ধুঁয়াবাবা
ধুঁয়াবাবা
পীরতলার কাছে এক সন্ন্যাসী এসেছেন দিন-কয়েক আগে। লোকের মুখে মুখে তার কথা রটে গেলো গ্রামে। তিনি নাকি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। এক দেহ থেকে আরেক দেহে প্রাণ স্থানান্তর করতে পারেন।
বাজার এলাকা ছাড়িয়ে গোবিন্দপুরের দিকে যাবার পথে পড়ে পীরতলা। রাস্তা ছেড়ে একটু ভিতরের দিকে এগোলে দেখা যায় ইয়া বড়ো একটা অশত্থ গাছ। ঈশ্বরবিশ্বাসী কেউ কেউ মানত করতে আসে এখানে দিনের বেলা। কিন্তু সন্ধ্যের পর জায়গাটা পুরো অন্ধকার। তার মধ্যেই ডেরা বেঁধেছেন এক সাধু। কোথায় নাকি হিমালয়ে ছিলেন তিনি বহুকাল। অদ্ভুত কিছু মন্ত্রশক্তি অর্জন করে এখন এই গ্রামে এসে রয়েছেন। সকালবেলা খুব একটা পাওয়া যায় না তাকে। রাত দশটার পর দেখা যায় - ওই অশত্থ গাছের কাছে হোমকুন্ড জ্বেলে তিনি কীসব যাগযজ্ঞ করছেন। হোমকুন্ড থেকে গলগল করে তখন ধোঁয়া বেরোয়। তাই থেকেই লোকের মুখে মুখে নাম হয়ে গিয়েছে ধুঁয়াবাবা।
শোনা যায় জ্যান্ত বিড়ালের দেহ থেকে প্রাণ নিয়ে মরা বেড়ালকে আবার জীবিত করে দিতে পারেন ধুঁয়াবাবা। গ্রামের লোক স্বচক্ষে দেখেছে তার এই অলৌকিক কান্ড। রোজ ভীড় বাড়ছে পীরতলায়। লোকে যত শুনছে এসব কথা, ততোই ছড়িয়ে দিচ্ছে দূর-দূরান্তে। ততোই আরও তাতে রং চড়ছে।
এই গত সপ্তাহেই তো। হেডমাস্টার বৈকুণ্ঠবাবুর টিঁয়াপাখিটা মারা গিয়েছিলো। নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ধুঁয়াবাবার কাছে। বাবা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমাকে আর একটা এরকম জ্যান্ত টিঁয়া এনে দে, তোর মরা টিঁয়ার দেহে আমি আবার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবো।
শুনেই গায়ে কাঁটা দিয়েছিলো বৈকুণ্ঠবাবুর। আরেকটা টিঁয়া তিনি পাননি কোথাও। এখানে পাখি-টাখি বিক্রি হয় না। চাঁদপুরের হাটে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কে যাবে অতদূর।
সেই টিঁয়াটা এখনো ধুঁয়াবাবার কাছেই আছে। ভেবে ভেবে হেডমাস্টার রফিককে ধরলেন একদিন। রফিক শহরের দিকে যায় কাজে-টাজে। যদি একটা ভালো টিঁয়াপাখি কোনোভাবে কিনে আনতে পারে।
**************************************************
দিন দুই পরের কথা। রাতের খাওয়া শেষ করে এগারোটা নাগাদ রফিককে নিয়ে বৈকুণ্ঠবাবু চললেন পীরতলার দিকে। হাতের খাঁচায় একটা নতুন কেনা টিঁয়াপাখি। অবিকল আগেরটার মতোই দেখতে। রফিক আজই কিনে এনেছে।
অতো রাতেও অন্ধকার পীরতলা লোকে লোকারণ্য তখন। অন্ধকার অবশ্য ততো নেই। ধুঁয়াবাবার হোমকুন্ডের আগুন দাউদাউ করে উঁচু হয়ে গাছের পাতা ছুঁয়েছে। সেইসঙ্গে ধোঁয়ায় ভরে গেছে জায়গাটা। বাবা একপাশে বসে হেলেদুলে মন্ত্র পড়ছেন উচ্চৈঃস্বরে। চোখ দুটো বোজা। কালো দাড়িগোঁফের আড়ালে তার মুখ প্রায় অদৃশ্য। কিন্তু দুর্বোধ্য সেই মন্ত্রের ধ্বনি গুঞ্জিত হচ্ছে চারদিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতোই দেখছে সবাই বিস্ময়ে। বাবার ঠিক পাশেই একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে। আগুন দেখে ভয় পাচ্ছে সে, আর সরে যেতে চাইছে। কিন্তু বাঁধনটার জন্য পারছে না।
মিনিট কয়েক পরে একটু চোখ খুললেন ধুঁয়াবাবা। তারপর অকস্মাৎ ছাগলের দড়িটা হেঁচকা টানে খুলেই ছাগলটাকে ধরে ছুঁড়ে দিলেন আগুনের কুন্ডের ভিতর। সঙ্গে অদ্ভুত অশ্রুতপূর্ব সেই মন্ত্রোচ্চারণ। গলা তার সপ্তমে উঠলো। সেই আওয়াজে ছাগলের চিৎকার চাপা পড়ে গেলো।
মুহূর্তের মধ্যেই উপস্থিত জনতা সবিস্ময়ে দেখলো, অশত্থ গাছের পিছন থেকে ছুটতে ছুটতে একটা ছাগল এসে কালীচরণের কোলে আশ্রয় নিলো। এই ছাগলটাই মারা গিয়েছিলো পরশুদিন।
অদ্ভুত! অলৌকিক! লোকের মুখে আর কোনো কথা নেই এছাড়া। কালীচরণ তার ছাগল ফিরে পেয়ে সেটার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ছাগলটাও মাথা ঘষতে লাগলো মনিবের পায়ে। এই অসম্ভব কোনোদিন সম্ভব হবে, কেউ ভাবতে পেরেছিলো ?
ধুঁয়াবাবা আবার মৌন হয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন বৈকুণ্ঠবাবু। বাবার সামনে পাখির খাঁচাটা রেখে দাঁড়ালেন একটু। খানিক বাদেই ধুঁয়াবাবা চোখ খুলে দেখলেন সব। তারপর হাতের ইশারা করে দূরে সরে যেতে বললেন ওদের।
আবার শুরু হলো মন্ত্র। সেই সঙ্গে আগুনে কিছু যোগ করলেন তিনি। কালো ধোঁয়ায় ভরে গেলো চারদিক। একটু পরে তীব্র মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথেই খাঁচার দরজা খুলে টিঁয়াপাখিটা নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন আগুনের ভিতর। মুহূর্ত কয়েক। তারপরেই অশত্থের ডাল থেকে উড়ে এসে পড়লো একটা টিঁয়া। একটু যেন হতভম্ব। আগুনের দিক থেকে সরে এলো। এদিক-ওদিক দেখছে। কিন্তু পালিয়ে গেলো না। পোষা টিঁয়া যেমন হয়, ঠিক তেমনি।
**************************************************
ক্রমে অবস্থা এমন হলো যে রাত্রিবেলা পীরতলায় তিলধারণের জায়গা রইলো না। এই গ্রাম, ওই গ্রাম থেকে লোক উপছে উপছে আসছে এই অলৌকিক কান্ডকারখানা দেখতে।
গ্রামের একমাত্র ডাক্তার হরেশ মিত্র এসব কিছুই মানতে চান না। বলেন - বুজরুকি, শুধু বুজরুকি। ওই হাতসাফাই করে নতুন ছাগলকে পুরোনো ছাগল, নতুন পাখিকেই পুরোনো পাখি বলে উড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। অবলা পশুপাখি সব, কথা বলতে তো পারে না। ধোঁয়ার আড়ালে কী হচ্ছে কেউ কি দেখতে পায় ? সাধুবাবা করবেন নাকি প্রাণপ্রতিষ্ঠা! আরো কত কী শুনবো! এখানে মানুষ বোকাসোকা বলে ভেলকি দেখিয়ে করে খাচ্ছে। প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারে তো কই মরা মানুষ জ্যান্ত করে দেখাক তো দেখি ? তাহলে নয় তবু বুঝবো।
কিন্তু ডাক্তার যাই বলুক, গ্রামের সবাই দেখা গেলো ধুঁয়াবাবাকে সত্যি সত্যি দেবতাজ্ঞানে মানছে। রোজ ফলমূল প্রসাদ ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া হয় বাবার জন্য। তার যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে, তা তো প্রমাণিত।
মরা মানুষ বাঁচিয়ে তুলতে অবশ্য আজ অবদি কেউ দেখেনি। কিন্তু খুব শীঘ্রই একদিন সেই নহবৎ-ও এসে হাজির হলো।
মাঘমাস। তীব্র শীত গাঁয়েগঞ্জে। তবু সেসবকিছু উপেক্ষা করে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হচ্ছে রোজ পীরতলায় বাবার দর্শনে। দিন-দুয়েক পরের কথা। এক রাতে মরিচপাড়ার কানাইলাল ও তার ভাই এসে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লো বাবার পায়ে।
"কী হয়েছে তোদের ?"
"বাবা আমাদের বাঁচান। আমার ছেলে আজ মাত্র তিনদিনের জ্বরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। তারে শ্মশানে শুইয়ে রেখে এসেছি। ডাক্তারবদ্যি কিচ্ছু করতে পারলো না। করবে কী করে ? ওর কপালেই যে লেখা ছিলো। এখন আপনিই ভরসা। আপনি বাঁচান বাবা, বাঁচিয়ে দিন। ওইটুকুন ছেলে -"
"কত বয়স ?"
"এগারো বছর হয়েছে সবে।" বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়েই বললো কানাইলাল।
"বাঁচাতে আমি পারি, কিন্তু তার বদলে আর কাউকে যে লাগবে।"
"বাবা -"... কানাইলালের মুখে কথা সরলো না।
"আমি ভগবান তো নই। আত্মা সৃষ্টি করতে আমি পারি না। তোরা যে মোবাইলে মেসেজ পাঠাস এখান থেকে ওখানে, আমি এই দেহের আত্মা আরেক দেহে পাঠাতে পারি শুধু রে। প্রাণ তৈরী করার ক্ষমতা আমার নেই।"
উপস্থিত জনতা বিস্ফারিত চোখে দেখছে তখন।
কানাইলাল কিছু বলবে, এমন সময় ভীড়ের মধ্যে থেকে ছুটে এলো জগা পাগলা। পরনে শতছিন্ন পোশাক। মাঝবয়সী লোকটা থাকে শ্মশানের কাছে। কেউ কিছু দিলে-টিলে খায়। মাথার ঠিক নেই। লোকে জগা পাগলা বলেই ডাকে তাকে।
সে ছুটে এসে ধুঁয়াবাবার সামনে বসে পড়লো। বললো, "আমার নাম জগা। আমার জীবনের কোনো দাম নেই বাবা। আমার বদলে বরং এই বাচ্চাটার প্রাণ ফিরিয়ে দিন।"
বাকী সবাই তো বটেই, এমনকি কানাইলালও অবাক হয়ে গেলো। জগা পাগলাকে কেউ গ্রাহ্য করতো না কোনোদিন। কিন্তু জগার কথা শুনে আজ তাদের মনে হলো, জগার মাথা অতটাও খারাপ ছিলো না হয়তো।
ধুঁয়াবাবা জগাকে দেখে একটু মৃদু হাসলেন। তারপর কানাইলালকে বললেন, "জগা থাক এখানে। আর সবাইকে নিয়ে এখন চলে যা তোরা। আমাকে আজ সেই সাধনা করতে হবে যা কখনো আগে করিনি। ভয় নেই, কাল সকালে তোর ছেলেকে ফেরত পেয়ে যাবি। যা এখন সব। সোজা বাড়ি চলে যা। শুধু জগা থাকবে এখানে।"
**************************************************
পরদিন ভোরবেলা। সবে একটু একটু আলো ফুটতে শুরু করেছে পুব আকাশে। সারারাত জেগেই বসেছিলো বাড়ির সবাই। ঘুম কি আর আসে ? একদিকে ছেলে হারানোর শোক। অন্যদিকে ধুঁয়াবাবার দেওয়া আশ্বাস। জগা পাগলার আত্ম-বলিদান। সব মিলিয়ে মনের মধ্যে সবার তখন উথালপাথাল ভাবনা। তবু ভোরের দিকে যে যার মতো একটু হয়তো ঢুলে পড়েছিলো। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে প্রথম তন্দ্রা ভাঙ্গে কানাইলালের স্ত্রীর। বাইরে থেকে কেউ যেন ডাকছে, "মা - ও মা, দরজা খোলো।"
স্বামীকে ডেকে তিনি বললেন, "হ্যাঁ গো, শুনছো। কে যেন ডাকছে গো। সত্যিই কি আমাদের ছেলে এসেছে, নাকি নিশি ডাকছে ?"
তড়িঘড়ি উঠে সদর দরজা খুলেই কানাইলাল ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আনন্দে তার স্ত্রীর চোখেও তখন জল। বাপ-মায়ে মিলে ছেলেটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখছেন, সব ঠিক আছে আগের মতোই। যেন কিছুই হয়নি। এ কী অকল্পনীয় ব্যাপার! ধন্য সাধুবাবা, ধন্য তার সাধনা!
সম্বিৎ ফিরতেই গ্রামের সবাই মিলে দৌড় দিলো পীরতলার দিকে। দিনের বেলা অবশ্য ধুঁয়াবাবার দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু সেদিন রাত্রেও আর দেখা গেলো না ধুঁয়াবাবাকে। শুধু সেদিন কেন, কোনোদিনই আর সেই সাধুবাবাকে দেখা যায়নি।
আর জগা ?
জগা আছে। আগের মতোই শ্মশানে পড়ে থাকে। যা পায় তাই খায়। আর সাধুবাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতে পারে না, কীরকম যেন ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তখন চেয়ে থাকে।
~ সমাপ্ত