Subhra Roy

Children Stories Classics Children

3  

Subhra Roy

Children Stories Classics Children

কিশলয়

কিশলয়

6 mins
318



---‘ মা দুতো ট্যাকা দ্যাও  না ’ ....ছয় সাত বছরের একটি বাচ্চা ছেলে বর্নালীর কাছে হাত পেতে দাঁড়ায় । ছেলেটির ধুলায় মলিন গা , পরনে নোংরা ছেঁড়া বড়দের হাফ প্যান্ট হাঁটুর তলা অবধি ঝুলছে , কোমরে দড়ি বাঁধা । ওর সাথেই ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি ছেলে ওর থেকে একটু লম্বা আর একটি বাচ্চা মেয়ে , তার গায়ে এক চিলতে ছেঁড়া কাপড় । 

 ---'সাত সকলেই ভিক্ষা করতে শুরু করে দিয়েছিস ? ’

--’ ভিক্ষা করবু লাই তো খাবো কি ? তুমার বাসাতে খাবার আইছে । তুমো গিয়া খাই লিবে । ম খাবো কি ? দুতো ট্যাকা দ্যাও টিফিল খাবো । ‘ 

----’ দুটাকাতে কি টিফিন খাবি তুই ? দু টাকাতে আবার কিছু পাওয়া যায় নাকি ? ’  

---’ ক্যানে চা পাউওতি খাবো । ’

---’এই এক ফোঁটা ছেলেকে মা বাবা খাওয়াতে পারে না । ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছে ....

---’ মা ফা কেউ লাই , ফালতু জিগাইছে । ট্যাকা দিবার লাম লাই । চ চ ....বাচ্চাছেলেটি ওর সাথে থাকা ছোট মেয়েটি ও আর একটু বড় ছেলেটার হাত ধরে টেনে সামনে অগ্রসর হয় । 

--- ‘ এই শোন আমারও খিদে পেয়েছে । আমিও তোদের সাথে খাবো । যাবি আমার সাথে খেতে । ‘ 

--- ‘ বাচ্চা তিনটে দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁ করে বর্নালীর মুখ দেখছে । তারপর একে অপরের মুখ চাওয়া চাই করে জবাব দেয় ---‘ তুমও খাবে ? তুমও বড় বাসার বৌ ! আমরা বিকিরি । ‘ 


--- ‘ তাতে কি হয়েছে খিদে তো একই । চল হাতে টাকা দেবো না , তোদের আমি খাইয়ে দেবো । ’

বর্ণালী দুপা হেঁটে স্টেশান সংলগ্ন চায়ের দোকানে অর্ডার দেয় ডিম টোস্ট পাউরুটি চা । স্টেশানের চায়ের দোকানে দুটাকার বিনিময়ে দুতিনদিনের পুরোনো বাসি দুপিস পাউরুটি সহযোগে একহাতা চা এদের জন্য বরাদ্দ থাকে । তাই যখন বর্ণালী ডিম টোস্ট পাউরুটি আর গ্লাস ভর্তি চা অর্ডার দিলো তখন চাওয়ালা বলেই ফেললেন – ‘ দিদি এদের এতো মাথায় তুলবেন না । আপনিতো খাইয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠে চলে যাবেন । এরা অন্য যাত্রীদের বিরক্ত করে মারবে । এদের পেট কিছুতেই ভরে না । ‘ 


ছোটো বাচ্চাটা শুনতে পেয়েই পাউরুটি মুখে পোরা অবস্থায় ঝেঁঝিয়ে ওঠে --- ‘ ক্যানে ফালতু বকিস ? ট্যাকা পাবি তুই । ‘ 


--- ‘ ওই ঝগড়া করিস না চুপ করে খেয়ে নে । ‘--- মৃদু ধমকে ওঠে বর্ণালী ।  ...গতকাল সকালে জল খাবারের টেবিলে বর্ণালী দেবপমের সাথে অশান্তি করে নিজের ঘরে দরজায় খিল দিয়েছিল । তারপর সারাদিন বাড়ির কোন সদস্য বর্ণালীকে খাবার কথা বলেনি । সেই থেকে এখনও অবধি সে অভুক্ত ছিল । আজ ভোরে হাতে পার্স নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে । পার্সে কত টাকা আছে আসার আগে খুলেও দ্যাখেনি । এখন কাটোয়া স্টেশানে বর্ধমান লোকালের অপেক্ষায় । বাচ্চা তিনটিকে দেখে বড়ই মায়া হলো বর্নালীর । শুধুমাত্র একটি সন্তানের অভাবে আজ তাকে ঘর পরিবার ছাড়তে হলো । দেবপমকে বর্ধমান ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন বাবা মার অমতে বিয়ে করেছিল বর্ণালী । দেবপমের পরিবারের সংকীর্ণ মানষিকতা ও শুচিবাইগ্রস্ত জীবন যাপন দেখে সমরবাবু অনেক আগেই বর্ণালীকে বলে দিয়েছিলেন এই বাড়িতে কোনদিনই বর্ণালী শান্তি খুঁজে পাবে না । তারপর বাচ্চা না হওয়াকে কেন্দ্র করে দেবপম ও বর্নালীর ভিতর প্রতিনিয়ত অশান্তি লেগেই থাকতো । শুচিতাবাই গ্রস্ত শ্বশুর শ্বাশুড়ী বর্নালীর উদার ও সংষ্কারমুক্ত মানষিকতাকে কখনোই মেনে নেননি । বর্ণালী বাচ্চা দত্তক নেবার কথা ওঠাতে অশান্তি আরো চরমে ওঠে । বাড়ি থেকে বিধান দেওয়া হয় বর্ণালী যেন তাদের গুরুদেবের আশ্রমে মাস খানেক গিয়ে থাকে । বর্ণালী মেনে নিতে পারেনি এই কদর্য বিধান । তাই নিয়ে দেবপমের  সাথে ঘোর অশান্তি শুরু হয়েছিল কাল সকাল হতে । দেবপম অফিসে বেরোনোর আগেই বর্ণালী ঘরে খিল দেয় । আজ কাক ভোরে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে । দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আপসের জায়গা থাকে না , তখন বাড়ির চৌকাঠের বাইরে পা চলে যায় । তখন আর স্বামী পরিবার সমাজকে তোয়াক্কা করা যায় না , আর সেটাই বর্ণালী করতে বাধ্য হয়েছে আজ ।  

    চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে বর্ণালী বাচ্চা গুলির কাছে খোঁজ নিয়েছে , বাচ্চা তিনটি স্টেশানের ভবঘুরে । মা বাবার চিহ্ন নেই । মাথা গোঁজার আশ্রয় নেই খাবারের সংস্থান নেই । থাকার মধ্যে আছে শুধুই পেট ও তার খিদে । 

---’ এই শোন তোরা আমার সাথে যাবি ? চারবেলা খাবার পাবি সেখানে । যাবি ? ’

--’ কি কাম করতি হবে ? ’

---’ কাজ বলতে - - পড়াশোনা করতে হবে , গান শিখতে হবে , আর খেলাধুলা করতে হবে । করতে পারবি তো ? 

--- ‘ খেতি দিলে সব করতি পারবি । ’

---’ অ্যাঁ ! বর্ণালী হেসে ফ্যালে । চল তাহলে 


বর্ধমান যাবার লোকাল ট্রেন চলে আসায় বর্ণালী বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে । বর্ধমান স্টেশানে নেমে একটা অটো ভাড়া করে বাড়ি চলে আসে । হ্যাঁ নিজের জন্মবাড়ি । 

      বাগানের গ্রিলের গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই সমরবাবু তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে নেমে আসেন । রিটায়ার মানুষের যেন এটাই মস্ত বড় কাজ - -কে গেট খুলে ভিতরে এলো তক্ষুনি সেটা তদন্ত করা । দরজা খুলেই দ্যাখেন বর্ণালী দাঁড়িয়ে । এই সকাল দশটার সময় মেয়েকে দেখতে পাবেন দরজার দোরগোড়ায় আশা করতেই পারেননি । ---’ বনুমা তুমি ! ’ 

---’ বাবা তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে আমায় ? ’

---’ আমি তো মা তোমাকে অনেকদিনই চলে আসতে বলেছিলাম । তুমিই খালি বলে এসেছো আর একটু দেখি বাবা , সম্পর্ক ভাঙ্গতে কতক্ষণ । হয়তো পরে সব ঠিক হয়ে যাবে । এযে ঠিক হবার নয় আমি অনেক দিন আগেই বুঝে গেছিলাম মা , তুমিই খালি বুঝতে চাও নি । বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভেতরে এসো ? ’


---’ হ্যাঁ বাবা তুমিই ঠিক বলেছিলে ওখানে থাকা যায় না । কিন্তু বাবা আমি আজ একা আসিনি । আমার তিন ছেলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি । তুমি ওদের থাকতে দেবে তো ? ’

মেয়ের প্রশ্ন শুনে সমরবাবু হতবাক , মুখ থেকে বেরিয়ে আসে --- ‘ মানে ? ’


বর্ণালী সরে দাঁড়ায় তার পিছনে দাঁড়ানো  তিনটি বাচ্চা আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে । ধূলো মাখা প্রায় অনাবৃত শীর্ণ দেহের তিনটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে । সমরবাবু ওদের দেখে আরো হতবাক হয়ে যান । বাচ্চা তিনটি সমর বাবুর পায়ে হাত দিয়ে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করে নেয় । অটোতে আসার সময় বর্ণালী ওদের পাখী পড়ানোর মতো করে শিখিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিলো -- কি ভাবে দাদুকে প্রণাম করতে হবে ।  

----’ বাবা , দ্যাখো এদের চোখ গুলো কি নিস্পাপ ! এতোটাই নিস্পাপ যে স্নেহ হারা ভবঘুরে হয়ে ভিক্ষা করছিল । ওরা আমাকে মা বলে ডেকেছে বাবা । এই প্রথম আমি মা ডাক শুনলাম বাবা । ওদের দেখে আমি মুখ ফেরাতে পারিনি । তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি । আমি ওদের সাফ বলে দিয়েছি চারবেলা খাবার খেতে হলে মন দিয়ে পড়াশোনা খেলাধুলা আর গান শিখতে হবে । ওরা রাজী হয়ে গেছে বাবা । এদের তুমি থাকতে দেবে ? বাবা একদিন তুমিও তো মায়ের কাছে চলে যাবে । আমি তখন বড় একা হয়ে যাবো বাবা । দেবপমকে আমি একেবারের মতো ছেড়ে চলে এসেছি । আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো তুমি বলো ? আমি এদের নিয়ে আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করিনা বাবা ? ’


মেয়ের আর্তি শুনে সমরবাবুর চোখ ভিজে আসে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন --- ‘ হ্যাঁ রে মা , মা হারা সন্তানের মা হওয়া অনেক গর্বের । পথশিশুদের মধ্যে নিজের সন্তান খুঁজে পেয়েছিস এতো ঈশ্বরের আশীর্বাদ ।  আমার বনুমার সন্তানদের আমি কি অবহেলা করতে পারি ?  আয় রে দাদুভাইরা ভিতরে আয় । শীগগির তোরা স্নান সেরে ফ্যাল , চেহারার যা অবস্থা তোদের । ’


সেদিন মনের জোর নিয়ে ঘর পরিবার সব ছেড়ে চলে এসেছিল বলেই আজ বর্ণালী আবার নতুন করে পৃথিবীটাকে ভালবাসতে শুরু করেছে । মনের আনাচে কানাচে জমে থাকা ধূলো গুলো আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে নব বিথীর কল্লোলে । সারাদিনে সহস্র বার মা ডাক শুনে একবারের জন্যও অতীতের না পাওয়া অনুভূতিগুলি আর গায়ের উপর কাল নিঃশ্বাস ফ্যালে না । ভোর হতেই বর্ণালী  তার প্রিয় তানপুরাটা কোলে টেনে নিয়ে বসে । বাচ্চা গুলিকে ডাকতেও হয় না । নিজেরাই চোখ মুখ ধুয়ে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে পড়ে রেওয়াজে । সাতাশটি কচি গলা মিশে যায় বর্নালীর সুরেলা কণ্ঠের সাথে । সুরে সূর মিশে মুখরিত হয়ে ওঠে ‘ কিশলয় ‘ । হ্যাঁ বর্নালীর তার নতুন পৃথিবীর নাম দিয়েছে ‘ কিশলয় ’ । রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা কচি কাঁচাদের নির্ভর যোগ্য বাসস্থান এই ‘ কিশলয় ’ । এই কিশলয় এখন বর্নালীর গর্ব , বর্নালীর জীবন্ত স্বপ্ন । এইতো দুতিন আগে বর্নালীর মেজমাসি ফোন করে ছিলেন বর্ণালীকে । জিজ্ঞাসা করেছিলেন --- ‘ কেমন আছিস বনু তুই ? এই দুবছরে কটি সন্তানের মা হলি তুই ? ’ বর্ণালী সগর্বে উত্তর দেয় --- মাসিমুনি সাতাশটা গো । আর বলো না সারাদিন বাচ্চাদের সামলাতে আমার আর ঘড়ি দেখাও হয়না । আমি খুব ভাল আছি মাসিমুনি । একবার এসে তোমার নাতি নাতনিদের দেখে যাও গো । ’

--- ‘ হ্যাঁ রে মা যাবো । তোর কিশলয়ে গেলে আমার ত্রিভুবনের তীর্থ হয়ে যাবে । বনু তুই পেরেছিস মা ঈশ্বরের যথার্থ সেবা দিতে । ঈশ্বর সদাই তোর উপর প্রসন্ন থাকবে । মাতৃ হারা শিশুর মা হওয়া অনেক গর্বের । এতো ঈশ্বর সাধনার মূল মন্ত্র । 









Rate this content
Log in