ধাপ্পা
ধাপ্পা
লাল লাল ডিমের ঝোল মাখা ভাতের দলাটা মুখে ভরে তুলির গোলাপি ঠোঁট রক্তমাখা হয়ে গেল। মা ত্রস্ত হাতে জলের গেলাস মুখে ধরতেই তুলির আত্মবিশ্বাসী উত্তর, "ঝাল খেলে তো বড়ো হয়ে যায় তাড়াতাড়ি, আমিও...!"
ওদিকে পিছন দরজায় টুম্পা দিদি সিগনাল দিচ্ছে, আজ দুপুরে পিউদের বাগানে বেগুন টবগা, আম ছেঁচা আর তেঁতুলের আচারের ফিস্টি, মিস টি যেন না হয়!
কিকরে ওদের বোঝাবে তুলি, মা না ঘুমোলে সে যায় কি করে? অনেক্ষন চোখ বুজে মটকা মেরে শুয়ে আছে তুলি, মা নিশ্চয়ই এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে? একচোখ আলতো খুলে দেখে নেয় তুলি, তারপর পা টিপে আস্তে করে দরজা খুলতেই, ...ধাঁ.... !
কচি বেগুনের খোলার মধ্যেই শাঁস চেঁছে বিটনুন, কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল, অল্প চিনি... উমমম! যা লাগছে! চকাস চকাস খাচ্ছে টুম্পা, বিট্টু, গোপা, মনি, হদু।
তুলির নজর তেঁতুলে, কিন্তু কাঁচা তেঁতুল খেলে নাকি পেটে ব্যথা হয়, মা বলেছে।
মনি বলে, '' খা না, কিচ্ছু হবেনা, মায়ের ওরকম ভয় দেখায়। কাকিমা জানলে তবেই না!"
আর মা যদি জানতে পারে! কি জানি মায়েরা যেন কিভাবে সব লুকানো কথাগুলো জেনে যায়!
জানলে জানবে, নাহয় চারটে গাট্টা বেশি পড়বে, হোক, কিন্তু ওই টক টক তেঁতুল, "ওই আমায় একটু..."
...আলতা বাটি পানের পাটি পা ধুইয়ে দে, জল নিবি না আড়া নিবি, তা বলে দে....
গোপা চোর.. হে হে..
- ওই না, দেখ, আমি আড়া য় আছি, তুই জল নিবি বলেছিস!
- যা আমি খেলবোনা, সব সময় চোরটামি।
- হ্যা হ্যা, চল চল, ও খালি আব্বুলিশ করে, চল...
...এলাডিং বেলাডিং সইলো, কিসের খবর রইলো, রাজা মশাই বলে গেছেন... একটি বালিকা চায় লো..
কোন বালিকা চাইলো...
- ওই আমাকে খেলতে নিবি?
- আর ধাপ্পা করবি?
- না, মাইরি, মাকালীর দিব্বি!
- ওই গোপা আমাদের দলে...
...কোন বালিকা চাইলো... গোপা বালিকা চাইলো... কিসে করে যাবে... ট্যাক্সি করে যাবে... কই তোমাদের ট্যাক্সি ...ওই তো...
... ওই তো, এইখানে তুই, সারাদুপুর পাড়া বেড়িয়ে, এখন এলাডিং বেলাডিং... চল ঘরে চল... ইস! হাতে পায়ের কি অবস্থা! এক্ষুনি স্যার চলে আসবেন!
চুলের মুঠিখানা বেশ করে বাগিয়ে ধরে তুলির মা তুলিকে নিয়ে ঘরে ঢোকে।
বারো দুই এ চব্বিশ
বারো তিন এ ছত্রিশ
বারো চার এ আট... আট..
চোখদুটো আলগা জুড়িয়ে আসতেই ... স্যাপাক!
তালপাতার পাখার হাতল ততক্ষনে তুলির থাই এ, সামনে যমদ্যুত মাস্টারমশাই!
এ এর জায়গায় বি বসলেই পাখার বাড়ি!
অথচ অন্দর থেকে আসা চা টা, চপ টা, মিষ্টি টা দিব্বি গেলে তুলির সামনেই!
ইচ্ছে করে... ইচ্ছে করে... আস্ত একটা আরশোলা ছেড়ে দেয় জামার ভিতর!
আজ তুলিদের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান, ছোটখাটো জলসা হয়ে ছুটি থাকবে দিন দশেকের।
মায়ের লিখে দেওয়া 'লুকোচুরি' কবিতাটা তুলি দেখে নিচ্ছে বারবার। এইবার তার নাম ডাকবে, সামনে কত লোক, তুলি পারবে তো?
- তিলোত্তমা বসু....
মাটি থেকে স্টেজে ওঠার জন্য একটা তক্তার সেতু, উঠতে গিয়ে তুলি হড়কে গেল, ভয়ে!
ঠোঁটের কাছ অব্দি লম্বা মাইক্রোফোনটা, তুলির গলাটা শুকিয়ে এলো। এবার বলবে ? শুরু করবে?
- নমস্কার!
একি! কথাটা অতো দূরে শোনা গেল!
" আমি যদি দুস্টুমি করে...
... দুপুরবেলা মহাভা ভা ভা...রত হাতে
বসবে তুমি......!"
যাহ! গলাটা শুকিয়ে গেল যে!
ঢোক গিলে "... আমি বলবো, ' বলবো না সে কথা।'
নমস্কার!"
হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো তুলি।
বড় বড় চোখে মা তাকিয়ে আছে।
মাথায় একটা চাঁটি, "এতবার করে পড়ালাম, লেখালাম, সেই ভুলে গেলি, থেমে গেলি?
কিস্যু হবেনা তোর! কিস্যু হবে না!"
চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসতে চাইছে তুলির।
ছোটমামা সঙ্গে এসেছিল, এবার বাড়ি ফিরবে।
তুলিও চলে যাবে মামারবাড়ি। এখানে তাকে কেউ ভালোবাসেনা, কেউ না! মামারবাড়ির বাগানে সবেদা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে কঞ্চি দিয়ে রাস্তায় মিছিমিছি মাছ ধরছে তুলি।
ওটা কে? বাপি আসছে না?
তুলি দৌড়ে গেল।
বাপি দুই হাতে তুলিকে কোলে তুলে বললো, "তুই কবিতা বলে থার্ড হয়েছিস, তোকে "আবোলতাবোল" বই দিয়েছে প্রাইজে!"
"কি মজা আমি থার্ড হয়েছি? কিন্তু ওরা আবোলতাবোল বই দিলো কেন, ভালো বই দিতে পারলোনা?"
লাল মোড়ক খুলতেই বেরিয়ে এলো বোম্বাগড়ের রাজার ছবি, এই তাহলে "আবোলতাবোল", বই?
এতে এত কবিতা?
বাপির ব্যাগ থেকে বেরোলো আরও একটা, "টুনটুনির বই", এটা দাদুর উপহার, বাপির হাতে পাঠিয়েছেন, নাতনির সফলতার উপহার।
বই দুটোকে বুকে জড়িয়ে ঘুমোয় তুলি।
বেশ কয়েকদিন কাছছাড়া করেনি বই দুটোকে।
বেশ কয়েকটা কবিতা, গল্পও গড়গড় বলে যেতে পারে না আটকেই। ছুটির দিন শেষ।এবার বাড়ি ফিরতে হবে তুলিকে। আবার সেই স্কুল, মায়ের বকুনি, স্যারের মার।
মুখ ঝুলে যায় তুলির। গুছিয়ে রাখা ফ্রকের উপর মিটিমিটি হাসছেন সুকুমার রায়।
ওদিকে বাড়ির উঠোনে ডাকছে টুম্পা, বিট্টু, গোপা, মনি, টোটন, হদু...লুকোচুরি... আর... ধাপ্পা!!
*************************
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের ওড়না কুঁচি দিয়ে পরে মাথায় ঘোমটা দেয় তুলি, নাহ! ঠিক মায়ের মত লাগছে না, মা তো কপালে টিপ পরে, লাল টিপ, মস্ত বড় লাল টিপ।
আয়নার ফ্রেমে লাগানো রয়েছে কয়েকটা, তুলি একটা তুলে নেয়, কপালে পরে, নাহ! এখনো ঠিক মার মত লাগছে না।
মা তো মাথাতেও লাল টিপ দেয়, লম্বা করে, তুলি ড্রেসিং টেবিল থেকে মার লিপস্টিক উঠিয়ে দেয়, সিঁথির সামনে ঘষে, হ্যা, এবার এক্কেবারে মায়ের মত লাগছে।
তুলি দৌড়ে যায় মার কাছে, মাকে দেখাতে হবে না!
পাশের বাড়ির উত্তমকাকু। তুলিদের বাড়ি প্রায়ই আসে, বাবার সঙ্গে টিভিতে খেলা দেখে, মার সাথে গল্প করে, দাদুর সাথে দাবা খেলে, ঠাম্মির জন্য পান এনে দেয়... তবে উত্তমকাকুকে ঠিক ভালো লাগেনা তুলির।
শাড়ি টিপ পরা তুলিকে দেখেই কোলে তুলে নিলো উত্তম কাকু। গাল টিপে দিয়ে বললো, "বৌদি, এবার তো জামাই দেখতে হয় গো! তুলি সোনা বড় হয়ে গেল যে!", বলেই তুলির বুকের কাছে চাপ দেয় উত্তমকাকু।
তুলির মগজে টোকা , কালই তো স্কুলে গুড টাচ, ব্যাড টাচ শিখিয়েছে।
টিচার বলেছিল, চেস্ট হচ্ছে সিক্রেট সাইড, উত্তম কাকু ওখানেই টাচ করলো, তারমানে এটা ব্যাড টাচ।
তুলি প্রমাদ গোনে, উত্তম তুলির নিতম্ব চেপে ধরতে তুলি চিৎকার করে, "তুমি আমার রঙ প্লেসে হাত দিচ্ছ কেন?"
সঙ্গে সঙ্গে তুলিকে নামিয়ে উত্তম দৌড় লাগায় দরজার দিকে।
মা বাবা দৌড়ে এসেছে তুলির কাছে।
তুলি বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, "উত্তম কাকু পচা, বারবার আমার সিক্রেট পার্টসে হাত দেয়, তুমি ওকে আর বাড়িতে আসতে দেবে না বাবা!"
মায়ের চোখে ভয়ের ছায়া। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, "হ্যা গো, ঘরের মধ্যেই এই, মেয়েটা কি আর বাইরেও বেরোতে পারবে না?"
তুলি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, "কেন পারবো না মা, টিচার বলেছে, রঙ কিছু হলেই শাউট করতে, আর বাবা বলেছে আমায় ক্যারাটে ক্লাসে নিয়ে যাবে, তাই না বাবা? আমিও সুপার লেডি হবো, কেউ রঙ কিছু করলে সবাইকে ঢিসুম ঢিসুম...!"