দায়িত্ব
দায়িত্ব
আমার মামাতো বোনের বিয়ে হয়েছে মেদিনীপুরে কাঁথীর কাছেই। ওর বাড়িতে জোর করে থাকার ব্যবস্থা করলো ওর বর সুজন। বিদেশ চাকুরী করে ইশ্বরের আশীর্বাদ একটু আধটু পয়সা মুখ দেখেছি। তাই হোটেল বা একটা গেস্ট হাউসে খুলবো বলে একটা জায়গায় খুঁজছিলাম হঠাৎ পেয়ে গেলাম মেদিনীপুরে। বগুরান জলপাই।
বাঙালি মানেই ঘুরতে ভালো বাসেন। বাঙালি সমুদ্রপ্রেমী হয় । শহরে একঘেয়েমি, নীরস, যান্ত্রিক জীবনযাত্রা থেকে ১/২ দিনের জন্য সাময়িক মুক্তি পেতে দিঘা-মন্দারমনির মতো জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত ছাড়া, বাংলার অন্য কোনো নির্জন, শান্ত, অজানা সৈকতের খোঁজ করছিলাম আমি। সেই হিসেবে বগুরান জলপাই আমার পছন্দ হয়ে গেলো। কাঁথি থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ঘন ঝাউবনের জঙ্গল বেষ্টিত এই শান্ত, নির্জন সুপ্রসস্থ সমুদ্র সৈকত। শহুরে জীবন থেকে দূরে অথচো কোলকাতার কাছাকাছি। এই সৈকতটিতে সমুদ্র তীরের মানুষ জনের দেখা ভার। আছে শুধু ক্লান্তি দূর করা শীতল বাতাস, আর আছে প্রকৃতির এক নির্মল শান্তি ও নীরবতা - আর সেই নীরবতাকে ভেঙে দেয় নাম না জানা পাখির কোলাহল আর সমুদ্রের গর্জন। দিগন্ত বিস্তিত সমুদ্রতীর যেনো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে লাল কাঁকড়ার রঙে। কিন্তু এটা নতুন করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার খুব সুযোগ আছে।
কাঁথিরেল স্টেশন আর কাঁথি সেন্ট্রালবাস স্টপ কাছে কাছি। এখানে এখনো প্রযন্ত একটাই গেস্ট হাউস হয়ছে ফলে প্রতিযোগিতা কম। তবে ভবিষ্যতে সম্ভবনা আছে অনেক। কাছাকাছি অনেক আকর্ষণীয় স্থান আছে। জুনপুট, বাঁকিপুর বীচ, দরিয়াপুর লাইটহাউস, কপালকুণ্ডলা মন্দির, পেটুয়াঘাট মৎস্য বন্দর আর খেয়া পেরিয়ে (রসুলপুর নদী) হিজলী শরীফ। ঝাউবনের ঝাউবনের জঙ্গলে ঘেরাসমুদ্র থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে। একটা জমিও পেয়ে গেলাম। এখানে কয়েকটি ৪ বেডেড রুম , কিচেন রুম একটা মেস রুম বানিয়ে ব্যবসাটা শুরু করবো ভাবলাম । ওখানে একটা ঘর ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সুজন আর তিন্নি তা হতে দিলো কোথায়।
তবে ওদের বাড়ি আমার ভালো ই কাটছিলো। সকালে দুপুরে ভালো ভালো খাওয়া দেওয়া। রাতে জমিয়ে আড্ডা । তবে এ বাড়িতে একটা বিষয় আমায় একটু কষ্ট দেয়। সেটা হলো স্নেহা দেবী। তিন্নি ছড়া কেউ ওর সাথে ভালো করে কথা বলে না।
স্নেহা দেবীকে আমি চিনি যখন উনি তিন্নিকে পড়াতো। গরীব হলেও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তিন্নিকে ও এ বাড়ির বৌ করে এনেছে। স্নেহা দেবী সাথে আমার সে ভাবে আলাপ যদিও হয়নি কারণ দশবছর আগে আমি ছিলাম একটু বাচাল গোছের কিন্তু উনি ছিলেন একটু গম্ভীর, তাই একদিন রসিকতা করতে উনি আমার দিকে খুব কটমট করে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর থেকে এড়িয়ে যেতুম ওনাকে। উনি স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করলেন। এই অঞ্চলের স্কুলেই চাকুরী পেলেন। সেই সময় সুজন বাবা মানে চৌধুরী বাবু ওকে প্রায় হাইজ্যাক করে ওকে বৌ করেছিলো। আর তার কয়েকটি বছর পর সুজনের সাথে তিন্নির বিয়ে হয় স্নেহা দেবীর উদ্যোগে কারণ তিন্নি আর বেশি দূর পড়াশোনা হবে না সেটা জানতো আমার মামা। তাই সুজনের মতো পাত্র হাতছাড়া করে নি। যদিও সুজন তেমন কিছু করে না। পৈত্রিক সম্পত্তির আয় থেকে ই চলে যায় ওদের।
তিন্নি সুখে থাকলেও স্নেহা দেবী এ বাড়িতে সুখে নেই। চাকরি বহাল রেখে তাঁকে সব কাজ করতে হয়। তিন্নি তাকে সাহায্য করতে গেলেও তাকে বাঁধা দেয় ওর শাশুড়ি। স্নেহার অপরাধ সে বিধবা এবং নিঃসন্তান। সহানুভূতি থাকলেও প্রকাশ করতে পারতাম না। কারণ আমি এ বাড়ির অতিথি।
তবু একদিন স্নেহা দেবীকে একা পেলাম রাস্তায়। ব্যাস মিস করছেন উনি আমার দি চক্র যানে করে ওনাকে স্কুল ওবধি ছেড়ে দেবার সুযোগ একটু বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম। একদিন উনি সহজ হবে না জানি। পথটা জান হয়ে যেতে দুই এক দিন স্কুল থেকে বাড়ি , বাড়ি থেকে স্কুল করার পর ওনার সাথে একটা সহজ সম্পর্ক হতে একদিন সাহস করে বললাম " আপনার তো একটা সরকারী চাকুরী আছে। তাহলে ঐ বাড়িতে পরে আছেন কেন? স্বনির্ভর আপনি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চেষ্টা করুন।"
উনি হাসলেন বললেন " স্বাধীন হতে চাইলেই কি স্বাধীনতা পাওয়া যায়?আপনিও তো শুনেছি স্বাধীনতা উপভোগ করতেই জীবনে কোন বন্ধনে জাড়ান নি, কিন্তু আপনি কি সত্যি সুখী "
এটা সত্যি জটিল প্রশ্ন পৃথিবীতে কোনো মানুষ বোধহয় সুখি নয়।
যাইহোক হোটেল ব্যবসা আমার শুরু হয়ে গেলেও। ও বাড়িতে যাওয়া আসা বন্ধ হলো না। বরং সুজনকে সাবলম্বী করতে আমার ব্যবসায় ওকে পাটনার করে নিলাম। কারণ ওদের যখন বিয়ে হয়েছিল আমি দেশে ছিলাম না। তাই এটাই ছিলো আমার , ওদের কে দেওয়া উপহার।
দেখতে দেখতে আমি সুজন দের পরিবারের একজন হয়ে গেছিলাম। সব কিছু ঠিক ঠিকঠাক চলছিলো। তিন্নি চা ছেকতে গিয়ে হাত পুরিয়ে ফেলো গরম জলে। স্নেহা দেবীকে উনার শাশুড়ি খুব অপমান করলেন। ঘটনাতে আমার মাথার ঠিক থাকলো না। আমি তিন্নির শাশুড়ি কে অনেক গুলো কথা স্পষ্ট ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম।
সত্যি তিন্নির শাশুড়ি ভালো বাসে মেয়ে মতো। তিনি বৈসম্য করে স্নেহাদেবীর ক্ষেত্রে।কিন্তু স্নেহা দেবীও তো সে হিসেবে ওনার ছেলের বিধবা বৌ , এবং তার এ সংসারে অবদান অনেক বেশি। সংসারে ব্যায় ভারের অনেকটাই তার আয়ের উপর নির্ভর করছে। স্নেহা দেবী আসলে তার মৃত স্বামীর কর্তব্য পালন করছে। অথচ তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালো না বেসে সব সময় কেন অপমান করা হয়? এ তো নয় যে তার সন্তানের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। তাহলে স্নেহা দেবীকে এতো অপমান সহ্য করতে হবে কেন!!
কিন্তু এই মুহূর্তে স্নেহা দেবী প্রতিবাদ করে উঠলেন। উনি বলে উঠলেন " দুই দিন আপনার সাথে একটু হেসে কথা বলেছি বলে ভেবেন আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে কথা বলার অধিকার দিয়েছি। আপনি আমার পরিবারের কোনো সদস্য কে অপমান করতে পারেন না। আপনি বোধহয় এ বাড়িতে না এলেই ভালো হয়।"
ও ঘটনার পর সপ্তাহ দুয়েক ও বাড়ির মুখ হলাম না। তিন্নি সুজন অবশ্যই আমাকে সমর্থন করলো। বললো " সত্যি আমাদের খারাপ লাগে কিন্তু কোন দিন প্রতিবাদ করাতে সাহস হয়নি। তবে তুমি করে ভালোই করেছো"
কিন্তু ওনার কথা গুলো আমার মনকে কেন যেনো খুব কষ্ট দিচ্ছিলো। তাই শেষ মেশ গেস্ট হাউস টা দায়িত্ব দিয়ে সুজনকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি কোলকাতায় ফিরে আসবো ঠিক করলাম। হঠাৎ দেখি স্নেহা দেবীকে সাথে নিয়ে চৌধুরী বাবু আর তার স্ত্রী হাজির হয়েছেন।
চৌধুরী বাবুর স্ত্রী বলেন " তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে আমাদের এই অভাগী মেয়েটার কি হবে?"
