Subhra Roy

Children Stories Inspirational Children

3  

Subhra Roy

Children Stories Inspirational Children

শঙ্কর যদি পেত

শঙ্কর যদি পেত

5 mins
315



জয়দেববাবুর নাতি বিতানের সাড়ে পাঁচ বছর বয়স । স্কুল থেকে আসার পর সারাদিন দাদাই ঠাম্মীর কাছেই থাকে । সেই কারণে সব বায়নাক্কা জয়দেববাবু আর পল্লবীদেবীকে ( জয়দেববাবুর স্ত্রী ) সামলাতে হয় । ছেলে বউমা দুজনেই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার । সেই কারণেই দুজনেই তাদের ডিউটি অনুযায়ী বাড়ীতে অনুপস্থিত ।

এই পরিস্থিতিতে বউমা সুপর্ণা কখনই শ্বশুর শাশুড়ির মতামতকে অবহেলা করেন না । কারণ বিতান ওনাদের কাছে ভালই থাকে। বিতান গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। জয়দেববাবু নাতিকে গল্প শুনিয়ে ব্যস্ত রাখেন । না হলে কখনো সোফায় উঠছে কখনো জানালার গ্রিল ধরে জানালায় উঠছে। পড়ে গিয়ে চোট পেলে ভীষণ ব্যাথা পেতে পারে ।তাই যতটা সম্ভব সাবধান হওয়া যায় ।

এই বিতানের খাওয়া নিয়ে সাংঘাতিক বায়নাক্কা। আবার জেদও আছে নিজে নিজে খাবে । খাবার সময় পল্লবীদেবী সামনেই বসে থাকেন । মাছ ভাত তরকারী সবই খেতে পারে, তবুও ফেলে ছড়িয়ে খাবে । এটা জয়দেববাবুর একদম পছন্দ নয় । রোজই বারণ করেন কিন্তু বিতান শোনেনা । এই বকাঝকা পল্লবী দেবীর একদম ভাল লাগে না । জয়দেববাবু সামান্য বেতনে তন্তুজ হস্ত শিল্পে কেরানীর চাকরী করতেন ,তাই কর্মজীবনে খুব কষ্ট করে সংসার টেনেছেন । তাই এক একটা অন্নদানা তাঁর কাছে খুবই মূল্যবান । পল্লবীদেবী ব্যাপারটা বোঝেন কিন্তু নাতিকে বকাঝকা একদম পছন্দ করেন না ।

এই বয়সে বিতান দাদাই এর কাছে রামায়ণ , মহাভারত ,চাঁদ মামার গল্প সব শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে । জিম করবেটের কাহিনীও তার শোনা হয়ে গেছে । ওর জঙ্গলের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প খুব পছন্দ , তাই দুদিন ধরে জয়দেববাবু বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের "চাঁদের পাহাড় " পড়ে শোনাছেন ।

"চাঁদের পাহাড় " শুনতে শুনতে বিতান এখন একেবারে টাঙ্গানিয়ার জঙ্গলে বিচরণ করছে , কালীপূজার সময় কেনা পিস্তলটা সব সময় ইলাস্টিকের প্যান্টের কোমরে গুঁজে রেখেছে ।

ডাইনিং এর চেয়ার গুলোকে বাঘ সিংহ , ভাল্লুক বানিয়ে দিন ভোর ঠাঁই ঠাঁই করে মারছে। আর ড্রয়িং রুমের সোফাটা তো অজ্ঞাত পরিচয়ের জানোয়ার বুনিপ ,তাই সোফাটাকে রাতের অন্ধকারে লাইট নিভিয়ে পিস্তল আর রান্না ঘরের রুটির বেলনা দিয়ে মাঝের মধ্যেই সজোরে আক্রমণ করে চলেছে ।

শঙ্কর কি খেত ? শঙ্কর কি জামা পড়তো ? সারাদিন নানা প্রশ্নে জয়দেব বাবুকে জেরবার করে তুলছে । জয়দেববাবুর তাতে কোন বিরক্ত নেই । তিনিও মজা করে করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন সকল প্রশ্নের ।

আজ যখন খাবার টেবিলে বিতান মাছের ঝোলের বাটিটা উল্টে দিল , তখন জয়দেববাবু খুব রেগে গিয়ে বকা দিয়ে বললেন------ " তুমি এই ভাবে খাবার নষ্ট করছো ? আর শঙ্কর কালিহারি মরুভূমিতে কত কষ্ট করছে , একফোঁটা জল নেই , ভাত নেই , দুধ নেই । খিদায় তেষ্টায় শঙ্কর প্রায় মরেই যাচ্ছে ,তোমার ফেলে দেওয়া ভাত ,মাছ শঙ্কর যদি পেত ,দুহাত দিয়ে খেত "।

যেমন বলা তেমন কাজ । তীর আজ সঠিক জায়গায় বিঁধেছে , লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি । বিতান থম মেরে গেল , বড় বড় চোখ করে একবার দাদাই এর দিকে একবার ঠাম্মীর দিকে তাকালো । তারপর সুরসুর করে মাছ আলু তুলে খেতে লাগলো । তাই দেখে পল্লবীদেবী থা-ক থা-ক বলতে যাবেন অমনি জয়দেববাবু ইশারায় বারন করে দিলেন ।

সেদিন থেকে বিতান আর ভাত মাছ কিছুই ফেলে খায়না । যতটা খেতে পারবে ততটাই থালায় নেয় , বাকিটা তুলে রাখে ।এমন কী স্কুলের টিফিনও পুরোটা খেয়ে নেয় । সেই কথা শুনে জয়ন্ত ও সুপর্ণা খুব খুশি । ওরা বলেন- --"বাবা আপনিই পারবেন বিতানকে মানুষের মত মানুষ করতে "।

কিছু ভালোরও খারাপ দিকও আছে । একবার বাচ্চারা মনের ভিতর যা গেঁথে নেয় , তার থেকে চট করে বেরোতে চায় না । তখন যদি আমরা কিছু বোঝাতে চাই তখন ফল বিপরীতমুখী হতে পারে ।

গতকাল রবিবার জয়ন্ত ওর কলিগ চারজন ডাক্তারকে বাড়িতে লাঞ্চে ডেকেছিলেন । তারা সবাই মিলে ড্রইংরুমে বসে গল্প করছিলেন , সুপর্ণা তাদের জল ,শরবত ,স্ন্যাক্স পরিবেশন করছিলেন। এর মধ্যে ডক্টর দীপেন বোস শরবতের গ্লাসটা নিতে গিয়ে অসাবধানে উল্টে ফেললেন । ডক্টর বোস সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন----" আমি তোমার কাজ বাড়ালাম "।

সুপর্ণা হেসে উত্তর দিলেন - " ঠিক আছে আমি পরিষ্কার করে নিচ্ছি "।

ব্যাপারটা বিতান টিভি দেখতে দেখতে লক্ষ্য করলো । এরপর যখন ডক্টর রেশমী কুণ্ডু প্লেট থেকে চিকেন পকোড়া নিতে গিয়ে একটা পাকোড়া কার্পেটে ফেলে দিলেন , তখন বিতান স্থির থাকতে না পেরে কার্টুন দেখা ফেলে রেখেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো । মিষ্টি মুখের বিতানকে দেখে সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করে বিতানের সাথে কথা বলা শুরু করে দিলেন ।

-- তোমার নাম কি ? কোন ক্লাসে পড়ো ? কি কার্টুন দেখছিলে ?............

বিতান কোন কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করলো ------" তুমি শরবতের গ্লাসটা উল্টে দিলে , জানো কালাহারিতে একটুকু জল পাওয়া যায় না , শঙ্করের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়ে ছিল , অ্যান্টি তুমি পকোড়াটা ফেলে দিলে , জানো শঙ্কর কতদিন খেতে পায়নি ? দাদাই বলেছে গরীব বেবীরা খাবার পায়না , কত কাঁদে?".....কথা গুলো বলে বিতান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো । বিতানের কথা শুনে ওনারা অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন । ডক্টর বোস আমতা আমতা করে বললেন--------" স্যরি , আর এমন ভুল হবে না ।"

ডক্টর রেশমী বললেন------" জয়ন্ত তোমার ছেলেতো খুব স্মার্ট ! "

জয়ন্ত সেই শুনে এক ধমকে ভিতরে মা বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন । বিতান দাদাই এর বিছানায় গুম মেরে বসে থাকলো । ঠাম্মী জিজ্ঞাসা করলেন ---' কি হয়েছে বিতানসোনা ? ....বিতান সব কথা ঠাম্মীকে বলে দিল । সেই কথা শুনে দাদাই ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন ------"ওরা চলে যাক ,আমি তোমার বাবাকে বকবো"।

রাতে শোয়ার সময় জয়ন্ত বিতানকে ডাকতে এলে ,জয়দেববাবু ছেলেকে বললেন---------"তোমার বিতানকে বকা উচিৎ হয়নি , তোমাকে কে বলেছে বড়রাই একমাত্র ছোটদের শিক্ষা দিতে পারে ? সময় বিশেষে আমাদেরও ছোটদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ , নাহলে ছোটদের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া এবং মানুষ করা যায় না । মানুষ হওয়ার সঠিক অর্থটা তোমাকেও বুঝতে হবে জয়ন্ত "।

পরের দিন স্কুল থেকে ফিরেই বিতান দাদাই এর কাছে দৌড়ে এলো ---' 'আচ্ছা দাদাই কে বেশী সাহসী শঙ্কর না ফেলুদা ? অনীক বলছিলো ফেলুদা বেশী সাহসী । ও ঠিক বলেছে দাদাই ? '

জয়দেববাবু বুঝতে পারলেন এবার বিতান ফেলুদাকে নিয়ে ব্যস্ত হবে । তিনি একগাল হেসে বিতানকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন ---- ' আরে শঙ্কর আর ফেলুদা দুজনেই খুব সাহসী আর বুদ্ধিমান । শঙ্কর আফ্রিকায় গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করেছিলো সেখানে হিংস্র জীবজন্তুর বাস । আর ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার ছিলো দুষ্টু লোকেদের শায়েস্তা করা নিয়ে । দুজনেই বেস্ট । তুমি কাল স্কুলে গিয়ে অনীককে বলে দিও । '

----' আচ্ছা দাদাই আমাকে আর একটা পিস্তল কিনে দিও তো । অনীক বলে পিস্তল চালানো ওর বাঁয়ে হাত কা খেল , এর মানে কি ? '

----' ফেলুদার গল্প শুনলেই জানতে পারবে ----- বাঁয়ে হাত কা খেল কি ব্যাপার ?

---- ' তাহলে আজ থেকেই ফেলুদার গল্প বলো শুনি '

----' তাহলে শঙ্কর বাদ ? '

----' তুমি তো কালকে বললে শঙ্কর স্টিমারে করে শহরে ফিরেছে । ভালো করে ভাত খেয়েছে ' ।

জয়দেব বাবু বিতানের যুক্তি শুনে হোহো করে হেসে ফেললেন ।


Rate this content
Log in