দুর্ঘটনা ।
দুর্ঘটনা ।


আজ ১৬ই নভেম্বর রিমির আঠেরতম জন্মদিন। আসলে আঠের বছর আগে এই দিন থেকেই ও আমার কাছে আছে। আমি অর্ঘ, অর্ঘদীপ ব্যানার্জী মিমির বাবা। আমার চোখের মণি রিমি আমার খুব আদুরে। আসলে মা মরা মেয়েরা একটু বেশিই অদূরে হয়। সেই ছোট্ট থেকেই আমিই ওর মা আর আমিই ওর বাবা।
প্রায় মাস খানেক আগে থেকে ও জন্মদিনের প্লান করে আসছে। সকালে অফিস যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে বাড়িতে আসার পর শুরু হয়ে যায় বাবা এটা চাই বাবা ওটা চাই। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে সে সর্বক্ষণ। আমার চিন্তা অন্য জায়গায়। সকাল থেকেই মাথায় ওই একটাই কথা ঘুরছে। কিভাবে রিমিকে তার জীবনের সবথেকে কঠিন বাস্তবটা ওর সামনে তুলে ধরব। এই কাঠিন্য শুধু রিমির নয়, আমার ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। সকালে ওকে ওর ঘরে গিয়ে জন্মদিনের উইশ করে ওর পছন্দের উপহার সামগ্রী দিলাম । ওগুলো পেয়ে রিমি তো বেজায় খুশি। এর পর ওর মোবাইল ফোনে একের পর এক জন্মদিনের শুভেচ্ছার মেসেজ আর ফোন রিসিভ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমি পাশের ঘরে গিয়ে অমলকে ফোন করলাম । যদিও গতকাল অমলর সাথে বার কয়েক রিমিকে তার নাজানা সত্যিটা জানানোর ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবুও নিজের মনের উদ্বেগ সামলাতে অমলকে আবারও ফোন করলাম। অমল আজ রাতে আমার সাথে থেকে ওই দুর্বিসহ ঘটনার কথা জানানোর ব্যাপারে সাহায্য করবে বলে আস্বস্ত করেছে।
পিতা, কন্যার সম্পর্ক আজ সেই আঠের বছর আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সত্য প্রকাশের সরু সুতোর ওপরে দাঁড়িয়ে।
এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। জন্মদিনে আমন্ত্রিত প্রায় সবাই রাতের খাবার খেয়ে ফিরে গেছে। ঘরে আমরা কয়েক জন। আমি অমলের দিকে তাকাতেই অমল গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে আস্বস্ত করল। রিমি তার বন্ধুদের বাইরে ছেড়ে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই অমল রিমিকে বলল,....
--- 'মা রিমি, তোমার সাথে আমার আর তোমার বাবার কিছু দরকারী কথা আছে।
রিমি অমলের কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাকে দেখে কি বুঝল জানি না। সামনে এসে বলল,...
--- বাবা তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
আমি রিমিকে সোফায় বসতে বললাম।
অমল বলতে শুরু করল,..…
ঘটনাটি প্রায় আঠের বছর আগে। তোমরা বাবা আর আমি বাইপাসের কাছেই একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে সদ্য একটা অফিস খুলেছি। বিদেশ থেকে ফিরে ওটাই ছিল একসাথে আমাদের প্রথম কাজ। দেশের মাটিতে প্রথম কাজ শুরু করে পূর্ণ উদ্যমে অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করতাম। ঠিক আঠের বছর আগে ১০ই নভেম্বর রাতে অর্ঘদীপের গাড়ী করে ফিরছিলাম। রাত তখন পৌনে বারোটা হবে। চিংড়িঘাটার কাছে রেড সিগনাল থাকা সত্তেও কোলে বছর দুয়েকের বাচ্চা নিয়ে অসতর্ক ভাবে রাস্তা পার করতে গিয়ে আমাদের গাড়ির সামনে এসে পড়ে। তৎক্ষণাৎ ওই মহিলা গুরুতর জখম হয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পরে। আশ্চর্য ভাবে ওই শিশুটি অক্ষত থাকলেও পরদিন সকালে ওই মহিলা মারা যান। এপর্যন্ত বলেই অমল থেমে যায়।
রিমি একরাশ উত্তেজনা মিশ্রিত কৌতূহল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি ওর সেই চোখে আর চোখ রাখার শক্তি পেলাম না।
মুহূর্তেই রিমি বুঝে গেল অমলেরর ব্যক্ত সেই গল্পের সাথে তার কি সম্পর্ক। একরাশ ঘৃনা ভরা আক্রোশে সে চিৎকার করে উঠে বলল,....
---- ছি, ছি,..….তোমরাই তাহলে আমার মাকে মেরে ফেলেছ!! তোমরা খুনি, আমার মায়ের হত্যাকারী।
অমল রিমিকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে এটা একটা দুর্ঘটনা। তাছাড়া ভুলটা মহিলার ছিল।
রিমি হাত উঁচিয়ে অমলকে থামিয়ে বলল,....
---- তোমরা বড়লোক। তোমরা অনেক কিছুই করতে পার। বলেই সে উঠে দাঁড়াল। অর্ঘদীপের দিকে তাকিয়ে বলল….
---আমি চললাম। আর যাইহোক আমি আমার মায়ের খুনির সাথে থাকতে পারব না।
এরপরই কাকে যেন রিমি একটা ফোন করল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটা বাইক এসে বাড়ির সামনে দাড়াল। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে বাইকের পেছনে চেপে বেরিয়ে গেল।
আমি আর্কদীপের দিকে ফিরতেই দেখি বিস্ফারিত চোখে বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে তার প্রানহীন দেহটা সোফায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে।