ভোরের আলোয় ফিরে দেখা
ভোরের আলোয় ফিরে দেখা
চৈতি এ কী বলছে! এটাও কী সম্ভব? তনুজার মনের দোরে কড়া নাড়ে আবারও সেই হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত অধ্যায়।
দীর্ঘদিন পর দীপঙ্করের সন্ধান পাওয়া গেছে! দীপঙ্কর বেঁচে আছে! এই কথায় আবারও শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলে প্লাবন। এই জলোচ্ছ্বাস সুখের, পরিতৃপ্তির।
তনুজার সাথে দীপঙ্করের প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু চৈতিই। সেই প্রথম দর্শনেই তনুজার মনে গেঁথে বসেছিল দীর্ঘায়িত বন্ধনের বিশ্বাস, ভরসার আচ্ছাদন। আত্মসমর্পণ করেছিল অক্লেশে নিজের ভালোবাসাকে। যে মেয়েটি কোনোদিনই বিশেষ পাত্তা দেয়নি প্রেম ভালোবাসার মূর্ছনাকে, সেই মেয়েই এক প্রগাঢ় অনুভূতির ছোঁয়া অনুভব করল দীপঙ্করের সাথে প্রথম পরিচয়ে।
"শোন তনু, এই দীপুদা মানে দীপঙ্কর সেন অসম্ভব গুণী মানুষ, প্রকৃত ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। আর দীপুদার আরেকটি পরিচয় আছে, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। এই কাজটি অবশ্য নিভৃতে করতে ভালোবাসে।" কথাগুলো চৈতি গড়গড়িয়ে বলে গেল।
"আপনার সাথে আলাপ করে ভালোই লাগল।" গম্ভীর পুরুষালী গলায় দীপঙ্করের প্রথম বাক্যালাপ।
"আমারও...", লাজুক মুখে বলল তনুজা।
সেই থেকে শুরু দু’জনের মধ্যে একটা দীর্ঘায়িত সম্পর্কের বুনিয়াদ গড়ার মুখবন্ধ। এছাড়া দু’জনের জীবিকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা হওয়ায় নিজেদের মাঝে একটা তীব্র অনুভূতির মেলবন্ধন গড়ে উঠল নিমেষেই। তনুজার বিষয় জীববিজ্ঞান, আর দীপঙ্করের সাহিত্য। সাধারণত ঠিক উল্টোটাই হয়ে থাকে। একজন আরেকজনের মধ্যে খুঁজে পেল নিরবচ্ছিন্ন ভরসাস্থল।
"দীপুদা, আজ কি মনে হয় জানো? তোমার সাথে আরও আগে কেন দেখা হল না?" একদিন দীপঙ্করকে বলল তনুজা।
- কেন? তাহলে কী
হতো?
- কী হতো মানে! জীবনের দর্পণে পরিপূর্ণতার পাঠ নিতে পারতাম তোমার সান্নিধ্যে। প্রকৃত ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই হতে পারতাম আরও আগেই।
- এখন থেকেই সেই পাঠ নাও না নিজস্বী ঢঙে, কে আপত্তি করেছে?
সব ঠিকঠাকই চলছিল, প্রাণচাঞ্চল্যের দীর্ঘসূত্রতা খুঁজে বেড়ে চলছিল ওদের ভালোবাসার গভীরতা। হঠাৎই স্বপ্ন ভঙ্গ!
দীপঙ্করের একটা ম্যাসেজ তনুজার মোবাইলে! "আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় এই বন্ধনে ধ্রুবক হয়ে থাকা, আমি চিরতরে দূরে চলে গেলাম তোমার জীবন থেকে। ব্যর্থতার দায় স্বীকার আজ না হয় আমিই করি। নিজের অপারগতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।"
এই আকস্মিক খবরে তনুজার জীবনের দর্পণে বিসর্জনের আবাহনী সঙ্গীত। দীপঙ্করের এইভাবে হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ কী হতে পারে? এক লহমায় ভেঙে পড়ল সুউচ্চ পাহাড়প্রমাণ বিশ্বাসের বুনিয়াদ।
অনেক পরে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে শুনেছিল যে চৈতিই নাকি কলকাঠি নেড়েছিল এই শাশ্বত প্রেমের মাঝে প্রাচীর গড়তে। তনুজা আজও ওকে বলতে পারেনি সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা! শুধু এটুকু জানত, সেই ঘটনার পর দীপঙ্করও আর চৈতির সাথে যোগাযোগ রাখেনি। কারণ চৈতি একবার মুখ ফসকে বলেছিল, "আমার জন্যই আজ তোর জীবনে এই অমাবস্যা! দেখিস, একদিন ঠিক পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দেবে আবার তোর জীবনে।"
সেই ঘটনার পর থেকে তনুজা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সকল প্রকার সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে। বন্ধুর মানেটা এখন বড্ড অপ্রাসঙ্গিক। তাই বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি সেদিনের চৈতির কথায়। কেবল মৃদু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল যাবতীয় মনোবাঞ্ছার বহিঃপ্রকাশ।
আজ এতদিন পরে চৈতির সেই কথা আর ফেলে আসা মুহূর্তের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তনুজা!
চোখের সামনে পরিবর্তনশীল ভোরের আলো....