Subhra Roy

Abstract Crime Others

3  

Subhra Roy

Abstract Crime Others

দ্রামিক

দ্রামিক

7 mins
230



আজকেও অফিসে পৌঁছাতে দশটা ষোল হয়ে গেলো । প্রায় রোজই ট্রাফিকে এমন ফাঁসে যে সেই জট কাটিয়ে অফিস পৌঁছাতে দশটা পনেরো কুড়ি হয়েই যায় । রজতাভ কোন রকমে গাড়ি পার্ক করে দৌড়াতে দৌড়াতে লিফটের কাছে আসেন , এসে দ্যাখেন জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে । এর মধ্যে তার জায়গা সুনিশ্চিত নয় বুঝতে পেরেই সিঁড়ি দিকে এগোন । পাঁচতলায় অফিস , এতোটা সিঁড়ি এই বয়সে ভাত খেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট লাগে । রজতাভ তবুও সিঁড়ি ওঠা ঠিক মনে করলেন কারণ লিফট বারোতলা গিয়ে খালি হবে তারপর আবার প্রতি তলায় ভরতে ভরতে নাববে । রজতাভ হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে ঢুকে বায়োমেট্রিকে ফিঙ্গার পুশ করে এসেই চেয়ার টেনে বসেন । তার চেয়ারে বসার অনেক আগেই ফাইল স্তুপাকৃত করে টেবিলে বসানো আছে । সবই মিঃ দাশগুপ্তের কারসাজি সেটা ভালোই বুঝতে পারেন । রজতাভ ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে গলা ঠান্ডা করে স্তুপের তলা থেকে একটা ফাইলটা টেনে বের করে পাতা ওল্টাতে শুরু করেন । মিনিট দশেক যেতে না যেতেই ইন্টারকমে মিঃ দাশগুপ্তর গলা --- " একটু আগে এলে কি ক্ষতি হয় ? কার অ্যালাউন্স তো টাইম মতোই পেয়ে যাও তবুও , যাই হোক পাঁচটা মেল ফরোয়ার্ড করেছি তোমায় । ভালো করে দেখে রিপলাই দিয়ে দিও আর ইউনিট গুলো ভেরিফাই করতে ভুলো না । " 


রজতাভ হুঁ টুকু বলে কমপিউটার অন করেন । কাজের মধ্যে ডুবে যেতে বসেছেন এমন সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে । রজতাভ আড় চোখে দেখে নিয়ে আবার মনিটরে মনোনিবেশ করেন । আবার ও ফোন বেজে ওঠে -- নীলিমার ফোন । .... " এই এক বিরক্তিকর ফোন মাইরি , রোজ অফিস পৌঁছে প্রেশারের ওষুধ খেয়েছি কিনা জানানোর জন্য ওকে মিস কল দিতে হবে । " নীলিমার ফোন কেটে দিয়ে রজতাভ অফিসের ডেস্কের ড্রয়ারে রাখা ' টেলমি সার্টনের ' পাতা বের করে একটি ট্যাবলেট জল সহ মুখে দিয়ে আবারও মনিটরে চোখ রাখেন । সঙ্গে সঙ্গে আবার মোবাইল বেজে ওঠে --- " এই মহিলাতো আমাকে পাগল করে তুলবে দেখছি , অফিসে ঢুকতে না ঢুকতে একশোবার ফোন " ...অত্যন্ত বিরক্ত সহকারে ফোন ধরে রজতাভ ---" কি হলো কাজ করতে দেবেনা ? এর থেকে বাড়িতে বসেই থাকতাম আমি , বসে বসে সারাদিন তোমার কথা শুনতাম। " 


" শুনছো , বাবিনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ....হু ..হু ..করে কেঁদে ফ্যালে নীলিমা । " 


" কেন ! ! বাবিনতো টিউশান গেছিলো তো ? 


" হ্যাঁ ...অ্যা ( কেঁদেই চলেছে ) , প্লীজ তুমি বাড়ি ফিরে এসো , থানায় যেতে হবে এক্ষুনি , বাবিনকে টিউশান ক্লাস থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে । কুন্তল এসে আমাকে খবর দিলো বৈদেহী রেপ কেসে তমাল সূর্যর সাথে বাবিনকেও পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে । শুনছো , তোমায় বলেছিলাম না তিনদিন আগে একটি মেয়েকে সন্ধ্যায় পার্কের ফুটপাতে রক্তাক্ত অচৈতণ্য অবস্থায় কারা যেন ফেলে গিয়েছিল । পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় । সেই মেয়েটাই বৈদেহী , বাবিনের সাথে স্বপন স্যারের কাছে অঙ্ক শেখে । মেয়েটার অবস্থা খারাপ । চেতনা ফেরেনি ঠিক মতো , সে ওই অবস্থায় তমাল সূর্য দ্রামিকের নাম নেয় গো । আবার জ্ঞান হারায় বিশেষ কিছু বলতে পারেনি । দ্রামিক এই কাজ কখনই করতে পারে না গো । " 


" তুমি শান্ত হও , আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছি ...বলেই রজতাভ ফোন রেখে দিয়েই মিঃ দাশগুপ্তর কেবিনের দিকে দৌড়ান । ছুটি কিছুতেই পাওয়া যাবে না দেখে রজতাভ একদিনের ছুটির জন্য সাতদিনের পে অফ করিয়ে রেজিস্টরে নোট লিখে বেরিয়ে পড়েন । " 


বাড়িতে পৌঁছেই নীলিমাকে নিয়ে থানায় আসেন রজতাভ । জীবনে কোনদিন থানার চৌকাঠে পা রাখেননি । আজ এই চোর ছ্যাচড় গুন্ডা ও পুলিশের সহাবস্থান দেখে বুকটা কেঁপে উঠে রজতাভর । অজানা আতঙ্কে গলা জ্বীভ শুকিয়ে আসছে । রজতাভ টাই এর নটটা আলগা করে নেয় । ভিতরে ঢুকে হাড় হিম হয়ে যাবার অবস্থা , সাব ইন্সপেক্টরের টেবিলের পাশেই পাঁচ গজ দূরে লকাপে তখন চলছে বলপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রচেষ্টা । নীলিমা সেটা দেখতে পেয়েই ছুটে এসে হাতজোড় করে মিনতি করেন --- " স্যার দ্রামিক , এই কাজ করতে পারে না , প্লীজ ওকে ছেড়ে দিন ।" 


" ছেড়ে দেবার কথা আপনি বলার কে ? " ...তীক্ষস্বরে ধমকে ওঠেন ইন্সপেক্টর । 


রজতাভ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন ---- " আমরা দ্রামিকের বাবা মা , আমরা নিশ্চিত ও এই কাজ করার ছেলে নয় । প্লীজ স্যার, আর মারবেন না । মরে যাবে ছেলেটা , ও আমাদের একমাএ সন্তান । ও মরে গেলে আমরা শেষ হয়ে যাব স্যার । " 


" ও তাই ! আর মেয়েটি যে শেষ হয়ে গেলো । সেও তো বাবা মায়ের একটি মাত্র মেয়ে । ওরা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে বলুনতো ? এখনও কুড়ি পেরোয়নি এই বয়সে এতো নিকৃষ্ট মনোবৃত্তি ! অমানুষ একটা , একই সাথে পড়াশোনা করে, কি করে সহপাঠিকে রেপ করলো ? মেয়েটিকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিয়েছে প্রায় । মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছে , বুঝলেন ! .....ইন্সপেক্টর এরপরেও রজতাভ ও নীলিমার সামনেই দ্রামিককে অশ্লীল সম্ভাষণে কটুক্তি করে গেলেন । 


দ্রামিক রুলের বাড়ি খেতে খেতে তাৎস্বরে চিৎকার করছে --" বাবা আমাকে বাঁচাও । আমি কিছু করিনি । আমি তমাল সূর্যকে অনেক বারণ করেছিলাম । ওরা আমাকে বাথরুমে লক করে দিয়েছিল । তোমাকে আর মাকে গুম করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলো , তাই আমি ভয়ে চুপ ছিলাম । বৈদেহীকে আমি কিছু করিনি , ওকে জিজ্ঞাসা করো প্লীজ । " 


" দেখুন স্যার , ও নিজে বলছে কিছু করেনি । একবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করুন তারপর না হয় চামড়া তুলে নেবেন । এটা ঠিক হচ্ছে না স্যার । আইন তো সবার অল্প বিস্তর জানা আছে স্যার । "


বারবার দ্রামিকের একই স্বীকারোক্তি দেবার কারণে পুলিশ দ্রামিকের শরীর থেকে রুলটা সরিয়ে রাখাটা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন এবং বৈদেহীর পূর্ণ বয়ান অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে পুনরায় হাসপাতালে যান । 


দুদিন বাদে জ্ঞান ফিরতে বৈদেহী বয়ান দিয়েছে --টিউশনি থেকে ফেরার পথে তমালের বাড়িতে নোটস নেবার জন্য যায় , বাড়িতে তমালের মা বাবা কেউ ছিলো না দেখে নোটস নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে যায় তখনই তমাল সূর্য পথ আটকে দাঁড়ায় , দ্রামিক বারণ করেছিলো , ওকে বাথরুমে আটকে রাখে ওরা । পরিচিত বন্ধুরা এমনই পাশবিক অত্যাচার করে যে আর কিছু মনে নেই । ' 


দ্রামিক লকাপ থেকে ছাড়া পায় , শিরদাঁড়ায় ভীষণ চোট পায় , হাতে পায়ে কালসিটে পড়ে গেছে । অসহ্য মানষিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর দ্রামিক নিজেকে গৃহবন্দি করে নিয়েছে । চোখের সামনে মান সম্মানের নিলাম হতে দেখে বিধস্ত । গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে একবারের জন্য বুঝতে পারেনি তমাল সূর্যর অভিসন্ধি । 


আজই সকালে নিচের ফ্ল্যাটের তন্ময় নিয়োগী ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে দ্রামিকের মাকে দেখতে পেয়ে --' শুনলাম নাকি আপনার ছেলে বৈদেহীর রেপ কেসে ধরা পড়েছে ! এতো অধঃপতন ছেলের ! ভাল শিক্ষা মনে হয় ছোটবেলা থেকে পায়নি ? ' নীলিমা চিৎকার করে ওঠেন --" আমার ছেলে কিছু করেনি , ওকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে । " চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস্ গুপ্তা বেরিয়ে এসে বললেন -- " কিছু করেনি তো মেয়েটিকে বাঁচালো না কেন ? দেখে মজা নিচ্ছিলো বলুন ? চোরের মায়ের জোরে গলা , হুঁ... । " 


নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢোকেন । দ্রামিকই দরজা খুলে দেয় । মায়ের চোখের জল দেখে দ্রামিক মাকে কিছু বলতে যায় তখনই নীলিমাদেবী বললেন ও কিছু নারে । মিসেস গুপ্তা সুযোগ পেয়েছে আর কি । তুই বাবিন টিফিন খেয়ে স্নান করে নে বাবা । " 


এরই কিছুক্ষণ পর দুপুরে দ্রামিকের বড় মাসি সবিতা সেনের ফোন আসে , নীলিমা বাথরুমে ছিলেন বলে দ্রামিক ফোন ধরে । হ্যালো বলার আগেই সবিতা মাসি বলে ওঠেন --" হ্যাঁ রে নীলু , দ্রামিকের নামে কি শুনছি রে ? শেষে কিনা রেপ কেসে জড়ালো ! আমার তো পাড়ায় থাকা দায় হয়ে ওঠেছে । বাড়িতে সবাই ছিঃ ছিঃ করছে । দ্রামিক এটা কি করলো ? বাড়ির সুনামের কথা একবারও চিন্তা করলোনা , ছিঃ ছিঃ । " 


উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দ্রামিক নিজের ঘরে বিছানায় এসে শোয় । চোখের দৃষ্টি ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে । হাজার প্রশ্নের ঝড় আছড়ে পড়েছে দ্রামিকের --- " আমি করেছিলাম কি ? কেন এতো মার খেলাম ? আমার জন্য মা বাবা মুখ দেখাতে পারছে না । বৈদেহী আমার ভাল বন্ধু ওর সম্মান বাঁচাতে পারলামনা । স্বপন স্যার গতকাল বাজারে বাবাকে দেখতে পেয়ে বলেছেন উনি আমাকে আর পড়াবেন না । আমার দোষটা কোথায় ? আমিতো গ্রুপ স্ট্যাডি করতে গিয়েছিলাম । একবারও তমাল সূর্যর অভিসন্ধি বুঝতে পারিনি । না - আর না । সবাই নোংরা , বন্ধু , সমাজ , প্রতিবেশি , স্যার সবাই নোংরা । ওদের নিজেদের মন নোংরা , একদম নোংরা । তাই আমাকেও ওরা নোংরা বানিয়ে দিলো । আমার গা ঘিনঘিন করছে । এই সমাজের চোখে আমি আর কোনদিনও সম্মান ফিরে পাবো না । আর দরকার নেই এখানে থাকার । আর থাকবো না এখানে ..... । ' 


" এই ' বাবিন ' দরজা খোল , বেলা দুটো বেজে গেছে , স্নান করে খেয়েনে । কি রে ! দরজা খোল ? সমানে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলেছেন নীলিমা.... খোল দরজা.... খোল ...


অভিমানী দ্রামিক কেন দরজা খুলবে ? দরজার বাইরে বেরোলেই তো নোংরা , আবার গা ঘিনঘিন করে উঠবে । তার চেয়ে বরং ফ্যানে বিছানার চাদর বেঁধে ঝুলছে , হাল্কা হাল্কা দুলতে দুলতে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে । আর তার গায়ে মনে নোংরা লাগবে না ..........

ধড়পড় করে উঠে পড়ে রজতাভ । কি ভয়ংকর স্বপ্নে তলিয়ে গেছিলেন  রাতভোর !  জানুয়ারী মাসের শীতেও কুলকুল করে ঘামছেন । লেপ অনেক আগেই লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছেন । বিছানায় ডান পাশে কুঁকড়ে শুয়ে আছে নীলিমা , গায়ে লেপের চার ভাগের একভাগ ঢাকা দেওয়া আছে বাকিটা বিছানা থেকে মাটিতে ঝুলছে । রজতাভ তখনও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁপাচ্ছেন । গলা বুক শুকিয়ে উঠেছে । এই ভয়ংকর অনুভূতি যে স্বপ্নদোষ সেটা ধাতস্থ হতে সময় লাগে । কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর লেপটা টেনে নিয়ে নীলিমাকে ঢেকে দেন । ধীর গতিতে উঠে দরজা খুলে দ্রামিকের ঘরে যান । তাঁর আদরের বাবিন কানে হেডফোন লাগিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে । সামনের এপ্রিলে বারো ক্লাসের বোর্ড দেবে । অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে তারপর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে । রজতাভর চোখে জল এসে যায় , বাবিনের ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে নিজ মনে বলে ওঠেন --- বাবিন তোর সমন্ধে আমরা খারাপ কিছু ভাবতে পারিনা , তুইও বাবিন সর্বদাই শুভ চিন্তাই করিস । আমরা তোকে  ভরসা দিয়ে যাবো সারাজীবন , তুই শুধু সুস্থ থাকিস আমাদের জন্য এবং তোর নিজের জন্য । 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract