ডাক
ডাক
(এক)
একজন মহিলার কোলে তিন মাসের একটি বাচ্চা। প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে।
কতরকম ভাবে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন মহিলাটি এবং তার স্বামী। 9কিন্তু পারছেন না।
তাই দেখে চেম্বারের বাইরে অপেক্ষারতা দুজন মহিলা বলে উঠলেন,কী হয়েছে বাচ্চার?..একটানা এভাবে কাঁদছে কেন?...বাটের দুধও টানছে না দেখছি!
শুনে বাচ্চার মা কাঁদো,কাঁদো মুখ করে বলে উঠলেন,জানি না বোন। দুদিন ধরে একই রকম অবস্থা। ডাক্তার তো দেখিয়েছি তবু কোন কাজ হয়নি। তাই বড় চিন্তাই আছি। এইটুকু সোনার আমার কী যে হল কী জানি!...দেখে আমারো কান্না পাচ্ছে বোন। ও কী আর মুখ ফুটে বলতে পারে আমাদের মত? কী করে বুঝব কষ্টটা কোথায়?
তাই শুনে পাশের মহিলাটি একটু হেসে জবাব দিলেন,একদম চিন্তা করো না বোন। একেবারে ঠিক জায়গায় এসে পড়েছো। ডঃ স্বর্ণকমল চ্যাটার্জী একজন ডাক্তার নন। উনি ডাক্তাররূপী ভগবান।এই সকল অবলা শিশুদের শুধুমাত্র চোখ,মুখ দেখলেই বলে দিতে পারেন,বাচ্চার কোথায় অসুবিধা?... একদিনের মধ্যেই তোমার সোনা হাসতে শুরু করবে,দেখে নিও।
কথাটা শুনে চেম্বারের বাকি মহিলারাও গলা মিলিয়ে বলে উঠলেন,যা বলেছো গো!...আমরা দেখছি তো। সত্যি উনি ভগবান। জীবনে এত অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন যে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারেন,বাচ্চার কষ্ট কোথায়? অবাক ডাক্তার বলতে হবে!... আমি তো আজ পর্যন্ত এরকম কোন ডাক্তারকে দেখিনি।
ততক্ষণে মহিলাটির ডাক পড়ল ভেতরে যাওয়ার।
মিনিট দশেক পরেই মহিলাটি, তার স্বামী সাথে হাসি মুখে ভেতর থেকে বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। শিশুটির কান্নাও স্পিরিটের মত উবে গেছে।
সেই দেখে পাশের মহিলাটি বলে উঠলেন,দেখলে তো বোন?..সত্যি হল কথাটা?
শিশুর মা শিশুটির মাথায় একটা নরম হামি ভরে বলে উঠলেন, সত্যি উনি ভগবান!..সোনার আমার কানে একটা ফুন্সি উঠেছে গো। তাই সারাক্ষণ ব্যথায় কাঁদত। ডাক্তার কানে দুফোটা ঔষুধ দিতেই মায়ের আমার কান্না থেমে গেল।
শুধু, শুধু মা আমার দুটো দিন কষ্ট পেয়ে কাঁদলো গো!
(দুই)
---শোনো মা।...কাল সকাল আটটার মধ্যে তোমার প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস ব্যাগে গুছিয়ে রেডি থাকবে। আমার কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই। চেম্বারে এমনই এখন রুগীর প্রচন্ড ভীড়। ম্যানেজারের সাথে আমার সমস্ত রকম কথা ফোনে হয়ে গেছে। জায়গাটা খুবই ভাল।নিরিবিলি। তুমি স্বাচ্ছন্দে নিজের মত করে থাকতে পারবে।
আশালতাদেবী চশ্মার ফাঁকে চোখজোড়া মুছে বলে উঠলেন, আমি আর কী বলব বল? তোর তো আর বাবা বেঁচে নেই। তাই দাবী করব কার কাছে বল? এখন তুই যা ভাল মনে করিস, আমাকে তাই মেনে নিতে হবে।
ডঃ স্বর্ণকমল চ্যাটার
্জী তার বৃদ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আজকাল তুমি বড্ড কান্নাকাটি করো মা। আরে বাবা। এখান থেকে ভালই থাকবে। ওখানে দেখাশুনোর লোক রাখা আছে।
আশালতাদেবী আঁচলটা টেনে বলে উঠলেন, ওখানে কী তোর বাবার হাতে গড়া বাগানটা আছে?...তোর শৈশবের হাজার স্মৃতির গন্ধ!...পাপাই-এর ঠাম্মা...ঠাম্মা ডাক!....দক্ষিণের এই জানলাটা!...যার সামনে আমি সারাদিন উপোস দিয়েও নিশ্চুপ ভাবে বসে থাকতে পারি। মনে হয় তোর বাবা যেন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর যাওয়া হয়ে গেল মানুষটার অথচ এক মুহূর্তও মনে হয়নি একা আছি।..কিন্তু এবার মনে হবে। আমাকে যেন তোরা পাপের সাজা দিচ্ছিস। তোকে বুকে আগলে মানুষের মত মানুষ করার। এযে কত বড় একটা শাস্তি যে পায়, ব্যথাটা সেই ভাল অনুভব করতে পারে বাবা। এই কষ্ট তোরা যেন কভু না পাস।
স্বর্ণকমলবাবু বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন, তুমি বোঝ না কেন মা বলো তো?...আমরা আর বাবার এই পুরনো বাড়িটায় থাকছি না। প্রোমোটার কিনে নিয়েছে। আমরা তো পর্ণশ্রীতে ফ্ল্যাট নিয়েছে। টেনথ ফ্লোরে ফ্ল্যাটটা। তুমি সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। ঘোরার জায়গা পাবে না। ওঠা,নামা করাও অসুবিধা। আরো অনেক ব্যাপার আছে। শুধুই কী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া? আর তোমার যা ছুৎমার্গের বাতিক!...প্রতিমার সাথে রোজ ঝগড়া হবে। ওর কলেজটা ওখান থেকে সামনে হবে। তাছাড়া এসকল তো ওরই সিদ্ধান্ত মতো হচ্ছে।ওর মতামতটাই সব। আফটার অল ফ্ল্যাটের পুরো ডিপোজিট মানিটা ওই পে করেছে।
আশালতাদেবী শেষবারের মত তার সন্তানের দিকে ভাল করে চোখ মেলে তাকালেন।
তিনি শুনেছেন, ছেলে তার বিশাল বড় ডাক্তার। অবলা শিশুদের চিৎকার আর চোখের জল দেখেই বলে দিতে পারে তার কষ্টটা কোথায়?
সে কী তবে নিজের গর্ভধারিনী মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারবে না?
স্বর্ণকমলবাবুও তার মায়ের দৃষ্টিপানে কিছুক্ষণ নিষ্পলকভাবে চেয়ে থাকলেন।
আশালতাদেবীর মনটা খুশিতে নেচে উঠল। না...না..তার সন্তান তার হৃদয়ের ব্যাকুলতাকে উপলব্ধি করতে পেরেছে।তিনি বেকার সন্দেহ করছিলেন!
এই তো ছেলে মুখে অল্প হাসি মেখে তার দিকে এগিয়ে আসছে।হয়তো এবার বলবে,... থাক মা। আর তোমাকে এই বয়েসে কোত্থাও যেতে হবে না। তুমি আমাদের সাথেই থাকবে। একদম নিজের মত করে। আমি প্রতিমাকে বুঝিয়ে বলবো।
আশালতাদেবী এমন শ্রুতিসুখ পাওয়ার লোভে চোখদুটো বুজে ফেললেন।
স্বর্ণকমলবাবু সামনে এসে বলে উঠলেন, মা তোমার সোনার হারটা গলায় দেখছি না কেন?
ওটা ওখানে একদম নিয়ে যেও না। তোমার নাতিকে দিয়ে যাবে। এত দামী অলংকার বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষ এলাও করে না।
কথাটা শুনে আশালতাদেবীর অবশিষ্ট মাতৃহৃদয়টুকু মড় মড় করে ভেঙে গেল।