Baiduryya Sarkar

Inspirational

3  

Baiduryya Sarkar

Inspirational

স্বপ্নের ম্যাচ

স্বপ্নের ম্যাচ

13 mins
829


খেলা হচ্ছে ঝড়ের বেগে । একপ্রান্ত থেকে পায়ে বল নিয়ে একের পর এক ফুটবলারকে ড্রিবল করে এক কিশোর এগোচ্ছে, তার জার্সির নম্বর দশ। বুবুন খেলাটা দেখছে কিন্তু স্ক্রিন কেন যে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বুঝতে পারছে না । ছেলেটা গোলকিপারকে কাটিয়ে বলটা গোলে ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠলো । যেন ঝলসে উঠলো স্ক্রিনটা । তারপরেই স্ক্রিনটায় রং এসে গেল । নীল সাদা জার্সি পড়া ছোটখাটো চেহারার একজন বাঁ পায়ে বল নিয়ে এগোচ্ছে, তার মুখে মিষ্টি হাসি কিন্তু প্রতিটা মুভমেন্টে শরীরের মাসেল যেন ছিটকে বেরোচ্ছে । তাকে ফাউল করে ফেলে দেওয়ার পরের মুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়ে সে ফ্রিকিক নিতে যাচ্ছে । গোল হবে কি ...

বুবুনকে আজ আবারও মা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিল । কাল থেকে স্কুলে ইউনিট টেস্ট । তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে বসার কথা বলছে মা । বুবুন ঘুমের ঘোরে পা ছুঁড়ছিল দেখে মা খানিকটা চিন্তিত । কিন্তু ঘুম ভেঙে উঠে বুবুনের আপসোস হতে লাগলো অন্য কারণে । এটাই তো সেই স্বপ্নের ম্যাচ । ফুটবলের ইতিহাসের এক নম্বর আর দু’নম্বরের মুখোমুখি লড়াই । ইসস ... রেজাল্টটা দেখা হল না !  

দাদুর সাথে বুবুনের পেলে আর মারাদোনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে নিত্য তর্ক হয় । আশ্চর্য যেটা, এই তর্কটা যে দু’জনের মধ্যে হয় তাদের সময়ের পার্থক্য ছয় দশকের । একজনের বয়স চোদ্দ, আরেকজনের তিয়াত্তর । বুবুন আর তার ফুটবল দাদু । এক পাড়াতে থাকা দু’জন যেন সমবয়সী বন্ধুর মতো ফুটবল নিয়ে মেতে ওঠে।

বুবুন প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ান্স লিগের পোকা, ইউটিউবে ফুটবল হিসট্রির নানারকম ভিডিয়ো দেখে খেলার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে । ওর ফুটবল দাদু নির্মলবাবু এককালের বিখ্যাত ফুটবলার - ১৯৭০ এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জেতা ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম আর মোহনবাগানের উল্লেখযোগ্য প্লেয়ার । 

রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আশপাশের মাঠে ওর সমবয়সীরা যখন হুটোপাটি করে, বুবুন দাদুর কাছে যায় । প্রতিদিন নির্মলবাবুও বুবুনের আসার অপেক্ষায় থাকেন । সেরিব্রাল হয়ে ওনার বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা না থাকলেও বুবুনকে দেখে তার ফুটবলার জীবনের ঝাঁপি খুলে বসেন ।

বুবুন জানে ওর পা ওকে চিরজীবনের জন্য মেরে দিয়েছে, কোনোদিন বড় জায়গায় ফুটবল খেলাই হবে না । জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পলসি হয়ে ওর দুটো পা খুব দুর্বল । তারপর অনেক জায়গায় ট্রিটমেন্ট হয়েছে বলে এখন বুবুন হাঁটতে বা মোটামুটি দৌড়তে পারে ।

মুখ কালো করে বুবুন সাইডলাইনে বসে খেলা দেখে। গেমস টিচার অমিয়বাবু খানিকটা বিরক্ত মুখে তাকান কিন্তু কিছু বলেন না। বন্ধুদের মধ্যে তুহিন স্কুল টিমের সেরা স্ট্রাইকার । বুবুনের বেস্ট ফ্রেন্ড। দুজনেই বার্সিলোনার ফ্যান –সোজা কথায় দুজনেই মেসির ফ্যান ।

গেমস টিচার অমিয়বাবু তুহিনকে অবশ্য অকারণে বকাবকি করেন । এই এক উত্তমকুমারের নাতি এসেছে, চুলের বাহার দেখো... পেটে কিল মারলে অঙ্কের ফর্মুলা বেরোবে না, এদিকে মাঠে নামলে যেন মারাদোনা ! উনি রেগে গিয়ে নামটাম গুলিয়ে ফেলেন । গতবছর অঙ্কে লাল কালি হয়ে গার্জেন কল হয়েছিল । তুহিন যে খেলে স্কুলকে ট্রফি এনে দেয় তার কি কোনও মূল্যই নেই ! 

এই দুনিয়ায় তুহিন আর ফুটবল দাদু –এই দু’জন বুবুনের খেলার ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছে । বাড়িতে অবশ্য সবাই ভয় পায়, তাই খেলার ব্যাপারে সবাই আপত্তি করে । 

ফুটবল দাদু ওর সাথে ফুটবলের একেকটা ভিডিও দেখার সময়ে বলে ওঠে, এই মুভটা দেখলে ... মনে রেখে দাও, সুযোগ আসলে এমনটা যেন করতে পারো । তুহিন আশা দিয়েছে – পরেরবার যদি টিমের ক্যাপ্টেন হয়... বুবুনের কথা বলবে, অন্তত ট্রায়ালে যদি চেষ্টা করা যায় । কিন্তু সে আশা পূরন হওয়া যে সহজ কথা নয় –বোঝে বুবুন ।  

দাদুর ছেলে স্বপনকাকু আমেরিকায় থাকে, বাবার ছোটবেলার বন্ধু । দাদু আমেরিকা গিয়ে ৯৪’র ওয়ার্ল্ড কাপের ম্যাচ দেখে এসেছিল । যদিও সেবারের চ্যাম্পিয়ান ব্রাজিল টিমটাকে দাদু তেমন পছন্দ হয়নি । দাদুর হিরো পেলে-গ্যারিঞ্চার ব্রাজিল । তার পরের পছন্দ জিকো-সক্রেটিস ... যদিও ৮২’র সেই টিম জিততে পারেনি, বলে দাদু কষ্ট পাওয়া মুখে হাসেন । তবে ৮৬’র মারাদোনাকে কেন যে দাদু তুলনায় একটু পিছিয়ে রাখে কে জানে । বুবুনের মনে হয় পেলের প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই হয়তো। বুবুন বোঝাতো, পেলের টিমের মতো টিম না পেয়েও মারাদোনা দেশকে কাপ তো দিতে পেরেছে । কথাটা শুনে দাদুর মুখে আলতো হাসি দেখে বুবুনের কষ্ট হয়, মনে পড়ে তার হিরো লিওনেস মেসিও ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে উঠেও হেরে গেছে ।

কিন্তু বুবুন তো মাঠে নামতেই পারে না । ফুটবল দাদু উৎসাহ দিয়ে বলে, কেন পারবে না... গ্যারিঞ্চা যদি একটা পা ছোট নিয়েও ওর’ম খেলা দেখাতে পারে, তাহলে তুমিই বা পারবে না কেন !   

বুবুন আর ওর দাদুর একটা প্রিয় বিনোদন হল কল্পনার টিম বানানো । পাড়ার খেলায় যেমন ডাকাডাকি করে দু’টো টিম খাড়া করা হয় – সেই কায়দায়। তবে সময়ের কোনও হিসেব নেই। ইতিহাস নেড়েঘেঁটে প্লেয়ার তুলে আনা হয় ।

দাদু প্রথমেই বলে দিয়েছে তার টিমের ক্যাপ্টেন যথারীতি পেলে । সাথে নিশ্চিতভাবেই থাকছে গ্যারিঞ্চা । শুনে বুবুন দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেছে, ওর টিমের ক্যাপ্টেন স্বাভাবিকভাবে মারাদোনা... সাথে থাকবে মেসি । দাদু বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠলো, মারাদোনাকে আটকাতে লোথার ম্যাথুস আর তার কোচ বেকেনবাউয়ার । বুবুন পাল্টা বলল, আমার টিমে স্ট্রাইকার থাকবে রোনাল্ডো... মিডফিল্ডে জিদানের সাথে রোনাল্ডিনোহ । দাদু খানিকটা অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন, আমার স্ট্রাইকার গার্ড মুলার সাথে ক্রুয়েফ ... আর জিকো সক্রেটিস তো থাকবেই । বুবুন হেসে বলল, এদের আটকাতে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে মালদিনি আর ক্যানভারো... রাইট ব্যাক কাফু আর লেফটে কর্লোস । এবার দাদু একটু যেন বিপদে পড়লেন । বললেন, বেশ... ডিফেন্সের ব্যাপারে জার্মান দুজনের সাথে লামকে রাখছি, সাথে গোলে থাকবে লেভ ইয়াসিন – বল গলতে দেবে না । বুবুন তার টিমের কিপার বাছলো বুঁফোকে ।

আর বেশীদূর কথা এগোনোর আগে মা বুবুনকে ডাকতে এসেছে কারণ পরের সপ্তাহ থেকে বুবুনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। ইউনিট টেস্টে ম্যাথসে ওর নম্বর ভালো হয়নি । তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুবুনকে উঠে যেতে হল ।

দাদু মাঝে মাঝে বলে, মানুষ ক্রমশ যেন যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে । সেটা অপছন্দ বলেই দাদুর টিমটা হয়েছে মূলত রোম্যান্সে ভর করে । বুবুনের টিমটায় ব্যালান্স বেশী । বুবুন খেয়াল করলো – দুটো টিমেই দশজন করে হয়েছে । হাতে আরেকটা করে জায়গা আছে ।

আরেকজন কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা এসে গেল। শেষদিনের অঙ্ক পরীক্ষাতেই সবথেকে টেনশান। যদিও বুবুনের মোটামুটি ভালই পরীক্ষা হল এবার । তুহিন যথারীতি ধেড়িয়েছে । এরপর ক’দিনের ছুটি । যদিও স্কুল খোলার পর বুবুন দেখলো তুহিন বেশ খুশি মনেই আছে । অঙ্ক পরীক্ষা তার মাথায় নেই । দেখে মনে হল, খুশির পরিমাণটা যেন খানিকটা বেশি । ওকে জিজ্ঞেস করে কারণটা বুবুন জানতে পারলো – অমিয়বাবু রিটায়ার করেছেন আর তার জায়গায় যিনি এসেছেন – তার নাম অর্ঘ্য রায় । ব্লু জিন্স আর টিশার্ট পরে স্কুলে আসেন, দেখতে একেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো । স্কুলের ফুটবল টিমের ব্যাপারে তুহিন নাকি ওনার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেছে । উনি ডিভিশান খেলা ফুটবলার এবং তুহিনকে ফুটবলের ব্যাপারে বেশ ইন্সপিরেশান জুগিয়েছেন। তাতেই বাবু ফুটবল নিয়ে নাকি নতুন করে স্বপ্ন দেখছে আবার ।

দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা গেল – তুহিন খুব বাড়িয়ে বলেনি । অর্ঘ্য স্যার লোকটা একদম আলাদারকমের। এই ক’দিনের মধ্যে ছেলেদের হিরো হয়ে উঠেছেন । উনি খুব দ্রুত একটা পরিকল্পনাও করে ফেলেছেন, স্কুলে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করার। আগেও ক্লাস অনুযায়ী টুর্নামেন্ট যে হতো না তা নয় । তাতে অসুবিধে ছিল – কিছু দল বেশী শক্তিশালী কিছু একদম দুর্বল । তাতে খেলা জমতো না । উনি নতুন যেটা করতে চাইছেন – সব দলের থেকে প্লেয়ার নিয়ে তাদের আটটা টিমে ভাগ করা । তাতে টিমগুলো ব্যালান্স হবে । টিমের নামগুলো বিখ্যাত ফুটবল খেলিয়ে দেশের নামে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড আর স্পেন । ক্লাসটিমগুলোর আটজন ক্যাপ্টেন লটারি করে দেশের নাম পাবে । তুহিন লটারিতে আর্জেন্টিনার নাম পেয়ে আনন্দে লাফালাফি করতে লাগলো । যেন টুর্নামেন্টটাই জিতে গেছে । বাকী তেরো জন নিয়ে টিমটা তৈরি হবে কয়েকটা ছোট ট্রায়ালের মাধ্যমে । সেগুলো টিমের ক্যাপ্টেনরা দেখে নেবে ।

হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় হেড স্যারও ব্যাপারটায় আপত্তি করেননি । মাঠ তদারকির কাজও শুরু হয়ে গেছে । বর্ষার সময় খেলাটা হবে ঠিক হয়েছে – জুনের শেষ সপ্তাহে । তুহিন বলছে দেখি আর্জেন্টিনাকে কে হারায় ! কিন্তু এতো উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যেও বুবুনের মন ভালো নেই । তার তো আর খেলা হবে না । আর তুহিন তার আর্জেন্টিনা টিম নিয়ে মেতে আছে, ওকে তার নিজের খেলার ইচ্ছের কথা বলতে কেমন যেন লজ্জা করছে । তাই এসব নিয়ে বেশী উৎসাহ দেখাচ্ছে না বুবুন । বরং ক্লাসে থাকছে বেশী, মাঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে না ।

তুহিনকে যতটা পাগল মনে হয় – সে তার থেকেও বেশী । বুবুনের ব্যাপারটা সে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও ভোলেনি । বরঞ্চ বিষয়টা নিয়ে অর্ঘ্য স্যারের সাথে কথা বলে রেখেছে । তাই শনিবার ছুটির পরে তুহিন যখন ওকে মাঠে যেতে বলল, বিশ্বাসই হয়নি বুবুনের । কিন্তু মাঠে গিয়ে দেখলো তুহিনের ব্যবস্থা পাকা । অন্য সবার ট্রায়াল যখন চলছে, অর্ঘ্য স্যার ওকে ড্রেস চেঞ্জ করে আসতে বললেন । মাঠের একটা সাইডে গিয়ে ওর থাই আর পায়ের মাসেল হাত দিয়ে টিপে তারপর পা ভাঁজ করে স্যার দেখতে লাগলেন । পাশে দাঁড়ানো তুহিনকে একটা বল নিয়ে আসতে বললেন । তুহিনকে উল্টোদিকে দাঁড় করিয়ে বুবুনকে গ্রাউন্ড শট নিতে বললেন । দু’চারটে শট নেওয়ার পর বল রিসিভ করতে করতে তুহিন চিৎকার করে উঠলো – খাসনি আজ ! তাহলে শটে পাওয়ার আসছে না কেন ? শুনে বুবুন যেন একটা ধাক্কা খেলো । পরের শটগুলোর স্পিড তুলনায় ভাল হল । স্যার কিছুটা প্রসন্ন মুখে তুহিনের সাথে ওকে স্প্রিন্ট টানতে বললেন । বুবুনের এবার একটু যেন ভয় ভয় করছে –পারবে তো ! কিন্তু তুহিন একরকম জোর করেই ওকে নিয়ে দৌড়তে শুরু করলো । শেষটায় মনে হল তুহিন ওর হাত ধরে টানতে টানতে উড়ছে।

ওরা যখন হাঁফাতে হাঁফাতে স্যারের কাছে পৌছোল... তখনও ব্যাপারটা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না বুবুনের । স্যার এবার সিরিয়াস মুখে বললেন, তোমাকে খেলতে গেলে নিয়মিত প্রাক্টিস করতে হবে । তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, বন্ধুকে নিজের টিমে নাও কিন্তু পুরো ম্যাচ নয়... একটা হাফ খেলাবে । উনি যে নিছক সান্ত্বনা দিচ্ছেন না সেটা বোঝানোর জন্য বুবুনকে বললেন, ভাইচুংকে প্রথম জীবনে এভাবেই খেলানো হতো ।

অবশ্য সেসব শোনার মতো অবস্থায় বুবুন আর নেই । তার চোখে জল এসে গেছে । মনে হচ্ছে জীবনের সব আশা আজ পূরণ হয়ে গেছে । ব্যাপারটা কিছুটা অর্ঘ্য স্যারও বুঝতে পারলেন । তাই দু’বন্ধুকে একা ছেড়ে দিয়ে মাঠের অন্যদিকে যাওয়ার সময় বলে গেলেন – আমি দেখতে চাই তোমরা আর্জেন্টিনাকে যেন জেতাতো পারো ।

পরীক্ষা আর তার পরের ছুটিতে মামারবাড়ি যাওয়ার কারণে মাঝের ক’দিন দাদুর কাছে যাওয়া হয়নি । আজও দাদুর সাথে কথা হল না । চোখ বুজে শুয়ে আছে, নাকে অক্সিজেন নল লাগানো । সিস্টার বেশীক্ষণ থাকতে দিল না । বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে এলো বুবুন । এখন চরম উত্তেজনার সময় । কাল থেকে প্রাকটিস ।

টুর্নামেন্ট শুরু হতে দেখা গেল – যতটা সহজ মনে হয়েছিল সের’ম নয় ব্যাপারটা । প্রতিটা দলই প্রাণপণে খেলছে । দু’টো গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে আটটা দলকে । প্রতি গ্রুপ থেকে দুটো করে টিম নিয়ে নক আউট রাউন্ড হবে । প্রথম ম্যাচে তাদের মুখোমুখি জার্মানি । ওই টিমে আছে বুবুনদেরই ক্লাসের সম্পদ । ও স্কুল টিমে খেলে কিন্তু তুহিনের সাথে বনিবনা নেই । প্রথম ম্যাচেই কড়া ট্যাকলের মুখে পড়ল তুহিন । একসাথে খেলার জন্য ওর খেলার ধাঁচটা সম্পদ জানে বলেই তুহিন বিশেষ সুবিধে করতে পারলো না । গোললেস ড্র হল । এই ম্যাচে চাপ আছে বলে বুবুনকে নামালো না তুহিন । তবে সাইডলাইনে বসে বুবুন লক্ষ্য করলো – কোথায় সমস্যা হচ্ছে । ম্যাচের পর তুহিনকে বলাতে সে বেশ খুশি... বলল, তুই ভালো অঙ্ক পারিস তো তাই চট করে ছকটা ধরে ফেলতে পারলি ।

পরের ম্যাচে তুলনায় দুর্বল প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড । এই টিমটা মোটামুটি হলেও হাল্কাভাবে নেওয়া যাবে না । জিততেই হবে কারণ আরেকটা ম্যাচে জার্মানি জিতে গেছে । এই ম্যাচে বুবুনের বুদ্ধিমতো তুহিন মিডফিল্ডে পাঁচজনকে রাখলো । সামনে তার সাথে থাকবে দু’ক্লাস নীচের সুমিত । ছেলেটা বেশ জোরে ছুটতে পারে । খেলা শুরু হতে দেখা গেল আর্জেন্টিনা মাঝমাঠের দখল বেশ ভালোভাবে নিয়ে নিয়েছে । ফার্স্ট হাফে একটা গোল পেয়ে গেল সুমিত । পরের হাফে বুবুন নামলো । তুহিন ওকে কিছুটা পেছনে খেলতে বলল ।

খেলার শুরুতে বুবুন যতটা ছটফট করছিল এখন যেন ততটা জোর পাচ্ছে না । দুএকবার ধাক্কা খেয়ে বল ধরতে পারলো না। তবে বুদ্ধি করে একটা পাস বাড়ালো, তুহিন সেটা থেকে লং শটে একটা গোল করে দিল ।

পরেরটা ইংল্যান্ড ম্যাচ । কিন্তু জার্মানি দুটো ম্যাচ জিতে নেক্সট রাউণ্ডে চলে গেছে । আরেকটা গ্রুপ থেকে স্পেন উঠে গেছে। সুতরাং লাস্ট ম্যাচটা ডু ওর ডাই । আগের খেলাগুলো দেখে ওরা বুঝে গেছে ইংল্যান্ড টিমটায় অ্যাটাকিং মুভ নেই, যেটা করছে – নিজেদের গোলের সামনে পায়ের জঙ্গল তৈরি করে গোল খাচ্ছে না । 

তুহিন অল আউটে যেতে চায় । মিডফিল্ডে পাঁচজন সাথে বুবুন । সামনে সে আর সুমিত । দুজন ডিফেন্ডার সমরেশ আর দীপঙ্কর শুধু গোল ছেড়ে উঠবে না । ফার্স্ট হাফে কাজের কাজটা করে ফেললো তুহিন । একটা ফ্রিকিক থেকে দারুণ গোল করলো । যদিও বুবুন বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে দু’তিনবার পড়েছে । ফ্রি কিকটা তাকে ফাউলের কারণেই পাওয়া গেছে বলে ব্যাথা সত্ত্বেও বেশ গর্বিত মনে হল তাকে ।

নকআউটের ম্যাচ জার্মানির সাথে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সাথে স্পেন । স্পেন টিমটাকে নিয়ে তুহিনরা মিটিংয়ে বসলো । বুবুন বেশ ভালো অ্যানালিসিস করছে । এদের সাথে কাউন্টার অ্যাটাকে খেলাই ভালো । মানে সোজা কথায় টিমটায় ফাঁকফোকর বিশেষ নেই আবার অসাধারণ কোনও প্লেয়ার নেই । তুহিন খানিকটা মেনে নিয়ে ৪-৪-২ ছকে ফিরে যেতে রাজী হল । প্রথমে বুবুন নামছে না বদলে এতদিন তেমনভাবে না খেলা গোঁয়ার প্রকৃতির অর্ণবকে নামানো হচ্ছে মূলত ওদের খেলাটা নষ্ট করে দেবার জন্য । এই প্ল্যানটা বুবুনেরই । যদিও তুহিন গায়ের জোরে ফুটবল পছন্দ করে না । তবু মেনে নিলো । দেখা গেল ম্যাচে সেটাই সবথেকে কার্যকারী হয়েছে । অর্ণবের কড়া ট্যাকলের কারণে স্পেনের মিসপাস হতে লাগলো, সের’ম একটা ধরে নিয়ে সুমিত গোল করে বেরিয়ে গেল । সেকেন্ড হাফে স্পেন চেপে ধরলেও তুহিন ততক্ষণে চেগে গেছে । তার ড্রিবলে যেন লেখা ছিল জার্মানির সাথে আসন্ন ফাইনালের পূর্বাভাস ।

ফাইনালের আগে অর্ঘ্য স্যারও তুহিনকে বলল, ওভার কনফিডেন্স ভালো নয় ... মনে রেখো ৮৬’তে হারার পরে ৯০’তে ওরা মারাদোনাকে হারিয়ে দিয়েছিল । ফাইনালের গেমপ্ল্যানের সময়ে বুবুনের সাথে একটু রাগারাগি হয়ে গেল তুহিনের । ও মাঝে মাঝে নিজের ব্যাপারে এতো বেশী ভেবে ফেলে যে কোনও যুক্তি মানতেই চায় না । বুবুন বোঝাতে চেয়েছিল তুহিন একটু পেছনে থেকে শুরু করুক কারণ ওকে ওরা টার্গেট করবে । কথাটা তুহিনের মানে লেগেছে – মেসিকে কি কেউ নেমে খেলতে বলে !

দাদুর চোখ খোলা কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থা নয় । তবু একদমে তার কথাগুলো বুবুন বলে এলো । দাদু কিছু না বললেও বুবুনের মনে হল – দাদু শুনেছেন । তাই যেন মুখে একটা খুশির ভাব ।

রাতে বুবুনের স্বপ্নে আবার সেই ম্যাচটা ফিরে এল । মারাদোনা ভার্সেস পেলে । শুধু এই দু’জন নয় । আজ প্রায় সব প্লেয়ারকেই দেখতে পাচ্ছে বুবুন । এত স্পিডে খেলা হচ্ছে, যেন মনে হচ্ছে সবাই বাতাসে উড়ছে । জিদান দু’বার চেষ্টা করেও বেকেনবাউয়ারকে টলাতে পারলো না । সক্রেটিসের পাস থেকে পেলে গোল করে দিল । রোনাল্ডোকে দেখতে পেল দারুণ একটা হেড নিল মারাদোনার করা ফ্রিকিকে । কিন্তু ইয়াসিন উড়ে গিয়ে আটকে দিল । পরের হাফে মেসি সবাইকে কাটিয়ে যখন গোলের দিকে এগোচ্ছে, কোথা থেকে একজন এসে সাইড ট্যাকল করে ফেলে দিল । অবাক হয়ে বুবুন দেখলো, লোকটাকে দেখতে ঠিক দাদুর অল্পবয়সের ছবির মতো । ক্রমশ ম্যাচ যতো শেষের দিকে যাচ্ছে বুবুন বুঝতে পারছিল দাদুর টিমের কাছে তার টিম হারতে চলেছে । কিন্তু শেষ মুহূর্তটায় তুহিনকে দেখতে পেল বুবুন । সে প্রবল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রোনাল্ডিনোহর সাথে পাস খেলতে খেলতে ।

ঠিক এই মুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে গেল বুবুনের । মনটা খারাপ হয়ে রইল । মনে হল... তুহিন কি কাল পারবে !

ফাইনালের দিন স্কুলে উৎসবের মতো ব্যাপার । দু’টো টিমের জন্য জার্মানি আর আর্জেন্টিনার নতুন জার্সি এসেছে । ওদের ক্লাসের ছেলেরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে – একদল তুহিনের দিকে আরেকদল সম্পদের সঙ্গে । নতুন জার্সি গায়ে যখন ওরা মাঠে নামবে ঠিক তখনই বেশ মেঘ করে এল । কিন্তু তাতে কারোর উৎসাহে কমলো না । তুহিন ১০ নম্বর জার্সিটা পরে নিজেকে স্বয়ং মেসি ভাবতে শুরু করেছে ততক্ষণে । উল্টোদিকে সম্পদও ফুটছে । বুবুনকে নামানো হয়নি ।

খেলা শুরুর বাঁশি বাজতেই গোটা মাঠ উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো । সমানে সমানে টক্কর শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ণবকে তুলে নিতে হল, কারণ ওকে প্ল্যান করে ফাউল করছে ওরা। তুহিনের ড্রিবল গিয়ে আটকে যেতে লাগলো সম্পদের ট্যাকলের সামনে । আশার কথা সমরেশও ডিফেন্স দিয়ে বল গলতে দিল না । ওদের মাঝমাঠ আটকাতে সম্পদ দুজনকে ডিফেন্সিভ স্ক্রিন খেলাচ্ছে । ফ্রিকিক পেলেও তুহিন সুবিধে করতে পারলো না । তার মধ্যে সুমিত একটা সহজ সুযোগ মিস করলো ।

সেকেন্ড হাফে বেশ দিশাহারা অবস্থা । গোলের কাছে পৌছনো যাচ্ছে না । তুহিন খানিকটা বিরক্ত হয়েই সুমিতকে তুলে বুবুনকে নামিয়ে দিল । এই চেঞ্জের ফলে জার্মানি আরও চেপে বসলো ম্যাচে । তুহিন নিজেই খোঁড়াতে শুরু করলো চোট পেয়ে । খেলা শেষের দিকে যাচ্ছে । ট্রাইব্রেকারে গেলে জার্মানির আডভান্টেজ কারণ ওদের গোলে থাকা অভীক স্কুলের সেরা কিপার।

হঠাৎই বুবুনকে সম্পদ ফেলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো । চোখে অন্ধকার দেখছে বুবুন । কিন্তু পরের মুহূর্তেই ওর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, উঠে দাঁড়িয়ে তুহিনকে কিছু একটা ইশারা করে ফ্রিকিক নিতে ছুটলো । বলটা তুহিনকে পাস করে দিল ও । আর তুহিন সব ব্যাথা ভুলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে লাগলো, সঙ্গে বুবুনও । কাল রাতের স্বপ্নের মতো অবিকল । তুহিন গোলটা করার সময় বুবুন গোলপোস্টের পাশে যেন একঝলকের জন্য দাদুর হাসিমুখের ছবি দেখলো । ততক্ষণে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ।

কাপ হাতে যখন তুহিনের সাথে টিমের সবাই যখন ছবি তুলছে তখন কেউ লক্ষ্য করলো না বুবুন ফুঁপিয়ে কাঁদছে । চ্যাম্পিয়ান টিমের মেডেল নিয়ে পাড়ায় ফিরে বুবুনের কান্না আরও বেড়ে গেল যখন দেখলো দাদুর বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড় । ততক্ষণে মোহনবাগানের ফ্ল্যাগ এসে গেছে দাদুর শরীরটা ঢাকা দেওয়ার জন্য । ওনার মুখে লেগে থাকা হাসিটা বুবুন একাই দেখতে পেল ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational