Subhra Roy

Tragedy Classics Inspirational

4.2  

Subhra Roy

Tragedy Classics Inspirational

চায়ের ঘ্রাণে

চায়ের ঘ্রাণে

5 mins
243


আজ তাজ প্রিমিয়াম হোটেলের বুটিক হলরুমটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে । তাতে বহু শেফের আনাগোনা । হোটেলের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসও এসেছেন । আপনারা ভাবছেন হয়তো তাজ প্রিমিয়াম হোটেল কোন ব্রাঞ্চ প্রমোট করছে অথবা মাস্টার্স শেফ কনটেস্ট চলছে ! সত্য হলো আজ এই ফাইভস্টার হোটেলের চীফ শেফ নিলেশ কাপুরের ফেয়ারওয়েল পার্টি । বাইশ বছর বাদে স্বেচ্ছায় কর্মজীবনের ইতি টানলেন  । আমি দ্যা বেস্ট ফুডি ম্যাগাজিনের রিপোর্টার তন্ময় সেন , এসেছি আজকের অনুষ্ঠানে মিঃ কাপুরের ইন্টারভিউ কভার করতে । বেশ সমাদরে মিঃ কাপুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো ফুল কাশ্মিরীশাল ও আরও নানান উপহার সামগ্রী দিয়ে । হোটেলের সত্তরজন শেফ এক অভিনব উপায়ে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করেছেন । তারা প্রত্যেকে নিজেদের বানানো বেস্ট ডিশটা মিঃ কাপুরের অনারে আজ সবার জন্য করেছেন । বুঝতেই পারছেন এলাহি খাবারের আয়োজন হয়েছে ।


দেশ বিদেশের বিখ্যাত শেফদের মধ্যে মিঃ কাপুরের নাম সহজেই চলে আসে । এই সুনাম তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের হাতের যাদুতে ও সুমধুর ব্যবহারে । কর্মজীবনের শেষ লগ্নে স্বভাবতই মিঃ কাপুরের আজ একটু বিমর্ষ থাকার কথা , এতদিনের পরিচিত কর্মস্থল থেকে চির বিদায় নিতে হবে যে । কিন্তু আজ অসম্ভব খুশি দেখলাম মিঃ কাপুরকে । আমি সংবর্ধনার পরই সুযোগ বুঝে ইন্টারভিউর জন্য মিঃ কাপুরের সামনে হাজির হয়ে যাই । ঠিক হলো সবাই একটি করে প্রশ্ন মিঃ কাপুরকে করবেন আর সেটাই হবে ইন্টারভিউ এর রসদ । ম্যানেজিং ডিরেক্টরস এর একজন প্রথম প্রশ্নটি করলেন ---’ মিঃ কাপুর আপনি এতো বছর ধরে এই হোটেলে আছেন , আমি দেখেছি আপনি ভীষণ উদ্যমী । কোনদিনই আপনার ইনার্জির ঘাটতি দেখিনি । এর রহস্য কি ?'


মিঃ কাপুর হেসে উঠলেন প্রশ্ন শুনে , তারপর ধীরে ধীরে বললেন --- ‘ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার স্ত্রীর হাতে করা এককাপ চা আমার এনার্জির মূলমন্ত্র । অদ্ভুত সুবাসিত ধুমায়িত বড় পেয়ালার এককাপ চা সকালে আমার স্ত্রী যখন হাতে তুলে দিতেন আমার প্রভাত ওই চায়ের মতোই সুবাসিত হয়ে উঠতো । কাজের মধ্যে ডুবে যাবার অদ্ভুত এনার্জি পেতাম , সেই ঘ্রাণ এখনও পাই .....'


--- ‘ মিঃ কাপুর পেতেন কেন বলছেন উনি তো এখনও বর্তমান !


--- ‘ হ্যাঁ উনি বর্তমান , কিন্তু তিন বছর যাবৎ অসুস্থতার কারণে উনি সকালে উঠতে পারেননা , তাই এখন আমিই চা করি । আমি এতো বছর চীফ শেফ হিসাবে কাজ করে এসেছি কিন্তু আমার স্ত্রীর মতন চা আজও বানাতে পারলাম না । কিন্তু আমার স্ত্রী বলেন অবিকল ওনার তৈরী চায়ের স্বাদ হয় আমার তৈরী চায়ে । পরে নিরীক্ষণ করেছি – আসলে স্ত্রীর বানানো চায়ে ওনার স্বামীর প্রতি ভরপুর ভালবাসা থাকতো যেটা আমার তৈরী চায়ে অমিল । আমিও আমার বেস্টটাই দিতাম , তাতে আমার চা পাতা দুধ চিনির মেজারমেন্টের প্রতি বেশি মনোনিবেশ করতে গিয়ে ভালবাসার ফ্লেবারটা কিঞ্চিৎ কম পড়ে যেত আমার মনে হয় ।'


মিঃ কাপুরের কথা শুনে সবাই প্রায় হেসে ফেললেন । একজন জুনিয়র শেফ জিজ্ঞাসা করলেন --- ‘ স্যার ,আপনাদের কি প্রেমের বিবাহ ?'


---’ আমাদের বিয়ের একদিন আগেও আমি লিয়েনাকে চিনতাম না । বিয়ের পরেরদিন সকালবেলা লিয়েনা আমার হাতে বড় পেয়ালার এককাপ চা তুলে দেয় । সেই চায়ের সুবাস আর স্বাদ ছিল অতুলনীয় । প্রথম চুমুকে আমি লিয়েনার প্রেমে পড়ে যাই । চা পান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমি ইন্টারভিউ দিতে যাই , কারণ তখন আমি ইতালি থেকে সদ্য আগত , কোন চাকরী ছিলনা । সেই দিনের ইন্টারভিউতে আমি অ্যাসিস্টেন্ট শেফ হিসাবে সিলেক্ট হই । তারপর থেকে আমাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি । ‘



সিনিয়র শেফ মিঃ আকাশ আগরওয়াল প্রশ্ন করলেন -- আপনার আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্যের মূলমন্ত্র কি ?


প্রশ্ন শুনে মিঃ কাপুর স্মিত হেসে বললেন --- ' আপনাদের একটা ছোট্ট গল্প বলি । লিয়েনার একটা অদ্ভুত গুণ ছিল সময়কে ভাল বুঝতে পারতো । কখনও কোন অবস্থাতে হতাশ হতো না । প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিল । বহু বছর আগের কথা আমার বড় মেয়ে টিউলিপ তখন কেজিতে পড়তো । ওর অ্যানুয়াল পেরেণ্ট মিটিং জন্য প্রিন্সিপাল ওর হাতে কল লেটার দিয়ে পাঠিয়েছেন । মেয়ের স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সে কি কান্না ! তার একটাই প্রশ্ন টুয়েলভ নুন - এ পাপা তো বাড়িতেই থাকেনা , পাপা কিভাবে পেরেণ্ট টিচার্স মিটিং আসবে ? লিয়েনা মেয়েকে অনেক করে বোঝায় ঠিক পাপা আসবেই । রাত্রে যখন আমি বাড়ি ফিরি তখন আমি ভীষণই ক্লান্ত ছিলাম । লিয়েনা এককাপ চা করে এনে আমার হাতে দিয়ে বললো -- খেয়ে নাও ক্লান্তি দূর হবে , আমি দশ মিনিট বাদে তোমায় ডিনার দিচ্ছি । সত্যি ঐ লিকার চা পান করার পর আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যায় । তারপর লিয়েনা আমার কাছে পেরেণ্ট টিচার্স মিটিং -এর কথাটা তোলে । আমি শোনামাত্র ই নাকচ করে দিলাম । পরের দিনই রাশিয়া থেকে  ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর আমার হোটেলে অতিথি হয়ে আসছেন । সমস্ত প্রেজেন্টেশন আমাকেই দেখতে হবে । লিয়েনা তখন কিছু্ বললো না ।

ডিনারে বসে বললো -- নীলেশ , আমি জানি কর্মক্ষেত্রে তুমি অত্যন্ত দায়িত্বশীল শেফ । কিন্তু তুমি কাল যদি পেরেণ্ট টিচার্স মিটিং না যাও তোমার মেয়ে ইন্সিকিওর ফিল করবে । ও এখন অবুঝ শিশু তোমার অনুপস্থিতি ছোট্ট মেয়েটার মনে দাগ কেটে যাবে , কষ্ট পাবে । আর আমি যতদূর জানি ভাইরাল ফিভার হলে তোমাদের কিচেনে ঢুকতে দেয় না । তুমি কি একদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না ? ভবিষ্যতে টিউলিপ যখন বড় হয়ে বুঝতে শিখবে তখন আর তোমায় ছুটি ম্যানেজ করতে হবে না । '



পরেরদিন বিনা নোটিসে আমার ভাইরাল ফিভার হয়ে গেল । টিউলিপ ভীষণ খুশী , সারাটা স্কুল আমাকে আঁকড়ে থাকলো । হাতই ছাড়ে না । অত বাচ্চার মধ্যে গিয়ে আমারও ভীষণই ভাল লেগেছিল । স্কুল থেকে বেরিয়ে আমি ঘড়ি দেখি , দুপুর তিনটে বাজে তখন । লিয়েনা আমাকে বললো --' তুমি একবার হোটেল ম্যানেজারকে ফোন করে বলো তুমি এখন সুস্থ আছো । '


আমি লিয়েনার কথা মতো হোটেলের ম্যানেজারকে বুথ থেকে ফোন করি -- ' স্যার আমি এখন বেটার ফিল করছি , আমি কি হোটেলে চলে আসবো ? আমার ফোন পেয়েই ম্যানেজারের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন এবং আমাকে ডেকে নিলেন । কারণ রাশিয়ান অতিথি বিকালে আসার কথা ছিল । এরপর আমি পরপর দুবছর পেরেণ্ট টিচার্স মিটিং এ গিয়েছিলাম । তৃতীয় বছর পেরেণ্ট টিচার্স মিটিংএর সময় আমি জাপানে ছিলাম , ওখান থেকেই আমি টিউলিপকে ফোন করে সরি বলি । তার উত্তরে আমার ক্লাস টু তে পড়া মেয়ে বলে -- ' পাপা ডোন্ট ওরি , আই উইল ম্যানেজ , প্লীজ টেক কেয়ার । ' ....বুঝতে পারলাম আমার টিউলিপ বড় হয়ে গেছে । ধৈর্য আর সময়ের পাঠ আমায় লিয়েনা শিখিয়ে ছিল । ওর সবরকম সাপোর্টে আমি ভীষণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি । আর হ্যাঁ হোটেল থেকে ফিরলেই আমি ঐ লিকার চায়ের ঘ্রাণে নিজের ক্লান্তি মেটাতাম সব সময়ই । '


মিঃ কাপুরের কথা শেষ হতেই এরপরই আমি প্রশ্ন করি --- ‘ স্যার সাধারন তো চাকরী জীবনের শেষদিন সবাই একটু সেন্টিমেন্ট হয়ে যায় । পুরোনো কলিগ পুরোনো কর্মক্ষেত্র ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগে কিন্তু আজ আপনাকে বেজায় আনন্দিত মনে হচ্ছে , এর কি বিশেষ কোন কারণ আছে ?'


--- ‘ অভিজ্ঞ চোখ আপনার , ঠিক ধরেছেন । সব কাজ স্থগিত রেখে আজ থেকে আমার চব্বিশ ঘন্টা আমি লিয়েনাকে দিতে চাই । গত তিনবছর যাবৎ লিয়েনা লিভার ক্যান্সারে ভুগছে । চারদিন আগে ডাক্তার জানিয়েছেন লিয়েনার লাস্ট স্টেজ চলছে বড়জোর তিনমাস বাঁচবে । এতোগুলো বছর লিয়েনা আমাকে ও আমার পরিবারকে ভরিয়ে রেখেছিল ।  কিন্তু যাবার আগে আমার সবটুকুতে লিয়েনা যেন তৃপ্তি পায় , ঈশ্বরের কাছে এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা । লিয়েনার শেষ যাত্রায় আমি ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওর হাতে হাত রেখে অতীতের অপূর্ণতা গুলিকে মুছে দিতে চাই । সেই কারণে আমি আজ বেজায় খুশি লিয়েনার পাশে থাকতে পারবো বলে ।



আজ আপনাদের সাথে সময়টা কাটাতে আমার বেশ ভাল লেগেছে । হাতে আর সময় নেই এবার আমাকে অনুমতি দিন আমি আসি ।’......মিঃ নীলেশ কাপুর নমস্কার জানিয়ে প্রস্থান করলেন । আজ তিনি তাজ প্রিমিয়ামের ঘেরাটোপের বাইরের মুক্ত বিহঙ্গ , চায়ের ঘ্রাণের সুবাসে প্রথম প্রেম দিয়েছে যে হাতছানি ।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy