Sayantani Palmal

Classics

4.9  

Sayantani Palmal

Classics

উপহার

উপহার

9 mins
920


  ভ্রূ কুঁচকে ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল চোখ দুটো দিয়ে ঐ দূরের পথ পানে চেয়ে আছে ঘুটকু। অপেক্ষায় আছে সে কখন ওই পথখানা যেখানে আকাশের হাত ধরেছে সেইখানে তার মায়ের লাল সাইকেলের ঝলকটুকু দেখা যাবে। 

" অ ঘুটকু, ঘরে আয় না দাদু।" খুনখুনে গলায় ঠাকুমা ডাক দিলেন ঘুটকুকে।

" দাঁড়াও না মা আসছে নাকি দেখছি।" 

" মা, তো ঘরেই আসবে নাকি? তুই দাঁড়িয়ে থাকলেও আসবে না থাকলেও আসবে বরং এই চাঁদিফাটা রোদ্দুরে তুই বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস দেখলে বকবে। ঘরে আয় বলছি।" ঠাকুমার ধমক খেয়ে ঘরে ঢুকে যায় ঘুটকু। চুপচাপ গিয়ে দাদুর পাশে বসে। ঘুটকুর দাদু আজকাল প্রায় কথাই বলেন না। মাঝে মাঝে বাইরের দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন আর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন। নয় বছরের ঘুটকু বুঝতে উঠতে পারে না দাদু কি বলে। আজকে ঘুটকুর মায়ের অনেক দেরি হচ্ছে। ঘুটকুকে বকলেও ঠাকুমার নিজের মনটাও অস্থির হয়ে উঠছে। ঘুটকু দাদুর পাশে শুয়েই পড়েছে। ওর কষ্টটা বুঝতে পারেন ঠাকুমা। ছোট ছেলে কতক্ষন খিদে সহ্য করে থাকবে কিন্তু ওর মা না এলে রান্না হবে কি করে? নাহ, ঠাকুমা একেবারে অচল হয়ে যান নি, ঘরে দুদিনের মত চালও আছে তবুও রান্না করা সম্ভব নয় কারণ জল। ঘুটকুদের এই তালকুন্ডা গ্রামে সবচেয়ে দুর্মূল্য বস্তু হলো জল। ঘুটকুদের গ্রামে বৃষ্টি নামে না, নদীতে বান ডাকে না। গ্রামের পাশের তোয়া নদী একটা মরা সাপের মত শুয়ে আছে। তাতে একবিন্দু জল নেই। তোয়া নদীর খাতের ফুটিফাটা শরীরটা দেখলে ঘুটকুর অজগর সাপের কথা মনে হয়। আসলে ঘুটকুদের পুরো গ্রামটারই মৃতবৎ দশা। কোথাও সবুজের আভাষ মাত্র নেই। একটা দুটো যে গাছ আছে তার পাতা সব হলুদ হয়ে গেছে। চাষবাস হয় না।মাটি এক ফোঁটা জলের জন্য হাহাকার করছে। পুকুর-ডোবার তলায় যেটুকু কাদা-কাদা জল আছে তাতে অন্যান্য কাজ চললেও খাবার জলের জন্য চার কিলোমিটার দূরের দেউল ঘাঁটি গ্রামে যেতে হয় সেখানে সরকারী কল আছে সেখান থেকে জল নিয়ে আসে সবাই। যাদের বাড়িতে ছেলেরা আছে তাদের বাড়ির ছেলেরা জল আনে কিন্তু ঘুটকুর বাবা তো বাইরে কাজ করে আর দাদু বুড়ো হয়ে গেছে তাই ঘুটকুর মাকেই যেতে হয়। মায়ের একটা লাল সাইকেল আছে সেটার দুপাশে দুটো ঢাকনা দেওয়া ডাব্বা ঝুলিয়ে আর ক্যারিয়ারে আরেকটা জলের ডাব্বা বেঁধে ঘুটকুর মা মুক্তি যখন ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে অতি কষ্টে উঠোনে এসে দাঁড়ায় ঘুটকুর ভীষন কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবে বড় হয়ে গেলে সে যাবে জল আনতে। ঘুটকুর বাবা যেখানে কাজ করে সেখানে নাকি কল খুললেই জল। খাবার জল, স্নানের জল কোনও কিছুর অভাব নেই। প্রাণ ভরে সাবান মেখে স্নান করা যায়। শুনতে শুনতে ঘুটকুর মনে হয় যেন রূপকথার গল্প শুনছে। বাবা বলছিল সবাইকে তার কাজের জায়গায় নিয়ে চলে যাবে। নুন-ভাত খেয়ে হলেও সংসার চালিয়ে নেবে কিন্তু সেখানে জলের কষ্ট তো থাকবে না। ঘুটকুর দাদু রাজি নয়। এই তালকুন্ডা ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। দাদু-ঠাকুমাকে তো একলা রেখে যাওয়া যাবে না তাই ঘুটকু আর ঘুটকুর মাও আছে এখানে।


 " ও কাকী,ও কাকী মুক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে।" হারান কাকার ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল। ঘুটকুর মাও এই গ্রামেরই মেয়ে তাই সবাই চেনে তাকে।

" হায় রে কপাল আমাদের। কাল থেকে মেয়েটার শরীর ভালো ছিল না তাও জলের জন্য এতদূর যেতে হলো।" ডুকরে কেঁদে উঠলেন ঘুটকুর ঠাকুমা তারপর ঘুটকুকে নিয়ে হারান কাকার সাথে ছুটলেন।





   খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ঘুটকু। ঘুম আসছে না তার। মা বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে। মায়ের শরীরটা খুব দুর্বল। মায়ের শরীর খারাপ হলে ঘুটকুর একটুও ভালো লাগে না। আস্তে করে দরজা খুলতে এসে ঘুটকু দেখল বাইরের দরজা খোলাই আছে। অবাক হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সে দেখল দাদু দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। সেই আলোয় ঘুটকুর মনে হোল দাদু কাঁদছে। সে দাদুর পাশে গিয়ে বসল।

" দাদু, তুমি কাঁদছ কেন?" দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলে সে।

" কাঁদছি এই গাঁয়ের জন্য, এই গাঁয়ের মানুষদের জন্য। কি ছিল কি হয়েছে!"

" তুমি কি বলছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না দাদু।" 

উদাস গলায় দাদু বলতে শুরু করেন, " সে এক সুখের দিন ছিল দাদু। তখন এ গাঁয়ের কি চেহারা ছিল তুমি ভাবতেও পারবে না। তোয়া নদী কুলকুল করে বয়ে যেত । পুকুর-ডোবায় টলটল করত কাঁচের মত স্বচ্ছ জল। ক্ষেতে ক্ষেতে ফসলের ঢেউ। আমিও কত চাষ করতাম। আমাদের এই উঠোন ভরে থাকত খড়ের গাদায়। ধান,গম, সরিষা, সবজি কত কিছু চাষ করতাম। সেসব কি দিন ছিল! গাঁয়ে তখন এত অভাবও ছিল না। সবাই চাষবাস করত, নদীতে, পুকুরে মাছ ধরত। এখন যেখানে ডাহি সেখানে ছিল ঘন শাল জঙ্গল।" ঘুটকু এতক্ষন হাঁ করে শুনছিল এবার বলল," তাহলে গাঁয়ের এরকম দশা হলো কি করে দাদু?" 

একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদু বললেন, " লোভ, মানুষের লোভ দাদুভাই। তুমি সব বুঝবে না। শুধু জেনে রাখ একদিন একদল লোভী মানুষ এসে জঙ্গল কেটে সাফ করতে আরম্ভ করল। শুধু তাই নয় গাঁয়ের পশ্চিম প্রান্তে গড়ে উঠলো কারখানা। সেই কারখানার ভাঙা বাড়ি তো তুমি দেখেছ।"

" হুম। তারপর কি হলো?"

" তারপর সেই কারখানার নোংরা জল তোয়া নদীতে মিশে তোয়ার জলকে দূষিত করে তুলল। কারখানার কালো ধোঁয়া গাঁয়ের আকাশকে ভরে তুলল। কারখানার দূষিত বর্জ্য মাটিতে মিশতে আরম্ভ করলো। বাতাসে সবসময় দুর্গন্ধ ভেসে থাকতো। আস্তে আস্তে গাঁয়ের পরিবেশ বদলাতে শুরু করল। জমিতে ফসল শুকিয়ে যেতে লাগলো। নদী-পুকুরে জল কমতে আরম্ভ করল। ধীরে ধীরে গ্রামটা প্রায় শ্মশান হয়ে গেল। একসময় কারখানাও বন্ধ হয়ে গেল। ওই বদমাশ লোকগুলো চলে গেল কিন্তু শেষ করে দিয়ে গেল আমাদের গ্রামটাকে। চাষবাস না হওয়ায় লোকে গরীব হতে আরম্ভ করল। তোর বাবার মত যারা একটু-আধটু লেখাপড়া শিখেছিল তারা তাও বাইরে গিয়ে কাজ জুটিয়ে নিল কিন্তু যাদের পুরো পরিবার এখানে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ রে দাদুভাই।" একটানা বলে দাদু চুপ করে রইলেন। ঘুটকুও নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। মনে মনে ভাবতে লাগলো কোনও দিন কি এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না? তালকুন্ডার মানুষ কোনও দিন কি এই কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি পাবে না?





   দাদু দাওয়ায় বসেই খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুটকুর চোখে ঘুম নেই। গাছপালা না থাকার জন্য তাদের গ্রামে গরমও প্রচুর। ঘুটকু পায়ে পায়ে উঠোনে নেমে এল। উঠোনের মাটিও জলের অভাবে ফুটিফাটা। হঠাৎ করেই ঘুটকুর কানে মৃদু একটা কটকট আওয়াজ এল। আওয়াজটা ক্রমাগত বাড়ছে। ঘুটকু বেড়ার ধারে এগিয়ে গেল। কটকট আওয়াজটার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে ঘুটকুর চোখে পড়ল একটা নীল আলোর বল আকাশ থেকে নেমে আসছে। বলটা ঘুটকুদের বাড়ির পেছনের ডাহি জমিটায় নামলো। ঘুটকু এক অদম্য আকর্ষণে সেদিকে চলল। চাঁদের আলোয় ঘুটকু দেখল বলটার আলো নিভে গেছে কিন্তু রুপোলি রঙের বলটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে। বলটার সাইজ খুব একটা বড় নয়। একটা ছোট ঘরের মত। একটু একটু ভয় ভয় করলেও ঘুটকু বলটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ করেই বলটার একটা অংশ দরজার মত খুলে গেল আর সেদিক দিয়ে একটা বড়সড় পুতুলের মত জিনিস প্রায় গড়িয়ে মাটিতে চিত হয়ে পড়ল। পুতুলটার চোখ দুটো লাল টুনি বাল্বের মত জ্বলছে। মাথায় একটা শিংয়ের মত জিনিস। লম্বায় ঘুটকুর ঘাড়ের কাছে হবে।

" জল, একটু জল দাও।"

ঘুটকু অবাক হয়ে দেখল পুতুলটা কথা বলছে!

" দয়া করে আমাকে একটু জল দাও নাহলে আমি মরে যাব।" চমকে উঠলো ঘুটকু। কয়েক মুহূর্ত ভেবে বাড়ির দিকে ছুটল সে। দাদু ততক্ষনে দাওয়াতেই শুয়ে পড়েছেন। ঘুটকু একবার ভাবলো কাউকে ডাকে কিন্তু তাতে সময় নষ্ট হবে ভেবে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আর মাত্র এক ঘটি খাবার জল আছে ঘরে। এটা নিয়ে চলে গেলে ঘরে আর একটুও খাবার জল থাকবে না কিন্তু ঘুটকু সেসব না ভেবে ঘটিটা নিয়ে তাড়াতাড়ি সেই পুতুলটার কাছে চলে এল। পুতুলটাকে উঠিয়ে বসিয়ে ঘটিটা মুখের কাছে ধরতেই চোঁ চোঁ করে সব জলটা খেয়ে ফেলল তারপর কয়েক সেকেন্ড পরে ঘুটকু দেখল পুতুলটার চোখগুলো লালের বদলে নীল হয়ে গেছে।

" ধন্যবাদ, বন্ধু তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে।"

পুতুলটা কথা বলছে।

" তুমি কে গো? কথা বলা পুতুল?" ঘুটকুর অবাক প্রশ্ন।

" আমার নাম ব্যমব্যামড্যানডংফোর্টেন।"

" কি?"

পুতুলটা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, " জানি আমার নামটা পৃথিবীবাসীর পক্ষে বিশেষ করে তোমার মত ছোট ছেলের কাছে খুবই জটিল। তাই তুমি আমাকে ছোট করে বোম বলেই ডেকো।"

" সে নাহয় হলো কিন্তু তুমি কে? তোমাকে এমন পুতুলের মত দেখতে কেন?" ঘুটকু প্রশ্ন করে।

" এখানে প্রচুর তাপ চল আমার যানের ভেতরে গিয়ে বসি । ভয় নেই আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পারো।"

ঘুটকু বোমের সাথে ভেতরে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। ভেতরটায় উজ্জ্বল হলুদ আলো জ্বলছে। চারিদিকে নানাধরনের যন্ত্রপাতি। ঘুটকুর যেটা সবচেয়ে ভালো লাগলো সেটা হলো কি সুন্দর ঠান্ডা ভেতরটা। ঘুটকুর প্রাণ জুড়িয়ে গেল। একটা চেয়ারের মত জায়গায় ঘুটকুকে বসতে দিল বোম। 

" তুমি বললে না তো তুমি কে?"

" বলছি। আমি কে সেটা বলা খুব জটিল ব্যাপার তাই সহজ করে বলার চেষ্টা করছি তোমায়। আমি একজন ভিনগ্রহী। তোমাদের এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মত একটা ছায়াপথ প্রশিয়ার সবচেয়ে বড় সৌরমন্ডলের একটি গ্রহ ফোর্টেন থেকে আসছি আমি। তোমাদের এই গ্রহের সাথে আমাদের গ্রহের পরিবেশের অনেক মিল তবে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের দিক থেকে আমরা অনেক বেশী উন্নত। আমাদের গড় আয়ুও অনেক বেশি। আমি এবং আমার সহযোগী মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তোমাদের এই গ্রহের সন্ধান পাই। আমরা কয়েকটি মহাকাশ যান নিয়ে তোমাদের গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। আমাদের প্রযুক্তি অনেক উন্নত হওয়ায় আমরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে সমর্থ্য হই। তোমাদের গ্রহের কেউ আমাদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে নি । আমরা সারা পৃথিবী ঘুরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাতে থাকি। আমরা কিন্তু শত্রু নই। পৃথিবীবাসীর বন্ধু। কিন্তু আজ আমি মুশকিলে পড়ে গেলাম। আসলে পৃথিবীর মত আমাদের গ্রহেও জলের অস্তিত্ব আছে। অফুরন্ত জলের ভান্ডার আমাদের। জল থেকে আমরা শক্তি পাই। আমাদের প্রতিটি মহাকাশযানে কৃত্রিম উপায়ে জল তৈরির ব্যবস্থা আছে কিন্তু আজ হঠাৎ করে আমার যানের জল তৈরির যন্ত্রটি খারাপ হয়ে যায়। তোমাদের মত আমাদেরও শরীর খারাপ হয়। আজ আমিও হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করি। আমার জলের ভীষন প্রয়োজন হয় কিন্তু তোমাদের এই অঞ্চলে আমি কোথাও জল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভীষন অসুস্থ অবস্থায় আমি এখানে ল্যান্ড করতে বাধ্য হই। তারপর তো তুমি আমাকে বাঁচলে।" ফোর্টেন থামতে ঘুটকু বলল," আমি তোমার কথা সব বুঝতে পারলাম না তবে একটু একটু বুঝলাম। আচ্ছা তোমরা কি আমাদের মতই কথা বল?" ফোর্টেন হেসে বলল," একটু একটু বুঝলেই হবে আর আমরা এমন একটা যন্ত্র ব্যবহার করি যার সাহায্যে আমি যা বলছি তুমি তোমার ভাষায় তা শুনতে পাচ্ছ। আচ্ছা, একটা কথা বল তোমাদের এখানে জলের এত অভাব কেন? এখানে গাছপালাই বা নেই কেন?"  ফোর্টেনের প্রশ্নে উৎসাহিত হয়ে ঘুটকু বলে," আমি তোমাকে সব বলছি দাঁড়াও।" এই বলে আজ দাদুর কাছে শোনা সব গল্প ফোর্টেনকে শোনায় ঘুটকু। তার মায়ের অসুস্থ হওয়ার কথাও জানায়। বিস্মিত ফোর্টেন ঘুটকুকে বলে," তোমাদের এত কষ্ট তাও তুমি আমাকে জল দিলে! ঠিক আছে ছোট্ট বন্ধু তোমার এই উপকারের প্রতিদান তো আমায় দিতেই হবে। তোমাদের হিসাবে আর তিনদিন পরেই আমরা ফিরে যাবো তবে তার আগে কাল রাতে আবার আমি আমার সঙ্গীদের নিয়ে আসবো। তুমি এইখানে চলে এসো কেমন। আজ আমি আসি। তবে আমার কথা তুমি কাউকে বলো না কিন্তু তাহলে আমি আসবো না।" 

 ঘুটকু বাইরে বেরিয়ে আসার পর ফোর্টেন তার মহাকাশযান নিয়ে চলে গেল। 



  পরের দিন সারাটা দিন ঘুটকু ছটফট করল রাত হবার জন্য। সারা গ্রাম ঘুমিয়ে আছে। তার দাদুও আজ ঘুমোচ্ছে শুধু ঘুটকুর চোখে ঘুম নেই। সে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক রাত একটার সময় আকাশে আলোর সংকেত দেখতে পেয়েই ঘুটকু ছুটল।

আজ বোমের সাথে বোমের মত দেখতে আরও চারজন এসেছে চারটে যান নিয়ে। বোম এগিয়ে এসে বলল, " আমার চারসঙ্গী। এরা প্রত্যেকেই ফোর্টেন গ্রহের বিজ্ঞানী। আমরা এসেছি তোমাকে উপহার দিতে।"

" কি উপহার গো?"

" পৃথিবীর যেসব জায়গায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় ধরে নাও আমরা সেখান থেকে তোমার জন্য একটু করে মেঘ ধার করে এনেছি।" ঘুটকু অবাক হয়ে গেল বোমের কথা শুনে। বোম আবার বলল," ঘুটকু, তোমাদের এই গ্রাম আবার সবুজ হয়ে উঠবে। আবার সবাই আনন্দে বাঁচবে। তোমার মাকে আর জল আনতে যেতে হবে না।"

" সত্যি?"

" হুম।"

বোমের সঙ্গীরা এগিয়ে এসে ঘুটকুকে চারটে থলির মত জিনিস দিল। বোম বলল," শোনো ঘুটকু, আগামী কয়েকদিন তোমাদের এখানে প্রচুর বৃষ্টি হবে। তারপর 

 এই নীল ব্যাগের ক্যাপসুলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে দিও। এতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে, মাটি উর্বর হবে। লাল ব্যাগে আছে ঘাসের বীজ। তোমাদের মাঠ আবার সবুজ হবে। সবুজ ব্যাগের বীজগুলো যেখানে জঙ্গল ছিল সেখানে ছড়িয়ে দিও। জঙ্গল আবার মাথা তুলবে আর হলুদ ব্যাগে আছে শস্যের বীজ তোমার দাদুকে দিও আবার ফসল ফলাতে। তবে একটা কথা আমাদের কথা যেন কেউ না জানে। যা করবে লুকিয়ে করবে।" ঘুটকু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো।

 



  গুড়গুড়, গুড়গুড়। তালকুন্ডার মানুষ ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। এই ডাক তো তারা ভুলতেই বসেছিল। চোখে দুকূল ছাপানো বিস্ময় নিয়ে তারা দেখলো আকাশ ঢেকেছে কালো বাদল মেঘে। একফোঁটা, দুফোঁটা করে বৃষ্টি এসে তালকুন্ডার মাটির বহুকালের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। একনাগাড়ে কয়েকদিন ধরে চলল প্রবল বৃষ্টি। তোয়া নদী আবার উচ্ছল কিশোরীর মত ছুটতে লাগলো। তালকুন্ডার ফুটিফাটা জমিতে আবার কচি ঘাসের সবুজ রেখা উঁকি দিতে লাগলো। সবকিছু যেন নতুন করে শুরু হচ্ছে। 




  পাক্কা চল্লিশ বছর পর প্রশিয়া ছায়াপথের ফোর্টেন গ্রহের প্রধান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের রিসিভার যন্ত্রে সুদূর আকাশগঙ্গা ছায়াপথের পৃথিবী গ্রহ থেকে বিশেষ একটা তরঙ্গ সংকেত ভেসে এল যার অর্থ অনেকটা এইরকম ," পুতুল বন্ধু, অনেক ধন্যবাদ এক আকাশ বৃষ্টির জন্য, অনেক ধন্যবাদ মাঠ ভরা সবুজের জন্য। পৃথিবী থেকে তোমার ছোট্ট বন্ধু।" মহাকাশ কেন্দ্রের প্রধান ব্যমব্যামড্যানডংফোর্টেনের মুখে একরাশ হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর পৃথিবীবাসী ছোট্ট বন্ধু কথা রেখেছে। সে বলেছিল অনেক লেখাপড়া শিখে তার পুতুল বন্ধুকে চিঠি পাঠাবে সে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics