STORYMIRROR

Barun Biswas

Classics

3  

Barun Biswas

Classics

ধোঁয়াটে জীবন

ধোঁয়াটে জীবন

5 mins
267

গ্রামে কাজের বড় আকাল। নিজের জমি থাকলে যদিওবা চাষবাস করা যায় কিন্তু না থাকলে তার অবস্থা খারাপ। ফটিক মাহাতোর অবস্থা তাই। বাপ ঠাকুরদা তার জন্য তেমন কিছু রেখে যায়নি। গ্রামের এক কোণে ছোট একটু জমি। সেখানে একটা কুঁড়েঘর। তাতেই বউ ছেলেমেয়ে আর বুড়ি মাকে নিয়ে থাকে। লোকের জমিতে কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে চলে। তবে গ্রামে কাজের লোকের অভাব নেই। যা কাজ তার চেয়ে লোক বেশি। আর তাই অনেককেই বসে থাকতে হয়।

এভাবে বসে থাকলে তো আর সংসার চলবে না। তাই গ্রামের কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা শহরে গিয়ে কাজ করবে। একথা বাড়িতে জানাতেই ফটিক মাহাতোর বাড়ির লোকজন কান্নাকাটি লাগিয়ে দিল। গাঁয়ের ছেলে শহরে গেলে আর ফিরবে না এরকম একটা ধারণা তাদের সবার মনে ছিল। তাই ফটিককে তারা যেতেই দেবেনা। বাকিদের অবস্থাও একই। কোনরকম বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাদের রাজি করানো হল।

বোঝানোটা সহজ হলো কেননা তাদের হাতে কোনো কাজ ছিল না। কাজ না পেলে পরিবারের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে সেটা তাদেরকে বোঝানো গেল।

অবশেষে তারা গোছগাছ করে শহরে যাবার জন্য তৈরি হলো। সঙ্গে পরার মতো দু একটা জামা কাপড় ছাড়া আর নেবার মতো কিছু নেই। একদিন ভোর বেলা তারা চার-পাঁচজন রওনা দিল শহরের দিকে। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন ভালো না। অনেকখানি পথ হেঁটে গিয়ে তবেই বাস পাওয়া যাবে। সেই বাসে করে শহরে পৌঁছানো যাবে।

পয়সা কড়ি ওদের হাতে বেশি নেই। দু একজনের কাছে যা জমানো পয়সা ছিল সেটাই সম্বল। শহরে পৌঁছে দু'চারদিন চালানো গেলেই হবে। তারপর একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। ওখানে কাজের অভাব নেই বলেই তাদের ধারণা।

বাস এসে দাঁড়াতেই ওরা উঠে পড়ল সবাই। বাস রাস্তার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। বাসের ভেতর ফটিকরাও অপেক্ষা করছিল কখন পৌঁছাবে শহরে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল পথ পার হয়ে যাচ্ছে। এবার বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলো বাস। সবাই নেমে যার যার মতো খাওয়া-দাওয়া করে নিল। ফটিক আর তার সঙ্গীরা সঙ্গে যে শুকনো চিড়ে মুড়ি আর বাতাসা এনেছিল তাই খেয়ে নিল। পয়সা খরচ করে বাইরে কিছু খাবার মতো পরিস্থিতি তাদের নেই।

সময় হলে আবার বাস ছেড়ে দিল। তারপর একটানে শহরে পৌঁছে দিলে ওদের। শহরে ওরা নতুন এলো। কোথায় কি আছে না আছে সব অজানা। তাই লোকেদের কাছে শুনে শুনে যেতে হবে। ওরা যে ধরনের কথা বলে তাতে লোকেরা শুনে অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ করে কাজের সন্ধান করলে অবাক তো হবারই কথা। কেউ তো আর কাজ নিয়ে বসে নেই যে চাইলেই দিয়ে দেবে।

এভাবে বার বার ব্যর্থ হবার পর ওরা সিদ্ধান্ত নিল আগে থাকার জায়গা খুঁজতে হবে। পরে কাজের জোগাড় করতে হবে। শহরে নানা রকমের লোক থাকে। তবে সাহায্য করার মতো লোক হয়তো খুব কম সেটা ওরা বুঝতে পারল। আর বড় লোকেরা ওদের পাত্তা দেবে কেন। তাই সবজিওয়ালা ঠেলা ওয়ালাদের শরণাপন্ন হলো ওরা। কারণ গরীবকে একমাত্র গরীবই বুঝতে পারে।

শেষ পর্যন্ত থাকার মত একটা জায়গা ওরা খুঁজে পেল। এলাকাটা একেবারে ঘিঞ্জি বস্তি। তাতে কি? থাকার জায়গা হলেই হল ওদের। এরপর কাজের সন্ধান করতে হবে। ওদের ভাগ্য ভালোই। ওখানেই একজন শহরের একটা পাওয়ার প্লান্টে কাজ করে। মাস গেলে মাইনে পায়। সামান্য হলেও চলে যায়। হাই নিশ্চিত হলে মাইনে কম পেলেও কোন ব্যাপার নয়। বস্তিতে ঘুরে ঘুরে সবার কাছে সন্ধান নিয়ে লোকটার খবর পেয়েছে।

রাতে তার কাছে গিয়ে ওদের সমস্যা জানালো ফটিকরা। ওদের সমস্যা শুনে অনেকক্ষণ ভাবলো লোকটা। কাজের নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও চেষ্টা করার আশ্বাস দিল সে।

লোকটা বলল,' আমি চেষ্টা করছি। তবে যতদিন না হয় অন্য কিছু করো। এখানে সবাই কোন না কোন গ্রাম থেকে এসেছে। সবাই পেটের দায়ে কিছু না কিছু করছে। কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে। দেখি কথা বলে ম্যানেজার কি বলে।'

লোকটার কথা শুনে আশ্বস্ত হলো ফটিক। শহরের লোক সম্পর্কে যেসব কথা শুনে ছিল আগে তাতে লোকটাকে ভালোই মনে হল। এখন দেখা যাক কি হয় ভবিষ্যতে। একটা ছোট ঘরের মধ্যে ওরা ক'জন রইলো সেই রাতের মতো নতুন ভবিষ্যতের আশায়।

পরদিন সকালে ফটিকরা তৈরী হয়ে নিল লোকটার সঙ্গে যাবার জন্য। এখান থেকে অনেকটা পথ নাকি যেতে হবে তাও আবার হেঁটে। কারণ এসব পাওয়ার প্লান্ট জনবসতি থেকে দূরে তৈরী হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর ওরা দেখল যে পথ এসেছে তার চেয়ে বেশী পথ ওদের হাঁটা অভ্যাস আছে গাঁয়ে।

ওরা অবাক হয়ে গেল এতো বিশাল প্লান্ট দেখে।গ্রামে থেকে ওরা যা আন্দাজ করেছিল তার থেকে বিরাট কারখানা দেখে একেবারে তাজ্জব হয়ে গেছে। ওরা রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষা করছিল। সেরকমই ওদের বলে গেছে লোকটা। অনেকক্ষণ পর সে ফিরে এলো হাসি মুখ নিয়ে। আর তাদের জন্য নিয়ে এলো খুশির খবর। ওদের এখানে কাজ হয়ে গেছে।

এতো সহজে কাজ হত না ওদের যদিনা কয়েকজন এখানে দীর্ঘদিন কাজ করার পর অসুস্থ হয়ে কাজ না ছেডে দিত। তাই কর্মী সংকট হওয়ায় চটজলদি ওদের কাজে নিয়েছে মালিকপক্ষ। সেটা ওদের অজানাই রইলো। তবে ফটিকদের আনন্দের সীমা নেই শহরে কাজ পেয়ে। এবার সুখের মুখ দেখতে চলেছে ওরা সবাই।

এভাবে বেশ চলছিল ফটিকদের। মাস গেলে হাতে বেতন পেয়ে যাচ্ছে সবাই। তাতে নিজেদের চলে যায় আর গ্রামে পরিবারের কাছে টাকা পাঠায় মানি অর্ডারে। তারাও বেশ রয়েছে। যে ভয় ওরা প্রথমে পেয়েছিল এখন সেটা কেটে গেছে।

কিন্তু একদিন সব এলোমেলো হতে শুরু করে দিল। সকালে কাজে গিয়ে দেখে কারখানার সামনে লোকভর্তি। তারা সব কি নিয়ে চিৎকার চেঁচামাচি করছে। কাছে গিয়ে জানতে পারল ওরা প্লান্ট বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করছে। এটা নাকি পরিবেশ দূষণ করছে। মানুষকে অসুস্থ করে ফেলছে। কাউকে ডুকতে দিচ্ছে না ভিতরে।

যে বড় চিমনি দিয়ে রোজ সকাল হতেই গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে আজ সে আর ধোঁয়া উদগীরণ করছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা ফিরে গেল ওদের থাকার জায়গায়। এভাবে চললে কিছুদিন। ওরা কাজে যায় আবার ফিরে আসে। সরকার থেকে প্লান্ট বন্ধ করার আদেশ দিয়েছে। পরিবেশের ক্ষতি করছে বলে পরিবেশবিদরা আন্দোলন করায় তাকে বন্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগে তো পরিবেশ বাঁচুক তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে।

ফটিকরায় প্লান্ট এর সামনে গিয়ে আজকে জানতে পারলেই ঘটনা। ওদের মতো সকলেই আজ থেকে কাজ হারালো। কি ওদের ভবিষ্যৎ ওরা জানেনা। প্লান্টের বড় বড় কাঠামো গুলো সব দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের জায়গায়। বড় বড় চিমনি দিয়ে আর ধোঁয়া বের হচ্ছে না।

শেষ ধোঁয়ার পাক হারিয়ে গেছে কবে। সেই ধোঁয়ার সঙ্গে নিয়ে গেছে ওদের জীবনের ভবিষ্যৎ। সত্যি মানুষের জীবনের স্রোত ধোঁয়াটে। কখন তৈরি হয় কখন হারিয়ে যায় এক মুহূর্তে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics