দায়মুক্তি
দায়মুক্তি
চিন্তিত মুখে বসে আছেন কিঙ্করদেব। দুর্ভাবনার কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে তাঁর মুখমন্ডলে। ঘরে প্রবেশ করলেন বল্লরী।
“ কি সংবাদ পেলেন?”
“ সংবাদ খুব খারাপ। তুর্কীরা নদীয়া আক্রমণ করেছে। লক্ষণ সেন গোপনে নৌপথে বিক্রমপুরের অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তুর্কীদের অধিপতি খিলজির পরবর্তী গন্তব্য খুব সম্ভবত গৌড়।” থেমে থেমে আস্তে আস্তে কথাগুলো বললেন কিঙ্করদেব। তাঁর কথা শুনে শিহরিত হয়ে উঠলেন বল্লরী। অজানা আশঙ্কার ঝড় তাঁর হৃদয়ে আছড়ে পড়ল, “ তার মানে তো….।” কথা শেষ করতে পারলেন না বল্লরী।
“ তোমার আশঙ্কা সঠিক বল্লরী। তুর্কীদের গৌড় যাত্রার পথেই পড়ে আমাদের এই জনপদ রাড়ীখেল আর তুর্কীরা তাদের যাত্রাপথের সমস্ত কিছু ধ্বংস করে ধন-সম্পদ লুন্ঠন করতে করতে অগ্রসর হয়। যারা ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করতে পারে। তারা তো...। ওদের প্রাণে কোনও দয়া-মায়া নেই।” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কিঙ্করদেবের ভেতর থেকে।
“ তাহলে কি হবে?”
“ সেটাই ভাবছি কিন্তু কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সারাজীবন ধরে এত কষ্ট করে সঞ্চয় করা ধন-সম্পদ। সব ওই ভিনদেশি দুর্বৃত্তদের কবলে চলে যাবে! তাছাড়া প্রাণ বাঁচাবই বা কিভাবে?”
তাঁদের কথাবার্তার মধ্যেই পরিচারিকা এসে খবর দিল, “ আনন্দ ঠাকুর আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী।”
উঠে বসলেন কিঙ্করদেব, “ তাঁকে এক্ষুনি এখানে নিয়ে এস।” তারপর বল্লরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ একমাত্র আনন্দ ঠাকুরের বুদ্ধিই পারে এই বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।”
দরজায় এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী আনন্দ ঠাকুর। জাতিতে ব্রাহ্মণ হলেও বলিষ্ঠ গড়ন তাঁর। নির্ভীক তাঁর চোখ, তেজদীপ্ত, সংকল্পে অটল তাঁর মুখমন্ডল।
তিনি প্রবেশ করতেই কিঙ্করদেব বলে উঠলেন, “খুবই দুঃসংবাদ ঠাকুর।”
“ আমি জানি।” গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন আনন্দ।
“ তাহলে কি হবে এবার? সব কি শেষ হয়ে যাবে?”
“ এত উতলা হবেন না। আমাকে একটু ভাবার সময় দিন।” আশ্বাস দেন আনন্দ। আরও কিছু কথাবার্তার পর আনন্দ বিদায় নিলেন।
পরদিন সন্ধ্যায় আবার কিঙ্করদেবের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন আনন্দ ঠাকুর।
“ কোনও পথ খুঁজে পেয়েছো?”
“ হুঁ।” সংক্ষিপ্ত উত্তর আনন্দ ঠাকুরের।
“ শীঘ্র বল আমাদের বাঁচার পথ কি? তুর্কীরা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে।”
“ তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। আপনি কি আমায় সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করেন?”
“ এ কি প্রশ্ন ঠাকুর?” বিস্মিত হন কিঙ্করদেব।
“ উত্তর দিন।”
একমুহূর্ত ভেবে কিঙ্করদেব বলেন, “ নিজের থেকে বেশি।” দৃঢ় কণ্ঠে আনন্দ বললেন, “ তাহলে প্রতিশ্রুতি দিলাম আপনার ধন-সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আজ থেকে আমার।”
“ তাহলে মিস্টার চৌধুরী, কি বলছেন?”
“ আমার যা বলার আমি অলরেডি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি।”
“ তাহলে এটাই আপনার শেষ কথা? আপনি আমার লোনটা এপ্রুভ করবেন না?” এবার বিভোর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “ দেখুন মিস্টার দাস, আপনি বারবার একই কথা বলে আমার এবং আপনার দুজনেরই সময় নষ্ট করছেন। আপনার একটা কাগজপত্রও ঠিক নেই। বলছেন বিজনেস পারপাসে লোন চান কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে আর একটু আগে যে ভুলটা করেছিলেন ভুল করেও আর সেই ভুলটা করবেন না। বিভোর চৌধুরীর সামনে দ্বিতীয়বার ঘুষের নামও উচ্চারণ করবেন না। এবার আপনি আসতে পারেন। আমার প্রচুর কাজ আছে।” বিভোর কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখলেন।
“ ম্যানেজার, মাধব দাসকে অপমান করে কতবড় ভুলটা তুমি করলে। সেটা পরে বুঝবে।” বিভোরের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই কথাগুলো বিড়বিড় করে বেরিয়ে গেল মাধব দাস।
চারপাশে দেখতে দেখতে সাইকেল চালাচ্ছিল বন্ধন। এই জায়গাটা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। মাত্র একমাস হলো তারা এখানে এসেছে। তার বাবা ব্যাংকের অফিসার। বাবার বদলীর চাকরির সুবাদে এই চৌদ্দ বছর বয়সেই চার জায়গায় বাস করা হয়ে গিয়েছে তার। রথখোলা জায়গাটা ছোটখাটো শহর হলেও বন্ধনের বেশ ভালোই লাগছে এখানে। বেশ একটা মেঠো ভাব আছে এখানকার পরিবেশে। ওদের বাড়িওয়ালা পরিবারটিও খুবই ভালো। শুধু ওর স্কুলটাই যা একটু দূরে। তবে তাতে ওর সেরকম কোনও অসুবিধা হচ্ছে না আসলে ছোট থেকেই সবরকম পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে বন্ধন। শনিবার তাই আজ টিফিনেই ছুটি হয়ে গেছে। ভরদুপুর বলে রাস্তাঘাট প্রায় সুনসান।
“ঘ্যাঁচ।” একটা মারুতি ভ্যান খুব স্পিডে বন্ধনকে ওভারটেক করে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাধ্য হয়ে বন্ধনকে সাইকেল থেকে নামতেই হল। মুহুর্তের মধ্যে মারুতি থেকে গুন্ডা মতন কয়েকজন লোক নেমে এসে বন্ধনের মুখটা রুমাল দিয়ে চেপে ধরলো। মিষ্টি গন্ধটা নাকে ঢোকার সাথে সাথে চোখে অন্ধকার নেমে এলো বন্ধনের চোখের সামনে।
চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আছে তাও বহুকষ্টে চোখ খুলল বন্ধন। আচ্ছন্ন ভাবটা একটু কাটতে সব মনে পড়ল তার সেই সঙ্গে বুঝতে পারলো তার হাত-পা, মুখ সব বেঁধে তাকে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। কেন এভাবে তাকে ধরে আনা হয়েছে তা না জানলেও একটু ধাতস্থ হয়ে সে বোঝার চেষ্টা করল তাকে কোথায় রাখা হয়েছে। চারিদিকে চোখ চারানোর চেষ্টা করে বুঝল এটা কোনও ভাঙাচোরা বাড়ি। মাথার ওপর ভাঙা ছাদ। তারায় ভরা আকাশ দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদের জোৎস্না চারিদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে। বন্ধন হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই একটু নড়ার চেষ্টা করল।
“ রঘু, ছেলেটার জ্ঞান ফিরেছে মনে হচ্ছে।”
“ চল তো দেখি।”
টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ল বন্ধনের মুখের উপর। চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। মুখ দিয়ে একটা গোঙানি বেরিয়ে এল।
“ কি করবি এটাকে নিয়ে? শেষ করে দিবি এক্ষুনি?”
“ দাঁড়া, বসকে আগে জিগ্যেস করি। বস বলেছিল নিজের হাতে মারবে ম্যানেজারের ছেলেটাকে।”
গুন্ডা দুজনের কথা শুনে কেঁপে উঠলো বন্ধন। তারমানে এরা তাকে খুন করবে বলে ধরে এনেছে! কিন্তু কেন?এখানে তো মাত্র একমাস আগে এসেছে তারা। তাহলে কি সেদিন বাবা যে লোকটার কথা মাকে বলছিল সেই এসবের মধ্যে জড়িত? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না বন্ধন। বারবার মা-বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তারা জানতেও পারছে না সে এখন কি অবস্থায় আছে। আর কদিন পরেই সে আর মা মেদিনীপুর যেত। তাদের আসল বাড়ি, তার মামাবাড়ি সব ওখানে। সবাই তাদের অপেক্ষায় আছে। দাদু-ঠাম্মি, দিদান-দাদাই কারুর সাথে আর দেখা হবে না। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে এল বন্ধনের।
“ বসের ফোন লাগছে না।”
“ আবার ট্রাই কর। তাড়াতাড়ি এখান থেকে কাটতে পারলে বাঁচি। ভাঙা দেউড়ির খুব একটা সুনাম নেই। কয়েকশ বছর ধরে এমনি অবস্থায় পড়ে আছে। লোকে বলে কিছু আছে এখানে নাহলে এতদিনেও পুরো ভেঙে পড়েনি কেন। বসের কি যে মতি হলো! এখানে আনতে বলল ছেলেটাকে।”
“ আরে বুদ্ধু এখানে এই আধা জঙ্গলে চট করে কেউ খুঁজতে আসবে না। আর ভাঙা দেউড়ির চারপাশ সাধারণত লোকে এড়িয়েই চলে। বুঝলি পদা, আমি না একটা কথা শুনেছিলাম আমার দাদুর কাছে।”
“ কি?”
“ এই ভাঙা দেউড়ির কোথাও নাকি গুপ্তধন পোঁতা আছে।”
“ বলিস কি রে!”
“হ্যাঁ রে, একবার যদি খুঁজে বের করতে পারি তাহলে আর আমাদের পায় কে। সিধা মুম্বাই।”
“ যা বলেছিস।” রঘু আর পদার কথোপকথন কানে আসছে বন্ধনের। এদের বস কি বাবার সঙ্গে ঝগড়া হওয়া লোকটা?
“ এই পদা টর্চটা মার তো ঐদিকে।” পদার অপেক্ষা না করে নিজেই ভাঙ্গা দেওয়ালের ওপারে টর্চ ফেলল রঘু। দুজনে অবাক হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকালো। বন্ধন দেখলো তার পাশ দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল লোক দুটো।
রঘু আর পদা টর্চ ফেলে দেখলো ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।
“ আগেও তো একবার এখানে এসেছি কিন্তু তখন তো এটা চোখে পড়ে নি।”
“ আরে কোনও ভাবে রাস্তাটা খুলে গেছে। চল এখন নামি।” তাড়া লাগায় রঘু। তার মাথায় গুপ্তধনের কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
“ আরে দাঁড়া। ছেলেটা
কে কি করবি?”
“ ওর তো হাত-পা বাঁধা।”
“ আর বস যদি এসে দেখে ওকে একলা রেখে আমরা নীচে নেমেছি তখন কি হবে ভেবে দেখেছিস?”
“ হুম, সেটাও ঠিক।”
“ এই নাম তাড়াতাড়ি।” বন্ধনকে ঠেলা দেয় রঘু। ওরা বন্ধনের পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে ওকে সাথে নিয়েই নীচে নামছে যাতে ওদের বস এলে বলতে পারে সাবধানতার জন্য ওরা বন্ধনকে আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখেছে। সিঁড়িটা বহু পুরোনো। জায়গায় জায়গায় ভেঙেও গেছে। বন্ধন একবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে তাকে ঠাস করে একচড় মারলো রঘু। বন্ধনের গালটা ভীষন জ্বালা করছে। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ধাপ নিচে ওরা একটা ছোট হলঘরের মত জায়গায় এসে পৌঁছল। পদা আর রঘুর টর্চের আলো ঘরময় ছোটাছুটি করছে। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে অনেকগুলো পিতলের কলসী আর বেশ কয়েকটা বাক্স রাখা।
“ পদা!”
“ রঘু!”
“ দাদুর কথা সত্যি মনে হচ্ছে রে।” দুজনে ছুটে চলে গেল কলসিগুলোর কাছে। বন্ধনের পা যে খোলা সে কথা আর ওদের মনেও নেই।
“ রঘু এ যে কলসী ভরা সোনার টাকা।”
“ এদিকে দেখ বাক্স ভর্তি সোনার গয়না। পদা এসবের কথা কেউ যেন না জানতে পারে। বস জানলে আমাদের সব ফক্কা।”
“ ঠিক বলেছিস কিন্তু এই ছেলেটা যে দেখে ফেলল বসের সামনে বলে দিলে হয়ে গেল।”
“ নো প্রবলেম। এটাকে শেষ করে দিয়ে বসকে বলব পালাচ্ছিলো তাই বাধ্য হয়ে...। তাহলে বস আর এদিকে আসবেও না।”
“ বাহ, দারুণ প্ল্যান করেছিস।”
বন্ধন পিছিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পদা ছুটে এসে ওর চুল মুঠি ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে গালে সপাটে একটা চড় কষাল।
“ তবে রে...।” রঘু ততক্ষনে পকেট থেকে বের করে ফেলেছে ধারালো একটা ছুরি। ছুরি হাতে রঘু এগিয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ফেলল বন্ধন। মায়ের স্নেহমাখা মুখটা ঘিরে ধরছে তাই চেতনাকে।
“ আউ।” রঘুর আওয়াজ সেই সঙ্গে তীব্র বজ্রপতনের শব্দে চোখ খুলে ফেলল বন্ধন। সারাঘর নীল-হলুদ মাখা অদ্ভুত একটা আলোয় ভরে উঠেছে। বন্ধন অবাক হয়ে দেখল তার সমস্ত বাঁধন খুলে গেছে। পদা আর রঘু তার থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের সারা শরীর বেয়ে সরু সরু কালো কালো সাপ চরে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কে দুজনেরই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘরের মধ্যে বন্ধনের সমবয়সী একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুন্ডিত মস্তক, পরনে রক্তাম্বর, গলায় লম্বা একটি সোনার হার। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে পদা আর রঘুর দিকে। তার দুচোখ থেকে যেন অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে। বন্ধন দেখলো পদা আর রঘুর সামনে বিশাল এক সাপ ফনা তুলে দাঁড়িয়ে। বন্ধনের গলা শুকিয়ে আসছে। সে পালাতে চাইছে কিন্তু পালাতে পারছে না। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে আকর্ষণ করছে। সাপটা ছোবল মারলো পদা আর রঘুকে। বন্ধনের চোখের সামনেই ওরা ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। সেই ছেলেটির দৃষ্টি এবার ঘুরে গেল বন্ধনের দিকে কিন্তু সেই দৃষ্টিতে এখন ক্রোধের পরিবর্তে এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা।
“ আজ আমার এত বছরের প্রতীক্ষার অবসান হলো। তুমি এসেছ আজ আমার দায়মুক্তি ঘটবে।”
“মানে! কে তুমি? এখানে এসব কি ঘটছে?” ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে বন্ধন।
স্মিত হেসে ছেলেটি বলে, “ এককালে আমার নাম ছিল অনন্ত। সে কয়েকশ বছর আগের কথা। এই জায়গায় তখন রাড়ীখেল নামে এক ক্ষুদ্র জনপদ ছিল। কিঙ্করদেব ছিলেন সেখানকার অধিপতি। আমার পিতা আনন্দ ঠাকুর ছিলেন তাঁর পরম মিত্র। পিতার চরম দুর্দিনে কিঙ্করদেব তাঁকে আশ্রয় দেন। রাড়ীখেলে চতুস্পাঠি নির্মাণ করে পিতাকে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ দেন। আমার পাঁচবছর বয়সে আমার মায়ের মৃত্যু ঘটলে কিঙ্করদেবের স্ত্রী আমায় তাঁর স্নেহছায়ায় ঘিরে দেন। আমি তাঁকে বল্লরী মা বলে ডাকতাম। তাঁদের পুত্র বিল্বদল ছিল আমার ভ্রাতৃসম। সেটা ১২০৪ সনের কথা তুর্কীরা ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় ধেয়ে এল বাংলার বুকে। কিঙ্করদেব বুঝতে পারলেন রাড়ীখেল আক্রান্ত হতে পারে। তিনি প্রবল দুশ্চিন্তায় আমার পিতার শরণাপন্ন হলেন। আসন্ন বিপদের আগাম আভাষ তিনি পেয়েছিলেন। কিঙ্করদেবের সাথে পরামর্শ করে সমস্ত ধনসম্পদ এই দুর্গের পাতালঘরে এনে রাখা হয় এবং কিঙ্করদেব সপরিবারে সাময়িক ভাবে রাড়ীখেল ত্যাগ করা মনস্থ করেন কিন্তু আমার পিতা এবং কিঙ্করদেব কেউই তুর্কীদের গতি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না। রাড়ীখেল ত্যাগ করার পূর্বেই তুর্কি আক্রমণ ঘটল। আমার পিতা দূরদর্শী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এই দুর্দমনীয় তুর্কীদের হাত থেকে কিঙ্করদেবের সম্পদ রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। আমার পিতা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে এই ধনসম্পদ তুর্কীদের হাত থেকে তিনি রক্ষা করবেন। নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য তিনি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। পিতা আমায় প্রশ্ন করেছিলেন যে বল্লরী মায়ের জন্য আমি কি করতে পারি। আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারি। তখন পিতা আমার উপর এই বিপুল সম্পদ রক্ষার ভার অর্পণ করলেন।”
“ মানে?” বন্ধন এতক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল।
“ আমার পিতা একজন জ্ঞানী ব্রাহ্মণ ছিলেন। বিভিন্ন ক্রিয়া-আচার বিষয়ে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। যকের হস্তে সম্পত্তি সমর্পণ ক্রিয়াও জানা ছিল তাঁর। সেই কৃষ্ণ দ্বাদশী তিথিতে এই ঘরে তিনি আমাকে নিয়ে এই ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।”
“ ক কি বলছ তুমি?” বন্ধন উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। যকের কথা সে গল্পের বইতে পড়েছে।
“ অবিশ্বাস্য ঠিকই কিন্তু এ ছিল আমার আর পিতার যৌথ সিদ্ধান্ত। আমরা আমাদের আশ্রয়দাতার ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিলাম।”
“ তারপর কি হলো?”
“ পিতা আমায় এঘরে রেখে। প্রবেশ দ্বার চিরকালের জন্য বন্ধ করে কিঙ্করদেবের গৃহে পৌঁছান কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। কিঙ্করদেবের পুরো পরিবার নিঃশেষ। পুরো রাড়ীখেলই তুর্কী আক্রমণে বিপর্যস্ত। আমার পিতা কোনও ক্রমে তুর্কীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও আমাকে হারানোর শোকে গঙ্গায় প্রাণ বিসর্জন দেন।এখান থেকে বেরতে না পারলেও যকজীবনে আমি সবই জানতে পারি। সেই থেকে মুক্তির অপেক্ষায় আছি। আজ তুমি এসেছ। আমি দায়মুক্ত।”
বন্ধনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তাহলে কি এখন তাকে যক করে এই ছেলেটি মুক্তি পাবে!
“ ভয় পেওনা। তোমাকে যক হতে হবে না।” ছেলেটা কিকরে যেন বন্ধনের মনের কথা জেনে গেছে।
“ পিতা আমায় শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে কিঙ্করদেবের রক্ত শরীরে বইছে এমন কোনও ব্যক্তি ব্যতীত কারুর হাতে এ সম্পত্তি আমি সমর্পণ করব না। তাই এতবছরে এখানে এত মানুষ এসেছে কিন্তু এই প্রবেশ দ্বার খোলে নি। আজ তোমার জন্য খুলেছে। এই সম্পত্তির মালিকানা তোমার হাতে দিলেই কয়েকশ বছরের যক জীবন থেকে আমার মুক্তি ঘটবে।”
“ আমার জন্য প্রবেশ দ্বার খুলেছে! এসব কি বলছ তুমি!”
“ হ্যাঁ, বন্ধন এই প্রথমবার কিঙ্করদেবের রক্ত শরীরে নিয়ে কেউ এই কেল্লায় এসেছে।”
“ ক কি বলছ! তুমিই বলেছিলে ওনার পরিবার তুর্কীদের হাতে মারা গিয়েছিল।”
“ হুম কিন্তু ওনার এক কন্যার বিবাহ হয়েছিল সুদূর তাম্রলিপ্ত এ। তুমি তারই বংশধর। তাই আজ এই বিপুল সম্পদ তোমার। এই সম্পদ গ্রহণ করে আমাকে দায়মুক্ত কর বন্ধন।”
মাধব দাস জেলে থাকলেও নিরাপত্তার কারণে বন্ধনের বাবাকে উপরওয়ালা ওদের বাড়ি মেদিনীপুরের কাছাকাছি একটা ব্রাঞ্চে বদলি করে দিয়েছেন। বন্ধনরা রথখোলা থেকে ফিরে যাচ্ছে। রাত নেমেছে। ট্রেনের কামরার মৃদু আলোয় পিঠ ব্যাগটায় হাত ঢোকাল বন্ধন। জিনিসটায় একবার হাত ছোঁয়াল সে। বর্তমান আইন অনুযায়ী সমস্ত সম্পত্তি সরকারের ঘরে জমা পড়েছে। তাছাড়া বন্ধন সব সত্যিকথা বললে সবাই তাকে পাগল ভাবত তাই কাউকে সে কিছু জানায় নি। সবাই জানে মাধব দাসের শাগরেদরা বন্ধনকে আটকে রাখতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে। অনন্ত এক জ্যোতিরবলয় হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার আগে নিজের হাতে বন্ধনকে তুলে দিয়েছিল তার বল্লরী মায়ের একটি আংটি। সেই আংটিটা বন্ধন লুকিয়ে রেখে দিয়েছে অনন্তর স্মৃতি হিসেবে। তার বয়সী একটা ছেলে যকজীবন বেছে নিয়েছিল শুধু আশ্রয় দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এটা ভাবলেই বন্ধনের বুকে অনন্তর জন্য কান্নার মেঘ জমে উঠছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে বন্ধন মনে মনে বলল, “ ভালো থেকো অনন্ত।”