দেবেন বাবুর ভৌতিক গল্প
দেবেন বাবুর ভৌতিক গল্প


আধুনিক লেখকদের মধ্যে রহস্য-রোমাঞ্চের উপর লেখাটা খুব বেড়ে গেছে । অতএব, বইয়ে বলুন বা অনলাইনে বলুন সাসপেন্স স্টোরি আজকাল যে কেউ লিখতে চায় তার লেখার ক্যারিয়ারকে সুন্দর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে । দেবেন চৌধুরী একজন নামকরা লেখক হিসেবে নিজের নাম করেছেন।
সাহিত্যিক জীবনের ২৫ বছর উপলক্ষ্যে একটি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস প্রকাশের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি দেবেনবাবু । একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,
"আচ্ছা ফিকশন আর নন-ফিকশন মিলিয়ে এটা আপনার কততম উপন্যাস?"
দেবেনবাবু বললেন,
"২৫ শে ২৫ বলে ট্যাগলাইন তো আপনারাই বানিয়েছেন। এটা আমার ২৫ তম উপন্যাস।"
এরপর আরও প্রশ্ন হতে থাকে ও বেশ মনঃপুত করেই উত্তর দিলেন দেবেনবাবু । সবশেষে ঠিক যখন আসন ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই প্রশ্নটা এলো,
"স্যার ওয়ান লাস্ট কোশ্চেন, আপনার থেকে প্রচুর রহস্য উপন্যাস পেলেও এখনও হরর বা অলৌকিক বলতে যা বোঝায় তা এখনও পাই নি।ক্যান উই এক্সপেক্ট ওয়ান ?"
দেবেনবাবু পিছন ফিরে গিয়েছিলেন। প্রশ্ন শুনে ফের ফিরে বললেন,
"দেখুন আমি কোনোদিন ভৌতিক বা অলৌকিক কিছুর সম্মুখীন হই নি আর মনে মনে আমি এই বিষয়টায় বিশ্বাসও করিনা । আর যা শুনেছি এই জেনরের সব গল্প মনোগ্রাহী হতে হলে অধিকাংশই বাস্তব ঘটনা হতে হয় । কোনোদিন কোনো অভিজ্ঞতা তৈরী হলে লিখব বৈকি।"
সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ফিরতে ফিরতে দেবেনবাবু বারেবারে ওই প্রশ্নটার কথা ভাবছিলেন। তিনি নিজেও কম ভাবেননি তবু মাথায় ভৌতিক কোনো রহস্য প্লট দানা বাঁধতে পারেনি। সত্যি কথাই বটে, লোকে রহস্য রোমাঞ্চ লেখকদের থেকে ভুতুড়ে লেখা আশা করতেই পারে। এটা একটা যে তাঁর অক্ষমতা জোর করে কোনো কাল্পনিক ভৌতিক গল্প লেখার চেষ্টা করেও তিনি লিখতে পারেননি, এটা মনে মনে নিজেই স্বীকার করেন। কিন্তু ...
" স্যার নামবেন না? এসে গেছি।"
ড্রাইভার না ডাকলে নিজের বাড়ির গেটে ঢুকেও বুঝতে পারতেন না । ভাবনাটাকে আটকে নামতেই হলো । অবিবাহিত দেবেনবাবুর দোতলার ফ্ল্যাটের দুটো ঘরে তিনি আর এক হেল্পার থাকেন । এই ৪৫ বছর বয়সে বিয়ে করার কথা আর ভাবেনও না ।একাই জীবনটা কেটে যাবে ঠিক ।
রাত্রে শুতে যাবেন হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো । খুব ক্লান্ত স্বরে হ্যালো বলার পর দেবেনবাবু শুনলেন,
"নমস্কার দেবেন চৌধুরী বলছেন?"
দেবেনবাবু বললেন,
"হ্যাঁ বলছি, বলুন।"
উত্তর এলো,
"আমি আপনার লেখা ভৌতিক উপন্যাসটি নিয়ে একটি ওয়েব সিরিজ..."
দেবেনবাবু এক লহমায় তন্দ্রা ভাব কাটিয়ে ফোনের ওপারের লোকটিকে থামিয়ে বললেন,
" দেখুন আমার লেখা কোনো ভৌতিক উপন্যাস তো কোন ছাড় কোনো গল্পই নেই । কে বলুন তো আপনি এত রাতে মাথাখারাপ করছেন?"
ফোন ততক্ষণে কেটে গেছে। একরাশ চিন্তাসহ ফোনটা রেখে দিলেন দেবেনবাবু ।
ফোনটা কেটে গেলে পর দেবেনবাবুর একবারের জন্য মনে হলো ওই লোকটা হয়তো তাঁর নতুন উপন্যাসের কথাই বলেছেন। ওটা প্রকাশিত হয়েছে তার খবর থাকলেও বিষয়টা ভুল আন্দাজ করেছেন। তাই এরকম ফোন! তবে লোকটা নিজের পরিচয় কিন্তু দিলেন না ! সবটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো রাত্রে ঘুমের পরে।
ঘটনার দুমাস পর সকালে ,
চ্যানেলে চ্যানেলে একটাই খবর প্রতিভাত হচ্ছে । বিশিষ্ট লেখক দেবেন চৌধুরীর অকালপ্রয়াণ । ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আর তার ফলেই ভোররাতের দিকে মৃত্যু ।
দেবেনবাবুর এক খুড়তুতো ভাই মিডিয়ার সামনে কয়েকগুচ্ছ কাগজ আনার পর বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা শুরু হলো। দেবেনবাবু কোনোভাবে একটি ভৌতিক গল্পের প্লট ভাবছিলেন । ওই খুড়তুতো ভাইয়ের দাবি যে দেবেনবাবুর এই মৃত্যু ও এই গল্পের মধ্যে সম্পর্ক আছে। পুলিশ আপাতদৃষ্টিতে ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করেও কোনো সন্দেহ জাগেনি ।
তবু দেবেনবাবুর অনুরাগীদের জোরাজুরিতে ওনারা একটা তদন্ত করতে বাধ্য হন । দেবেনবাবুর ফোনে কললিস্টে থাকা নম্বরগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয় । দেবেনবাবুর ওই খুড়তুতো ভাইয়ের পুলিশকে দেখানো কাগজগুলো বাড়ির ভেতরেই রাখা হয়েছে । প্রকাশকদের দ্বারা ওই লেখাটার পাঠোদ্ধার করার পর অস্বাভাবিক কিচ্ছুই পাওয়া গেলো না । কিন্তু ওই খুড়তুতো ভাইয়ের দাবি এইরকম হঠাৎ করে তাঁর দাদা ভৌতিক গল্প লিখতে কী করে শুরু করলেন?
সেদিনের রাতের সেই কলটা নিয়ে অনেককে বলেছিলেন দেবেনবাবু কিন্তু সবাই মুখ মুচকে বলেছেন,
"কে জানে!আপনার কোনো অনুরাগী হবে বোধহয় ! "
আশ্চর্য ব্যাপার! এই যে দেবেনবাবু ট্রুকলারে ওই নম্বরটির মালিকের সম্পর্কে ঠিক করে জানতে পারেননি । নামের জায়গায় শুধু একটা স্মাইলি ।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে ফের ওই নম্বরে ফোন এলো দেবেনবাবুর কাছে । দেবেনবাবু এবারে ফোনের নম্বরটার দিকে ভালো করে তাকালেন । ওটা যে কোনো ল্যান্ডলাইন নম্বর তা প্রথমেই বুঝেছিলেন । আজ ৯১৩৩ এর পরের নম্বরগুলো দেখেই চমকে উঠলেন । ২৫০৪১৯৭৪ - এ যে তাঁর জন্মতারিখ। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপা কন্ঠে বললেন,
" হ্যালো! "
অন্যপ্রান্ত থেকে শোনা গেলো,
"গল্পটা কবে পাচ্ছি? বলেছিলাম বোধহয় আপনাকে, যে আমি একটা ওয়েব সিরিজ করছি। "
মনে সাহস এনে বললেন,
" সে আপনি মন মতো যা খুশি বলতেই পারেন, আপনার দাবী মেটানোর জন্য কি আমি প্রস্তুত নাকি ? তাছাড়া আপনি কে, কোত্থেকে উদ্ভুত হলেন কিছুই তো জানি না! "
এবার উত্তর এলো,
"জানবেন জানবেন, সব ধীরে ধীরে জানবেন । আগে বলুন গল্প রেডি কিনা? "
দেবেনবাবু উত্তর দিলেন,
"ধুর মশাই, কি আপদ! বলেছি তো কতবার, আমি ভুতুড়ে অলৌকিক লিখিনা। আমার শেষ উপন্যাসটা সাই-ফাই নিয়ে । ভৌতিক গল্প কোনোদিন লিখিনা আর তা লেখার সামর্থ্যও আমার নেই।"
এই বলে দেবেনবাবু ফোনটা রাখতে যাবেন এমনসময় ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
"শ্রীপতি বিশ্বাস কে মনে পড়ে?"
দেবেনবাবুর কানে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিলেও ওরূপ অনুভূতি হতো না যেরকমটা ওই নামটা শুনে হলো! ওপারের ব্যাক্তি বলে গেলেন,
"না মনে পড়লে আমি করিয়ে দিচ্ছি । একবছর পুজোয় আপনার আর ওনার দুইজনেরই উপন্যাস বেরোনোর কথা ছিলো । আপনি শুধুমাত্র প্রতাপ খাটিয়ে প্রকাশককে পয়সা খাইয়ে ভৌতিক উপন্যাস বেরোনো বন্ধ করে দিলেন । প্রকাশক আপনার পুরোনো বইয়েরই নতুন সংস্করণ ছাপলো ।এই সমস্তকিছুর পিছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিলো শ্রীপতি বাবুকে আপনার পায়ের নীচে রাখা কারণ উনি আপনাকে টপকে আনন্দসভা ও অন্যান্য বড়ো পত্রিকায় লেখা দিয়ে জনপ্রিয় হচ্ছিলেন।এতে আপনার আঁতে ঘা লাগে আর সেইজন্যই..."
আর শুনতে পারলেন না দেবেনবাবু, ফোনটা রেখে দিলেন । সেবছর পত্রবিলাসীর প্রধান নিজে শ্রীপতিবাবুকে তাঁর ভৌতিক উপন্যাসটি নিয়ে আসতে বলেন । কিন্তু শ্রীপতিবাবু এলে পর যারপরনাই খারাপ আচরণ ও বিশ্রী অপমান করে তাড়িয়ে দেন ওই প্রকাশক শুধুমাত্র দেবেনবাবুর কথায় ।
নিজের উপর রাগে ও দুঃখে এই ঘটনা নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে বসেন। লেখার ঠিক আরও একসপ্তাহের মাথায় ফের ফোন,
"তাহলে লেখাটা কবে পাচ্ছি?"
এদিকে পুলিশ ফোনের কললিস্ট চেক করে কোনো কিনারা করতে পারলেন না কারণ কোনো নম্বরই বেশীবার নেই যাতে সন্দেহ করা যায়। প্রায় দুটো সপ্তাহ পর যেদিন দেবেনবাবুর শোকসভা সেদিন অবধি চলে । কিনারা না হওয়ায় দেবেনবাবুর খুড়তুতো ভাই নিজেই কেস বন্ধের আর্জি জানান ।
শোকসভায় বিশিষ্ট লেখক লেখিকারা উপস্থিত । মধুরঞ্জন মল্লিক দেবেনবাবুর লেখা শেষ উপন্যাসের খসড়া পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন । এই গল্প দেবেনবাবুর শেষ কদিনের সাথে হুবহু মিলে যায় যদিও কেউ সেটা টের পাননি । চরিত্রগুলোর নাম আলাদা করেও বিষয়টাকে মনোগ্রাহী করে তুলেছিলেন । কারণ তাঁর বক্তব্য অনুসারে ভৌতিক গল্প মনোগ্রাহী করতেই হবে ।
সেদিন প্রথম কিছু মিনিটের মধ্যেই দেবেনবাবুর ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় কারণ তিনি স্পষ্ট বোঝেন ওপাশ থেকে যেন তাঁরই কন্ঠ শোনা যাচ্ছে । তিনি যখন সেবারেও না করতে যাচ্ছেন তখন ওপারের ওই কন্ঠ বলে,
"শ্রীপতিবাবুর মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী একথা যদি ফাঁস হয়ে যায়..."
ফোন এবারেও ভয়ে রেখেই দিয়েছিলেন । শ্রীপতিবাবু আত্মহত্যা করেছিলেন দেবেনবাবু জানতেন । কিন্তু কোনোদিন বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও করেননি । এরপর থেকেই তাঁর খুব অনুশোচনা হতে শুরু করে ।
এরপরে শেষ ফোন আসে তাঁর মৃত্যুর দিন এই বলে,
"আমি উপন্যাসটা নিতে আসছি।"
শেষলাইনে গল্পে লেখা,
"আমার মৃত্যুর জন্য আমার বিবেক ছাড়া কেউই দায়ী নয়।"
মধুবাবু আক্ষেপের সুরে বললেন,
"শুধু এই শেষ লাইনটাই সকলকে ভাবায়।"
(সমাপ্ত)