STORYMIRROR

BAIDURYYA SARKAR

Abstract

4.0  

BAIDURYYA SARKAR

Abstract

চরিত্রের খোঁজে

চরিত্রের খোঁজে

4 mins
255



স্লিপারের সবথেকে বড় সমস্যা হল, প্রচুর লোকের সাথে যেতে হয় । তার মধ্যে অধিকাংশেরই রিজার্ভেশন নেই । টিটিকে টাকা দিয়ে ওঠে । তারপর‘একটু চেপে বসুন’ কিংবা পায়ের কাছে বা শুয়ে পড়ার পর নিচের জায়গায় অথবা বাথরুমের সামনে কিংবা চলন পথে ।


বিরক্ত হওয়া, ঝগড়া করা কিংবা ওজর আপত্তি কতক্ষন করা যায় ! শেষ উপায় টিটিকে নালিশ করা। আমাদের সে যাত্রার টিটি বেশ ঘোড়েল । আমিযখন বললাম, আপ টিকিট চেক করেগা ? শুনে সে অবাক হয়ে বলেছিল, কিউ নেহি ! আমি উত্তর আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম, বললাম – মুঝে তো ইয়ে কামরা জেনারেল লাগরাহে হ্যায় । আমার হিন্দির বহরে কিংবা দার্শনিকসুলভ ভঙ্গিতে অদ্ভুত হেসে সে বলল, হররোজ তো তেওহার নেই আতা হ্যায় বাবু ... সুতরাং তার কিছু করার নেই । উৎসব বলে কথা !


টাকা খেয়ে এসব বলছে জানি, তবু সত্যিই কারোর কিছু করার নেই । সবথেকে বিরক্তিকর যেটা, বউবাচ্চা নিয়ে উঠে বসা লোকজনদের সাথে কতক্ষণই বা দুর্ব্যবহার করা যায় ! আমার ডান পাশে একটা রীতিমতো সুন্দরী মেয়ে আসানসোলে নামবে বলে যেন আমাদেরই ভরসায় ট্রেনে অনেকক্ষণ উঠে বসে আছে । চোটপাটের উত্তরে সে বলল, তাহলে আমি কোথায় বসব ! শুনে আমাদের পাষাণ হৃদয়ের গলতে আর দ্বিধা কী ! আরেকপাশে আরেকটি মেয়ে, সে দেহাতি । তার সঙ্গে দুজন ছেলে । একজন বর হলে অন্যজন কে ? সেই ছেলেটা কিছু একটা বলতে এলে তাকে আমি যাতা বলতে শুরু করলাম ।এরা এভাবেই পঁচিশ ঘণ্টার জার্নি করতে চাইছে, টিটিকে টাকা দিয়ে পাওয়া স্লিপের অজুহাতে।

তারপর অন্য ছেলেটা করুণ ভঙ্গিতে ওকে কয়েকবার – ‘শঙ্কর আব চুপ হো যা’ ... বলাতে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হল ।

বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সাইড লোয়ারের সিটে আমার পাশেই সেই শঙ্কর বসে আছে নিশ্চিন্তে ।আমিও নিশ্চেষ্ট হয়ে তাদের সঙ্গিনীর সাথে বাকী দু’জনের সম্পর্ক আঁচ করে সময় কাটাতে লাগলাম ।

 

 

পুরনো দিল্লির ঘিঞ্জি গলি থেকে কাবাব কিনে ফেরার সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার সাথে । কিছু না পেয়ে তার সাথে এক টোটোতে উঠেছিলাম । তার গায়ে কালো রঙের হিজাবের ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটে থাকা উজ্জ্বলতা । বেশ মোহময় আতরের গন্ধ । লক্ষ্যনীয় ছিল যেটা, তার উদ্ধত ভঙ্গিতে একটা পা উল্টোদিকের সিটে রেখে ব্যালান্স করা ভঙ্গিমা । তখনই লক্ষ্য করেছিলাম তার হাত পায়ের মেহেন্দি ।বলেছিলাম, এর’ম কমপ্লেকশানেই এসব মানায় ।

সাথের বন্ধুর সাথে বেশ খানিকটা বাংলা বিশ্রম্ভালাপে বারবার উঠে আসছিল সৌন্দর্যের কথা আভিজাত্যের কথা, আরও নানা বেসামাল ইঙ্গিত । কথায় কথায় বলে ফেললাম, একেই বলে ডাঁহাবাজ ।ও আমাকে সতর্ক করার জন্য বলল, ঐ শব্দটার মানে কিন্তু এখানে সবাই বুঝে যেতে পারে ! অবশ্য এত ভাবনা মাথায় থাকছিল না । ভাবছিলাম নামবো চাউরি বাজারে । যেখানে মির্জা গালিবের বাড়ি ছিল।একটু পরে চতুর্থ সিটটাতে আমাদের সঙ্গী হল ভাঙাচোরা চেহারার একটা লোক । সে ঐ মহিলার সাথে টুকটাক কথা বলতে চাইলেও উনি ততটুকু উত্তরই দিচ্ছিলেন যতটা ওনাকে মানায়। আমাদের টুকটাক কথায় লোকটা উৎসাহিত হয়ে এরপর জিজ্ঞেস করল, আপলোগ কেয়া কলকাতা সে আয়ে হো? আমাদের কিছু বলার আগেই সুগন্ধের অধিকারিণী মহিলার কথা শুরু হল ... ইতনা মিঠি বাত শুননেই তো পাতা চলা যাতা হ্যায় ।

আমাদের অবাক করে উনি বললেন, আমি একটু একটু বাংলা ভি জানি... বহুত সাল পহেলে একবার কলকাতা গিয়া থা ... ও যাঁহা

হাওড়া ব্রিজ... ।

এতটা শুনে, প্রমাদ গোনা যে কী জিনিস বুঝতে শুরু করেছি । অর্থাৎ আমাদের ওইসব অনৈতিক স্তুতি শুনেছেন এবং বুঝেওছেন । যদিও তাতে যে কোনও আপত্তি নেই তা বুঝে আমরাও প্রগলভ হলাম বেশ ।

উনি বলছেন, বাঙ্গালিলোগ মুঝে বহুৎ মহাব্বত দিয়া উস সময় ... আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, তখন স্লিম ভি ছিলাম ... শোনা ইস্তক আমরা ঘাবড়ে গেছি । সুগন্ধা নামটাতেই ওনাকে মানায় বুঝতে পেরেছি । সাথের ভাঙাচোরা লোকটার নাম শুনলাম- শাহজাহান । নামার সময় ‘আল্লা হাফেজ’ বলে হাঁটতে লাগলাম । চাউরি বাজার মীর্জার বাড়ি সব গুলিয়ে অলি গলির ভেতর যে কোথায় গেলাম !

 

শাহজাহানের সাথে শঙ্করের যোগাযোগ হয়েছিল সুগন্ধার সূত্রে । ভারী অদ্ভুত ছিল সুগন্ধার ভাবভঙ্গি । ও কি বেশি সরল ছিল বয়সের তুলনায় ? 

আমরা সুগন্ধাকে দেখেছিলাম শঙ্করের বান্ধবী হিসেবে । শুনেছিলাম ওর বাপ কী কারণে যেন কিছুদিন জেলে আছে, ওর মায়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে । সদ্য যুবতী সুগন্ধার পোড়োবাড়িতে আধপাগল ঠাকুমা ছিল শুধু । অবাক হয়ে দেখেছিলাম বেশ ক’মাস ওদের বাড়িতে ইলেকট্রিকের লাইন কাটা। শঙ্করের অবস্থাও বিশেষ ভালো ছিল না, সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছিল না, সর্বত্র ধারদেনা । তবে শাহজাহান ওদের দু'জনকেই টাকা ধার দিত ।এটা জেনেই দিত –যে ও আর শোধ হবে না।

 

শাহজাহানের মনে হত প্রেমচন্দের ‘সওয়া সের গম’-র শঙ্করের মতোই অবস্থা হয়েছে, সারাজীবনেও গোলামি ঘুচবে না। শঙ্কর মনের মধ্যে নিষ্ফল আক্রোশ নিয়েও কিছু করতে পারতো নাশাহজাহানের । যদিও বুঝতে পারতো সে আসলে সুগন্ধাকে লোভ দেখাচ্ছে ।

শাহজাহান গোছানো পারিবারিক ব্যবসা হাতে পেয়েছে, জীবনটাকে কাব্যিক মনে হলে ফল যা হয়... শেক্সপিয়ারের আডপ্টেশানে কেন ভরদ্বাজ সেরা, সে’সবের সমজদার । 

তবে সুগন্ধা কেন যে শঙ্করের দিকেই বেশি ঝুঁকছিল বুঝতে পারেনি কেউই। সুগন্ধা যে কোন আক্কেলে শাহজাহানকে এড়িয়ে আলাদা থাকতে চাইছিল, সেটাও কেউ ধরতে পারছিল না । সেদিন সরাসরি শঙ্করকে চেপে ধরে শাহজাহান। সাথে দু’চারজন ছিল। শঙ্করেরও এটা নিজের এলাকা, সেও এত সহজে ছেড়ে দেবে না । সেই শনিবার নেশার ঝোঁকেই হয়ত, শঙ্কর ওকে বলেছিল- ‘ফয়সালা শনিবারে’ ...

 

 

শাহজাহান লক্ষ্য করে দেখছে টাওয়ার বারটা আগের মতোই রয়ে গেছে। শিয়ালদার এই জায়গাটাও। ফ্লাইওভার হওয়াতে চিনতে অবশ্য একটু অসুবিধা হয় । আজকের এই সন্ধেটাতে সবকিছুই যেন বড় বেশি অবাক করা । কেনই বা মনে পড়বে এত বছর আগের এক বর্ষার বিকেলের কথা, প্রথম যৌবনের অর্থহীন সেই বাজী । কেন শাহজাহান সেসব মনে রেখে অপেক্ষা করছে ! তখন জীবন কিছু অন্যরকম ছিল, শহর অন্যরকম ছিল, বয়সও কম ছিল। এত বছর কেটে আজ আবার একটা শনিবার । এখন শাহজাহানের এখানে আসার কথা নয় । তার বেঁচে থাকার লেয়ারটা পাল্টে গেছে। তবু এককোণে বসে, দু’পেগ নিয়ে জরিপ করে যাচ্ছে সবাইকে । কাউকেই ঠিকমতো মনে হচ্ছে না। শঙ্করের মুখ কি ভাল মনে আছে? এত বছরে পাল্টে যাওয়া চেহারা কি সত্যিই চেনা যায় ? ও কি বদলায়নি, যে শাহজাহানকে খুঁজে পেয়েছিলাম ‘পূর্ব পশ্চিমে’ । প্রেমের কারণে খুনপর্যন্ত করেছিল যার বন্ধু ! 

দু’জনে একটা মেয়েকে চেয়ে একজনই তাকে বিয়ে করতে পারে, এটাই চালু নিয়ম...শাহজাহান কি আজ সেটাই দেখতে এসেছিল শঙ্কর কেমন আছে ওই দাঁওটা মেরে ? 

আসলে সামাজিকভাবে হেরে যাওয়া শঙ্করদের যেখানে সেখানে দেখতে পেয়েছিলাম আমরা । শাহজাহান যে সব ব্যাপারে এগিয়ে গেছে সেটা দেখাতে ফিরে আসতো, নাকি আসলে গল্পের শেষে হেরে গেছিল বলেই ! যৌনতায় বাধ্য করা সুগন্ধার সন্তানের খবর নিতে শাহজাহানদের ফিরে আসা লক্ষ্য করছিলাম আমরা । সুগন্ধাকে পড়েছিলাম মান্টোর গল্পে ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract