চ্যাটিং উইথ সাহেব
চ্যাটিং উইথ সাহেব
--- ' মা ' , তোমার সাহেব দেখছি ক্ষেপে উঠেছে , এই দেখো কি লিখেছে ? '
পরমা হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো । -- ' কি লিখেছে রে ? '
যা লিখেছে তাতে বাংলায় ট্রান্সলেট করলে দাঁড়ায় --' পরমা , আমার প্রতিটা দিন খুব বাজে কাটছে । আমি তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছি । এক একটা দিন আমার কাছে যেন অভিশপ্ত ।'
পরমা মুচকি হেসে বললো --' তা পাগল না হয়ে উপায় কি আছে বল ? তোর বাবা অফিস যাওয়ার আগে ' শেলীর ' একটা প্রেমের কবিতা পোস্ট করে গেছে যে । ও কবিতার কয়েক লাইন পড়লে যে কেউ ছটফট করবে ।'
( পরমা সেনগুপ্ত , গৃহবধূ , মাস ছয়েক হলো হাতে নতুন টাচ্ মোবাইল পেয়েছে । পুরনো ফোন টার সফট ওয়ার খারাপ হয়ে গেছে । ঠিক ঠাক টাইপ করা যেত না । ম্যাসেঞ্জারে কিছু লিখতে গেলেই আটকে আটকে যেত ।ঠিক মতো সার্ভ করা যেত না । পরমার স্বামী সুশান্ত সেনগুপ্ত , ব্যাঙ্কে চাকুরীরত । সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকেন না । ছেলে অয়ন ল কলেজের সেকেন্ড ইয়ার । সেও সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকে না । পরমা সকাল সকাল রান্না তো সেরেই ফ্যালে আর কিছু কাজ পড়ে থাকলে তাও সে বেলা এগারোটার ভিতর সেরে ফ্যালে । তাই বিকাল অবধি অনেকটা সময় নিরিবিলিতে থাকতে পারে । এই সময়টা সে ঘুম , টিভি আর মোবাইল চ্যাটিং - এ ব্যাস্ত থাকে । প্রচুর ফ়েসবুক ফ্রেন্ড রয়েছে । গত কুড়ি দিন ধরে এক বিদেশী লোকের সাথে চ্যাট করছে । পরমা তার নামের মতই সুন্দর , ফ়েসবুকে পরমার মিষ্টি মুখ খানি দেখেই হয়তো ম্যানচেস্টার -এর বাসিন্দা মাইকেল ক্যারিক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন । পরমা কোন বিচার বিবেচনা না করেই কনফার্ম করে দেয় । সেই শুরু সাহেবের সাথে চ্যাটিং । )
পরমার পরিবারে স্বামী স্ত্রী ছেলের মধ্যে বন্ডিং টা বেশ দারুণ । ওরা প্রত্যেকেই জীবনের দৈনন্দিন ছোটখাটো সব ঘটনাই একে অপরের সাথে নির্দ্বিধায় খোলা মনে আলোচনা করে । একে অপরের সাথে যে ভাবে মেশে তাতে সম্পর্ক বা বয়সের তারতম্যের কোনটাই বাঁধা হয় না । যাকে বলে সাবলীল বন্ধুত্বের সম্পর্ক । তাই যেদিন থেকে পরমা সাহেবের সাথে চ্যাট করছে , সুশান্ত ও অয়ন সব জানে এবং তারা বাড়ি ফিরে চ্যাট গুলো খুব মজা করেই পড়ে আর পরমাকে চ্যাট লিখতে সাহায্য করে । পরমা বাংলাতে যতটা দক্ষ ঠিক তার উল্টোটাই তার ইংরাজীর দখল । দুলাইন লিখতে দশ মিনিট পেন চেবায় । ঠিক ঠাক গ্রামার লিখতে হবে তো ! এরপর কি ভাবে ওই পেন দিয়ে ইংরাজী সাহিত্যর ঝড় ওঠে ? কিন্তু সাহেবের বক্তব্যের যথাযথ উত্তরটাও তো লিখতে হবে , না হলে সাহেব ভাবতে পারে পরমা ইংরাজীতে অপারদর্শী ।
সুশান্ত অফিস থেকে বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে সাহেবকে ভালই টাইম দেন । আর সাহেব ভাবে পরমা চ্যাটিং দারুণ এনজয় করছে । মধ্যেখান থেকে অয়ন তার বাবাকে দুষ্টু বুদ্ধির যোগান দেয় । একদিন পরমা ওদের দুজনকে বকে ছিলো --- ' কি গো তোমরা দুজনে এই সব কি করছো বলোতো ? সাহেব তোমাদের লেখা পড়ে আমার সমন্ধে অন্য কিছু ভাবতে বসেছে । আমি শুধু গল্প করতেই চেয়ে ছিলাম । তোমরা দুজনে মিলে ওকে নিয়ে মজা করছো আর ওই সাহেব প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । '
এটা ঠিক পরমা কিন্তু বন্ধু সুলভ আচরন করতে চায় লেখার মাধ্যমে । এখন ব্যপারটা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে সুশান্ত আর অয়ন সাহেবের সাথে বেশী চ্যাটে ব্যাস্ত থাকে ।
মাঝ বয়সী সাহেব নিজে কতটা এ্যাট্রাকটিভ , কতটা অ্যাক্টিভ জানানোর জন্য প্রায়ই ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও পাঠায় । সেটা কখনও সাহেবের জিম করার ভিডিও বা কখনও পার্টিতে এনজয় করার ভিডিও হয় ।
পরমা দেখতো আর মন্তব্য করতো -- ' ভেরী নাইস ' । ইচ্ছা থাকলেও ইংরাজীর পাণ্ডিত্য দেখাতো না , যদি গ্রামারের কোন ভুল বেরিয়ে যায় । তাই দেখে সুশান্ত একদিন বললেন -- ' কি খালি ' ভেরী নাইস ' লেখো বলোতো? দাও আমাকে একটু ফাটিয়ে লিখে দিই । সেই শুরু সুশান্তের চ্যাটিং - এ নাক গলানো ।
সেই কারণে ম্যাসেঞ্জারে এত ভাল রেসপন্স পেয়ে সাহেব প্রেমের স্রোতে ভাসছে। পরমার মোহময়ী সৌন্দর্য্য সাহেবের বড়ই মনে ধরেছে মনে হয় । রোজই সাহেব পরমাকে জানান দেয় সে সিঙ্গেল ।
পরিবর্তে পরমা লিখে পাঠায় --সে সিঙ্গেল নয় , তার পরিবার আছে । বাড়িতে আছে তার একমাত্র ছেলে অয়ন যার কুড়ি বছর বয়স । আর আছে তার প্রিয়তম স্বামী সুশান্ত সেনগুপ্ত । এই পরিবার নিয়ে সে বড়ই সুখী ।
সাহেব পরমার বক্তব্য শুনে অ্যাপ্রিসিয়েট করেছিল । তারপর দুদিন ম্যাসেঞ্জারে আসেনি । এই দুদিন পরমা আরাম করে ফ়েসবুক ঘেঁটেছে । নাহলে তো এর আগে পরমা নেট অন করলেই হলো , ফর ফর করে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ ঢুকতে শুরু করে দিত । তার সাথে টুং টুং সাউন্ড । ফ়েসবুকে কোন কিছু দেখার উপায় নেই ।প্রায় একই কথা সাহেবের --- ' তুমি এখন অন লাইনে ? কি করছো ডার্লিং ? আমি তোমার সাথে চ্যাটে খুব আগ্রহী.......ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রতি কথায় ডার্লিং ডার্লিং আর ডার্লিং। একে এতো গুলো মেসেজর ইংরাজীতে উত্তর দেওয়া, তারপর ডার্লিং শব্দের বারে বারে খোঁচা খাওয়া , পরমা যেন অস্থির হয়ে রেগে উঠেছিল । কিন্তু সে শান্ত ভাবে একদিন সাহেবকে লিখেছিলো ---' প্লীজ কল মি ' পরমা '' । কিন্তু সাহেব প্রতি উত্তরে জানায় --- ' হোয়াই ডার্লিং ? আই আম রিয়েলি লভ্ যু ' । সেদিন পরমা রাগের চোটে নেট বন্ধ করে দিয়ে দিবা নিদ্রায় মনঃসংযোগ করেছিলো । নিজেই বিড় বিড় করে বলেছিল ---' ওফ ! কি মরতে যে এই হতছাড়া সাহেবের সাথে চ্যাট করা শুরু করেছিলাম , এখন আমি নেট অন করতেই পারছি না । আমার মতো এই মাঝ বয়সী মহিলার সাথে ফ্লাট করার কোন মানে আছে ! ওর দেশে কি মেয়ের আকাল পড়েছে !.. বেয়াদব ইংরেজ ' ।
দুদিন সাহেবের পাত্তা ছিল না , আবার মেসেঞ্জারে আগমন । আগের মতই সে পরমাকে প্রভাবিত করতে চায় ।আর সব উত্তরই সুশান্ত অথবা অয়ন দেয় ।
আজ যখন অয়ন বললো ----' মা তোমার সাহেব ক্ষেপে উঠেছে ।' , তখন পরমা মুচকি হাসলেও পরে অয়ন চলে যাবার পর পরমা একটু চুপ করে বসে ভাবলো ---- 'এই ফরেনার সাহেব বন্ধুত্বের মানে বোঝে ? বন্ধু মানে যার কাছে নিজের সব কথা ব্যক্ত করা যায় । একে অপরের সমস্ত অনুভূতি গুলিকে সম্মানের চোখে দেখবে । জীবনের চড়াই উতরাই পথে সঠিক পরামর্শক হবে । যার কাছে হাত বাড়ালেই ভরসার ছোঁয়া পাওয়া যাবে । এই সাহেব কি কখনো এই গোত্রের বন্ধু হতে পারবে ? তাই চ্যাটিং টা স্রেফ মজার ফ্রেমে বেঁধে রাখার মানে কি আছে ? সুশান্ত আর অয়ন যে ভাবে সাহেব কে নিয়ে লেজে খেলাছে , এতে সাহেব অনেক কিছুই মানে করছে । কারোর মন নিয়ে মজা করা একদম উচিত্ নয় ।আবার এটাও ঠিক সাহেবও কম যায় না । আমি বিবাহিতা জেনেও আমাকে বারে বারে ভালবাসার প্রস্তাব দিচ্ছে । আমার জীবিত অবস্থায় সুশান্তর জায়গা কেউ নিতে পারবে না । তবে বেকার সাহেবের মন নিয়ে প্রেম প্রেম খেলা করার দরকার কি আছে ?
অনেক প্রশ্ন পরমার মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। পরমা যেন বিচলিত হয়ে পড়ে । সে ঠিক করে নেয় সাহেবকে এবার আনফ্রেন্ড করবে । কিন্তু একেবারেই কিছু না বলেই সে সাহেবকে আনফ্রেন্ড করতে চাইলো না । এই ব্যাপারে সে সুশান্ত বা অয়নের ও সাহায্য নিতে চাইলো না । পরমা ম্যাসেঞ্জারে লিখলো --- ' Michael , the message which I am sending you , get an Indian who knows bengali to explain that message . '
এবার সে মাতৃভাষায় মেসেজটা লিখলো --- ' সাহেব আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার বন্ধু হবে । কিন্তু তুমি বন্ধুত্বের মানে বোঝ না । বার্হ্যিক চেহারার সৌন্দর্যে প্রভাবিত হয়ে আমাকে বারে বারে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছো , এটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর । আমি আমার স্বামী সুশান্তকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসি । সুশান্তের জায়গা কেউ নিতে পারবে না । তুমি আমাকে ভুলে যাও । আমি তোমার সেই রকম বন্ধু হতে পারবো না।তাই তোমাকে আনফ্রেন্ড করছি । তুমি ভাল থেকো ।'
পরমা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিয়ে শুধু আনফ্রেন্ড করলো না , একেবারে ম্যাসেঞ্জারে সাহেব কে ব্লক করে দিলো যাতে আর ম্যাসেজ পাঠাতে না পারে । বাংলায় ম্যাসেজটা পাঠিয়ে পরমার সে কি আনন্দ হচ্ছিল ! সে নিজেকে এখন বড়ই হালকা অনুভব করছে । আজ দুপুরের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল , বিকালে কলিং - বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । অয়ন বাড়ি ফিরেছে । অয়নকে টিফিন দিয়ে পরমা ছাদে চলে গেলো শুকনো কাপড় গুলো আনতে । সন্ধ্যায় সুশান্ত বাড়ি ফিরলে পরমা সুশান্তকে চা জলখাবার দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো রাতের রান্নার তোড় জোড় করতে ।
সুশান্ত চা খেতে খেতে পরমার ফোন ঘাঁটছিলেন , ---' আরে তুমি সাহেব কে আন ফ্রেন্ড করতে গেলে কেন ? আরে ব্লক করেও দিয়েছো দেখছি । বেশ তো মজা করা হচ্ছিল ! '
পরমা রান্না ঘরে আটা মাখছিলো , সুশান্তের ডাকে আটা মাখা হাতেই বেরিয়ে এসে বললো --- ' অনেক হয়েছে , সাহেবের দিন ভোর ওই ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের প্রস্তাব আমার আর ভাল লাগছে না । তাছাড়া কারোর মন নিয়ে এই ভাবে ছেলে খেলা করা উচিত্ নয় । তাই আনফ্রেন্ড করে দিলাম । '
সুশান্ত হাসতে হাসতে বললেন -- ' রানী ভিক্টোরিয়ার বংশ আমাদের গোটা দেশটার উপর দুশো বছর রাজত্ব করলো , আর তুমি একটা সাহেবের মনে তিরিশ দিনও রাজত্ব করতে পারলে না ? '
পরমা প্রতি উত্তরে জানায় --- ' না ,পারলাম না , আমরা ভারতীয়রা খুব সহজেই বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পারি , কিন্তু বন্ধুত্বের মুখোশ পরে কারোর উপর রাজত্ব করতে পারি না । আমাদের বিবেকে বাঁধে। আমরা বন্ধুত্বের সঠিক সংজ্ঞা জানি । তাছাড়া কে জানে নাম ভাড়িয়ে কোন ইন্ডিয়ান রোমিও এই কাজ করছে কি না ! , দেখছে ছিপে মত্স্যকন্যা উঠে নাকি ? '
--- ' বাব্বা ! .....পরমা তুমি তো দেখছি বেশ বুদ্ধিমতী হয়ে উঠেছো ? '
--- ' হব না ! কার ছত্রছায়ায় আছি সেটা দেখতে হবে তো ? '
--- ' ও আচ্ছা , .... সুশান্ত হেসে ফ্যালেন ।
পরমা রান্না ঘরে ফিরে গেলে সুশান্ত রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বলে উঠলেন ---- ' আর মনে হয় না পরমা কোন দিন কোন অপরিচিত ফেসবুক ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটে আগ্রহী হবে । খুব শিক্ষা হয়ে গেছে ওর । যাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে ।
সমাপ্ত ॥
