Baiduryya Sarkar

Romance Tragedy

1.0  

Baiduryya Sarkar

Romance Tragedy

প্রবাহ

প্রবাহ

8 mins
633


সর্বক্ষণ একটা জানলার পাশে বসে নজর রাখে অমিতা । সামনে ওদের বাগানে আম জাম ফুলগাছ তারপর বেশ কিছুটা জঙলা জায়গা । এরপর মিশনারি স্কুল । অমিতা শুনেছে ফাঁকা জায়গাটায় একটা চার্চ হবে । সেজন্যই ওরা ফাঁকা জায়গাটা খুঁড়েছিল, তারপর কী হল কে জানে সব চুপচাপ । গত বর্ষায় জল জমে মজা পুকুরের চেহারা নিয়েছিল, পরে জল শুকিয়ে আগাছায় ভর্তি হয়ে জায়গাটা সাপ ব্যাঙ পোকামাকড়ের আড্ডা হয়ে উঠেছে । 

একা মানুষের পক্ষে গোটা বাড়ি সামলানো মুশকিল । তাই একটা জানলা দিয়ে আসা আলো হাওয়াতেই কাজ চালিয়ে নেয় অমিতা । সকাল আটটা থেকেই স্কুলটাতে ছেলেমেয়েদের আনাগোনা শুরু হয় । দুপুর বারোটা নাগাদ তাদের টিফিন ব্রেক হয় । হুটোপাটি দেখার জন্য জানলার ধারে সাগ্রহে বসে থাকে অমিতা । কেউ কেউ কথাও বলে ওর দিকে চেয়ে । অমিতা শুধু হাসে । ও খেয়েদেয়ে উঠলে তিনটের পর থেকে দফায় দফায় গার্জেনরা বাচ্চাদের নিয়ে যেতে থাকে । বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে সব ফরসা । পাঁচটা নাগাদ কয়েকজন টিচারকে দল বেঁধে চলে যেতে দেখে অমিতা । সবার শেষে সাদা জোব্বা পরা ফাদার আর সহকারী যায় । এরা সব আশপাশের কোয়ার্টারে থাকে বলে শুনেছে । ততক্ষণে আলো মরে আসে । নাজমা এসে বাসন ক’খানা মেজে দিয়ে যায়, আর পুরনো দিনের কিছু গপ্পোগাছা করে যায় । কথা বলার আর কেই বা আছে এখানে ! বড় ছেলেটা আলেকালে আসে, এসে এই ইংরেজি স্কুলটার দিকে তাকিয়ে কিসব বিড়বিড় করে বকে । ছোট ছেলের বউটা আসলে চুপি চুপি কাঁদে । নাতিটাকে দেখতে বড় সাধ হয় অমিতার, সে নাকি বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে দাদুর মতো।

ছুটির দিনগুলো ফাঁকা দুপুরগুলোয় স্কুল বাড়িটায় ঘুঘু ডাকে । নিঃসঙ্গ ঘুঘুর ডাক খুব চেনে অমিতা । স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে মেন গেট পেরিয়ে আলাদা একটা ছোটখাটো পাকা ঘর আছে । সেটায় গুনে গুনে দুদিকে দুটো জানলা । বাকী সময়টা ওখানে একজন পাহারাদার থাকে । সে যে কে – তা ঠিক জানে না অমিতা । তবে বুঝতে পারে তার মতোই কেউ অলক্ষ্যে জেগে আছে । নজর রাখছে । দারুণ বর্ষার দিনে ঘরটার ভেতরে জ্বলা আলো ঘষা কাঁচের পাল্লার ভেতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে বাইরে আসতে দেখেছে অমিতা । যখন চারিদিকের অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুৎচমকে একা বাড়িতে কেঁপে ওঠে সে । শীতের সময়েও সের’ম । হুহু করে বয়ে চলা ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে ওই ঘরটায় জ্বলা আলোর আলতো রেখাটুকু ওকে খানিকটা ওম দেয় । অন্য দিনগুলোতে আলো স্পষ্ট ঝাপটা দেয়। অমিতা লক্ষ্য করেছে ওখানকার আলো এসে আমগাছের ছায়া ফেলে ওর ঘরের দেওয়ালে । গরমকালের রাতে পাহারাদার ছায়ামূর্তি হয়ে আশেপাশে হাওয়া খুঁজে ফেরে । তখন হয়তো অমিতা জোরে জোরে শ্বাস টানে ।

রাতের গার্ড বুধিয়া আপন মনে লাঠি ঠুকে ঘুরে বেড়ায় । ফাঁকা জঙলা জায়গা, তার ওপর এতবড় চৌহদ্দিতে একা। পাশ দিয়ে হাইরোড গেছে, বাড়িঘর কাছাকাছি বড় একটা নেই । জায়গাটাকে ওর খুব চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু আগে তো কখনও আসেনি । এখনে আছে বলতে একটা ভাঙাচোরা জমিদারবাড়ি । দেখেই বুধিয়ার মনে পড়েছিল, এখানকার এক জমিদারের খাস লেঠেল ছিল ওর দাদু । বাপের মতো সেও হাতে লাঠি নিয়ে দারোয়ানের কাজ করছে । লোকজন বড় একটা দেখা যায় না । কেউ থাকে না বোধহয় । ও জানে না, শুধু অমিতা একা অপেক্ষায় বসে থাকে শনিবারের জন্য, কখন আসবে তার বর । যেমন অফিস সেরে সে বরাবর ফিরতো ।

ওকে এই চাকরিতে স্কুল রেখেছে কেননা এখানে রাতে কেউ থাকতে চায় না । সকাল সাতটা নাগাদ কোনও একজন দরোয়ান এসে ‘বুধিয়া’ বলে ডাক দিলে ওর ছুটি হয় । তবে একদিকে সুবিধে, সন্ধে সাতটা থেকে সকাল সাতটা – কাজ বলতে শুধু আলো জ্বেলে একা বসে থাকা । রুটি সবজি কৌটোয় করে নিয়ে আসে বুধিয়া, সাথে একটু গুড়। কল থেকে জল ভরে কটা বোতল রেখে দেয় । খৈনি আর বিড়ি মজুত রাখে বুধিয়া। এতেই রাত কেটে যায়।    


খ।


কলকাতার বাসাবাড়ি থেকে কয়লা ইঞ্জিনের ট্রেনে চেপে বরের সাথে ছুটিতে এখানে আসার কথা মনে পড়ে অমিতার । তার আগে বর আসতো শনিবার বিকেলে, আবার ফিরে যেতো সোমবার ভোরে । গোটা সপ্তাহটা একা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে অমিতা কোকিলের ডাক শুনতো ধূ ধূ দুপুরে । প্রথম প্রথম শুনতে বেশ লাগতো, আবার একটানা শুনলে বিরক্তিও লাগতো । অমিতা বুঝতো, সবই স্বপ্নের মতো । কোথা থেকে যেন ভেসে আসতো অস্পষ্ট বাঁশির সুর । এই গ্রামেরই মেয়ে সে, এ বাড়ির অন্ধিসন্ধিও আগে থেকেই সব জানা । বাড়ির ছোট ছেলের সাথে বিয়ের আগে থেকেই ওর যাতায়াত । 

বর এমনিতে ভদ্দরলোক ছিল, নেশাভাঙ ছিল না । তবে তবলা হারমোনিয়াম বাঁশি পেলে দুনিয়ার আর কিছু তার মনে থাকতো না । আমিতাও বিয়ের আগে আর পাঁচটা মেয়ের মতো গানবাজনা শিখেছিল । পরে তেমন আগ্রহ থাকেনি । বর এলে বৈঠকখানায় আসর বসাতো রবিবার । যাত্রার জোরদার মহলা শুরু হতো শীতে । সে বাবদে আশপাশের দুচারটে গ্রামে যাতায়াত করতো । কোথাও তেমন সন্ধান মিললে দু’চারদিনের জন্য নিরুদ্দেশ । গ্রামের জমজমাট জমিদার বাড়ি, কাজকর্মের লোকের অভাব ছিল না ।

বর ফিরলে মুখ ভার করে রাখতো অমিতা । তাতেও শান্তি ছিল না, জাপটে ধরে তাকে গরম করে তুলতো বর । অমিতা সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মনে করতো – লোকে তার সুখ দেখতে পারে না বলে কুকথা রটায় । তাছাড়া পুরুষমানুষের বাইরের দিকে টান না থাকলেও বিপদ, সে ঘরের সব ব্যাপারে নাক গলায় ।

ওদের গ্রামে অনেক মুসলমান ছিল । স্বাধীনতার সময় শোনা গেছিল এ গ্রামের পাকিস্তানে যাওয়ার কথা, কিন্তু কে জানে কেন যাওয়া হল না । বাড়িতে একটা কাজের বউ ছিল নাম – নাজমা । অমিতার বয়সী ছিল বলে, ভারী ভাব ছিল । মেয়েটার বরকে সবাই পাগল বললেও সে নাকি ছিল জ্বিনে পাওয়া । এমনিতে ভাল থাকলেও মাঝে মাঝেই খেপে যেতো । নাজমা ওকে বলতো এসব সময়ে বর তার ওপর নানারকম অত্যাচার করে, হাত পা বেঁধে চিৎপাত করে ফেলে করে, পেচ্ছাপ দিয়ে চান করিয়ে দেয়, সারারাত ঘুমোতে দেয় না । শুনে গা হাতপা শিরশির করে উঠতো অমিতার । তবে নাজমা হেসে এও বলতো, সে এমন সুখ মাঝে মাঝে দেয় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় । নাজমা লাজুক মুখে অমিতাকে বলতো, এক জামাইবাবুর সাথে ওর ভারী আসনাই। সে এলে বরটাকে একদম ঠাণ্ডা করে দেয় । শুনে চোখ বড়বড় করে তাকাতো অমিতা ।

এসব গল্পগাছা, সুখের দিন বিশেষ রইল না আর । তখন বড় দু’টো ছেলেমেয়ে হয়েছে সবে । কিছুদিনের মধ্যে হাতছাড়া হল জমিজমা । রইল না জমিদারি বোলবোলাও । সরকার কেড়ে নিল সব । এই বাড়ি আর কিছু সম্পত্তি ছাড়া সব গেল । সেই শোকেই একে একে শ্বশুর ভাশুররা চোখ বুজলো । পুরো সংসার এসে পড়ল বরের মাথায়। তার গান বাজনা মাথায় উঠলেও ক্রমে ঠিক সামলে গেল সব । চাকরির সাথে কিসব ব্যবসা করে কলকাতায় নিজের মাথা গোঁজার জায়গা করে ফেললো । তখন গ্রামের বাড়ির ওদিকে খুব অশান্তি । পূব পাকিস্তান থেকে দলে দলে লোক এদিকে এসে অস্তানা গাড়ছে । অমিতা শুনেছিল, পাগলা বরটাকে ফেলে সেই জামাইয়ের সাথে নাজমা ওদিকে পালিয়ে গেছে ।

তারপর যা হয়, সংসার বাড়ছিল । তিন ছেলে চার মেয়ে । ছেলেপুলে বড় হচ্ছিল । গ্রামের বাঁধন কেটে যাচ্ছিল একটু একটু করে । তবে বড় ছেলেটা নকশাল হয়ে কিছুদিন এই বাড়িতে লুকিয়েছিল । সে যে কিসব করতো, জানতো না অমিতারা । শুনেছিল, গ্রামের বাড়ি থেকে যেদিন কলকাতায় ফিরেছিল সেদিনই তাকে গুলি করে মেরেছিল পুলিস । ডেডবডি পর্যন্ত দিতে চায়নি । অমিতা তখন শক্ত হয়ে সংসার সামলেছে, পরের বছর বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে । মেজো ছেলে পড়াশোনা করে সেই যে বিদেশ গেছে – আর ফেরেনি । কোনও খবর পাওয়া যায়নি । সে মেম বিয়ে করেছে, কানাঘুষো শুনেছিল অমিতা । ছোট ছেলেটা ছেলেপুলে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে আছে । তার বড়বাজারে দোকান । বাপ ওকেই বোধহয় বেশী ভালবাসতো, তাই দোকানের ব্যবস্থাটা যাওয়ার আগে করে দিয়ে গেছিল । মেয়েদেরও যথাসাধ্য দিয়ে গেছে বাপ । তবু তাদের আশ মেটেনি । বর ওকে ফেলে গেছে, তাই নিত্য অশান্তি পোয়াতে হতো অমিতাকে । 


গ।


জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাপের সাথে ঝামেলা লাগে ধীমানের । বাপ বিষয়ী লোক, ধীমানের কোনও ব্যাপারেই গা করে না । ধীমান ছবি তুলতে ভালবাসে, অনেক কষ্টে একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড ক্যামেরা কিনেছে । সেই নিয়েই ছবি তুলে আওয়ার্ড পায় । গান না শিখলেও ইউটিউবে শুনে অনেক গান চমৎকার গাইতে পারে । তাতে কোনও কদর নেই । অনেক টাকা রোজগার না করতে পারলে এমনই হয় । তার চাকরি করতে ভাল লাগে না, দুচারটে জায়গায় পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে । ব্যবসাতেও ঢুকতে চায় না ।

বাপের থেকে হেন কুকথা নেই সে শোনেনি । নেহাত মা মরা ছেলে তাই বাড়ি থেকে তাড়ায়নি । তবে বাপ চেনা আরেক ব্যবসাদারের মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । ধীমানের মনে হয়েছে, এবার তাকে হেস্তনেস্ত করতেই হবে । তাই ব্যাগে কিছু টুকটাক জামাকাপড়, কিছু টাকা আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে । গন্তব্য তাদের গ্রামের বাড়ি । যদিও জানে না, সেখানকার পরিস্থিতি কি। সেখানে অনেক ছোটবেলায় গেছিল ।

সেই ভরসাতেই ঘণ্টাদুয়েক পর ট্রেন থেকে নেমে টোটোওলাকে বোঝাতে পারলো ওখানে যাওয়ার কথা । লোকটা প্রথমে ভেবেছিল স্কুলে যাবে বোধহয় । কথায় কথায় ওই বাড়ির কথা বলাতে সে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল । উত্তেজনার চোটে ধীমান এখন থেকে ওখানে থাকবে বলাতে লোকটা ওকে পাগল ঠাওরালো হয়তো । কিন্তু তাতে ধীমানের কিছু যায় আসে না, ওর কেমন যেন একটা রোখ চেপে গেছে । 

ঝলমলে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা এই অট্টালিকা ছবি তোলার তোলার পক্ষে আদর্শ হলেও এখানে থাকা সম্ভব কি ? নিজেকে প্রশ্নটা করে যখন আগাছার জঙ্গল ভেঙে ধীমান বাড়িটায় ঢুকছিল, লক্ষ্য করলো লাঠি হাতে একটা লোক ওর দিকে চেয়ে আছে অবাক হয়ে । লোকটা এক পা দু’পা করে কাছে আসলে, ধীমান জিজ্ঞেস করলো – এখানে থাকা যাবে ? ঘরদোর ভাল আছে !

লোকটাও অবাক । এর’ম ভাঙা বাড়িতে কেউ থাকতে আসে বলে শোনেনি কখনও । তবে মুখে কিছু বলল না, বরং কিসের একটা টানে সেও ধীমানের পেছনে এসে বাড়িতে ঢুকলো । একটা বহুদিনের পুরনো চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন মুক্তি পেল এতদিনে । যেখানটা দালান ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে ধীমানের মনে হল এতদিন এখানে আসারই কথা হয়ে ছিল ওর । কেউ বলেনি। তবু ভেতরের কে যেন ধাক্কা দিয়ে ওকে এখানে এনে ফেলেছে । গোটা বাড়িটা ঘুরে দেখে বুঝতে পারলো ওপরের কয়েকটা ঘর মোটামুটি বাসযোগ্য আছে । রান্নার সাবেক জায়গাটায় কিছু বাসনপত্র স্টোভ পাওয়া গেল । বাথরুম ভাঙাচোরা হলেও টিউবওয়েল পাম্প করতে বেশ ঠান্ডা জল বেরোলো।

অমিতার অপেক্ষা শেষ হয়েছে । সে এবার শান্তিতে ঘুমোতে পারবে বরের সাথে । পুরনো বাড়ি থেকে একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঝাপটা দিল ধীমানের গায়ে । ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো সিলিং থেকে ঝোলা ঝাড়টার দিকে, কাঁধে তার ক্যামেরা । বুধিয়া ওই নিঃসঙ্গ স্কুলে রাতে থাকার পর দিনটা এখানে থেকে এই বাবুর কাজ করে দেবে ঠিক করেছে।

ওরা জানে না, কিসের অনুসরণে এখানে এসে পড়েছে । জীবনের বিচিত্র গতির কথা কেই বা বলতে পারে ।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance