার্চ যখন ফিরে আসে তখন কবিগুরুর অনুপম চরণগুলো হৃদয়-মনকে উতলা করে তোলে।
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে গর্ব করার মতো কি আছে তা নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করেছেন। আমি এসব অতীত কাহিনী পড়ে তেমন উজ্জীবিত হই না। পাঠান আমলে বাংলাদেশে একটা স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এও সত্য যে, তৎকালীন পাঠানরা কোনো বিচারেই বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি জাতীয়তাবোধ তাঁদের কাছে অজ্ঞাত ছিল বলে আমি মনে করি। রাজ্য শাসনের সুবিধার জন্য এবং স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তাঁরা স্থানীয় ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা বাংলায় কথাও বলতেন না এবং আচার আচরণে খাঁটি বাঙালি সমাজের কাছাকাছিও ছিলেন না। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব স সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতির কাহিনী পড়ে আমরা বেদনা অনুভব করি, কিন্তু কেউ কি দাবি করবেন যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন? ইতিহাসে পড়েছি নবাব আলীবর্দী খান ইরান দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর দৌহিত্র সর্বাংশেই একজন ইরানী ছিলেন। হয়তো সে কারণেই আমরা দেখি, যখন পলাশীর আম্রকাননে লড়াই হচ্ছে তখন, তার পাশেই, শস্যক্ষেত্রে বাঙালি কৃষকরা নির্বিকারভাবে কৃষিকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল দুই বিদেশী শক্তির মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল অনুপস্থিত।"
(শাহ এ এম এস কিবরিয়া ১৯৯৭: ৫)
মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাত্র একবছর দুইমাসের মত শাসন ক্ষমতা ছিলেন । (১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের)। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে বিভিন্ন মিথ বাংলায় প্রচলিত আছে,তা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য কিনা জানিনা। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বিভিন্ন মিথের পিছনে দুটি কারণ। তবে ধর্মগত সাদৃশ্যের কারণে, তার পূর্বপুরুষ তুর্কি থেকে আগত হলেও তাকে অনেক বাঙালি স্বদেশীয় প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকে। যুক্তি দেওয়া হয়, বাংলায় বা ভারতবর্ষে তুর্কি, পাঠান বিভিন্ন শাসকেরা বিদেশি বংশদ্ভূত হলেও, তারা যেহেতু এদেশে বসবাস করত তাই তার এদেশীয় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গৌরবান্বিত করার বিবিধ প্রচেষ্টা শুরু করে। সে লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করে।ব্রিটিশেরা যেহেতু নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে ধীরেধীরে বাংলার শাসনভার নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। তাই তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বার্থে ব্রিটিশ পূর্ববর্তী নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ অন্যান্য শাসকদের গুনগান করেন।
সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না, তিনি বাংলায় কথা বলতেন কিনা সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত নয়। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সম্পূর্ণ নাম ছিল, মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের নাতি এবং জৈনুদ্দীন আহমদ খান ও আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তুর্কি জাতির বংশধর ছিলেন।আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী।তার পিতার নাম ছিলো মির্জা মুহম্মদ মাদানি। তুর্কি বংশোদ্ভূত মির্জা মুহম্মদ মাদানি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহের দরবারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দাদু আলীবর্দী খানের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। শুধুই তিন কন্যাসন্তান ছিল। তিনি তার কন্যাদের বড়ভাই হাজি আহমদের তিন ছেলের সাথে বিবাহ দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা দাদু আলিবর্দী বা ঠাকুর্দা হাজি আহমেদের বাবা মির্জা মুহম্মদ মাদানি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তাই পিতৃপুরুষের পরিচয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা আদতে তুর্কি বংশোদ্ভূত, কোনমতেই বাঙালি নয়।
নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা হলেও , তথ্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রকৃত তথ্য হল, তখনো পর্যন্ত ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের অধীনে ছিল। যেহেতু মুঘল সম্রাট ছিলেন, তাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন, তৎকালীন দিল্লীর মুঘল সম্রাটের পক্ষে বাংলার আঞ্চলিক প্রতিনিধি। তিনি ছিলেন সম্রাটের অধিনস্থ বাংলার নবাব। অনেকটা বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধিনস্থ মুখ্যমন্ত্রীর মত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র সম্পর্কে ইতিহাসকারগণ যে সকল তথ্য দিয়েছেন, সেই তথ্যানুযায়ী তাকে সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। মাতামহ আলিবর্দী খানের মৃত্যুশয্যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করানো হয় যে, তিনি মদ্যপান থেকে বিরত থাকবেন। অবশ্য তিনি মদ্যপান থেকে পরবর্তীতে বিরত ছিলেন কিনা এ নিয়ে ইতিহাসে পাতায় কিছু লেখা নেই।
এক কথায় সিরাজ ছিলেন খানিকটা উদ্ধত এবং কিছুটা অসহিষ্ণু। অস্থির চিত্তের সিরাজের মধ্যে দৃঢ়তার অভাব ছিল। এছাড়া সংকটকালে সিদ্ধান্তহীনতাও তাঁর অন্যতম ত্রুটি। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সিরাজ তখন ছিলেন মাত্র চবিবশ বছরের এক অপরিণত যুবক। ক্ষমতা ও উচ্চাসন তাঁকে কিছুটা বেপরোয়াও করে তুলেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এই যে, অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই সাথে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, তারা যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে সেরূপ কোন পদক্ষেপ তিনি নেন নি। এরূপ সাবধানতা অবলম্বনে তাঁর ব্যর্থতা এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার মতো মানসিক দৃঢ়তার অভাবের কারণেই তাঁর পতন হয়। কারণ তিনি নিজেই প্রথম ইংরেজদের আক্রমণ করেছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত 'বাঙ্গালার ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ' গ্রন্থে নবাব সিরাজুদ্দৌলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্বোধ, নৃশংস, ও অবিমৃশ্যকারী, কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক মানুষের সঙ্গী, নারীর সতীত্ব লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন সুশাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিয়ন্ত্রণহীন এক তরুণ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কাছে পরাজয় না হলেও তার নবাবী দিল্লির মুঘল সম্রাটেরা এমনিতেই কেড়ে নিতেন। কারণ সকতজঙ্গ বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদান প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুবাদারী প্রার্থনা করেছিলেন, দিল্লীর মুঘল সম্রাট একপ্রকার সম্মত হয়ে গিয়েছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে বসে মাতামহের পুরাণো কর্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করতে শুরু করেন। কিছু দুষ্টু মানুষের সঙ্গ দোষে এবং পরামর্শের ফলে, তখন, প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পাচ্ছিলো না ওদের হাতে থাকে।
রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকেরা, এই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারে, তাঁর পরিবর্তে, অন্য কোনও ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা করলেন। তাঁরা, আপাততঃ, সকতজঙ্গকেই নির্বাচন করেন। তাঁরা নিশ্চিত জানতেন, তিনি সিরাজউদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র না; কিন্তু, মনে মনে এই আশা করেছিলেন, আপাততঃ, উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হয়ে পরে, কোনও যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাবেন।
এ কথা আমার নয় , বিদ্যাসাগরের।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হিন্দু পন্ডিত তাঁর কথা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু কথার সত্যতা পাওয়া যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে। তার রচিত 'তারিখ-ই-বাঙ্গালা -ই-মহব্বত জঙী' গ্রন্থে তিনি নবাব সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে বলেছেন:
"সিরাজ-উদ-দৌলা এই পৃথিবীর রাজত্বে তৃপ্ত ছিলেন না এবং (কোনো কিছুতেই তিনি) সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর অত্যধিক অত্যাচারের মাত্রা, অত্যধিক রক্তপিপাসুতা ও সীমাহীন গালিগালাজপ্রিয়তা এই দেশের সব সিংহের পিত্তকে পানিতে পরিণত করতে পারত। আজ তাঁর মাথার উপরে ছিল একটি টুপি, (পরিধানে) ছিল পায়জামা এবং কাঁধে ছিল একটি কম্বল। সেই অবস্থায় পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি এই ধরণীর একটি ক্ষুদ্র কোণ মাত্র প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর এই বিধ্বস্ত দেহ বিরাট বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ালে তিনি তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ আর পাননি এবং মহা প্রতিশোধ গ্রহণকারী বিচারকের আদেশে মৃত্যুর তরবারি তাঁর সব আকাঙ্ক্ষার শিকল ছিন্ন করে দেয়। মীর মোহাম্মদ জা'ফর খান বাহাদুরের আদেশে তাঁকে মহাবত জঙের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়। এই ঘটনা এগারশ একাত্তর হিজরী সনের ১৫ই শওয়াল তারিখে ঘটে। তাঁর রাজত্বকাল দুর্যোগপূর্ণ হলেও এক বছর তিন মাস ছিল।"
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ১৯৯৭:১৯০-৯১)
নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে 'তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী' গ্রন্থের মত নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু এবং পরবর্তী মৃতদেহের বিবরণ 'মোজাফফরনামা' গ্রন্থেও পাওয়া যায়। মোজাফফরনামা গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন, করম আলি খান। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহকে কি পরিমাণে অমর্যাদা করা হয়েছিলো সে বিবরণ করম আলি খানের মোজাফফরনামায় পাওয়া যায়:
"সিরাজের দেহে বিশটি আঘাত করেও কাজ শেষ করতে না পেরে মোহাম্মদী বেগ তাঁর সঙ্গীদের মধ্য থেকে একজন মোঘলকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করে এবং সে ব্যক্তি ছোরার এক আঘাতেই সিরাজের জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। তাঁর দেহ একটি হস্তীর পৃষ্ঠে স্থাপন করে সীমাহীন অমর্যাদার সঙ্গে সমগ্র নগরে ঘোরানো হয়। সেই হস্তী সিরাজের জননীর বাসভবনের সামনে আসলে তিনি খালি পায়ে ও খালি মাথায় দৌড়িয়ে এসে হস্তীর পায়ের কাছে নিজেকে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু খাদিম হোসেন খানের লোকজন তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। (সিরাজের মৃতদেহ নিয়ে) খাদিম হোসেন খানের বালাখানার সামনে উপস্থিত হলে তিনি নির্লজ্জ হয়ে মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য একখানা বস্ত্র মৃতদেহের উপর নিক্ষেপ করেন।
অবশেষে সিরাজের মৃতদেহ বাজারের চত্বরে নিক্ষেপ করা হলে কেউ তা দাফন করতে সম্মত হয়নি। এই পরিবারের ঐতিহ্যকে স্মরণ রেখে এবং নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে মীর্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল মৃতদেহকে গোসল করান এবং একটি কফিনে ভরে তা আলিবর্দীর কবরের পাশে সমাধিস্থ করেন। সিরাজের রাজত্বকাল পনেরো মাস স্থায়ী হয়।"
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ১৯৯৮: ১২৮)
মাঝেমধ্যে দুইএকটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরাধীনই ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন প্রভু বদল হয়েছিল মাত্র। তখনকার বাঙালির মতে তুর্কিদের হাত থেকে কিছুটা সভ্য এবং কিছুটা মানবিক ব্রিটিশদের হাতে।
বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'পূরবী' কাব্যগ্রন্থের 'শিবাজি-উৎসব' কবিতায় বলেছেন:
"সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্যবিপণীর এক ধারে
নিঃশব্দচরণ
আনিল বণিকলক্ষ্মী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে
রাজসিংহাসন।
বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি
নিল চুপে চুপে-
বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী
রাজদণ্ডরূপে।"
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৭:৩০৫)
তাই বাঙালিরা ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠার বিজয় উৎসবকে দূর্গা পূজা হিসেবে পালন করলেও তার কোন দোষের ছিলো না।এই দূর্গাপূজা পরে নিজের চরিত্র বদলায়।ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বারোয়ারি দূর্গোৎসবকে বেছে নিলেন। ১৯২৭ সালে বার্মার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কোলকাতায় ফিরে এসে নেতাজি বিভিন্ন সামাজিক এবং সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সে সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু বারোয়ারি দূর্গা পূজার সাথে যুক্ত হন। দক্ষিণ কোলকাতার আদি লেক পল্লীর পূজা, মধ্য কোলকাতার ৪৭ পল্লীর পূজা, উত্তর কোলকাতার বাগবাজার, কুমারটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি- এই বারোয়ারি পূজাগুলোর সাথে নেতাজী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন। এই পূজা গুলো বিপ্লবী সংগঠনগুলোর শক্তি প্রদর্শন ও সদস্য সংগ্রহ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ছিলো।
তথ্য সহায়তা:
১. আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত), ইউসুফ আলী খান, তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন১৯৯৭
২.আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত),
মোজাফফরনামা ও নওবাহার- ই-মুর্শিদকুলী খানি,ঢাকা: বাংলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৮
৩. তীর্থপতি দত্ত ( সম্পাদিত),বিদ্যাসাগর রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা: তুলি-কলম, মার্চ ২০০২
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, ঢাকা: মেরিট ফেয়ার প্রকাশন,ফেব্রুয়ারি ২০০৭
৫ শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মৃদুভাষণ, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড,১৯৯৭
৬. সিরাজউদ্দৌলা,বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৫
৭. সিরাজউদ্দোলা , কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ( চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)