দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনা


"দেখ বাবু, তুই আর জেদ করে থাকিস না, আমাদের পরিবারে এমনিতেই অভিশাপ আছে।" সুনন্দাদেবী একমাত্র ছেলেকে কাতর স্বরে অনুরোধ করলেন।
"না না আমি কোনও কথাই শুনব না, এগুলো তোমার অজুহাত আমাকে বাইক না কিনে দেওয়ার।"তীব্র আপত্তি জানালো কলেজ পড়ুয়া অভিষেক রায়।
- কী ক'রে তোকে বোঝাই, তোর রাশিচক্রে দুর্ঘটনা যোগ আছে! তাই নিজে হাতে কী ক'রে মৃত্যুকে ডেকে আনি!
- দেখো, এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এইসব বুজরুকি অচল। মানুষকে দুর্বল করার চক্রান্ত। তুমি বাইক কিনে না দিলে আমি বাড়ি ছেড়েই চলে যাব।
শেষমেশ একমাত্র ছেলের কাছে নতি স্বীকার। পাঁচ বছর আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে অর্ধেক জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন এমনিতেই।সেই চরম বিপর্যয় থেকে এখনও সামলে উঠতে পারেননি।
ভীষণভাবে বিপর্যস্ত জীবন যাপন। একটা তীব্র শূন্যতা বিরাজ করে সর্বসময়। তাও জীবনকে তো এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে, একমাত্র ছেলের দিকে তাকিয়ে বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই। ধীরে ধীরে একটু একটু ক'রে আবার ভাঙা সংসার জোড়াতালি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সুনন্দা রায়।
কিন্তু তার কপালে বোধ হয় বিধাতা 'সুখ' নামক বস্তুটি কোনোদিনই লিখে রাখেননি।
অভিষেক বাইক পেয়ে খুব খুশি। আর মায়ের কাছে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি।
তবে মায়ের উৎকণ্ঠা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল ছেলের তীব্র গতিতে বাইক চালানো নিয়ে। বহুবার ছেলেকে সাবধান করে বলেছেন ধীরে চালাতে আর অবশ্যই হেলমেট পরতে।
ঈশ্বরের কাছে সুনন্দা দেবী সর্বক্ষণ প্রার্থনা করতেন একমাত্র ছেলের মঙ্গল কামনায়। কিন্তু বিধিলিপি খণ্ডাবে কে!
শ্রাবণ মাসের একদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল।ছেলেকে বারবার মানা করেছিলেন আজ অন্তত বাইক নিয়ে রাস্তায় না বেরোতে। বাসে ক'রে কলেজ যেতে বলেছিলেন। কিন্তু অভিষেক কোনও কথাই শুনল না।
অভিষেক মাকে বলল, "আরে, তুমি অযথাই ভয় পাও সবসময়। বাইক এখন আমার কথায় ওঠে আর বসে, আমার কিচ্ছুটি হবে না।" সেই শেষ কথা।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও ছেলের বাড়ি না ফেরায় ঘরের মধ্যে অস্থির হ'য়ে উঠলেন সুনন্দাদেবী। মোবাইলটাও সুইচড্ অফ্ অভিষেকের। একা মানুষ, বড্ড দিশাহারা হ'য়ে পড়লেন।
এদিকে বৃষ্টির তীব্রতায় রাস্তা শুনশান। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। প্রায় মাঝরাতে কলিং বেল বেজে উঠল!
সুনন্দাদেবী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন। কিন্তু এ কী! পুলিশ কেন?
- অভিষেক রায় কী এখানে থাকতেন?
- থাকতেন মানে! কী হয়েছে আমার বাবুর? আপনারা চুপ ক'রে আছেন কেন??
- শুনুন, বাড়িতে কোনও পুরুষ মানুষ থাকলে আমাদের সাথে এখনই যেতে হবে।
- আমাকেই বলুন, আমি বাবুর বাবা, আমিই ওর মা।
- আসলে আজ হাইওয়েতে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হেলমেটও না থাকায় মুখটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। চেনাই যাচ্ছে না। তবে আইডেনটিটি কার্ডে এই নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল, তাই...
মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে গেল সুনন্দাদেবীর। এই বন্ধনহীন সংসারে আর কোনও খড়কুটোই অবশিষ্ট রইল না যাকে আঁকড়ে বাঁচার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবেন তিনি।
অমাবস্যার ঘোর আঁধার আবারও গ্রাস করল।