লেভেল জিরো
লেভেল জিরো
ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়ালের রেজাল্টের পর স্কুলে পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ের পর বাড়িটা হিরোসিমার চেহারা নিয়েছিল । বিষয়টা যদিও তেমন গম্ভীর ছিল না । ভাল লাগে বলে সুনন্দ ইতিহাস স্যারের প্রিয়পাত্র । ইতিহাসের অনেক গল্প হয়, স্যার সিলেবাসের বাইরের নানা কথাবার্তা ওর সাথে বলেন । এই স্যার ক্লাস টিচার । তাই বাবাকে আলাদা করে ডেকে সেসব খুশি হয়ে জানিয়েছিলেন । আর বলেছিলেন, সুনন্দকে যেন খুশি মতো বিষয় নিয়ে পড়তে দেওয়া হয় ! যদিও সব ব্যাপারের মতো এক্ষেত্রেও বাবা উল্টো বুঝেছে – সুনন্দের দ্বারা টেকনোলজি বা ম্যানেজমেন্ট হবে না, তাই আর্টসের স্যার ওকে ফেভার করে । সেটাও বেশ খানিকটা অপরাধ ! সুনন্দ যে কম্পিউটারে ক্লাসের সবার থেকে বেশী মার্কস পেয়েছে, সেকথা বাবা গুরুত্ব দেয়নি । বড়রা অনেক কথা ভুল বলে, তাতে কিছু নয় - যত দোষ ওর মতো টিনএজারদের । সুনন্দ জানে, ক্লাস এইটে পড়ে এইরকম গঞ্জনায় দুঃখ হলেও কাঁদা যায় না ।
এইসব সময়ে দাদুকে ও খুব মিস করে । উনি থাকলে বাবার সব কথা থামিয়ে দিতে পারতেন । ওর ওপর বাবা বেশী চেঁচালেই বলে উঠতেন, নিজে তো সায়েন্স ছেড়ে কমার্স নিয়েছিলে কোনওক্রমে একটা ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি নিয়ে কিসব বিক্রিবাটার চাকরি করো ... ভুলভাল ধারণা ছেলের মধ্যে তৈরি করবে না একদম । সুনন্দ জানে, ওর দাদু ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন । তাই তিনি যে কথা বলতে পারতেন, সুনন্দ তো আর সেসব বলতে পারবে না । তবে দাদু ওকে বলে গেছিলেন, তোমার মধ্যে আলাদা একটা জিনিস আছে... কোনও চাপের সামনে মাথা নীচু করবে না । নতুন দিনের স্বপ্ন তোমাদের মতো ছেলেদের হাত ধরেই আসবে । সেটা যে কী, জানে না সুনন্দ । তবে মনে হয়, সেটা এমন একটা জিনিস যখন ‘স্কুলের ছেলেরা কিছু বোঝে না’ কেউ বলবে না ।
এসব আলোচনা একদিন শুনতে পেয়ে মা বলেছিল – বুড়ো মানুষের সাথে তোমার কিসের এতো কথা ! নিজের হোমটাক্স শেষ করো । শুনে দাদু মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন, ডিস্টান্সে একটা হাবিজাবি এমএ করে মিডিয়ায় মিথ্যে কথা বলে এসে ছেলের ওপর বিদ্যে ফলাচ্ছে !
এখন সুনন্দ স্কুল কোচিং নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত । স্কুল থেকেই বলে দিয়েছে – ক্লাস এইট থেকে পেন্টিং মিউজিক আউটডোর গেম সব বন্ধ । তাই ওর খেলা বা ছবি আঁকার সুযোগ নেই । তবে পেন দিয়ে খাতার শেষের পাতাগুলোয় মাঝেমাঝে হিজিবিজি কাটে । দাদুর কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে থাকে সুনন্দের । তিনি চলে যাওয়ার পর থেকে তাকে আলাদা করে কেউ গুরুত্ব দেয় না বলে মনে হয় ওর । বাবার সাথে কথা বলার সুযোগ নেই । অফিসের কাজে বাবা কোথায় কখন থাকে তারও ঠিক নেই । মা অফিস থেকে ফিরেও নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকে ।
দাদুর নাম করা পর্যন্ত এখন বেআইনি হয়ে গেছে এ বাড়িতে । দাদু কোথায় যে গেছে, সেটাও সঠিক জানে না কেউ । তবে দেশে নিয়ম হয়ে গেছে মানুষের সময় ফুরিয়ে গেলে তার কথা ডেটাবেস থেকে মুছে দেওয়া হবে । মানুষের মন থেকেও বোধহয় । যাওয়ার আগে দাদু ওকে বলে গেছিলেন, আমি বিজ্ঞানের সাথে কল্পনার গুরুত্বও বুঝি... মানুষের বাঁচার সাথে প্রকৃতির গান শোনাও জরুরি । চাপা গলায় বলেছিলেন, তোমার মধ্যে যে সম্ভবনা আছে, সেটাকে বাঁচিয়ে রেখো । কিন্তু সুনন্দ ঠিক জানে না সে কি করবে ! স্কুলে যায়, হিজিবিজি আঁকে, নিয়ম মানে... আবার ফাঁকফোকর পেলে নিয়মের বাইরে চলে যায় ।
*
নতুন খোঁজ পাওয়া এই অনলাইন গেমটা খেলতে বসে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সুনন্দ । যখন তার নিজস্ব দেশ পিছিয়ে পড়লে, জেদ চেপে যাচ্ছে । আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে সেই রাউণ্ডটা । এখন ও সপ্তম লেভেলে আছে । বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঘটছে রাজত্বে, হেরে না গেলেও বারবার যুদ্ধবিগ্রহে ক্ষয়ক্ষতির কারণে যে দেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, বেশ বুঝতে পারছে সুনন্দ । ও একটা কথা বুঝতে পারছে, বইতে পড়া যুদ্ধের কাহিনী কল্পনা করতে বেশ ভাল লাগলেও সেটাই শেষ কথা নয় । রাজার আসল কাজ দেশের সব মানুষকে খুশি করা । কিন্তু সেটা কি সত্যিই সম্ভব, বুঝতে পারে না ও । তার কিশোর বুদ্ধিতে সব ঘটনার সমাধান পায় না সুনন্দ ।
যদিও স্কুল থেকে ঠিক করে দিয়েছে খেলার সময় রবিবার এগারোটা থেকে বারোটা । স্কুল থেকে ফিরে ও অবশ্য রোজই ফাঁক পেলেই গেমটা চালু করে দেয় । একেকটা লেভেলের পর তীব্র স্বরে ‘তখখা’র মতো শুনতে একটা সাউণ্ড এফেক্ট দেওয়া আছে । ফাঁকা বাড়িতে ভেসে বেড়াতে থাকে শব্দটা । দাদুর মুখে শোনা গল্পে তক্ষকের ডাক বোধহয় এরকমই শুনতে ছিল । শুনশান দুপুরে ডাকটা শুনে সুনন্দ মাঝেমাঝে শিউরে ওঠে ।
গেমটার মোট পনেরোটা লেভেল । তবে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা, লেভেলগুলো এক থেকে শুরু নয় – শুরু হচ্ছে পনেরো থেকে । পনেরো থেকে চোদ্দ তেরো...ইতিহাসের সময়কাল অনুযায়ী এগোচ্ছে গেম। পাল্লা দিয়ে জটিল হচ্ছে গেমটা । আগে অনেক গেম খেলেছে সুনন্দ কিন্তু এই প্যাকেজটা একদম অন্যরকম । খানিকটা আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপারও বটে । সেজন্যই হয়তো এতো আকর্ষনীয় । একটা করে লেভেল একেকটা ঐতিহাসিক যুগের ঘটনার আদলে গড়া । দেশ গড়ে তুলতে হবে, তার সীমানা রক্ষা করতে হবে, সেনা অস্ত্র ফসল খনিজ সব জোগাড় করতে হবে । সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করা আছে । আছে অন্য রাজ্যের আক্রমণের ভয় কিংবা ষড়যন্ত্রের সন্দেহ । রক্ষা করতে হবে দেশের মানুষ, সেনাবাহিনী এবং সম্পদকে ।
সুনন্দ নিজেকে মাঝে মাঝে রাজা বলে ভাবে । তাকে সাহায্য করছে ভার্চুয়াল রানী । একটা মেসেজ ফিরে ফিরে আসছে, যেখানে সুনন্দকে বলা হচ্ছে – এ খেলায় তার স্কোরটাই এখনও সর্বোচ্চ । আরও অদ্ভুত ব্যাপার যেটা, শেষ রাউণ্ডটা নাকি ডিফাইণ্ড নয় – সেটা নাকি রিয়েল টাইম । ‘লেভেল জিরো’ । সেখানে যে কী হবে কেউ বলতে পারে না । কয়েকটা রাউণ্ড টপকানোর পর সুনন্দ বুঝতে পারছে – লেভেল পনেরো থেকে এক পর্যন্ত গেমটায় প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের জানা ইতিহাস অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়েছে। লেভেল জিরোয় বোধহয় আগামীর কথা । সেটা কি তবে সুনন্দের ওপরেই নির্ভর করছে ! ও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না পুরোটা ।
*
স্কুল থেকে বেরিয়ে ফেরার বাসটা না দেখতে পেয়ে একা হাঁটছিল সুনন্দ । ওর মনটা ভাল নেই আজ । ম্যাথসের ক্লাসটেস্টে কম মার্কস পেয়েছে । বাড়ি গিয়ে সেই অশান্তি, এক কথা শুনতে হবে – ইন্টারন্যাশানাল স্কুলে ভর্তি করা বৃথা ! সুনন্দ বুঝতে পারে না – প্রত্যেকের বাবা মা ছেলেকে ফার্স্ট দেখতে চায়, সেটা কি আদৌ সম্ভব ! ওর বলতে ইচ্ছে করে, ছোটবেলায় কাকে কোন স্কুলে ভর্তি করা হবে সেটা তো তার জানার কথা নয় ।
সুনন্দ জানে বাসটা আসে ব্রিজের ওপাশ থেকে । ওদিকটায় কেউ বিশেষ যায় না । সেখানে গ্যারেজ, লোহালক্করের গোডাউন আর কিছু গরীব লোকের ঘরবাড়ি আছে । জায়গাটার কথা শুনলেও কখনও যায়নি সুনন্দ । এলোমেলো হেঁটে ও ব্রিজের মাঝামাঝি চলে এসেছিল আজ । হঠাৎ একটা লোকের সাথে চোখাচোখি হল । লোকটা মুখে অনেকদিনের পরিচিত মার্কা একটা হাসি ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।
লোকটা আচমকাই বলে উঠল, তোমার দাদুর থিয়োরি অনুযায়ী দুনিয়াটা একদিন বদলে যাবে । হঠাৎ দাদুর কথা শুনে সুনন্দের চোখে জল এসে গেছিল সুনন্দ । লোকটা বুঝতে পেরে বলল, চিন্তা নেই... ওনার সাথে তোমার দেখা করানোর জন্য আজ সেন্ট্রাল সিস্টেমের সময় পিছিয়ে দিতে হয়েছে । তাই তোমার বাসটা আসেনি । একটু থেমে লোকটা বলল, কে বলতে পারে... সেই অভিপ্রায়েই হয়তো তুমি এদিকে হাঁটছিলে । লোকটার সব কথা সুনন্দের মাথায় ঢুকল না । তবে দাদুর কথা শুনে ওকে অনুসরণ করে ও নিঃশব্দে চলতে লাগলো ।
কিছুটা হাঁটার পর দেখল, এখানে পুরনো চেহারার সারিসারি সব বাড়িঘর । যেখান দিয়ে ওরা হাঁটছিল, সেটাকে একটা বাজার অঞ্চল বলে বুঝলো সুনন্দ । যদিও ওরা যেসব জায়গা থেকে মার্কেটং করে এগুলো তেমন নয় । খোলা রাস্তায় রঙ বেরঙের কাপড় দিয়ে সাজানো চালা করা দোকানে নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে । লোকটা ওর আগ্রহী মুখ দেখে বলল, তোমায় ফালুদা খাওয়াবো একদিন... খাওনি তো কখনও ! একটা দোকান থেকে খুব ধোঁয়া বেরোচ্ছে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সুনন্দ । লোকটা বলল, তোমার দাদু সেঁকা মাংস খুব ভালবাসে... এখন তোমাদের ওখানে এসব বেআইনি করে দিয়েছে । সবাই ক্যালরি মেপেঝুপে চলে তো । সুনন্দ খুব বেশী কিছু না বুঝলেও এটা বুঝেছে – সে অদ্ভুত একটা জায়গায় এসে পড়েছে । যেখানে অন্য কারো আসার অনুমতি নেই ।
গলির মধ্যে একটা একতলা বাড়ির সামনে ওরা এসে থামল । এর’ম বাড়ি শুধু ছবির বইতেই দেখেছে সুনন্দ । দরজা দিয়ে ঢুকে ঘরে এসে দেখল – দাদু শুয়ে আছে একটা সিঙ্গেল খাটে । গায়ে চাদর চাপা । কয়েকজন লোক ওনাকে ঘিরে আছে । তারা সবাই বয়স্ক হলেও চেহারা বেশ শক্তপোক্ত । মুখচোখে একরোখা ভাব । সুনন্দকে দেখে দাদু উঠে বসলেন । মুখে একটা আশ্চর্যরকম খুশি । হেসে পাশের জায়গায় চাপড় মেরে ওকে বললেন, এখানে বসো । পাশে বসতেই দাদুর গায়ের সেই আশ্চর্য গন্ধটা পেল সুনন্দ । দাদু বলেছিল, সুগন্ধি ফুল থেকে তৈরি করা আতর । রাতে এসব ফুল ফোটে, রাতেই কারিগররা আতর তৈরি করে । সেসব এখন খুব সহজে পাওয়া যায় না ।
দাদু ওর পড়াশোনা স্কুল খেলাধুলো ছবি আঁকার খবর নিলেন । বিস্তারিত শুনে উনি বিশেষ খুশি হলেন না । ভুরু কুঁচকে রইল ওনার । তারপর পাশের টেবিল থেকে একজনকে কিছু একটা দিতে বললেন । সুনন্দ দেখলো পুরনো খবরের মলাট দেওয়া একটা বড়মতো বই । দাদু ওর দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটাই এই বইয়ের বেঁচে থাকা শেষ কপি... তোমাকে এখান থেকেই খুঁজে নিতে হবে রহস্যের সমাধান । সুনন্দ হাতে নিয়ে দেখলো, বইটার নাম - ‘দ্য জায়েন্ট ব্ল্যাক বুক অফ কম্পিউটার ভাইরাসেস’ । লেখকের নাম – মার্ক লুদউইগের । খানিকটা অবাক হয়ে ও দাদুর দিকে তাকালো ।
ভাইরাস নিয়ে লোকজন এখন আর বিশেষ চিন্তা করে না । ভাইরাস সংক্রান্ত সব গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । কোনও ব্যাপারেই ছকের বাইরে কিছু করা যায় না । তার মনের জিজ্ঞাসা বুঝতে পেরেই দাদু বলল, এটাই তো লক্ষ্য ওদের... সব ধরণের নতুন প্রশ্নকে সমূলে উৎপাটিত করা । নয়তো গলদ ধরা পড়ে যাবে যে । মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অভাব যাতে বুঝতে না পারে তাই নানা নিয়ম করে সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া । আর আপত্তি তুললেই আইসোলেটেড করে দেওয়া । একটানা চড়া সুরে কথাগুলো বলার পর একটু থেমে দাদু বললেন, সার্ভারের সব রেকর্ড নষ্ট করে দিতে পারলে তবেই এই যান্ত্রিক কাঠামোটা ভেঙে পড়বে । আমি অনেকদিন থেকেই জানি, সে সম্ভবনা তোমার মধ্যে আছে । আমার জিনের সূত্রে প্রাপ্ত বিজ্ঞান আর তোমার কল্পনা মিলে জন্ম নেবে নতুন ইতিহাস ।
সুনন্দের মনে হল, আশপাশের সব লোক দাদুর এই পরিকল্পনাটা জানে । তাই তারা এতক্ষণ নীরব থাকলেও দাদুর মুখে আশার কথা শুনে জয়ধ্বনি করে উঠল । কোথা থেকে তীব্র স্বরে কী যেন ডেকে উঠল, ' তখখা... ' । হঠাৎ এই ডাক শুনে অবাক হওয়া সুনন্দ নোনাধরা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আবিস্কার করলো সড়সড় করে টিকটিকির মতো কী যেন দেওয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছে । দাদু মৃদু হেসে বললেন, প্রতিটা মিথের সাক্ষ্মী থেকে যায় ওটা ।
কানে তক্ষকের সেই তীব্র শব্দের রেশ নিয়ে সুনন্দ আবিস্কার করলো, সে বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে... বাসটাও এসে গেছে । ক্লাসের সবাই দৌড়দৌড়ি করে বাসে উঠছে ।
*
মাইথোলজি নিয়ে দাদুর খুব আগ্রহ ছিল । ছোট হলেও সুনন্দকে নানারকম গল্প শোনাতেন উনি । এলিয়েন নিয়ে নানারকম কথা বলতেন । সবকিছু এখন আর মনে নেই। তবে এটা সুনন্দের মনে আছে, উনি বলতেন- আদিম মানুষ থেকে বুদ্ধিমান মানুষ হওয়াটা নাকি তাদেরই হাত । আদিম মানুষকে শিখিয়ে পড়িয়ে তারা সভ্য মানুষ করে তুলেছিল । তারাই যে রাজা হয়ে মানুষকে পথ দেখিয়েছে তার নমুনাও অনেক জায়গায় পাওয়া যায় । ফ্যারাওরা নাকি সের’ম এলিয়েন ছিলেন, আমাদের রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণও তাই । সাধারণ মানুষ তাই তাদের দেবতা বলে ভাবতো ।
দাদুর এসব কথা যদিও অন্যরা বিশ্বাস করতো না । বাবা মাকে সুনন্দ বলাবলি করতে শুনেছে, বয়সকালে ভীমরতি ধরেছে... নয়তো একজন বিখ্যাত ফিজিস্কের প্রফেসর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় ! শুনে সুনন্দের খারাপ লাগতো । দাদুও ওদের মনোভাব জানতেন । তাই বলেছিলেন, ওসব মুর্খের ভাবনা... আজকের মানুষও সেইসব এলিয়েনের জিন বহন করে চলেছে । নয়তো কোন ব্যাপারেই কোনও নতুন আবিস্কার হতো না । শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সুনন্দ । দাদু হেসে বলেছিলেন, আমার মধ্যেও সে প্রভাব আছে বলে বুঝতে পারি...অঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী তোমার মধ্যেও সে সম্ভবনা আছে । সুনন্দ অবাক হয়ে বলেছিল, তাহলে বাবা ! দাদু একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ওর হাবভাবে একেবারে আদিম প্রভাব... আর জিনের এই বৈশিষ্ট্য এক পুরুষ পরপর প্রকট হয় । বায়োলজিতে জিনের কথা এখন পড়েছে সুনন্দ । তবে দাদু যে ঠিক কোন বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেন, বুঝতে পারেনি ও ।
একা বসে এসব কথা ভাবলে এখন খানিকটা অবাক লাগে সুনন্দের । কাউকে বলতেও পারে না এসব । স্কুলে জানাজানি হলে নিশ্চয় ওকে সার্ভিসসেন্টারে পাঠিয়ে দেবে । পুরোটা না জানলেও সুনন্দ শুনেছে, সেখান থেকে কেউ সহজে আর বাড়ি ফেরে না । নিয়মের বাইরের কথা বলা বা আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখা কিংবা নিষিদ্ধ বইপত্র পড়া সবকিছুর জন্যেই সেখানে একা অনেক বছর আটকে থাকতে হয় । ডাক্তারেরা ইঞ্জেকশান দিয়ে ভুলিয়ে দেয় সব উল্টোপাল্টা কথাবার্তা । সবকিছুই হয় সেন্টাল সার্ভার বলে একটা বিরাট যন্ত্রের নজরদারিতে । যার ক্ষমতা সুপার কম্পিউটারের কয়েক মিলিয়ান গুণ ।
সুনন্দ শুনেছে, প্রতি মুহূর্তের ঘটনা স্টোর করা থাকে ওখানে । সেইসব নথিপত্র বিচার করে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই চলতে বাধ্য । সেই অনুযায়ী দেশ চলে বলে, যে কোনও বিরুদ্ধ মতের প্রতি নির্মম ব্যবস্থা নেয় সেন্ট্রাল সার্ভার ।
কথাটা মনে পড়তেই দাদুর থেকে পাওয়া সেই বইটার কথা মনে পড়ে গেল সুনন্দের । সেদিন বইটা বুকশেলফের পেছন দিকে সে লুকিয়ে রেখেছিল । আজ বইটা নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে লাগলো । দু'এক পাতা পড়ার পর খানিকটা অবাকও হয়ে গেল । এত সহজে কারোর সিস্টেমে ঢুকে পড়া যায় !
এই বয়সে যেকোনো নিষিদ্ধ কাজের দিকেই বেশী উৎসাহ থাকে । তাই কম্পিউটার অন করে সোস্যাল সাইটে ঢুকে সুনন্দ দেখলো স্কুলের বেশীরভাগ বন্ধুই অন আছে । বই থেকে দেখে একটা টেক্ট ফাইলে @Echo off Del C: *.* |y লিখে সেটাকে .bat ফাইল হিসেবে সেভ করে মিকিকে মেসেজ করে দিল । এটা আসলে একটা ভাইরাস । লক্ষ্য করলো মিকি অফ হয়ে গেল । পরমুহূর্তেই সুনন্দের মনে হল, এটা করা বোধহয় ঠিক হল না । মিকি যদি সবাইকে বলে দেয় !
সারারাত টেনশানে কাটানোর পরের দিন স্কুলে মিকি ওকে জিজ্ঞেস করছিল, কাল কি পাঠিয়েছিলি রে ? মেশিন ফরম্যাট হয়ে গেছে বলে বুঝতে পারিনি । তবে একটা ব্যাপার সুনন্দ বুঝতে পারলো মিকি ব্যাপারটা ধরতে পারেনি । মিকির খুব একটা বুদ্ধিসুদ্ধি নেই । আর ভাইরাস জিনিসটাকেই আজকাল কেউ ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না । বুঝে সুনন্দের মুখে চাপা একটা হাসি খেলে গেল ।
তারপর থেকে সে কয়েকজন বন্ধুর ওপর ভাইরাস সংক্রান্ত নানারকম পরীক্ষা করে দেখেছে । কেউই কিছু বুঝতে পারেনি কিন্তু ও তাদের মেশিনে খুব সহজেই ঢুকে পড়তে পেরেছিল । কয়েকদিনের মধ্যে সুনন্দ বুঝতে পারলো, গেমটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে তাকে এই পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে । সোশ্যাল সাইটে লগইন করে গেমটা যেহেতু খেলতে হয় তাই ব্যাপারটা আরও সুবিধের । সবাই ইন্টারনেটে কানেক্টেড থাকার জন্য তাদের মেশিনে ঢুকে যাওয়া খুব সহজ ।
এভাবে দ্রুত চারটে রাউণ্ড পেরিয়ে গেল সুনন্দ । স্বাভাবিকভাবে শেষ তিনটে রাউণ্ডের ডিফিকালটি লেভেল অনেকটাই বেশী । তবে এখন ও বিশেষ একটা হেল্প অপশন পাবে । নানারকম অপশন আছে । এক মিলিয়ন সেনা, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র, শস্য ভাণ্ডার অথবা একজন নিরস্ত্র পরামর্শদাতা । তার চেহারাটা খুব সুন্দর, গায়ের রঙ নীল । হঠাৎ দাদুর মুখে শোনা মাইথোলজির কথা মনে পড়তে অপশন হিসেবে সুনন্দ চয়েস করলো ওই মায়াময় মানুষকেই ।
*
তৃতীয় রাউণ্ডে গেমটায় এসে একটা কথা সুনন্দ বুঝতে পারলো – এখন তার কোনও মানুষ প্রতিযোগী নেই । কেননা এই লেভেল পর্যন্ত কেউই পৌঁছতে পারেনি । যা বাঁধা আসছে – নানারকম সিস্টেমের কাছ থেকে । যাদের ক্ষমতা মানুষের থেকে অনেক বেশী । অ্যাকুরেসিও অনেকটা বেশী । তবু কিভাবে যেন পরামর্শদাতার অদ্ভুত সব মুভের কারণে সহজেই জিতে গেল সুনন্দ । থার্ড লেভেল টপকাতে তার এক সপ্তাহ সময় লাগলো ।
একটা কথা সুনন্দ ধরতে পারছে, তাদের কানেকশানটা কোনও কারণে সেন্ট্রাল সার্ভারের নজরদারির বাইরে । নয়তো এতদিন করা ভাইরাস নিয়ে কাজকর্ম কিংবা লাগাতার এই গেমের রিপোর্ট তার কাছে কি থাকতো না ! সুনন্দের মনে হল- দাদু সম্ভবত এমন ব্যবস্থাটা করে গেছিলেন, যাতে কেউ তার কাজকর্মের নাগাল কেউ না পায় । সুনন্দ বুঝে গেছে, এই গেমটা জেতা না জেতা তার ওপর নির্ভর করছে না । মূলত লড়াইটা হচ্ছে- সেন্ট্রাল সার্ভারের ক্ষমতার সাথে তার দাদুর মতো বুদ্ধিমান মানুষের আত্মবিশ্বাসের । সে লড়াইতে নেমেছে বটে, কিন্তু তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওই নীল মানুষটা ।
সেকেন্ড রাউণ্ডে এই গেমটা আরও অদ্ভুত । প্রতিটা ক্ষেত্রেই দু’টো করে পথ পাওয়া যাচ্ছে । দুটোর কোনওটাই ভুল নয় । কিন্তু একটা মেসেজ আসছে – ‘এই রাউণ্ডের ওপরেই নির্ভর করছে পরের রাউণ্ডটার সাফল্য’ । সুনন্দ বুঝতে পারলো যে পথটাকে এখন সহজ মনে হচ্ছে – সেটা পরের রাউণ্ডে ওকে ঠেলে দিতে পারে পরাজয়ের দিকে । তাই খুব সাবধানে এগোতে লাগলো ও । বুঝতে পারলো, রাউণ্ডটার শেষের দিকে উল্টোদিকে লড়তে থাকা কন্ট্রোল সিস্টেম যেন হাল ছেড়ে দিল । রাউণ্ডটা শেষ হওয়ার আগেই কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে ম্যাসেজ এল – রাউণ্ড ওয়ানে স্বয়ং সেন্ট্রাল সার্ভারের মুখোমুখি হতে হবে, খুব সাবধান । তার থেকেও বড় অসুবিধের যেটা – এতদিন একেকটা রাউণ্ড শেষ করতে যতদিন খুশি টাইম নেওয়া যেত, কিন্তু লেভেল ওয়ানে সে উপায় নেই। খেলা শেষ করতে হবে একদিনের মধ্যে । যদি কমপ্লিট না করা যায় –তাহলে এতগুলো রাউণ্ডের সব হিস্ট্রি মুছে আবার প্রথম থেকে গেম শুরু করতে হবে ।
এক রবিবার দুপুর থেকে চেপে বসলো সুনন্দ । ধুধু দুপুরে তক্ষকের ডাকে আর চমকে উঠছে না ও । নিজের অজান্তেই যেন কী একটা ভর করেছে ওর ওপর । দীর্ঘক্ষণ নির্ভুলভাবে খেলাটা চালিয়ে যেতে লাগলো ও । প্রচণ্ড শক্তিধর সেন্ট্রাল সার্ভার এরকম প্রতিরোধ আশা করেনি বোধহয় । ক্রমে সেও প্রবল আক্রমণ চালাতে লাগলো । কিন্তু দাদুর সায়েন্টিফিক কারসাজিতে কিছুতেই সুনন্দের নাগাল পেল না । তার সাথে নীল মানুষের চমকপ্রদ সব সিদ্ধান্তে ক্রমে জয়ের দিকে এগোতে লাগলো সুনন্দ ।
তার পরে সুনন্দ বুঝতে পারলো, এলোপাথারি কাজ করে ওকে ভয় দেখাতে চাইছে সেন্ট্রাল সার্ভার । কিন্তু ও দৃঢতার সাথে সেসব কাটিয়ে এগোতে লাগলো । একটা সময়ে মনে হতে লাগলো, সার্ভার বোধহয় ওকে প্রলোভন দেখাচ্ছে । একবার বেশী আগ্রাসী হতে গিয়ে বিপদে পড়ছিল সুনন্দ । শেষমুহূর্তে বাঁচলো নীল মানুষের পরামর্শে । আসলে ঘটনা ঘটেছিল যেটা – সেন্টাল সার্ভার ট্রেজারির পাহারাদার কমিয়ে দিয়েছিল । সুনন্দ সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করেছিল । কিন্তু বুঝতে পারেনি ওখানে লুকনো আছে এক্সপ্লোসিভ । শেষ মুহূর্তে বাহিনী ফিরিয়ে এনে বাঁচলো । নয়তো এখানেই সব শক্তি খুইয়ে খেলা শেষ হয়ে যেত ।
এরপর সুনন্দ খেয়াল করলো, সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্ততি নিয়েছে সার্ভার । অবস্থাটা ডু ওর ডাই । ওদের প্রতিরোধ না করতে পারলে শেষ হয়ে যাবে এতদিনের সব জয় । আর উল্টোদিকে সেন্ট্রাল সার্ভারের কি হতে পারে ভাবার আগেই ধেয়ে আসতে লাগলো অন্তিম সব শস্ত্র । তার সৈন্যদের যা ক্ষমতা তাতে ওদের বেশীক্ষণ আটকে রাখা মুশকিল । সুনন্দ উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করেছে । যদিও সে প্রবল চাপের মধ্যে যথাসাধ্য মুভ করে যাচ্ছিল । তখনই নীল মানুষ তার কৃতিত্ব দেখালো । খুঁজে বের করলো সেন্ট্রাল সার্ভারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুরনো সব রেকর্ড । সেখান থেকে সাহায্য পেতে শুরু করলো সুনন্দ । ওর মনে হচ্ছিল – দাদুর সাথে সেদিন যাদের দেখেছিল, তাদেরই এসব রেকর্ড । যদিও শেষরক্ষা করতে পারেনি ওনারা ।
ক্রমে সেন্ট্রাল সার্ভারের আক্রমণ স্তিমিত হয়ে এল । ওর বাহিনী এগোতে লাগলো বিনা বাঁধায় । সুনন্দ বুঝতে পারছিল একটা সন্ধিক্ষণের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে । এবার ভেঙে পড়তে চলেছে সার্ভার সিস্টেম। সুনন্দের মনে হল, ওই হারা মানুষগুলো এবার সান্ত্বনা পাবে । দাদুর স্মিত হাসি কল্পনা করে তার মনে অদ্ভুত একটা আলোড়ন হতে থাকলো ।
সেন্ট্রাল সার্ভার দখল করার পর ‘জিরো লেভেল’ লেখাটা এসে স্ক্রিনটা ফ্রিজ হয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড । তারপর সময় রেস্টোর করার একটা অপশন এল । সুনন্দ দেখলো – নিজে থেকেই একটা সময়ে গিয়ে থমকে গেল ঘুরতে থাকা সাল লেখা একটা ভার্চুয়াল ঘড়ি । লেখা ফুটে উঠল - ‘কনগ্রাচুলেশান’ । তারপরেই স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠল একটা ঝকঝকে সবুজ মাঠের ছবি । সেখানে উড়ছে খুব সুন্দর কয়েকটা প্রজাপতি ।
সুনন্দ বুঝতে পারছিল, আবার নতুন করে শুরু হবে দুনিয়ার পথ চলা । মানুষের মাথার ওপর থেকে সরে যাবে যন্ত্রের নিয়ন্ত্রন । কোথা থেকে যেন তক্ষকের সেই তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে এল । ঘেমে নেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুনন্দ অনুভব করলো, তার শরীরের ছটফটানি কমে গেছে । মাথার ভেতরটা ভীষণ শান্ত । কোথা থেকে বয়ে আসছে ফুরফুরে হাওয়া । তাতে ভেসে আসছে দাদুর পছন্দের সেই আতরের গন্ধটা ।
*
হঠাৎ বাইরে থেকে আসা একটা কোলাহলের আওয়াজ শুনতে পেল সুনন্দ । তাড়াহুড়ো করে বাবামায়ের ঘরের ব্যালকনিতে ছুটে গিয়ে দেখলো নিয়মের খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া ছেলেবুড়ো আনন্দে দলবেঁধে রাস্তায় নাচছে গাইছে । দলটা যখন ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে একজনকে দেখে মনে হল ওর সেই পরামর্শদাতার মতোই চেহারা । কোথা থেকে জোগাড় করা নিষিদ্ধ আবীর সে ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশের দিক্দের মনে হল – গোটা শরীরে আবীরের রঙ নিয়ে সে যেন ওর দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হাসলো ।
ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে সুনন্দ লক্ষ্য করলো, ঘোর কেটে যাওয়া মানুষের মতো দেখাচ্ছে বাবা মা’কে । সম্ভবত প্রথমবারের জন্য দাদুর কথা ভেবে চোখের জল ফেলছে ওরা । সুনন্দেরও কান্না পাচ্ছিল, একইসাথে ঠোঁটের কোণে একটা হাসিও ফুটে উঠেছিল । ও শেষপর্যন্ত দাদুর কথা রাখতে পেরেছে ।