arijit bhattacharya

Classics

3  

arijit bhattacharya

Classics

চন্দ্রাহত

চন্দ্রাহত

27 mins
806



উপক্রমণিকা


অবশেষে বেলা তিনটের সময় শিমুলতলা স্টেশনে নামলেন প্রফুল্লবাবু। ঝাড়খণ্ড-বিহার সীমান্তের এই ছোট্ট শহর বিভূতিভূষণ-শরৎচন্দ্রের সময় থেকেই বাঙালীর কাছে একসাথে ভ্রমণ আর স্বাস্থ্যোদ্ধারের স্থান। আগে হাওয়া বদল করতে যাওয়া মানেই বাঙালী বুঝত পশ্চিমে বেড়াতে যাওয়া আর তখন বাঙালীর কাছে পশ্চিম মানেই মধুপুর,গিরিডি,দেওঘর,ঝাঝা,শিমুলতলা ইত্যাদি। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বিহারের এই ছোট্ট শহরে দেখার জায়গা বলতে লাট্টু পাহাড়,হলদি ঝর্ণা, শিমুলতলা রাজবাড়ি।ছোটনাগপুরের সবুজ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বাবলা,মহুয়া ,শাল আর শিমুল অধ্যুষিত এই অঞ্চলের প্রকৃতি এতো মনোরম যে ছোট্ট এই শহরকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে 'বিহারের শিমলা' নামে।এখানে আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম,রাতের স্বচ্ছ আকাশে শুভ্র চন্দ্রমার জ্যোৎস্না নিমেষে কবিমনকে পুলকিত করে। মন মাতাল করে বয়ে যাওয়া ফুরফুরে বাতাস মনের সব নিভে যাওয়া আবেগকে জাগিয়ে তোলে। রাতে বনানীর মধ্যে পত্রের মর্মরধ্বনি হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রেমিকার কথা বিরহী মনকে মনে করিয়ে দেয়।ভেসে আসা মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ মনকে উষ্ণ নেশা ধরিয়ে দেয়। পাহাড়ের কোলে শুকনো অরণ্যের সাথে কতো হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের নির্বাক সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাজবাড়ি। যখন বুক চিরে বিশ্বচরাচরে অরুণ আলোর আভা ছড়িয়ে ঘটে সূর্যোদয়,সে এক রীতিমতো অনুপম দৃশ্য।সারা বিশ্বচরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে পাখির মধুর কলতানে।কবিগুরুর ভাষায়,

"ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত অম্বর মাঝে/

দিগে দিগন্তরে ভুবন মন্দীরে শান্তিসঙ্গীত বাজে।"

আবার,অপরাহ্ণের গোধুলিবেলায় যখন সারা বিশ্বচরাচরে রক্তরাগ ছড়িয়ে দিবাকর অস্তাচলে গমন করেন,সেও এক মন কেড়ে নেওয়া দৃশ্য। কিন্তু,প্রফুল্লস্যারের তাই নিয়ে খুব একটা আগ্রহও নেই। উনি এখানে এসেছেন বলতে গেলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে। প্রফুল্লস্যার একজন কোলকাতার নামজাদা অধ্যাপক,বয়স পঞ্চান্নের কাছাকাছি। অথচ কি এমন হল যাতে সাফল্যমুখর কর্মজীবন ছেড়ে বিহারের এই অখ্যাত শহরে বেশ কিছুদিনের জন্য স্বেচ্ছায় নির্বাসনে আসতে হল। কি সেই কারণ,যে কারণকে এতো গোপনে তিনি লুকিয়ে আসছেন সবার কাছ থেকে!একমাত্র প্রফুল্লস্যার জানেন যে,তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রোগের কথা কারোর কাছে প্রকাশ করা যায় না,সহানুভূতি দেখানোর লোক পাওয়া যাবে না। তাই এই স্বেচ্ছায় বনবাস। তাও,এখানে আসার আরেকটা কারণ রয়েছে। কাছেই ঝাঝা শহরে তিনি তার শৈশবের কিছু অমূল্য মুহূর্ত কাটিয়েছেন। এখানেই স্কুলমাস্টার সতীন্দ্র পাণ্ডে তার বাল্যবন্ধু। সেই বাল্যবন্ধুরও মিষ্টি সান্নিধ্য পাওয়া যাবে আর তাতে এই রোগের কিছুটা প্রতিকারও যে হবে না-কেই বা বলতে পারে। ভালোবাসার মধ্যে অমিত শক্তি থাকে। এখন এপ্রিল মাস,এদিকে পলাশেরও যথেষ্ট আধিপত্য। যখন গাছ ভরে যায় লাল রঙের পলাশ ফুলে,তখন প্রকৃতিতে যেন প্রেমের আগুন জ্বলে ওঠে।


সারা শহরটাই সবুজ দিয়ে ঘেরা,দিগচক্রবালে মৌন মহান ধূসর গিরিধর। শহরের কিছু বাইরেই দুর্নিবার শরীরী আকর্ষণ নিয়ে পথিককে আকর্ষণ করে বনানী। ব্রিটিশ শাসনের সমকালীন বাঙালীর এই ভ্রমণপ্রিয় অঞ্চল এখনো উইকএন্ড ট্যুর করার আদর্শ জায়গা। সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বাঙালী ভ্রমণবিলাসীদেরই তৈরি অজস্র কুঠি ও জমিদারবাড়ি। আছে পালকুঠি,সেনকুঠি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অবস্থা এখন করুণ প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। আবার কিছু এখনো কোনোরকমে টিকে আছে কেয়ারটেকারদের আন্তরিক প্রয়াসের জন্য। এজন্য কেয়ারটেকারদের প্রশংসা প্রাপ্য। আছে দাহারা ফলস। আরেক ভ্রমণের স্থান। অনেক বাড়িকে নিয়ে আবার ভৌতিক গল্পও দানা বেঁধেছে,রাতারাতি হন্টেড প্লেসের তকমা নিয়ে সেগুলো বিখ্যাত হয়ে গেছে।

থাকার ভালো জায়গা বলতে আছে 'অন্যা রিসর্ট'। যেমন থাকা খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা,তেমন ভোরে কি অপরাহ্ণে এই রিসর্টের ছাদে দাঁড়িয়ে মন মাতাল করা ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে বনানী আর পাহাড়ে ঘেরা শিমূলতলা শহরের অভিরাম দৃশ্য মনের গভীরে কোথাও এক অজানা ভাবসত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। এর বর্ণনা আমার সাধ্যাতীত!


যাই হোক, ফিরে আসি প্রফুল্লস্যারের কথায়। প্রফুল্লস্যার উঠেছেন সেনভিলায়। শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত। লাগোয়া কোনো বাড়িঘর নেই। একরাশ নিঃসঙ্গতা নিয়ে পড়ে আছে বাড়িটা। সারা বাড়িটা ছেয়ে আছে এক ধূসর কাহিনী। বাড়ির একমাত্র সঙ্গী বলতে কেয়ারটেকার কাম কাজের লোক বৃদ্ধ রামদা- পুরো নাম রাম দুবে। এই বয়সেও সকাল সন্ধ্যা রামদা যথেষ্ট পরিশ্রম করে। লোকটাকে দেখে করুণা হয়।


দিনের আলো পড়ে আসছে। পাঁচটা ঘর। প্রফুল্লস্যারের শোবার ঘরের জানালা থেকেই দেখা যায় পাশের একচিলতে পড়তি জমি। দিনের আলো পড়ে আসছে।

দিবাকর অস্তাচলে গমন করছেন। দিগন্তরেখায় ধূসর পাহাড়তলিকে রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। এক অদ্ভুত রক্তিম গোধূলি! সত্যিই কোলকাতার জনকোলাহলের চিহ্নমাত্রও এখানে নেই। কি অদ্ভুত নীরবতা! পোড়োজমির এককোণে আকাশের একপ্রান্তে উঠেছে ভাঙা একফালি চাঁদ। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনটা হু হু করে ওঠে প্রফুল্লবাবুর।


গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল শুভস্মিতার। দূরে,বহুদূরে কোথায় যেন ক্ষুদার্ত এক হিংস্র পশু গর্জন করছে। আর একটানা গর্জন করেই চলেছে। আর সেই গর্জনধ্বনি রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে এখানে ম্লান হয়ে এসে পৌঁছাচ্ছে। একটানা পশুটা গর্জন করেই চলেছে। না,বাঘ নয়,শুভস্মিতা ভালোই জানে এরকম গর্জনের প্রকৃতি কার হতে পারে। এ তো হুড়ালের ডাক, আর হুড়ালটাই বা কতো বড়ো যে তার ডাক এখানেও স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। না,আতঙ্কে আর উত্তেজনায় আর শুয়ে থাকতে পারল না শুভস্মিতা। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল,আর তখনই যে জিনিসটা ওকে মুগ্ধ করল সেটা হল আঁধার রাতের বুকে অপরূপ স্নিগ্ধ অনুপম জ্যোৎস্না। রূপোলী চন্দ্রালোকে বিশ্বচরাচরকে মোহময় বলে মনে হচ্ছে। রাত আটটার দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল,কিন্তু এখন আর আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্রও নেই। ধরণী এক অদ্ভুত মৌনতা অবলম্বন করে পূর্ণিমার মায়ায় মোহিত হয়ে আছে। শুভস্মিতা রাওয়াতের বাঙলো শিমুলতলা শহরের বাইরের দিকে। গোটা শিমুলতলার মধ্যে যথেষ্ট বড়ো বাড়ি। এই ব্যালকনি থেকে শহর ও তার বাইরে অনেকটা দেখা যায়। দূরে মৌনমহান পাহাড়তলি। রাত্রির মৌনতার মধ্যেও মন্দ্রিত হচ্ছে পূর্ণিমার মোহময়ী সঙ্গীতলহরী। বইছে ফুরফুরে ঠাণ্ডা মন মাতাল করা হাওয়া। সেই মায়াবী পরিবেশে মন মাতাল করা হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল শুভস্মিতার। বাড়ির কিছু দূরেই অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে দুটো দেবদারুগাছ। সেই দেবদারুগাছের সবুজ পাতার ওপর জমে থাকা বৃষ্টির জলবিন্দু শুভ্র চন্দ্রালোকে মুক্তোর মতো ঝিকিমিকি করছেআশ্চর্য,জানোয়ারটা ডেকেই চলেছে। সেই ডাকের মধ্যে কেমন যেন একটা সম্মোহনী ভাব আছে। বেশিক্ষণ শুনলে শরীর মন ঝিমঝিম করতে থাকে। যতদূর বুঝতে পারছে শুভস্মিতা,পশ্চিমের পাহাড়তলির দিক থেকে জানোয়ারটা গর্জন করছে। আশ্চর্য,ওদিকেই সেই সেনভিলা আছে না,যেখানেই কয়েকদিন আগেই এক অদৃশ্য আততায়ী নির্মমভাবে এক ভিখারীকে হত্যা করে। তবে কি! শুভস্মিতা এমনিতেই বিদেশী ভৌতিক সাহিত্যের ভক্ত। আর ভ্যাম্পায়ার,ওয়্যারউল্ফ এগুলো ওর কাছে অপরিচএসব ভাবতে ভাবতেই তার কানে এসে পৌঁছাল কোনো পথিকের আর্ত চিৎকার আর কোনো দানবীয় জন্তুর হাড় হিম করা ক্রুদ্ধ গর্জন। জন্তুটা যেন গর্জন করতে করতে তাদের বাঙলোর দিকেই এগিয়ে আসছব্যালকনিতেই মূর্ছিতা হয়ে পড়ল শুভস্মিতা।অবশেষে ভোরের আলো ফুটল। সূর্যের সোনালী কিরণ জানলা দিয়ে মুখের ওপর পড়তেই ঘুম ভাঙল প্রফুল্লস্যারের। কিন্তু শরীরটা যেন অসম্ভব দুর্বল। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে,বাইরে হালকা কুয়াশা। রামদা আসবে সাড়ে ছটায়। ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।


  .শিমুলতলায় এখনোও যেকজন বাঙালী মাথা উঁচু করে প্রতাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ান,তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি শুভ্র সাহা। তিনি একাই এখানের চার পাঁচটা হোটেলের মালিক, ফর্সা এই নাদুস নুদুস ব্যক্তি অবশ্য ঘনিষ্ট মহলে বরদাচরণ নামেই পরিচিত। 

দেখতে শুনতে সহজ সরল হলেও ঘটে চলা সব ঘটনা নিয়েও তার মনে সারাক্ষণ লেগে থাকে সন্দেহের প্যাঁচ। সেই প্যাঁচে তার মনে বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যেও লেগে থাকে দ্বন্দ্ব। তাই আগের দিন পালভিলার কাছাকাছি অঞ্চলে যেভাবে তার একজন বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী ,যিনি একাই তিনটে কুঠিবাড়ির মালিক ছিলেন শিমুলতলায়,সেই অশোক মজুমদারের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ পাওয়া গেছে,তাতে তার চিন্তা শত সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছে। ঘটনা হল,অশোকবাবুর কাছে দামী সোনার ঘড়ি আর টাকা পয়সা থাকলেও সেগুলি কিছুই খোয়া যায় নি। শুধু প্রবল হিংসায় দেহটাকে নখরের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। প্রতিপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ায় অশোকবাবুর শত্রুর অভাব ছিল না। তাদের মোটিভ থাকতে পারে,কিন্তু এতো জিঘাংসাপূর্ণ কাজ মানুষ করতে পারে বলে মনে হয় না।

স্থানীয় পুলিশ বলছে,এটা বাইরে থেকে আসা কোনো অজ্ঞাত আততায়ীর কাজ।সাইকোপ্যাথ কিলার হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু,কে সেই আততায়ী যে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েও কাজ সম্পন্ন করে আর নৃশংসতার দিক থেকে হিংস্র পশুকেও হার মানায়। এই ব্যাপারটাই তো বারবার ভাবতে বাধ্য করছে। আর আগের পূর্ণিমাতেও তো একটা খুন হয়েছে। একজন ছিন্নমূল ভিখারী। একইভাবে খুন হয়েছে। ভিখারী বলে হয়তো কেউ পাত্তা দেয় নি, কিন্তু এবার একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির খুন হতেই হইচই পড়ে গেছে।


বরদাচরণের সোর্স অনেক দূর।আর সোর্স মারফতই তিনি জেনেছেন যে,শিমুলতলা শহরে এক নতুন বাঙালীর আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি একজন অধ্যাপক,নাম প্রফুল্ল কুমার দাস। গণিতের অধ্যাপনা করেন। সতীন্দ্র পাণ্ডের ঘনিষ্ট বন্ধু। কিন্তু তিনি তো যথেষ্ট সাত্ত্বিক মানুষ। তাঁকে দেখে তো মোটেই নরপিশাচ বলে মনে হয় না। আর আগের বারের খুনটার সময় তিনি শিমুলতলাতে উপস্থিতও ছিলেন না। তাহলে কে সেই ব্যক্তি! কে সেই অদৃশ্য আততায়ী! যে পূর্ণিমারাতে নেমে আসে শিমুলতলার বুকে। তীব্র রক্তপিপাসা আর জিঘাংসায় উন্মত্ত হয়ে খুঁজে চলে নিজের শিকার। সে কি কোনো মানুষ,পশু ,না কি ভীন্নগ্রহের কোনো জীব!

এককালে এদিকে ভল্লুকের উৎপাত প্রচুর ছিল,গভীর জঙ্গলে বাঘ ছিল । মহুয়ার আকর্ষণে ভল্লুক অনেকসময় লোকালয়ের কাছে চলেও আসত। এছাড়া শিয়াল হুড়াল তো ছিলই। এখন এই শিমুলতলার জঙ্গলে বাঘ তো নেই,ভল্লুক লুপ্তপ্রায়। হায়না হুড়ালকে অবশ্য বাদ দেওয়া যায় না। কিন্তু একটা ব্যাপারই ভাবাচ্ছে বরদাকে। সেটা হল এক রিক্সাওয়ালার সাক্ষ্য,যেটা রিক্সাওয়ালা স্বয়ং পুলিশকে দিয়েছে।

ঘটনার দিন রাতে রিক্সা করে ফিরছিলেন অশোকবাবু। পূর্ণিমার রাত,চারপাশ রূপোলী জ্যোৎস্নায় আচ্ছন্ন। বইছে ফুরফুরে হাওয়া। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।রাত সাড়ে দশটা হবে। পথঘাটে লোকজন তেমন নেই। থমথমে পরিবেশ কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। যেন প্রকৃতি এক অদ্ভুত মৌনতা অবলম্বন করে কোনো এক অশুভ ঘটনার পূর্বাভাস জানান দেবার প্রয়াস করছে। চারদিকে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা

যাই হোক,রিক্সা তখন ভাঙা শিবমন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছেছে,হঠাৎই সাঁওতালী রিক্সাওয়ালা সুই মুণ্ডা দেখতে পায়,রাস্তার ওপর পড়ে আছে বিশাল গাছের গুঁড়ি। হতচকিত হয় সে, বৃষ্টি হয়েছে ঠিক আছে,ঝড় তো হয় নি,রাস্তায় গাছ পড়লো কি ভাবে! হতচকিত হয়েছিলেন অশোকবাবুও। যাই হোক,পথচারী কেউ নেই। ওটাকে সরানো না গেলে সামনে যাওয়া যাবে না । সুই মুণ্ডা অশোকবাবুকে বুঝিয়ে নেমে সরাতে যাবে এইসময়ই পাশের পোড়ো ঝোপজঙ্গল থেকে ভেসে এল,রক্ত জল করা বিভীষিকাময় হিংস্র গর্জন।

ব্যাস,বিদ্যুৎঝলকের মতো পুরো ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল সুই মুণ্ডার। আগের বারের হত্যাকাণ্ডটার সাথে সে যথেষ্ট পরিমাণে অভিহিত ছিল। বিপদের আশঙ্কা বুঝতে এক সেকেণ্ডও দেরি হল না তার। মুণ্ডারা ভীতু নয়,যথেষ্ট সাহসী। কিন্তু বিভীষিকা যেখানে অপার্থিব,আততায়ী যেখানে রহস্যের কুহেলিকায় ঘেরা,সেখানে যে কোনো সাহসের নীতিই কাজ করে না । সুতরাং,"চাচা,আপন প্রাণ বাঁচা" নীতিরই দ্বারস্থ হল সুই মুণ্ডা। এদিকে হতচকিত হয়ে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে রিক্সায় বসে রইলেন অশোকবাবু। ছুটতে ছুটতেই সুই শুনতে পেল রক্ত জল করা জিঘাংসাময় গর্জন আর অশোকবাবুর করুণ মৃত্যুকালীন আর্তনাদ। ছুটতে ছুটতে সুই মুণ্ডা গিয়ে পৌঁছাল শিমুলতলার পুলিশ ফাঁড়িতে। আর,গিয়েই ভেঙে পড়ল কান্নায়। পুলিশ প্রথমে সন্দেহ করেছিল সুইকেই,আর হাজতেও পুরতে চেয়েছিল। কিন্তু,থানার বড়বাবুর মাথাতে ছিল আগের খুনের ঘটনাটা। তিনিই দাঁড়ালেন সুইয়ের হয়ে। আর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ যেটা সুইয়ের পাশে ছিল, সেটা অশোকবাবুর কাছে দামী ঘড়ি আর প্রচুর টাকা পয়সা থাকলেও খুনী তার কিছুই নেয় নি।সুই না পালিয়ে নিজেই গিয়ে সেই রাতে পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দেয়। আর,সেই রাতে বিভীষিকাময় পাশবিক গর্জনটা তো শিমুলতলার অনেকেই শুনেছে। যেটা কোনো মতেই সুইয়ের হতে পারে না। পরের দিন ভিজে

মাটিতে পাওয়া গেছিল নখরযুক্ত পায়ের ছাপ,অশোকবাবুর মৃতদেহের পাশেই। সেই ছাপ নেকড়ের মতো হলেও আকারে অনেক বড়ো,মানুষের পায়ের ছাপ কোনো মতেই হতে পারে না। তাহলে প্রাণীটা কতো বড়ো হবে! আতঙ্কের এক শীতল স্রোত বয়ে গেল বরদাচরণের শরীর দিয়ে। আবার পরক্ষণেই মনে হল,কেউ অবশ্য ছদ্মবেশ ধারণ করে অশোকবাবুকে মারলে আলাদা কথা। হ্যাঁ,সেটাই হয়ে থাকবে। ফরেন্সিক হলেই সব বোঝা যাবে।

সুই নিজে একটাই দুঃখপ্রকাশ করছে,তার উচিত ছিল অশোকবাবুর জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করা। অন্তত আততায়ীর মুখোমুখি হওয়া। মুণ্ডারা গরীব হতে পারে,কিন্তু ভীতু নয়। এবার তার জীবনের লক্ষ্যই হয়ে উঠেছে,এই অজ্ঞাত আততায়ীর মুখোমুখি হওয়া। জীবন যায় তো যাক,এবার আর পালাবে না সে।


এদিকে বিষ্ণুমন্দিরের পুরোহিত তুলে ধরেছেন অদ্ভুত এক তত্ত্ব।তাঁর মতে,এ যেন বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার। পাপীদের সংহার করার জন্য স্বর্গ থেকে ভগবান ধরাধামে নেমে এসেছেন। "সম্ভবামি যুগে যুগে।"

যদিও আগের বার খুন হওয়া ভিখারী কিভাবে পাপী হয়,বুঝতে পারে না বরদাচরণ। যদিও অশোকবাবু তেমন একটা ভালো মানুষ ছিলেন না। ব্ল্যাক মানি তো ছিলই,প্রচুর অনৈতিক কাজ আর অশুভ চক্রের সাথে জড়িত ছিলেন। এদিক থেকে 'সম্ভবামি যুগে যুগে' য তত্ত্ব খাটে। বরদাচরণ নিজে অপেক্ষাকৃত সৎ হলে কি হবে সুদে টাকা খাটান। প্রচুর মানুষ তাঁকে আড়ালে 'রক্তচোষা বরদা' বলে ডাকে। তাহলে,কখনো তাঁর পালা কি আসতে পারে এই মৃত্যুর রঙ্গমঞ্চে! না কি,এর আগে শিমুলতলা

থেকে কেটে পড়াই ভালো।

তখনই মনে পড়ল বরদার আজ তার ভাইপো কৃষাণু আসার দিন।কৃষাণু কোলকাতার প্রেসিডন্সির জুলজি অনার্সের স্টুডেন্ট,বুদ্ধিতে তুখোড়। আজ রবিবার। কোলকাতা থেকে ট্রেন জার্নি করে আসছে আজ। হাঁক পাড়লেন শুভ্র সাহা,"মঞ্জুমাসি রান্নাটা দেখ। শানু আসছে। আমি চললাম মাংস আনতে।"


তৃতীয় পর্ব

ব্ল্যাকির মনে ফোবিয়া

মনের মধ্যে চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে শুভস্মিতার। কয়েকদিন আগেই সে গিয়েছিল তার মামা সতীন্দ্র পাণ্ডের বাড়ি,তার প্রাণের থেকেও প্রিয় কালো রঙের জার্মান শেফার্ড ডগ ব্ল্যাকিকে নিয়ে। ব্ল্যাকি যেমন বিশ্বাসী,তেমন ভালোবাসে শুভস্মিতাকে। ওর বাবা প্রিয়াঙ্ক রাওয়াত দিল্লিতে থাকাকালীন কেনেল থেকে কিনেছিলেন ব্ল্যাকিকে। এখন আসতে আসতে ব্ল্যাকি বড়ো হয়েছে,রাতের বেলা সারা বাড়িটাকে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাহারা দেয়। হতে পারে কুকুর,কিন্তু নেকড়েরই তো জাতভাই। প্রিয়াঙ্ক ও তাঁর স্ত্রী পায়েলকে কুকুরটা নিজের বাবা মা বলে মানে,আর শুভস্মিতাকে সেরকমই ভালোবাসে। কেনেল থেকে কুকুরটাকে আনার সময়ই প্রিয়াঙ্ক বাড়িতে বলেছিলেন,ব্ল্যাকির বাবা মা নেই। ওর জীবনে যেন এই ঘাটতি টা ও কোনোমতেই না ফিল করে। আর প্রিয়াঙ্কের স্ত্রী পায়েল আর শুভস্মিতাও ব্ল্যাকিকে সেরকম করেই দেখেন। পায়েলের কাছে ব্ল্যাকি সন্তানতুল্য,তেমন শুভস্মিতারও ছোটো ভাইয়ের মতো।বাবা মা বাইরে গেছেন কয়েকদিনের জন্য,শুভস্মিতা নিজেই এমনি ডাকাবুকো স্বভাবের,তার ওপর এই বাঙলোটাকে পাহারা দিচ্ছে ব্ল্যাকি। শুভস্মিতাকে সবসময় আড়াল করে রাখে অএই জার্মান শেফার্ড কুকুর। শিমুলতলার মানুষ শুভস্মিতাকে যতো না চেনে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের মেয়ে বলে,তার থেকেও বেশি চেনে ব্ল্যাকির বন্ধু বলে। ব্ল্যাকির আরেক গুণ আছে,সেটা হল মানুষ চেনার ক্ষমতা। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রিয়াঙ্কের,এর জন্যই ব্ল্যাকি অতুলনীয়। অন্য কুকুরেরা যেমন অচেনা মানুষ দেখলেই গর্জে ওঠে,তেমন অচেনা মানুষ যদি ভালো হয়,তাহলে ব্ল্যাকি টুঁ শব্দ করবে না। কিন্তু তার সাথে আলাপ করার লোভও ছাড়বে না। পা চেটে দেবে,কাছে এসে বসবে,লেজ নাড়বে,এক কথায় খুব ফ্রেন্ডলি। কিন্তু মন্দ হলেই সমস্যা,সেখানে ব্ল্যাকি নেকড়ের থেকেও হিংস্র হয়ে উঠবে।যাকে সাধারণ মানুষ খারাপ বলে বুঝতেই পারছে না,আচার আচরণে চালচলনে ভদ্রতার মুখোশ পরে আছে,ভালো পোষাক,মুখে শুধুই মিষ্টি কথা-এমন মানুষকেও এক লহমায় খারাপ বলে চিনে ফেলতে পারে ব্ল্যাকি। এর জন্য প্রিয়াঙ্কের ট্রেনিংও কিছুটা দায়ী। ছোটবেলা থেকেই ব্ল্যাকিকে আলাদা না রেখে মানবসমাজের সাথে নানাভাবে মেশার সুযোগ করে দিয়েছেন ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টার প্রিয়াঙ্ক। আই এ এস অফিসার প্রিয়াঙ্কের সাথে থেকে ব্ল্যাকি ছোটবেলা থেকেই দেখেছে,কেতাদুরস্ত ভদ্রতার মেকি মুখোশপরা মানুষগুলোর মধ্যে কিরকম জানোয়ার বাস করে। এভাবেই ব্ল্যাকি ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে ডেভেলপ করেছে মানুষ চেনার ক্ষমতা। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা খারাপ লোকেদের ওপর ব্ল্যাকি গর্জেছে,তাদের ভয় দেখিয়ে নাস্তানাবুদ করেছে,কিন্তু এখনো কাউকে আহত করে নি বা কামড়ায় নি।এককথায় ব্ল্যাকি অনবদ্য। উফ,আগের বার শুভ্র সাহা আর অশোক মজুমদারকে যেরকম নাকানিসে যাই হোক,গত কয়েকদিন ধরেই ব্ল্যাকি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সেই তেজী ভাবটা নেই,কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে।সবসময় কুঁই কুঁই করে শুভস্মিতার পেছন পেছন ঘোরে। ও কি শুভস্মিতার কোনো আগাম বিপদ আঁচ করতে পেরেছে, সে দিন যেদিন পূর্ণিমারাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অজানা পশুর অপার্থিব গর্জন শুনেছিল শুভস্মিতা আর কেঁপে উঠেছিল বিশ্বচরাচর,অজানা আততায়ীর হাতে খুন হয়েছিলেন অশোক মজুমদার,সেদিন থেকেই তার প্রিয় ব্ল্যাকির এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন।সাহসী ভাবটাই উধাও হয়ে গেছে ব্আচ্ছা,সেদিন যখন পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বিশ্বচরাচর,সেদিন তো ব্ল্যাকি বাইরেই ছিল। বাঙলো পাহারা দিচ্ছিল। অজ্ঞান হওয়ার আগে অবধি শুভস্মিতার মনে আছে ,জন্তুটা এদিকেই আসছিল। আচ্ছা,ব্ল্যাকি কিছু দেখে নি তো চাঁদের আলোয়!কুকুরটাকে শিগগিরি অ্যানিম্যাল সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে দেখাতে হবে।কিন্তু এই শিমুলতলার মতো জায়গায় ভালো অ্যানিম্যাল সাইক্রিয়াটিস্ট কোথায় পাবে সে। না,তাকে যেতে হবে ঝাঝায়। সেখানে একজন অ্যানিম্যাল সাইক্রিয়াটিস্ট আছেন। তাঁর নাম আশুতোষ শর্মা।


চতুর্থ পর্ব

প্রফুল্লবাবুর দুঃস্বপ্ন

কর্মজীবনে অঙ্কের প্রফেসর হলেও অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্সে পি এইচ ডি করা স্কলার প্রফুল্ল কুমার দাসের জীবন গড়পড়তা বাঙালীদের মতো কোনোওকালেই ছিল না। কলেজ লাইফ থেকেই তিনি করতে ভালোবাসতের দূরদূরান্তে ট্রিফ। দুর্দম বেগে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীতে বোটিং ও দুর্গম গিরিতে ট্রেকিংয়ের বরাবরের জন্য ফ্যান ছিলেন তিনি। অজানা অচেনা জায়গায় বাছাই করা গুটিকয়েক বন্ধুকে নিয়ে বা কোনোসময় একাই উইকএন্ড অ্যাডভেঞ্চার তাঁর কাছে জলভাত। ফটোগ্রাফির শখ ছোটোবেলা থেকেই। একবার বাড়ি থেকে একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন নন্দাদেবী পাহাড়ে ট্রেকিং করতে। সেখানের স্থানীয় আতঙ্ক মিগোইয়ের উপকথাকে পাত্তা না দিয়েই তিনজন শেরপার সাথে ট্রেক করেছিলেন পাহাড়টাতে। তারপর সেখানে ফটো তুলে বীরের মতো সেই ফটো বাড়িতে এসে সবাইকে দেখিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবনের একটাই রসায়ন,"ডর কে আগে জিত হ্যায়।" প্রফুল্লবাবুর একটাই দুঃখ ছিল,বন্ধুমহলে শেয়ার করতেন এই দুঃখের কথা। জীবনে তিনি সবই করলেন। কিন্তু সুন্দরবনে বাঘের ডেরায় গিয়ে বাঘ মারতে পারলেন না। আসলে শিকার করা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তো। আরেকটা তাঁর স্বপ্ন ছিল ফরেস্ট অফিআর প্রফুল্লবাবুর মতে,সুন্দরবনের বায়োডাইভার্সিটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। বিদেশি সংস্থা আর চোরাশিকারীদের কবলে পড়ে সেই সম্পদ এখন নিশ্চিহ্ন হতে বসেছভয় যে প্রফুল্লবাবু পান নি,তা নয়। একবারই পেয়েছিলেন এবং তাঁর জীবনে এর পরিণাম হয়েছিল বেশ ভয়প্রফুল্লস্যার কলেজের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক বলে পরিচিত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছে।পরিণতিও এসেছে জীবনে। কিন্তু এখনো তিনি অবিবাহিত। কিন্তু মাঝেমাঝে তাঁর ভেতরে সেই দামাল ছেলেটা জেগে ওঠে। যাই হোক,সেবার খবরের কাগজে প্রফুল্লবাবু দেখলেন ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা লাগোয়া মনোহরপুরে অজানা জানোয়ারের আক্রমণে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতিবারে মৃত্যুগুলো হচ্ছে পূর্ণিমারাতেই। আগে মানুষ ভেবেছিল হুড়াল বা হায়নার কাণ্ড । কিন্তু এতগুলো মানুষকে এরকম নৃশংসতার সাথে হত্যা করা হুড়ালের কাজ না। আর হুড়াল বা হায়না দল বেঁধে আক্রমণ করে। কিন্তু,আততায়ী ছিল অন্যরকম। ভিজে মাটিতে দেখা গেছিল,একজোড়া পায়ের ছাপ। পায়ের পাতার আকৃতি নেকড়ের মতো হলেও আকারে অস্বাভাবিক বড়ো,তাহলে এই প্রাণীটা আকারে কতো বড়ো হবে! আর তার চেয়েও বড়ো কথা,প্রাণীটা নেকড়ে বা হায়নার মতো চতুষ্পদ নযবনদপ্তরও নড়েচড়ে বসেছে। ব্যাপারটায় বেশ রহস্যের গন্ধ পান প্রফুল্লবাবু। ডাল ম্যায় কুছ তো কালা হ্যায়। প্রিয় বন্ধু সতীন্দ্রের সাথে পাড়ি দেন মনোহরপুরের উদ্দেকোলকাতা থেকে মোটামুটি চারশো কিলোমিটার দূরত্বে ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা সীমান্তে ছবির মতো সুন্দর শহর মনোহরপুর। শাল পিয়ালের অরণ্যে ঘেরা ধূম্র পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই শহর যেন কোনো সুদক্ষ চিত্রকর দ্বারা অঙ্কিত ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ছবি। ভ্রমণপিপাসু মানুষদের বেড়িয়ে আসবার জন্য এক আদর্শ স্থান। পাশ দিয়ে এক প্রাণোচ্ছল উদ্ভিন্নযৌবনা যুবতীর মতো তিরতির করে বয়ে চলেছে কল্লোলিনী কোয়না নদী। শীতকালে কুয়াশা ঘেরা সকালে শাল সেগুনের জঙ্গলে মর্মরধ্বনি জাগিয়ে বয়ে চলে উত্তুরে হাওয়া। ছবির মতো সুন্দর এই শহরে একরাশ পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছে হনুমান মন্দির। এছাড়া আছে রাধাস্বামী সৎসঙ্গ বিয়াস আর কিছু দূরেই মা তারিণীর মন্দির। এছাড়া কাছাকাছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাহাদা,বালিবা, অভয়পুর,বারপোস ইত্যাদি আদিবাসী গ্রাম। এখান থেকে চক্রধরপুর আর টাটানগরও খুব একটা দূরে নয়। কোয়েল নদী তো খুব কাছেই! এক কথায় প্রকৃতিরাণী সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে সাজিয়েছে নিজেদেরকে। মনোহরপুর সত্যিই মনোহর! এই জায়গাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল যে,মনোহরপুর দিয়ে সারান্দা ফরেস্টে প্রবেশ করা যায়। তাই তো মনোহরপুরকে বলা হয় সকিন্তু,সবচেয়ে বিড়ম্বনার ব্যাপার হল এইসব সুন্দর সুন্দর স্থানেই পৃথিবীর রহস্যময় অতিলৌকিক ব্যাপারগুলি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যাই হোক,মনোহরপুরের কাছেই সারান্দা ফরেস্ট। ফরেস্ট গেস্ট হাউসেই প্রিয় বন্ধু সতীন্দ্রের সাথে উঠলেন প্রফুল্লবাবু। ফরেস্ট রেঞ্জার মিত্রভানু শর্মা প্রফুল্লবাবুর পূর্বপরিচিত। যাই হোক,কয়েকদিন দারুণ কাটল। রাত্রের ডিনার বলতে বনমোরগ বা কোয়েল পাখির মাংস। এছাড়া দিনের বেলা মিত্রভানু আর তন্ময়ের সাথে জাঙ্গল সাফারি তো আছেই। আকাশে কিন্তু চাঁদ ইতিমধ্যেই গোল হতে শুরুসেইদিনই মিত্রভানু বলছিলেন অদ্ভুত এক কথা। " বুঝলে প্রফুল্ল,অনেকেই এখানে বলে আর আমারও জানি না কেন মনে হচ্ছে,এই হত্যাকাণ্ডগুলো অরণ্যের কোনো জন্তু কর্তৃক হয় না। এখানের মুণ্ডারা বলে অদ্ভুত এক কথা,যা এককথায় বিশ্বাস করা সাধারণ যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। যে ঐ শয়তান বাইরে থেকে আসে না,সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশ নিয়েই বেঁচে থাকে। কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদনি রাতে বেড়ে ওঠে শয়তানের রক্তপিপাসা। তখন সে ছদ্মবেশ ত্যাগ করে নিজের ভয়াল রূপ ধারণ করে। যে তার মায়ায় ভুলবে,তারই প্রাণহানি হবে। অথচ সাধারণ মানুষের রূপ নিয়ে থাকে বলে তাকে শনাক্ত করা এককথায় দুঃসাধ্য।" ভানুর কথাগুলো শুনে রক্তে আতঙ্কের এক শীতল স্রোত বয়ে গেছিল দুই বন্ধুর। তাহলে কি শয়তান তাদের মধ্যেই রয়েছে বনকর্মী বা মুণ্ডা যুবকের ছদ্মবেশ ধারণ করে!আর সেদিনই প্রিয় বন্ধু সতীন্দ্রের কাছে শুনেছিলেন প্রফুল্লবাবু এক অজানা তথ্য । প্রথমবারের জন্য শুনেছিলেন ওয়্যারউল্ফ কথাটা। গড়পড়তা দেখতে এক সাধারণ মানুষ যে চাঁদের জ্যোৎস্নায় পরিণত হয় মনে একরাশ কৌতুহল ভরে প্রফুল্লবাবু জানতে চেয়েছিলেন সতীন্দ্রের কাছে,তার কি মনে হয়,এরকম অসুস্থ মানুষের সত্যিই অস্তিত্ব আছে।উত্তরে সতীন্দ্র বলল,"ভাই,আমার যা পড়াশুনো তাতে মনে হয় শুধু চাঁদের আলোর উপস্থিতিতে শেপ শিফটিং করে কোনো মানুষের পক্ষেই হিংস্র নেকড়েতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু,বিজ্ঞানের পরিভাষায় একটা কথা আছে,'ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রোপি!' মানে ধর ,একজন মানুষ যাকে এমনিতে দেখে যথেষ্ট পরিমাণে সুস্থ স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পূর্ণিমারাতের মায়াবী চাঁদের আলোয় সে নিজেকে হিংস্র নেকড়ে বলে ভাবতে শুরু করে। হিংস্র কাজকর্ম শুরু করে দেয়। তুই দেখে ভাবতে পারবি না, সেই নিরীহ মানুষটা তখন কতোটা অপ্রকৃতস্থ ,কতোটা নির্মম,কতোটা ফেরোশাস হয়ে ওঠে। এটা আর কিছুই নয়- একধরণের মানসিক রোগ বা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। আরেক ধরণের জেনেটিক ডিসঅর্ডার রয়েছে। তাতে কোনো শিশু জন্মাবার সাথে যখন আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, তখন তাদের শরীরে ও মুখমণ্ডলে এতো রোমের আধিক্য থাকে,তখন তাদের মুখকে মানুষের বদলে কোনো পশুর মুখ বলে মনে হয়। আমি শিওর,এই দুটি কনসেপ্টের সংমিশ্রণে ওয়্যারউল্ফ নামক মিথের জন্ম ।" প্রফুল্লবাবু বলে উঠলেন -"ও মাই গড!" সতীন্দ্র-"হ্যাঁ ভাই ,জাস্ট একবার ভাব তো । ভারতের গ্রামাঞ্চলে এরকম জেনেটিক ডিসঅর্ডারের বাচ্চারা জন্মালে সমাজ তার অশিক্ষার ফলে তাকে নৃ-বৃকের শিশু বলেই আখ্যা দেয়। তারপরে সেই নিরীহ অভাগা শিশুদের সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। ভারত কেন,পৃথিবীর অনেক দেশেই এইরকম ঘটনা ঘটে থাকে। আর ওয়্যারউল্ফ যতো না নৃশংস,যতো না নির্দয়,তার চেয়েও বেশি নৃশংস,তার চেয়েও বেশি নিতারপর সতীন্দ্র যোগ করল অদ্ভুত এক কথা,"ইউরোপে উপকথা আছে যে , ওয়্যারউল্ফ কাউকে কামড়ালে বা আহত করলে ,সেও ওয়্যারউল্ফে পরিণত হয়। এটা অনেকটা একধরণের অসুস্থতা টাইপের। তখন সেই মানুষ চাঁদনি রাতে পরিণত হয় এক নৃশংস পশুতে। কিন্তু,এই রোগের একধরণের প্রতিষেধকও আছে। হ্যাঁ,একধরণের জড়িবুটি আছে যেটা ওয়্যারউল্ফে পরিণত হওয়া আটকাতে পারে।অনেকটা অ্যান্টিডোট টাইপের। আর,আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল,ওয়্যারউল্ফ যেখানে বাস করে সেখানে এইধরণের জড়িবুটি জন্মায়। আর ,একবার নৃ-বৃকে পরিণত হয়ে গেলে তখন সেই অ্যান্টিডোট কাজ করে না।তখন সেই নেকড়েমানুষকে আটকাতে গেলে তাকে হত্যা করতে হয়। আর যার জন্য একমাত্র প্রয়োজন সতীন্দ্রের দিকে নির্নিমেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন প্রফুল্লবাবু। পড়ন্ত যৌবনে নতুনভাবে আবিষ্কার করছেন তাঁর কলেজ ফ্রেণ্ডকে। অনুভব করছেন সতীন্দ্রের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাকে। বলে উঠলেন,"হ্যাঁ রে,তুই তো যুক্তিবাদী। তুই এইসব কথাকে বিশ্বাস করিস!সতীন্দ্র বলে উঠলেন,"কি বল তো,শুধু ইউরোপ কেন,ওয়্যারউল্ফের মিথটা কিন্তু কমবেশি সব জায়গাতেই প্রচলিত। দেখেছিস তো,এখানকার অশিক্ষিত আদিবাসী সমাজেও চলে এসেছে ওয়্যারউল্ফের মিথটা। আর যা রটে,কিছু তো তার ঘটে। আর এখানকার গভীর অরণ্যানী,দুর্গম গিরি,বয়ে চলা কোয়েল নদী এতোই রহস্যময় যে সেটাই মনের ভেতরের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের প্রাচীরকে ভেঙে ফেলে। মনের মধ্যে জেগে ওঠে এক অবর্ণনীয় আতঙ্ক।" এবার প্রফুল্লবাবুর মুখেও খেলে গেল ভয়ের কালো ছায়া। তাহলে কি সত্যিই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে নরপিশাচ,সময় পেলেই ধারণ করবে স্বরূপ,যার বর্ণনশুক্লপক্ষের চতুর্দশী। চাঁদ মোটামুটি গোল আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর বুকে আঁধার নামার সাথে সাথেই ঘনিয়ে এল পিশাচের রাত। সেই রাতেই অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে মৃত্যু হল মিত্রভানুর। মিত্রভানু উপর্যুপরি গুলি চালিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেগুলি সাধারণ গুলি। নরপিশাচের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে নি। বনের মধ্যে যে জায়গায় নরপিশাচকে শিকারের জন্য ক্যাম্প করেছিলেন মিত্রভানুরা,সেই ক্যাম্প তখন আতঙ্কে কাঁপছে। সবাই সবাইকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখছে ।বলা তো যায় না, কার আড়ালে লুকিয়ে আছে শয়তান। যাই হোক,মিত্রভানু সিলভার বুলেট জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছেন। সেইগুলো এখন প্রফুল্লবাবু আর সতীন্দ্রের জিম্মায়। যাই হোক,এই দিয়েই সাবাড় করবেন অদৃশ্য আততায়ীকে। প্রফুল্লবাবুর চোখমুখে ফুটে উঠল প্রতিজ্ঞা। না,অনেক দিন পর শিকারের শখ পূর্ণ হবে তাঁর। বন্ধুর হত্যাকারীকে তিনি সাবাড় করবেনই। কিন্তু দিনের আলো ফুটতেই কয়েকজন স্থানীয় বিশ্বাসী মুণ্ডা যুবককে নিয়েই জঙ্গল পরিদর্শনে বেরোলেন দুই বন্ধু। আজ পূর্ণিমা। আজ পিশাচকে ধ্বংস করার দিন। এরপর আর কোনো রহস্যময় হত্যাকাণ্ড হবে না মনোহরপুরের অরণ্যে। কিন্তু জিপে করে বেরোবার সময় তিনি লক্ষ্যই করলেন না,তাঁদেরই এক মুণ্ডা সঙ্গীর কব্জি আর কাঁধে ক্ষতচিহ্ন,একমাত্র গুলির আঘাতেই যেরআকাশে চাঁদ উঠেছে। প্রহ্লাদিনী চন্দ্রিমা। সারা বিশ্বচরাচর যেন চাঁদনির নেশায় মেতে উঠেছে। পাগলের মতো বন্দুক নিয়ে প্রফুল্লবাবু খুঁজছিলেন আততায়ীকে। আততায়ী যে তার বন্ধু সতীন্দ্রকে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তার আস্তানায়। আততায়ী আর কেউ নয় তাদের সবচেয়ে ভীতু মুণ্ডা সঙ্গী জোয়া ভগৎ,চাঁদের আলোয় কিভাবে ভীতু মুখচোরা যুবক ভয়ের প্রতিরূপে পরিণত হয় সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। দেহের আয়তন বিরাট থেকে বিরাটতর হয়েছে, কানদুটো ধীরে ধীরে ছুঁচালো হয়েছে,মুখটা লম্বাটে হতে হতে দুই ধারালো শ্বদন্ত বেরিয়ে পড়েছে,সারা দেহে গজিয়ে উঠেছে ঘন কালো রোম। রক্তবর্ণ দুচোখে জেগে উঠেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বিভীষিকা,মুখে কথার বদলে জেগে উঠেছে জান্তব গোঙানি,চোয়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে রক্তবর্ণ লালাঝরা জিভ। নরপশুর দুচোখকে রক্তের নেশায় ঘোলাটে বলে মনে হচ্ছে। জোয়ার শরীরে নেকড়ের উল্কি আগেই দেখেছিলেন প্রফুল্লবাবুরা। দেখে যে সন্দেহ জাগে নি,এমনটা নয়। কিন্তু জোয়াকে জিজ্ঞাসা করাতে ও বলে এটা দেওয়ের চিত্র। দেওকে ওরা পূজা করে। এরপর আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কিছু বলকিন্তু,চন্দ্রাহত জোয়া আজ পরিণত হয়েছে হিংস্র নরপশুতেসেই নরপশু টানতে টানতে নিয়ে গেল তার প্রাণের বন্ধু সতীন্দ্রকে। অথচ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। প্রফুল্লবাবু যে এখনোও চাঁদের ম্যাজিক দেখছেনা,পিশাচকে তিনি ছাড়বেনই না। এই গুহাটাই তাহলে ওর আস্তানা। সামনে সতীন্দ্রের ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে দেখে মনে জিঘাংসা জেগে উঠল প্রফুল্লবাবুর। ইশ,চারপাশটা কেমন অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে না। গুহার একদিকটা ফাঁকা ছিল,সেইদিক থেকে এসে পড়ছিল চাঁদের রূপোলী আলো। হঠাৎই সেই আলোকে আড়াল করে এসে দাঁড়াল এক বীভৎস বিরাট ছায়ামূর্তি। পেছন ফিরলেন প্রফুল্লবাবু,আর এবার পরিষ্কার দেখতে পেলেন সেই জীবন্ত বিভীষিকাকে। সাহসের জায়গা নিল আতঙ্ক,রক্ত জল হয়ে এল। নির্নিমেষ চক্ষে তাকে নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে নরপিশাচ। কিছুক্ষণের অপেক্ষা,আর তারপরই গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলল নরপিশাচ। আর এতক্ষণ যে চিৎকারটা দলা পাকিয়ে ছিল,সেটাই বেরিয়ে এল প্রফুল্লস্যারের মুখ থেকে।

চিৎকার করে ঘুম ভেঙে গেল প্রফুল্লবাবুর। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। বিশ্বচরাচর উষালগ্নে ফরসা হতে শুরু করেছে। উফ,কি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। গত কয়েক বছর এই এক স্বপ্নই তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। উফ,এই বিভীষিকার হাত থেকে মুক্তি নেই। কোথায় মনোহরপুর,আর কোথায় শিমুলতলা। না,তাঁকে এবার কিছু একটা করতেই হবে। কোনো একটা পদক্ষেপ ওঠাতেই হবে। মন দৃঢ় করে ফেললেন প্রফুল্লবাবু। শিমুলতলাতেই হয়তো পাবেন বহুপ্রতীক্ষিত শিকার।


পঞ্চম পর্ব

শুভস্মিতার উদ্বেগ আর কৃষাণুর সন্দেহ


অ্যানিমাল সাইক্রিয়াটিস্ট ড: আশুতোষ শর্মার কাছে ব্ল্যাকিকে দেখিয়েছে শুভস্মিতা। ড: শর্মার মতে, এইসব কুঁইকুঁই করা,ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়া,বারবার নিজের জিভ চাটা, চোখে চোখ না রাখতে পারা- এসব লক্ষণ একটাই অর্থ বহন করে। এর মানে হল,কুকুরটার মধ্যে কোনো কারণে তৈরি হয়েছে ভয় বা উদ্বেগ। নিশ্চয়ই তার সাথে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে বা ব্ল্যাকি এমন কিছু জিনিস দেখেছে ,যার ফলে দুঃসাহসী ব্ল্যাকির মনেও তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। আর এই আতঙ্কের কারণ যখন অবসৃত হবে,তখন ব্ল্যাকির মনের আতঙ্কও দূরীভূত হবে।উত্তেজনা কমাতে কিছু ওষুধ আর সিডেটিভসও তিনি প্রেসক্রাইব করে দিয়েছেন। যাই হোক, ব্ল্যাকিকে ডাক্তার দেখিয়ে ঝাঝা থেকে শিমুলতলা ফিরল শুভস্মিতা।

কয়েকদিন পরেই চিন্তা ফের দানা বাধল শুভস্মিতার মনে। তার মামা সতীন্দ্র পাণ্ডের বাড়িতে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ ছিল তার। আর সেখানেই তার সাথে পরিচয় হল মামার বন্ধু প্রফুল্ল দাসের সাথে। আর তখনই আবার শুরু হল ব্ল্যাকির অদ্ভুত আচরণ। প্রফুল্লবাবুর চোখের দিকে এক নিমেষে তাকিয়ে থাকল ব্ল্যাকি। আর তারপরই দুবার ঘেউঘেউ করার পর আবার সেই কুঁই কুঁই আওয়াজ। ব্ল্যাকি প্রফুল্লবাবুকে দেখে তার পেছনে লুকোচ্ছে কেন। আবার চোখ দিয়ে প্রফুল্লবাবুর দিকে তাকিয়েই ইশারা করছে। ব্ল্যাকি কি খুব ভয় পেয়েছে! সে কি প্রফুল্লবাবুর সম্পর্কে কিছু বলতে চায়। আর ঠিকই তো প্রফুল্লবাবুর আসার পর থেকেই ব্ল্যাকির আতঙ্ক শুরু হয়েছে। আর আজকে সে মামার কাছে সে জানতে পেরেছে যেদিন প্রফুল্লবাবু আসেন,সেই অভিশপ্ত রাতেই খুন হন অশোককাকু । তবে প্রফুল্লবাবুই কি সেই ..............! না,আর ভাবতে পারছে না শুভস্মিতা।প্রফুল্লবাবুর রহস্য ওকে জানতেই হবে। হ্যাঁ,নেক্সট পূর্ণিমার রাতে শিমুলতলায় আর কোনো হত্যাকাণ্ড হতে কৃষাণু ভালো করেই জানে যে,কাকার পেটে কোনো কথা থাকে না। ট্রেনে আসতে আসতেই সে মোবাইলে কাকার কাছে শুনেছে শিমুলতলায় পূর্ণিমারাতে ঘটে চলা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। কাকার তো যা অবস্থা,এখনই পালাতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু কৃষাণু সেটা হতে দিচ্ছে না। এমনিই রহস্যগল্পের জম্পেশ ভক্ত ও। আর এবার কলেজের ভ্যাকেশনে নিজেই অ্যাডভেঞ্চার করার সুযোগ পেয়েছে। কাকার মুখ থেকে শোনা হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা শুনেছে হত্যাকারীর ধরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে বিদেশী গল্পের বইয়ে পড়া নেকড়েমানব বা ওয়্যারউল্ফের সম্পর্কে। কিন্তু এও কি সম্ভব! নরনেকড়ে তো লেখকের কল্পনামাত্র। আবার এও হতে পারে ছদ্মবেশের আড়ালে হয়তো কোনোমানুষই এই কাজ করছে। কে না জানে,কুটিলতা আর ক্রূরতার দিক থেকে মানুষ হিংস্র জন্তুর থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর।চাঁদ গোল হতে শুরু করার আগেই শুভস্মিতার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কে না বলতে পারে,ওর কাছ থেকে কিছু ক্লু পেলেও পেতে পারশুভস্মিতার সাথে কৃষাণুর পরিচয় স্কুল লাইফ থেকেই। দুজনেই শিমুলতলার স্বামী বিবেকানন্দ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। একটা সময় দুজন দুজনকে পছন্দ করত। কিন্তু,এখন কৃষাণু কোলকাতা থাকার দরুণ দুজনের মধ্যেই দেখা বা কথা খুব একটা হয় না। একে অপরের প্রতি ভালোলাগাটা ব্যক্ত করাও হয় নি। সেটা মনেই থেকে গেছে। আর,ভালোবাসা মানে যদি ভালো চাওয়া হয় ,তাহলে একে অপরকে এখনোও ভালোবাসে। আরেকটা কথা তো আছেই,দূরত্ব আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয় প্রেমের ক্ষেত্রে। দুদিন কাকার বাড়িতে কাটিয়ে শুভস্মিতার সাথে দেখা করল কৃষাণু। কৃষাণু বলল,"ওয়্যারউল্ফের কথা শুনেছি গথিক লিটারেচারে। কিন্তু,বাস্তবে যে ওয়্যারউল্ফ থাকতে পারে,সেটা তোর মুখে না শুনলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।" প্রত্যুত্তরে শুভস্মিতা বলল,"সত্যিই কৃষ,আমিও এই নেকড়েমানবের কথায় বিশ্বাস করতাম না যদি আমি নিজের কানে সেই অপার্থিব হুংকার না শুনতাম। এখন পুলিশও বলছে জন্তুটা দুপেয়ে ছিল,চারপেয়ে নয়। আর অতবড়ো গাছের গুঁড়ি ওপড়াবার মতো শক্তি কোনো মানুষের মধ্যে থাকতে পারে না। ঐ অমানবিক শক্তির অধিকারী অতীন্দ্রিয় জগতেরই কোনো বাসিন্দা হয়ে থাকবে।" কৃষাণুর মুখ গম্ভীর হল,"আর তোর এই ব্ল্যাকির চোখে এই নিদারুণ ভয় আমি নিজের চোখেই দেখেছি। সত্যিই ব্ল্যাকিকে এত ভয়ভীত কখনো দেখি নি।" ফিসফিস স্বরে শুভস্মিতা বলে উঠল,"জানিস তো,আমার মনে হয় ঐ প্রফেসরটা,কি নাম যেন প্রফুল্ল দাস-ওর মধ্যে কোনো প্রবলেম আছে। ও আসার পর থেকেই গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।" কৃষাণু-"আমিও লোকটাকে দেখেছি। হাঁটাচলা,তাকানো কেমন যেন সন্দেহজনক। এখানেই সেনভিলায় উঠেছে। লোকটাকে দেখলেই সন্দেহ মনে দানা বাঁধে,সে কাকাএতক্ষণ পরে হাসল শুভস্মিতা,"আর ছাড় তো,তোর কাকা কতকিছুই না ভাবে!" ফুরফুরে হাওয়া বইছিল। শিমুলতলা শহরের বাইরের দিকে অবস্থিত রাওয়াতদের এই বাঙলো থেকে শিমুলতলা শহর আর পাহাড়তলি আর অরণ্যানীর অনেকটাই দেখা যায়। সকাল বেলা। পশ্চিমের পাহাড়তলিকে ধূসর লাগছে। সেদিন ঐদিক থেকেই পৈশাচিক গর্জন ভেসে আসছিল। স্মিতার গা ছমছম করে উঠল। ঐদিকেই তো আবার আছে সেনভিলা। যেখানে থাকেন রহস্যময় প্রফুল্লবাবু। কৃষাণু বলে উঠল,"কাকুর কাছে লাইসেন্সড গান আছে। বুঝলি তো। পারলে সিলভার বুলেটের ব্যবস্থা আমি করব। পুলিশের সাথে কথা বলতে হবে।" মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল স্মিতা,"তার আগে সেনভিলায় আমাদের দুজনকে গিয়ে অন্তত প্রফুল্লবাবুর সাথে কথা বলা উচিত। যতদূর জানি,এই ধরণের মানুষগুলো অসুস্থই হয়। এদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস ,আত্মনির্ভরতা বলতে কিছুই থাকে না। তাই যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ব্ল্যাকমেল করতে হবে,আর আমাদের সন্দেহ সত্যি হলে সেটা কাজ করবেই।"কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল শুভস্মিতা,তারপর সকালের খোলা হাওয়ায় বুক ভরে গভীর শ্বাস নিয়ে স্মিতা বলল,"আমি চিন্তায় আছি ব্ল্যাকিকে নিয়ে। আমি চাই না ওর কিছু হোক। "

"তুই দেখিস,নেক্সট পূর্ণিমায় কেউ খুন হবে না।কিন্তু একটা নরপিশাচ যেন মারা যায়।"




অন্তিম পর্ব

রহস্য থেকে সরল পর্দা


 শনিবার বিকালের পড়ন্ত সোনালী আলোয়  কৃষাণুর সাথে সেনভিলা গিয়ে শুভস্মিতা উপস্থিত হল প্রফুল্লবাবুকে জেরা করবার জন্য। ব্ল্যাকিও ছিল, কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল শুভস্মিতা কৃষাণুর সাথে আলোচনা করে সেনভিলাটাকে যতোটা বিভীষিকাময় মনে করেছিল ব্যাপারটা কিন্তু অতোটা বিভীষিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। বরং তার পরিবর্তে তার মননে জন্ম নিল একরাশ বিস্ময়। ব্ল্যাকির মনের উদ্বেগ আর ফোবিয়া কিছুটা কমেছে। সেদিন বিকালে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সেনভিলার ছাদে মন মাতাল করা ফুরফুরে হাওয়ার মধ্যে বসে প্রফুল্লবাবু তাদের শোনাচ্ছিলেন মনোহরপুরের সেই রহস্যময় কাহিনী। দিগন্তরেখায় অভ্রভেদী ধূম্র গিরিধর। নির্নিমেষ চক্ষে প্রফুল্লবাবুর দিকে তাকিয়ে সেই রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা কাহিনী শুনছিল শুভস্মিতা। সেই অভিশপ্ত পূর্ণিমার রাতে প্রফুল্লবাবু সিলভার বুলেট দিয়ে সত্যি সত্যিই সাবাড় করতে পেরেছিলেন সেই বিভীষিকাময় নরপিশাচকে। কিন্তু ,বাঁচাতে পারেন নি তার প্রাণাধিক বন্ধু সতীন্দ্রকে পূর্ণিমারাতের বিভীষিকার হাত থেকে। নরপিশাচের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছিল সতীন্দ্রের নিথর দেহ। ঘটনার ঘনঘটা এতোটা চমকে দিয়েছিল প্রফুল্লবাবুকে যে বন্ধুর অন্তিম সংস্কার না করেই তিনি পালিয়ে আসেন।নরপিশাচের সাথে যুদ্ধ করার সময় তিনি নিজেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। যাই হোক,অভিশপ্ত মনোহরপুর থেকে কোলকাতায় ফিরে এসে তিনি সুস্থ হন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেন এক পরিবর্তন। আগের সেই ঝিমঝিমে ভাবটা আর নেই,তার পরিবর্তে শরীর মনে এক অদম্য তেজী ভাব। অন্যের শরীরে ক্ষতস্থান দেখলেই তিনি নিজের মধ্যে অনুভব করেন অন্তহীন রক্ততৃষ্ণা। তাহলে কি তিনি স্বাভাবিক নন এখন,নাকি নরপিশাচের বিষাক্ত আঁচড় তাকেও ইনফেক্টেড করেছে। এক অভিশপ্ত পূর্ণিমার রাতে নিজের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করেন প্রফুল্লবাবু,তিনি মানুষ থেকে পরিণত হচ্ছেন এক ভয়াবহ অমানুষে ।না,আর দেরি করবেন না তিনি। এখনো তাঁর আত্মা পুরোপুরি অভিশপ্ত হয় নি। তার মধ্যে কিছু একটা করতে হবে তাঁকে। হ্যাঁ,তাঁর জিম্মায় তো রয়েছে সারান্দার জড়িবুটি থেকে ভানুর নিজের হাতে বানানো অ্যান্টিডোটটা।সেটাই ব্যবহানা,পরম করুণাময় ঈশ্বরের অসীম কৃপা। অ্যান্টিডোটের প্রভাবে ধীরে ধীরে পৈশাচিক সত্ত্বা থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন প্রফুল্লবাবু। কিন্তু,তাঁর দুঃস্বপ্নের রজনী তখনোও শেষ হয় নি।খবর পেলেন তিনি,সতীন্দ্র বেঁচে আছে,শিমুলতলাতেই আছে আর গত পূর্ণিমারাতে শিমুলতলায় একজনের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। প্রফুল্লবাবুর মনে জেগে উঠল সন্দেহ। তাহলে কি এখনোও শেষ হয় নি পূর্ণিমারাতের আতঙ্ক! নরপিশাচের অভিশপ্ত আত্মা কি সতীন্দ্রের শরীরে প্রবেশ করেছে! আর সতীন্দ্রের কাছে তো অ্যান্টিডোটও ছিল না। দুইয়ে দুইয়ে চার করতে দেরি হল না প্রফুল্লবাবুর । এবার নিজের দুঃস্বপ্নের অন্ত ঘটাবেন বলে শিমুলতলার ট্রেন ধরলেন প্রফুল্লবাবু।মনোহরপুরের পূর্ণিমারাতের অভিশপ্ত বিভীষিকা তার মনে তৈরি করেছে অশরীরী আতঙ্কের এক অসুস্থতা। আর এই অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে গেলে পিশাচকে স্বহস্তে বিনষ্ট করতে হবে। আর এই ব্যাপারে তাঁকে উপযুক্ত সাহায্য করতে পারে কৃষাণু আর শুভস্মিতা। যদি সতীন্দ্র পুরোপুরি ওয়্যারউল্ফে পরিণত হয়ে থাকে,তাহলে অ্যান্টিডোট আর সেই অসুস্থতা সারাতে পারবে না। তখন যেটা প্রয়োজন সেটা হল সিলভার বুলেট দিয়ে সেই পিশাচকে নিকেশ করা। আর সেই মৃত্যুদূতকে শেষ করলে পূর্ণিমারাতের আতঙ্কের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাবে শিমুলতলা। প্রফুল্লবাবু সবশেষে বললেন,"আমি যেদিন এখানে আসলাম,সেদিনই মনে হল ওর সাথে দেখা করে ওকে বোঝাই ,আর ওর পৈশাচিক সত্ত্বা না মানলে ওকে শেষ করি। তাও মনে দ্বিধা থাকে,কি বল তো,এককালের প্রিয় বন্ধু তো। তবে কি জান তো, ও আর সতীন্দ্র নয়,এখন ওর শরীরে প্রবেশ করেছে শয়তান। আগেরবার আমার কিছু করার আগেই শয়তানটা নিজের কাজ সেরে বসল,কিন্তু পরের বার আর আমি এটা হতে দেব না। পরের বার শিমুলতলায় খুন হওয়া আমি আটকাবোই।তোমরা একটু সাপোর্ট কোরো। এটাই তোমাদের কাছে আমার চাওয়া। ম্লান মুখে শুভস্মিতা বলল,"আপনাকে অনেক হ্যারাস করলাম,স্যরি।" প্রফুল্লবাবুর কাঁধে হাত রেখে কৃষাণু বলল,"কোনো চিন্তা করবেন না স্যার,আপনার পাশে আমরা সব সময় আছি। এবার শিমুলতলায় সব গোলমাল মিটিয়ে দেব। শুধু আকাশের এই চাঁদটাকে পুরোপুরি গোল হতে দিন।পূর্ণিমা আসতে এখনোও একসপ্তাহ দেরি। রাত তিনটে। ব্যালকনিতে এসে পড়েছে চন্দ্রিমার রূপোলী কিরণ। শুভস্মিতার ঘুম আসছে না। তার মনে এখন চিন্তার ঝড় বইছে। তার মামা,যে মামাকে সে এতো শ্রদ্ধা করে,এতোটা বিশ্বাস করে যে এইরকম একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক,তিনি কিভাবে এরকম একটা জঘন্য বিভীষিকাময় খুনি হতে পারেন। এরকম তো নয় যে প্রফুল্লবাবু মনগড়া মিথ্যে কথা বলে ওদের বোকা বানালেন। কিন্তু,মনেপ্রাণে চায় শুভস্মিতা,পূর্ণিমারাতে একটা নরপিশাচের যেন মৃত্যএবার পূর্ণিমা আসার আগেই বৃষ্টি শুরু হল শিমুলতলায়। অকালবর্ষণের প্রাদুর্ভাবে এই সবুজ বনানী আর ধূসর গিরিধরময় জগৎ যে কতোটা রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে,কবির মনে কতোটা কল্পনাশক্তি জাগিয়ে তোলে সেটা নিজের চোখে না দেখলে অনুভব করা যায় না। উদ্যম গতিতে উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীর মতো প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বইছে সম্পূর্ণশরীরা তটিনী,আকাশে ঘনকৃষ্ণ জলধর। মন মাতাল করা বাতাস বইছে যার পরশ মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে বন্য কামনা। মন চায় এক শরীর একটু উষ্ণতার জন্য। শালপত্রের ওপর জমে থাকা স্বচ্ছ জলবিন্দু মুক্তাবিন্দুর ন্যায় প্রতিভাত হয় আলোককিরণে। ভেসে আসে মাটির সোঁদা গন্ধ। বাদলা ঝোড়ো হাওয়া মনকে পাগল করে তোলে।কৃষাণুর মননে জেগে ওঠে প্রেমিকার কটাক্ষের নয়নবহ্নি,উচ্ছল যৌবনপ্রভা আর রক্তিম অধরের চুম্বযাই হোক,পূর্ণিমা আসার আগেই মামার বাড়ি থেকে এক অপ্রত্যাশিত নিমন্ত্রণ পেল শুভস্মিতা। আর এটাও জানতে পারল যে,গতবারের মতোই এবারও ওখানে থাকবে প্রফুল্লবাবুর উপস্থিতি। এছাড়া থাকছেন শিমুলতলার বাঙালী ইন্সপেক্টর প্রান্তিকবাবু। তাহলে কি ঐ আকাঙ্ক্ষিত দিনটাতেই হবে রহস্যের যবনিকাপাত। না কি মামা তাদের মধ্যে হওয়া কথাবার্তার ব্যাপারে কিছু জানতে পারেন নি তো। মামা কি অন্তর্যামী! ব্যাপারটা কৃষাণুকে জানাতেই হবে।ও সাহায্য করতে পারেএসে গেল পূর্ণিমা। শিমুলতলার সতীন্দ্র পাণ্ডের কুঠিবাড়ি শহরের একেবারে উত্তরাংশে। আশেপাশে বাড়িঘর নেই বললেই চলে,পড়তি জমি আর বাবলা আর মহুয়া। রূপোলী চন্দ্রালোকে বিশ্বচরাচর ভাসছে। মহুয়ার মন মাতাল করা গন্ধে চারিদিক মম করসতীন্দ্র পাণ্ডে হয় তো আগে থেকেই সন্দেহ করেছিলেন। আজ তাঁর বাড়িতে বিশেষ 'অনুষ্ঠান'। অতিথি মাত্র চারজন। প্রান্তিকবাবু,যিনি শিমুলতলায় প্রতি পূর্ণিমারাতে ঘটে চলা খুনগুলির তদন্ত করছেন,প্রফুল্লবাবু,যিনি শিমুলতলায় আসবার দিনই আততায়ী অশোকবাবুকে হত্যা করে,ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের মেয়ে শুভস্মিতা,কোলকাতা থেকে আসা বরদাচরণের ভাইপো কৃষাণু।।সতীন্দ্র বাবু শুরু করলেন মনোহরপুরের কাহিনী দিয়ে। আগের দিন প্রফুল্লবাবু যা বলেছিলেন তার ঠিক উল্টো কথা বললেন উনি। দোষারোপ করলেন প্রফুল্লবাবুকে। সর্বোপরি প্রফুল্লবাবুর আসার রাতেই অশোকবাবুকে খুন করা হয়েছে। এবার প্রতিবাদ করলেন প্রফুল্লবাবু। তিনি সতীন্দ্র পাণ্ডেকে সরাসরি মিথ্যেবাদী বলে প্রান্তিক সরখেলকে বললেন যে,প্রান্তিকবাবু চাইলে মনোহরপুরে গিয়ে কয়েক বছর আগের এই ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নিয়ে আসতে পারেন। একে অপরকে দোষারোপ ক্রমশ বাগবিতণ্ডার জায়গা নিল। কৃষাণু আর শুভস্মিতার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে,তারা যেন কোনো চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে।শুভস্মিতার ছায়াসঙ্গী ব্ল্যাকিও ঘন ঘন লেজ নেড়ে যেন কিসের ইশারা করছে। প্রান্তিকবাবুও মৌন,তিনি বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক দোলাচলে বিচরণ করছে। ওয়্যারউল্ফ,নেকড়ে মানকুঠিবাড়ির সামনের ঘরে আলোচনা হচ্ছিল। কেউ লক্ষ্যই করেনি,কখন আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে গোল চাঁদ হাসছে। চাঁদের রূপোলী কিরণ প্রবেশ করেছে জানলা দিয়েহঠাৎই কৃষাণুকে সচেতন করে এক ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল শুভস্মিতার মুখ থেকে। স্মিতার ইশারা তার মামার পায়ের দিকে যেখানে মানুষের পায়ের পাতার পরিবর্তে একগোছা ধূসর রোমযুক্ত পশুর বাঁকানো পা। ভাগ্নীর ইঙ্গিতকে অনুধাবন করতে বিলম্ব হল না সতীন্দ্রর। তিনিও দেখেছেন সবাই জেনে গেছে শয়তানের স্বরূপ। এক ক্রূর হাসি জেগে উঠল তার মকাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠল একজোড়া পেঁচা।আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ,রূপোলী জ্যোৎস্নায় পৃথিবী ভাসছে। শুরু হল মানুষের এক হিংস্র অমানুষে পরিবর্তন।পাঞ্জাবী প্যান্ট ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেল,শরীরের আয়তন বাড়তে লাগল,সারা শরীরে গজিয়ে উঠল অজস্র রোম,মুখ লম্বাটে হয়ে গেল,কান লম্বাটে আর ছুঁচালো হয়ে গেল,রক্তবর্ণ দুই চোখে জেগে উঠল আদিম জিঘাংসা। চোয়াল থেকে উঁকি মারতে থাকল শুভ্রধবল তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত,রক্তলোভে মুখ থেকে বেরিয়ে এল লালাঝরা জিভ। প্রান্তিক দেখছিলেন গোল চাঁদের যাদু,তিনি এতদিনে খুঁজে পেয়েছেন সেই বহু প্রতীক্ষিত পূর্ণিমারাতের সিরিয়াল কিলারকে।

প্রান্তিক এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রিভলবার বের করে পরপর তিনবার গুলি চালালেন,কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাড়হিম করা গর্জন করে উঠল নেকড়ে।সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সেই অমানুষ তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত দিয়ে প্রান্তিকের গলার নলি ছিঁড়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রক্তজল করা গর্জন করে রক্তপান করতে থাকল। এতক্ষণ যে আতঙ্ক গলার কাছে দলা পাকিয়ে এসেছিল,তাই চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এল স্মিতার মুখঅমানুষটা প্রান্তিককে ছেড়ে তাকাল স্মিতার দিকে। ততক্ষণ কোথা থেকে লাফিয়ে এল ব্ল্যাকি। এই ব্ল্যাকির মধ্যে আর ভয় নেই,এ সেই আগের ব্ল্যাকি। তীব্র জান্তব গর্জনে অমানুষটাকে চমকে দিয়ে লাফিয়ে পড়ল অমানুষটার ওপর। নিজের তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত আর নখর দিয়ে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল শয়তানটাকে। এদিকে নেকড়েমানবও অসম্ভব শক্তিশালী। ব্ল্যাকিকে ক্ষতবিক্ষত,নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। কিন্তু ব্ল্যাকি কোথা থেকে যেন আজ দৈবশক্তি প্রাপ্ত হয়েছে। ও যেন প্রতিজ্ঞা করেছে,শিমুলতলার বিভীষিকাকে ওই ধ্বংস করবে। অমিত শক্তির অধিকারী ব্ল্যাকির সাথে এঁটে উঠতে নেকড়েমানব হিমসিম খাচ্ছে। বীভৎস গর্জন করে ব্ল্যাকিকে ক্ষতবিক্ষত করছে,কিন্তু ব্ল্যাকি তার মালকিনকে বাঁচাতে শেষ শক্তি দিয়েমেঝে ভাসছে লাল রক্তে।

এই সুযোগকে হাতছাড়া হতে দিলেন না প্রফুল্লবাবু। পকেট থেকে রিভলবার বার করে পরপর ছখানা সিলভার বুলেট বসিয়ে দিলেন নেকড়ে মানবের বুকে। মৃত্যুকালীন গগনভেদী আর্তনাদে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেই বিভীষিকার নিথর দেহ যা কিছুক্ষণ পরে পরিণত হল সতীন্দ্র পাণ্ডের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহে।এদিকে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ব্ল্যাকিও কাতরাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে মৃত্যুর প্রশান্তি নেমে এল ব্ল্যাকির দুচোখে। না,সে নিজের দায়িত্ব পালনে এবারও পিছপা হয় নি। কান্নায় ভেঙে পড়ল শুভস্মিতা। তার ব্ল্যাকি আর নেই! প্রফুল্লবাবু নিশ্চিন্ত। শিমুলতলার আতঙ্কের বিনাশ হয়েছে। আর পূর্ণিমারাতে কেউ খুন হবে না। তবুও তিনি খুশি হতে পারছেন কই। দুঃখ আর অবসাদে ভেঙে যাচ্ছে বুক। এর আগে প্রচুর মৃত্যু দেখেছেন,কিন্তু একটা নিরীহ কুকুরের মৃত্যুতে তাঁর মতো পোড়খাওয়া লোকের এতো কষ্ট হবে,এটা তাঁর কল্পনার বদশ বছর অতিক্রান্ত। শুভস্মিতার সাথে কৃষাণুর বিয়ে হয়েছে। সে এখন আমেরিকানিবাসী। তবুও কখনো শিমুলতলায় এলে প্রিয় ব্ল্যাকির কবরে ফুল দিতে ভোলে না। কথাশিল্পীর দেওঘরের স্মৃতির মতো বিখ্যাত না হোক তবুও শিমুলতলার স্মৃতি ব্ল্যাকি আজ প্রভুভক্তির দিক

থেকে উজ্জ্বল। প্রার্থনা করে কৃষাণু আর শুভস্মিতা ব্ল্যাকির আত্মা যেখানেই থাকুক শান্তিতে থাকুক,আনন্দে থাকুক।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics