Subhra Roy

Inspirational

3.5  

Subhra Roy

Inspirational

নির্ভয়া

নির্ভয়া

14 mins
115


-- ' নিশি ঐ দ্যাক মা স্ব -র -শ - তি আসছে । মাইরি বলছি চোখ দুটো যা ডাগর নুশরত মালটাকেও হার মানায় । ঠোঁট দুটো যেন পাকা করমচা । মাইরি বলছি দেকলেই জিব দিয়ে লাল টসকে যায় ' ।

--' এই সা - লা প্রদিব , মেরে সালা ভোগের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো , বৌদি হয় তোর , ছম্মান দিয়ে কথা বলবি । অপর্ণা শুধু কার্তিকের ভাইয়ের বৌ হবে । '

--' কেন গুরু হটাৎ অপর্ণাতে মজেছো ? রত্না কুন্তলা মাধবী ওরা বাদ ? '

--' চুপ কর , ফালতু বকিস না , ফুর্তির মালকে কি আর ঘরের লক্ষী করা যায় ? ' কার্তিকের ভাইয়ের বৌ সিখিত হবে , তবেই না বীরশিবপুরে মান থাকবে । দেখলি না যোগমায়া ইস্কুলে ফাস্ত গাল , সেদিন মঞ্চে উঠে পlইজ নিলো । সেই দিনই আমি পেমে পড়ে যাই রে । মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি অপর্ণাই হবে কার্তিকের ভাইয়ের বৌ ' ।

-- ' ঐ দ্যাক নিশি অপর্ণা ...থুড়ি ....থুড়ি বৌদি ইস্কুলে এসে পড়েছে , আজ বলবি কথা ?

-- ' চল আজ বলেই ফেলি আমার দিলের কথা । ....হে ....হে '

বীরশিবপুরের কাউন্সিলার কার্তিক সমান্তর ভাই নিশি সামন্ত ঐ এলাকার নাম করা গুন্ডা লোফার । কাউন্সিলারের ভাই বলে কেউ নিশির কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না । প্রত্যেকেরই মানসম্মানের ভয় আছে , মারধরের ভয় আছে । এলাকাবাসী এদের ঘৃণার চোখে দ্যাখে । আর নিশি ও তার সঙ্গীসাথীরা মনে করে কার্তিক সমান্তর প্রতিপত্তির প্রভাব দেখে মানুষজন তাদের সমীহ করে চলে । তাই ওরা কার্তিক সমান্তর প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় দোকান গুলিতে তোলা আদায় করে , কারনে অকারণে চাঁদার জুলুম করে , আর রয়েছে এলাকার মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা । এই হলো ওদের দৈনন্দিন কর্মসূচি । ঐ এলাকার যোগমায়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হলো ওদের পীঠস্থান । সকাল নটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত স্কুলে আগত ছোট বড় সব মেয়েদের সাথে ওরা অশালীন ব্যবহার নোংরা কটুক্তি করে চলে ।

যেদিন ঐ এলাকার বিডিও অফিস ও লোকাল কাউন্সিলারের যৌথ উদ্যোগে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের প্রাইজ প্রদানের অনুষ্ঠান করা হয়েছিল সেদিন থেকেই কাউন্সিলার কার্তিক সমান্তর ভাই নিশি সামন্ত অপর্ণাকে টার্গেট করে । তার ধারণা অপর্ণাকে বিয়ে করে এলাকার লোকের চোখে জাতে উঠবে । যেহেতু তার দাদা কাউন্সিলার সেহেতু শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করে সে বাড়ির মান বাড়াবে । একটা লোফার গুন্ডার এতো উচ্চ চিন্তা ভাবনাকে বোধহয় গড় করা উচিৎ । অথচ নিশি নিজে প্রাইমারী স্কুলের গন্ডী পেরোয়নি । নজরের তার তারিফ করতে হয় । নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী নাবালিকা স্কুল ছাত্রীকে বিয়ের জন্য রোজই উত্ত্যক্ত করে চলেছে ।

অপর্ণার দুচোখে স্বপ্ন -- মাধ্যমিকের রেজাল্টের তুলনায় উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট আরো ভালো করতে হবে । বিডিও অফিসার বলেছেন রেজাল্ট খুব ভাল হলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে রাজ্য সরকারের বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়ে দেবেন । এই বৃত্তি পাবার জন্য অপর্ণা পড়াশোনায় আরো মনোনিবেশ করে চলেছে । কারণ অপর্ণা জানে ভালো কলেজে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন , সেটা তার মিলে কাজ করা বাবার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব । অপর্ণার বুকে আরো একটা আশা ধকধক করে , অপর্ণা ডাক্তার হতে চায় । অপর্ণা জানে একবার ডাক্তারিতে চান্স পেলে বাবা মায়ের কষ্টের প্রতিপালনের মূল্য সঠিক ভাবে সুদে আসলে মেটাতে পারবে । আর কোন কষ্ট থাকবে না তার পরিবারে ।

দুদিন ধরে অপর্ণার সাইকেলটা বিগড়েছে । অপর্ণার মা বলেছেন ------ ' সামনের মাসে তোর বাবা মাইনে পেলে তোর সাইকেলটা আগে সারিয়ে দেব । এই কটা দিন একটু হেঁটে স্কুলে যা মা । আমি বর্ণালীকে বলে দেব তোর সাথে যেন হেঁটে স্কুলে যায় ' ।

অপর্ণার বাড়ি থেকে স্কুল হাঁটা পথে কুড়ি পঁচিশ মিনিট । তাদের পাড়া থেকে বেরোতেই বড় রাস্তা । বড় রাস্তার মোড় ছাড়ালেই খাল , খাল পেরোলেই হনুমান মন্দির , তার পাশেই যোগমায়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় । স্কুল শুরু সাড়ে দশটা থেকে তার অনেক আগেই সাদা সালোয়ার ও নীল ওড়না পরিহিতা স্কুল ছাত্রীরা আসতে শুরু করে দেয় । এখন বেশির ভাগ মেয়েই স্কুলে সাইকেল নিয়ে আসে । অপর্ণা বর্ণালী দুই বন্ধু পঞ্চাননতলার একই পাড়াতে থাকে । অপর্ণা গতবছর মাধ্যমিকে স্কুল থেকে ফার্স্ট হয়েছিলো শুধু তাই নয় বীরশিবপুরে সব স্কুলের মধ্য থেকে সেই সর্বোচ্চ নম্বর পায় ।

এই অপর্ণাই এখন পড়াশোনা ভুলে গিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে । কয়েকদিন ধরেই নিশির দৌরাত্ম্যে একটা চাপা ভয় অপর্ণার মতো একটা শান্ত মেয়েকে চঞ্চল করে তুলেছে । স্কুলের এই সময়টাতে সে নিজেকে যেন একটা ভয়ার্ত কালো ছায়ার দিক চক্রের গন্ডীতে হারিয়ে ফ্যালে । কিছুতেই নিজের বুকের পাঁজরের খাঁচাটাকে মজবুত করতে পারে না , হৃদস্পন্দনের ধুকপুকানির গতি তীব্র হয়ে ওঠে । যদি ছেলে গুলো সত্যি সত্যি কোন অশ্লীল ব্যবহার তার সাথে করে ফেলে তখন সে কি করবে ? এই একটা নিদারুণ আশঙ্কা এখন সর্বদা তার মনে যেন ধেয়ে আসছে । কি বিশ্রী কথাবার্তা ছেলে গুলোর ভাবতেই অপর্ণার ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে । সারা সন্ধ্যেটা একটা অস্থিরতা নিয়ে কাটলো পড়ায় আর মন বসলো না । অপর্ণা আর থাকতে না পেরে রান্না ঘরে মায়ের কাছে ছুটে যায় , মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । তার মা সব কথা শুনে বললেন -------' ওদের কথায় কোন কান দিবি না , গম্ভীর মুখে হেঁটে যাবি , কাল থেকে আমি তোকে স্কুলে দিয়ে আসবো । '

কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ কাল রাত থেকে অপর্ণার ছোট বোনটার ধুম জ্বর তাই অপর্ণার মা আজও অপর্ণাকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারলেন না । অগত্যা অপর্ণা আর বর্ণালীকে মা ছাড়াই স্কুলে যেতে হলো ।

-- ' অপর্ণা দ্যাখ দ্যাখ সামনেই ছেলে গুলো '

অপর্ণা মৃদু ধমকে বলে ----' বনা , মুখ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি পা চালা , কোনদিকে তাকাবি না ' ।

মন্দিরের সামনে আসতেই ছেলে গুলো অপর্ণাদের প্রায় ঘিরে ধরে । তার মধ্যে নিশি ছেলেটি নিজের দিলের কথা বলবে বলে অপর্ণার ওড়নাটা পিছন থেকে টেনে ধরে ....... ' ওফ ! কি সুন্দর গন্ধ মাইরি তোমার ওড়নায় ! ! , কি সাবান দিয়েছো অপর্ণা ? .....সানলাইট না টাইড ? ...ওফ ! গন্ধে আমার দিলটা ঝকঝকে পরিসকার হয়ে গেলো ।' অপর্ণা বেগতিক দেখে ওড়নাটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে প্রাণপণে দৌড় লাগলো , বর্ণালীও অপর্ণার পিছু পিছু দৌড় লাগায় । হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলের গেট পার হয় ।

--' অ...প....র্ণা খু...ব জো.....র বেঁচে গেছি রে ....' হাঁপাতে হাঁপাতে বর্ণালী অপর্ণার কাঁধে হাত রাখে ।

অপর্ণা দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কেঁদে ফ্যালে । এই ভাবে হেনস্থা হয়ে নিজেকে তার বড় অসহায় মনে হচ্ছিল ।

-- ' এই অপর্ণা কাঁদিস না ! ! সবাই দেখতে পাবে । তার চেয়ে চল আজ হেড দিদিমণিকে বলি ।'

-- ' বলে কিছু হবে না রে ....' অপর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে । দেখলি না কাল সবিতাদিদিমনিকে জানালাম । উল্টে উনি আমাকে বললেন -----' ছেলেগুলো টিটকারি কাটছে তুমি কি করে বুঝলে ? তোমার ওদের দিকে তাকানোর কি আছে ? ..........' ছেলে গুলো অসভ্যতা করছে সেটা যেন আমার দোষ । তুই বল বড়দিদিমণিকে বলে আর কি হবে ? তিনিও একই কথা বলবেন ------'চুপ করে থাকো , পড়াশুনায় মন দাও ' । '

ভয় পেতে পেতে বেশির ভাগ মানুষের মনোবল ভেঙ্গে যায় , মেরুদন্ডটা নিজের দৃঢ়তা হারিয়ে মাথাটাকে নত করে দেয় । পরিবেশের সাথে বাস্তবতার সাথে আপোষ করে ফ্যালে । কিন্তু অপর্ণা এই গোত্রের মেয়ে নয় । আজ নিশির ওড়না টানাতে অপর্ণা ভয় ও লজ্জা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু আপোষ করার মেয়ে সে নয় । সারাটা পিরিয়ড ধরে ভেবেছে সে , তারপর ঠিক করে নিয়েছে ----- এই স্বাধীনদেশে আমরা এইভাবে ভয়ে ভয়ে বাঁচবো কেন ? সবাইকেই একদিন মরতে হবে ! স্বাধীন ভাবে যদি বাঁচতে না পারি তাহলে মেরে মরাই ভালো ।

এই সংকল্প তার চিত্তকে অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথের দিশারী করে তোলে । সংকল্প করে নেয় নিজেকে কতকগুলো মস্তানের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেবে না । টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসের বর্ণালী দীপ্তা রিঙ্কু মৌসুমীদের সাথে ঠিক করে নেয় কাল দল বেঁধে তারা স্কুলে আসবে , আর আজকের ওড়না টানার জবাব কাল সুদ সমেত মেটাবে । কি করবে সেটা তারা ক্লাসে বসেই ঠিক করে নেয়।

পরেরদিন রিঙ্কু মৌসুমী দীপ্তারা অপর্ণার বাড়িতে একজোট হয় । গতকালের প্ল্যান অনুযায়ী পাঁচটি মেয়ে বাড়ি থেকে রেডি হয়ে বেরোয় । আজকে তিনজনের কাঁধে স্কুল ব্যাগ ছাড়াও হাতে খবরের কাগজে মোড়া লম্বা মতো একটা জিনিস আছে যা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না কি জিনিস । খাল পার হতেই তারা দূর থেকে দেখতে পায় প্রতিদিনের মতো আজও নিশি তার সাগরেদদের নিয়ে হনুমান মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । অপর্ণা বর্নালীর দিকে তাকিয়ে বলে ---- ' আজকেও ওরা আমাকে কিছু করবে । মনে আছে তো তোদের কি করতে হবে । ভয় পাসনা । আমি ইশারা করলেই ঝাঁপিয়ে পড়বি । এখন চুপচাপ এগিয়ে চল । খুব সতর্ক থাকবি হাত থেকে কিছু যেন ফসকে পড়ে না যায় । '

হনুমান মন্দিরের কাছে আসতেই নিশি ও তার সাগরেদরা পাঁচটি মেয়েকে ঘিরে ধরে । ---' এতো দেরী করে কেন ইস্কুলে আসো বলো তো অপর্ণা ? এক্ষুনি ইস্কুলের ঘন্টা বেজে যাবে , তোমার সাথে দিল কি বাত কখন করবো অপু ? কাল কাছে ডাকলাম দৌড়ে পালিয়ে গেলে । '

-- 'আজ আর পালাবো না , আজ তোমরা পালাবে ........' অপর্ণা দৃঢ় গলায় জবাব দিলো । ওর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে । অপর্ণা গর্জে ওঠে ......' জয় দুর্গা ' .....সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটি মেয়ে নীল ওড়না দিয়ে নিজেদের মুখ ঢেকে নেয় । বর্ণালী রিঙ্কু মৌসুমী দীপ্তারা ব্যাগ থেকে মুঠো মুঠো লঙ্কার গুঁড়ো বের করে ছেলেগুলোর মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে । হঠাৎ আক্রমণে ছেলে গুলো আর্তনাদ করে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে । সেই সুযোগে অপর্ণা রিঙ্কু মৌসুমী হাতে কাগজে মোড়া উইকেট নিয়ে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । এই উইকেট তিনটি আজ মৌসুমী তার দাদাকে না বলেই অপর্ণার বাড়িতে নিয়ে এসেছিল । এরপর মারের পর মার , এলোপাতাড়ি মার শুরু করে তারা । দীপ্তা বর্নালী লঙ্কা গুঁড়ো ছেটাছে আর পায়ে করে লাথি মারছে । অপর্ণা মারতে মারতে দিকজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে । অপর্ণা যেন তখন মা দুর্গার -ই এক অংশ । সেই শান্ত মেয়েটা আজ নিরুপায় হয়ে অশান্ত হয়ে উঠেছে । এতো দিনের লাঞ্ছনা কটুক্তি শ্লীলতাহানির মোক্ষম জবাব দিতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । পাঁচটা মেয়ের আক্রমণে ছটা মস্তান তখন রক্তাক্ত হয়ে ধরাশায়ী । ওদের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই । মারের পর্ব চুকিয়ে মেয়েরা দৌঁড়ে স্কুলে ঢুকে যায় ।

স্কুলে ঢুকতে অপর্ণাদের নিস্তার নেই । রাস্তায় স্কুলের অনান্য মেয়েরা ওদের মারপিট দেখে ততক্ষনে দিদিমণিদের খবর দিয়ে দিয়েছে । অপর্ণারা ক্লাসরুমে ঢুকতেই সবিতাদিদিমণি হেডদিদিমণি ও আর দুজন দিদিমণি হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে ঢুকলেন । সবিতাদিদিমণি গর্জে উঠলেন - -----' কোথায় অপর্ণা ? অপর্ণা ? '

অপর্ণা কাছে আসতেই সবিতাদিদিমণি সপাটে এক চড় কষালেন । -------- ' কি ভেবেছিস তুই ? মাতব্বর হয়ে গেছিস ? তুই ওই গুন্ডা ছেলে গুলোর গায়ে হাত তুলেছিস ? জানিস এর পরিণাম কি হবে ? কার্তিক সামন্ত দলবল নিয়ে এসে স্কুলটাকে জ্বালিয়ে দেবে । শুধু তোর কারণে এতো গুলো মেয়ে নিয়ে আমরা বিপদে পড়লাম । তোকে বলেছিলাম না চুপ থাকতে , পড়াশোনায় মন দিতে । '

--' আহা ! সবিতা থামো থামো । মেরো না । ছেলে মানুষ , রাগের মাথায় করে ফেলেছে । এখন চলো অফিস রুমে । থানায় একটা ফোন করি । যদি দারোগাবাবু কোন প্রোটেকশান দেন ।' ......হেডদিদিমণি সবিতাদিদিমণিকে থামিয়ে অফিস রুমে নিয়ে যান ।

দিদিমণিরা ক্লাস রুম থেকে বেরোতেই রিঙ্কু মৌসুমী অপর্ণাকে বলে ------- ' অপর্ণা এবার কি হবে রে ? তোর কথায় ওদের মারলাম , এখন কার্তিক সামন্ত যদি স্কুল জ্বালিয়ে দেয় তখন কি হবে ? বাড়িতে জানতে পারলে মা বাবাও তো মারবে রে । ' .......... দিদিমণিদের কথা শুনে ওরা বেজায় ভয় পেয়ে গেছে । অপর্ণা একদম চুপ মেরে গেছে । খানিক্ষণ চুপ থাকার পর বললো -------'আমি তোদের বিপদে ফেলবো না । আমার উপরে ভরসা রাখ তোরা ' ।

তখনও ঘন্টা খানেক অতিক্রম হয়নি । এরই মধ্যে হনুমান মন্দিরের সামনে প্রচুর লোকজনের জটলা । খুব চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে স্কুলের ভিতর থেকে । নিশির উপর যোগমায়া স্কুলের মেয়েরা চড়াও হয়েছে শুনে কার্তিক সামন্ত দলবল নিয়ে হাজির । স্কুলের গেট থেকে খাল পাড় অবধি শতাধিক লোকের জটলা । কার্তিক সামন্ত হনুমান মন্দিরের সামনে জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন , স্কুলে লোক পাঠিয়েছেন হেডদিদিমণিকে ডেকে আনার জন্য । স্কুলের অফিস রুমে দিদিমণিরা তখন ভয়ে তটস্থ । একবার যদি কার্তিক সামন্ত দলবল নিয়ে ঢুকে আসেন তখন এতো ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের কে বাঁচাবে ? হেড দিদিমণি থানায় সব কথা জানিয়ে সাহায্যের জন্য অনেক অনুরোধ করেছেন । থানার ইনচার্জ ব্যপারটা দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন । হেডদিদিমণি দুজন শিক্ষিকাকে নিয়ে স্কুলের গেটের বাইরে বেরিয়ে কার্তিক সামন্তর সামনে উপস্থিত হলেন ।

-- 'এই যে হেডদিদিমণি ! কি নাম বেশ আপনার ?

--' ইয়ে স্যার , অপরাজিতা চক্রবর্তী ।

-- ' ও অপরাজিতা দিদিমণি , আপনার মেয়েরা কি শুরু করেছে বলুনতো ! ! পড়াশুনার নাম করে স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার বদলে মফস্বলের মেয়ে গুলোকে মাওবাদী বানাচ্ছেন ? কোথায় সেই মেয়েটি স্কুল থেকে বের করে আনুন । সে কত বড় মাওবাদী হয়েছে আমি তাকে দেখি একবার । যান , যান নিয়ে আসুন মেয়েটিকে । '

--' বাচ্চা মেয়ে , মাপ করে দিন স্যার । রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছে । আমি ওর হয়ে হাত জোড় করে আপনার কাছে মাপ চাইছি । আমি স্কুলের হেড দিদিমণি হয়ে একটা ছাত্রীকে আপনার সামনে আনতে পারিনা । একটু বোঝার চেষ্টা করুন স্যার । ওকে মাপ করে দিন । আসলে ছেলে গুলো বহুদিন ধরে স্কুলের মেয়েদের সাথে অশালীন ব্যবহার করছে , তাই মেয়েরা একটু রুখে দাঁড়িয়ে ছিলো । ' ........হাত জোড় করে অনেক অনুনয় বিনয় করলেন হেড দিদিমণি ।

-- ' এটাকে একটু রুখে দাঁড়ানো বলে ? মেরে আমার ছেলেদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে , চোখ অন্ধ করে দিয়েছে , হাত পাও ভেঙ্গে দিয়েছে । ডাকুন মেয়েটিকে , না হলে খুব খারাপ হবে ।' ....কার্তিক সামন্ত হুংকার দিয়ে ওঠেন ।

স্কুলে সব শিক্ষিকারা এবং মেয়েরা তখন স্কুলের ভিতরে গেটের কাছে জড়ো হয়েছে । সবাই অপর্ণাকে দোষারোপ করছে । অপর্ণা মাথানিচু করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় । সবিতা দিদিমণি বললেন ---- ' মা দুর্গা সাজার সাধ মিটেছে তোর ? স্কুলটাকে নষ্ট করলি তুই । তোর কারণে আজ আমরা ভীত । এবার কি করে বাড়ি ফিরবো বলতে পারিস ? '

এতক্ষণ অপর্ণা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো । সবিতাদিদিমণির কথা শুনে গেটের দিকে এগিয়ে গেল ....

-- ' এই ....এই কি করছিস অপর্ণা ? গেট খুলছিস কেন ? '

--' আমি বাইরে যাবো । আজ যদি না যাই ওদের সাহস শতগুণ বেড়ে যাবে । আর কোন মেয়েই ওদের হাত থেকে রেহাই পাবে না । '......অপর্ণা সবিতা দিদিমণির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর দিলো ।

অপর্ণা গেট খুলে বাইরে এসে লোকজনের জটলা সরিয়ে হনুমান মন্দিরের ভিতরে ঢোকে । হনুমানজীর গলা থেকে গাঁদাফুলে গড়া মালাটা খুলে নিয়ে কার্তিক সামন্তর সামনে এসে দাঁড়ায় ।

--' আমিই অপর্ণা ঘোষ , আমাকে ডাকছিলে ' দাদাভাই ' ? আচ্ছা তোমার কথা আমি পরে শুনবো , আগে তোমার ডান হাতটা বাড়াও তো । ........ কি দাদাভাই শুনলে না ? তোমার ডান হাতটা বাড়িয়ে দাও।'

কার্তিক সামন্ত বাকরুদ্ধ , কলের পুতুলের মতো অপর্ণার দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় ।

কার্তিক সামন্ত হাত বাড়াতেই অপর্ণা হনুমানজীর গলার মালাটা কার্তিক সামন্তর হাতের কব্জিতে পেঁচিয়ে পরিয়ে দেয় । তারপর কার্তিক সামন্তর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে কার্তিক সামন্তকে বলে -----' জানো ' দাদাভাই ' এটা হনুমানজীর গলার মালা , এটা দিয়ে আমি তোমাকে রাখী পরালাম । ' দাদাভাই ' জানো আমার কোনো দাদা বা ভাই নেই । আজ আমি গোটা বীরশিবপুরের মানুষদের সাক্ষী রেখে তোমাকে দাদা মানলাম । আমার সম্মান রক্ষা করা আজ থেকে তোমার দায়িত্ব । ' দাদাভাই' এই গুন্ডা ছেলে গুলো আমাকে রোজ বিরক্ত করে , আমার ওড়না ধরে টানে , নোংরা নোংরা কথা বলে । আর ঐ ছেলেটাকে দেখছো ..... নিশিকে দেখিয়ে ....ও আমাকে রোজ বিয়ে করবে বলে বিরক্ত করে । দিন কে দিন সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিলো । তাই আমি আজ অপমানের বদলা নিতে ওদের চোখে লঙ্কা গুঁড়ো ছিটিয়ে ওদের কাহিল করে তারপর উইকেট দিয়ে খুব মেরেছি । ' দাদাভাই ' তুমি বলতো আমি ঠিক করেছি কিনা ? তোমার বোন যদি আজ আমার জায়গায় থাকতো সে কি ঐ ভাবে অপমানের বদলা নিত না ? দাদাভাই বলো না আমি ঠিক করেছি কিনা ? তুমিই বিচার করে বলো ? '

অপর্ণার কথা শুনে কার্তিক সামন্ত স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ হতভম্ব । ....হাঁ করে অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । শুধু কার্তিক সামন্ত নয় ঐখানে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত অপর্ণার স্পর্ধা দেখে । সবাই নিশ্চুপ , গাছের পাতা পড়লে তখন যেন শব্দ পাওয়া যাবে । এমন স্থির পরিবেশে অপর্ণা আবারও বলে ওঠে --' ও দাদাভাই বলো না আমি ঠিক করেছি কিনা ? '

আবার অপর্ণার প্রশ্ন শুনে কার্তিক সামন্ত যেন স্তম্ভিত ফিরে পায় । তিনি নিশির দিকে এগিয়ে যান , তারপর সপাটে এক চড় নিশির গালে কষান। হুংকার দিয়ে ওঠেন ---- 'আর যদি কোনদিন তোকে বা তোর বন্ধুদের স্কুলের ত্রিসীমানায় দেখি বা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে দেখি সেদিন আমি তোদেরকে নিজে হাতে লকাপে দিয়ে আসবো । এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা বলছি ' ।

-- ' দাদা আমাকে তুমি মারলে ? '

--' একদম চুপ , এখান থেকে চলে যা না হলে আরেকটি চড় তোর গালে পড়বে । '

নিশি নিজের দাদার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে ঐ স্থান থেকে বন্ধুদের নিয়ে সরে যায় ।

কার্তিক সামন্ত অপর্ণার কাছে এসে অপর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ---- ' কিরে দাদার বিচারে খুশী হয়েছিস তো ? '

অপর্ণা একগাল হেসে মাথা নাড়ে । তাই দেখে কার্তিক সামন্ত বললেন , বেশ জোরেই বললেন ---- ' আজ আমিও খুব খুশী রে । বীরশিবপুরের লোকজন আমার প্রতিপত্তি দেখে ভয় পায় । কিন্তু শ্রদ্ধা করে না সেটা আমিও জানি । আমার পিঠ পিছু আমাকে হারামীর বাচ্চা বলে , আমাকে বেজন্মা শয়তান বলে । আমার সামনে সবাই মাথা নত করে থাকে সেটা সম্মানে নয় ঘেন্নায় করে । আজ এই প্রথম কেউ আমাকে দাদাভাই বলে মানুষের সম্মান দিলো । আমার বুকটা তুই ভরিয়ে দিলি বোন। '

কার্তিক সামন্তর কথা শুনে হেড দিদিমণি হাততালি দিয়ে ওঠেন । সাথে সাথেই জনতা হাততালি দিয়ে ওঠে । কার্তিক সামন্তর লোকজনেরা একসাথে বলে ওঠে ----' জয় কার্তিক সামন্তর জয় ' । ....

--' থাম থাম তোরা , আমার জয় করতে হবে না , আজ এই বোনটার জয় বল সব । তারপর তিনি জনতার উদ্দ্যেশে বললেন ----- ' আমি আজ আপনাদের কথা দিচ্ছি আজ থেকে কোন ছেলে স্কুলের কোন মেয়েকে বিরক্ত করবে না । যদি কেউ করে আপনারা আমাকে খবর দেবেন আমি উচিৎ ব্যবস্থা নেবো । ' ........তারপর হেড দিদিমণির দিকে তাকিয়ে বিনম্র স্বরে বললেন ----' আপনাকে ডেকে এনে অনেক সময় নষ্ট করে দিলাম , যান মেয়েদের নিয়ে স্কুলে যান , মানুষ গড়ার কাজে এগিয়ে যান। ......... নমস্কার । '

হেড দিদিমণি প্রতি নমস্কার জানিয়ে স্কুলের গেটের দিকে এগোতে যাবেন তখনি থানা থেকে পুলিশের জিপ এসে থামে । ---- ' এই যে হেডদিদিমণি কি হয়েছে ? সব ঠিক আছে ? '

হেড দিদিমণি অপর্ণার কাঁধে হাত দিয়ে পরম স্নেহে নিজের কাছে টেনে এনে স্মিতহাস্যে বললেন ----- ' হ্যাঁ সব ঠিক আছে । আমার নির্ভয়া ..... আমার অপর্ণা সব ঠিক করে দিয়েছে । বুঝলেন ! শুধু সাহস থাকলে হয়না , বুদ্ধিরও প্রয়োজন সেটাই আমার নির্ভয়া অপর্ণা করে দেখিয়েছে । একদিকে সাহসের সাথে দুষ্টের দমন করেছে । অপর দিকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে মেয়েদের আত্মসম্মান রক্ষা করেছে । কাউন্সিলার কথা দিয়েছেন আজ থেকে বীরশিবপুরের মেয়েরা পথেঘাটে স্বাধীন ভাবে সম্ভ্রমের সাথে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করবে । কোন মেয়ে আর লাঞ্ছনার শিকার হবে না । 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational