Sandip Das

Abstract

5.0  

Sandip Das

Abstract

চন্দননগরের মেয়েটা ( বই ২ )

চন্দননগরের মেয়েটা ( বই ২ )

15 mins
585



পূর্বকথন


ফরাসি বন্দর সেজে থাকে স্বপ্নে 

ভাঙা উপকূল সেজে ওঠে 

জেগে ওঠা প্রদীপের আলোয় 

ভালোবাসা বুক চিতিয়ে প্রার্থনা হয় 

খোলা বাতাসে , রাস্তার পাশে 

সংকট হরনের দুটো পায়ে করুন সুর 

নিমগ্ন হয় গান হয়ে ।

আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন 

কিন্তু ব্যাথাগুলো, আহত হয়ে বেঁচে থাকবে

কতদিন ??

গল্প এগিয়ে চলুক, অববাহিকা ধরে 

সকলের জন্য উন্মুক্ত হোক পটভূমি, 

চন্দননগরের তীরে।

হতাশ হবেন না, ঈশ্বর ফিরে এসেছে 

সকলের জন্য ---

শুধু এটুকুই উদ্বিগ্নতা হৃদয় জুড়ে 

লেগে থাকা জীবনের ব্যাথাগুলো , 

স্বাভাবিক কি হতে পারবে

কোনদিন ??


হাসপাতাল থেকে আজ ঈশ্বরকে ছেড়ে দেওয়া হবে । প্রায় দিন সাতেক হাসপাতালে থেকে এখন শারীরিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে । তাই এই সিদ্ধান্ত । এই সাতদিন ঈশ্বর যে কিভাবে কাটিয়েছে তা শুধু ঈশ্বর জানে । অবশ্য রাজধানী থেকে বহু দূরে বসে থাকা চন্দননগরের মেয়েটা কত রাত যে বিনিদ্র কাটিয়েছে তা শুধু সেই জানে । আজ যখন ঈশ্বর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসছে তখন সত্যবতী সংকট মোচনের দরবারে আর সংকট মোচনের আশীর্বাদে সব যেন কেমন ঠিক হয়ে গেছে । 

কি ঠিক হল আবার ???

ছেলের দুর্ঘটনার খবর শুনে মা দিল্লিতে উপস্থিত । কলিগ দের সহযোগিতা য় মা কে সত্যবতী র ব্যাপারে সব খুলে জানানো । আর সব শেষে সত্যকে বাড়ির বউ হিসেবে মা এর মেনে নেওয়া --- এ সংকটমোচনের আশীর্বাদ নয়ত আর কি !! এখন এই সুখবরটা শুধু সত্যকে জানাতে বাকি । সে কি যে আনন্দ হবে না !! তবে ঈশ্বর তার সত্যকে আরো বেশি চমক দিতে চায় । তাই সে চুপ করে গেছে পুরো বিষয়টা নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছান পর্যন্ত । 

এখন এক মাস ফুল বেড রেস্ট .... ডাক্তার এডভাইস ।

ওদিকে মা ঈশ্বরের সঙ্গে থাকায় সত্যবতী আর সাহস করে যোগাযোগ করতে পারে নি । তার মনেও যে ভীষন ভয় , যদি এই সম্পর্ক ভেঙে যায় । কিন্তু কতদিন আর চুপ থাকা যায় এভাবে । সেদিন রবিবার । তখন ওই সন্ধ্যে সাতটা হবে , কাজের অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয় সত্যবতী । ইস্টিশনের দিকটা এখন বেশ ফাঁকা । আর এর আগেও স্টেশনে বসে চুটিয়ে প্রেম করেছে তারা , অবশ্যই ফোনে । আজও ওই জায়গাটাই বেছে নিলো সত্যবতী ।

স্টেশন আজ মোটামুটি ফাঁকা । অন্যদিন তাও অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড় থাকে আজ তারাও নেই । ওভার ব্রিজের ওপরে উঠে ঈশ্বর এর নম্বর ডায়াল করলো সে নিজের মোবাইল থেকে । একবার রিং হতে না হতেই ফোনটা রিসিভ করলো কেউ । কে ফোন ধরেছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে না পেরে সত্যবতী ভয়ে ফোন কেটে দিলো । তার মনে সংশয় , যদি ঈশ্বরের মা অর্থাৎ তার আন্টি ফোন ধরে তবে সে কি বলবে তাকে । তিনি তো আমাদের ব্যাপারে কিছু জানে না । এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঈশ্বরী আবার ফোন করলো ঈশ্বরকে । ঈশ্বর এদিকে মজাটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল । তাই সে ফোন ধরেও চুপ করে রইল । 

সত্যবতী র আর তর সইছিল না । সে এবার মোবাইলের ওপাশ থেকে আস্তে করে নিচু গলায় বলল , হ্যালো ... হ্যালো .... 

ঈশ্বর , সত্যবতী র কান্ডকারখানায় আর চুপ থাকতে না পেরে হা হা করে হাসতে লাগলো । সত্যবতী র এমন মজা সহ্য হল না ঠিকই তবে ঈশ্বরের গলার আওয়াজ শুনে ধরে প্রাণ ফিরে পেল যেন । যাক , তার মানে আন্টি ঘরে নেই , মনে মনে এই ভেবে সত্য বলে উঠলো , " কথা বলছিলে না কেন এতক্ষন " ? 

ঈশ্বর এক মিনিট চুপ রইল , তারপর বলতে শুরু করলো কিছু কবিতার লাইন যা তার এই মুহূর্তে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হল –

" তব নীরবে আজ এ কেমন ছলনা 

মম হৃদয় ডোরে তোমায় বেঁধেছি গো বং ললনা 

মায়াবন মাঝে , চাঁদ বসে হাসে 

দেখে প্রতীক্ষার এ দীর্ঘ খেলা 

আমি তার থেকে তখনও অনেক দূরে 

নৌকায় ভেসে যাই প্রেম সমুদ্দুরে 

সাথে ত্রিরত্ন আমার ----

মা , তুমি আর আমাদের ভালোবাসা " ।

কবিতাটা শুনে সত্যর মুখ হাসিতে ভরে উঠল । জীবনের আরাম যেন বারবার সে খুঁজে পায় ঈশ্বরের কবিতায় । যে অবস্থাই হোক এ যেন এক একটা উপহার সত্যর কাছে । 

"কেমন আছো এখন " ? ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করলো সত্য । 

~ ভালোই আছি । সারাদিন ছুটি । খাচ্ছি আর ঘুমাচ্ছি .... 

ঈশ্বরকে এক প্রকার টোন কেটে সত্যবতী বলে উঠলো , " আর দিন দিন ভুড়ি বাগাচ্ছ জলহস্তীর মত ... " 

ঈশ্বর এ কথার কোন উত্তর দিতে না পেরে চুপ থাকাটাই ঠিক মনে করল । 

সত্যবতী ঈশ্বরের নীরব অবস্থা দেখে বেশ বুঝলো যে তার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি । তাই সেই বিষয় থেকে সরে গিয়ে একটু সুর চড়িয়ে বললো , " বাইক চালাবার সময় মন কোনদিকে থাকে তোমার ! জানো কত টেনশন " ….সত্যর কথাটা শেষ করার আগেই ঈশ্বর একদম নিজের কায়দায় বলে উঠলো ,

" আমার কিছুই হয়নি । সবটাই নাটক ।

অভিনেতা অভিনেত্রী ভরা রঙ্গমঞ্চ 

সবাই খল - শুধু এই শব্দ ছাড়া 

কিছু দেখেছ এতদিন আর অনেক দেখোনি " ।

সত্যবতী অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে । ঈশ্বর কি বলছে এসব !! সে ঠিক শুনলো নাকি এটাও একটা মিথ্যে স্বপ্ন ? 

কয়েক মিনিটের নীরবতা দুদিকেই আর তারপর ঈশ্বর এর হাহা করে সেই চেনা হাসিতে সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল । 

" ..... আমি তো মজা করছিলাম । তুমি সিরিয়াস ভাবলে নাকি " ? তারপর আবার হাসতে লাগলো সে । সত্যবতী আজ এত ইয়ার্কি সহ্য করতে না পেরে ফোন কেটে দিলো । ভালোবাসা বড্ড কঠিন , সব থামিয়ে দিয়েও আবার চলতে হয় একসাথে । অনেক গভির নীরবতাও ভেঙে যায় প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার ডাকে । এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি কিছুই । মোবাইলে ঈশ্বরের নম্বরটা ভেসে উঠতেই সত্যবতী নিজের আবেগ কে আর সামলাতে পারি নি । ফোন রিসিভ করেই স্ক্রিনের ওপরের চুমু খেতে থাকে সে । ঈশ্বর ওপাশ থেকে বলে ওঠে , " হয়েছে হয়েছে । আর ইমোশনল হতে হবে না । " সত্যবতী কোন মতে নিজেকে সামলে নেয় ও তারপর বলতে শুরু করে আবার , " জানো । তুমি যখন হাসপাতালে ছিলে তখন তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল আমার । আমি সংকটমোচনের কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করতাম তোমার জন্য । দেখো তিনি আমার কথা শুনেছেন । ' সত্যর অনবরত ভেসে চলা কথার মাঝখানে একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে ঈশ্বর বলে উঠলো , " একটা ভালো খবর আছে । মা তোমাকে কিছু বলবে " । বলেই সে মোবাইলটা মায়ের হাতে পাচার করে দিল ।

মায়ের নাম শুনেই সত্যবতী কেমন যেন ঘাবড়ে গেল । আসলে মানুষ মাত্রই এমন হয় । একটা গভির চিন্তা যখন ভর করে আমাদের ওপরে তখন আমরা প্রত্যেকে ঘাবড়ে যাই । আর যেখানে ভালবাসা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে সেখানে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু কি ? তবে এত উৎকণ্ঠার মধ্যেও সত্য একটা বিষয় ভেবে আনন্দিত যে ঈশ্বর তার মাকে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সব বলে দিতে পেরেছে আর আন্টি যখন তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে তখন ধরা যেতেই পারে যে এই সম্পর্কে তার কোন আপত্তি নেই ।

ঈশ্বরের মা ফোন হাতে নিয়ে কথা বলে চলেছে তার হবু বৌমার সাথে , ততক্ষনে ঈশ্বর হাত পা ধুয়ে সন্ধ্যে দেখিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে । বেশ কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে সে । বিছানায় পা তুলে বসে মাকে ডাক দিয়ে সে খেতে দিতে বললো এবার । সত্যর সাথে কথা বলতে বলতে মা যেন কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল । খেয়াল নেই ছেলেটার কথা । এতক্ষনে ঈশ্বরের ডাকে খেয়াল এলো তার । ফোনটা ঈশ্বরের হাতে ধরিয়ে মা এবার গেল চা করতে । 

" মা কে সব বলে দিয়েছো " ? সত্যবতী , ঈশ্বরের কাছে জানতে চাইলো । ঈশ্বর মুখে একটা ছোট্ট হাসি ফুটিয়ে একদম নিজের ভঙ্গিমায় উত্তর দিল , 

আমি নয় .... রাজীব.....  

মুহূর্তের মধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ঈশ্বরের । কথা যেন মুখ থেকে কোন ভাবেই বেরোচ্ছে না তার । একবার কোন মতে বেশ জড়িয়ে সত্য বলে হাক দিল সে আর তারপর দুবার মা বলে ডেকে উঠলো বহু কষ্টে । মা রান্নাঘর থেকে এমন বিকট ডাক শুনে দৌড়ে ঘরে এসে দেখে ফোন মাটিতে পড়ে আর ছেলেটা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে । সত্যবতী ঈশ্বরের কথা জড়িয়ে আসতে দেখে তিন চারবার চিৎকার করে ওঠে কিন্তু এরই মধ্যে ফোনটি কেটে যায় । এরপরেও সে বহুবার ফোন লাগাবার চেষ্টা করে সে কিন্তু ক্রমাগত ফোন সুইচ অফ আসতে থাকে । কোন উপায় না দেখে সত্য তাদের ব্যাপারে সমস্ত কিছু বাড়িতে জানাবে ঠিক করে এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে দিল্লি যাবে তার ঈশ্বরের খোঁজে । 

ওদিকে দিল্লিতে ঈশ্বরের ওই অবস্থা দেখে তার মা প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে পড়ে । হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া যে কোন পথ নেই তার কাছে এটা সে বেশ বুঝতে পারছিল কিন্তু একা মেয়েছেলে এই ভিনরাজ্যে কী করে সবকিছু সামলাবে তা নির্ধারণ করতে পারছিল না । অতএব , অজিতকে ফোন করে শেষ মেস । 

ঈশ্বরের এই অবস্থার কথা শুনে অজিত ও অন্যান্য কলিগ উপস্থিত হয় এবং রাত ১১.৩০ নাগাদ ঈশ্বরকে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয় । ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে কার্ডিয়াক এরেস্টের সম্ভাবনার কথা জানায় ও আই সি ইউ তে পাঠিয়ে দেয় । 

প্রায় দু আড়াই ঘণ্টা ক্রমাগত চিকিৎসার পর ডাক্তারবাবু শুকনো ঝোলানো মুখ নিয়ে আই সি ইউ থেকে বেরিয়ে এসে ঈশ্বরের পরিবারকে এক কোনায় আসার ইশারা করে । 

" ঈশ্বর ভালো হয়ে যাবে তো " , বেশ চিন্তিত কণ্ঠে ঈশ্বরের মা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলে ডাক্তার নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিনিট দুই । কি বলবে বোধহয় সে নিজেও ঠিক করতে পারছে না । অবশেষে মা ও তার সহকর্মীদের তিনি জানান , " একিউট সেরিব্রাল এটাক । পেশেন্ট কোমা মে চলা গয়া হয় । হম কুছ নেহি কহ সকতে । সায়েদ এক ঘন্টা ইয়া এক দিন ইয়া এক সাল ইয়া ..... " তিনি আর কিছু বলার আগে ঈশ্বরের মায়ের দুচোখ জলে ভেসে গেল । ছেলের এই অবস্থা দেখতে কোন মা চায় আর এই অবস্থা হয়ে গেলে মা কি পারে নিজেকে সামলে রাখতে ! তবু অজিত , রাহুল , রজত , আলী এদের চেষ্টা ছিল তাদের সহ কর্মীর মা কে ঠিক রাখা । বিশেষ করে সদ্য স্বামী হারা এই বিধবার ছেলে ছাড়া যে আর কেউ নেই । 

*******


পূর্বকথন


ভিষন মনে পড়ে মনে তার কথা 

হেরে যাওয়া কালি মুখেও  

লিখে গেছে কলমে অগণিত জয়গাথা । 


বিন্দু বিন্দু জলে সাগর ওঠে জেগে 

হাজার পরাজিত পুরস্কার আমার 


মৃত্যুই মুক্তির একক পথ এখন 

মরণেই সব সফলতা...


এপাশে ঈশ্বরের মা তার ছেলের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা নিয়ে হাসপাতালের বাইরে যখন ভেজা চোখে অপেক্ষারত , তখন এখান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলার এক ফরাসি নগরে গঙ্গার ধারে বসে সত্যবতী । গভীরভাবে চিন্তিত সে , তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় । আর হবে নাই বা কেন , সেরাতের পর থেকে ঈশ্বরের ফোন সুইচ অফ । ঈশ্বরের শেষ কন্ঠস্বর আজও তার কানে ভাসছে । বহুবার চেষ্টা করেও বাড়িতে বিষয়টি সে জানাতে পারেনি । 

ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করে নম্বরটা ডায়াল করলো সত্য । আজ রিং হল কয়েকবার , কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করলো না । কিছুটা আশার আলো পেয়ে সে আবার কল করলো । এবারেও তাই হলো । এবার সে ক্রমাগত কল করে চললো এই আশা নিয়ে যে কেউ না কেউ , কখনো না কখনো ফোনটা ধরবে । কিন্তু তার আশা সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে গেল যখন ফোনটা রিং অবস্থায় সুইচ অফ হয়ে গেলো অথবা করে দেওয়া হলো । এর পর আর ফোন রিং হলো না একবারও , যদিও সত্য বার দশেক চেষ্টা করেছিল ফোনে । হতাশ হয়ে সে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো , ব্যাগের চেনটা বন্ধ করলো আর তারপর হাঁটা লাগালো বাড়ির দিকে এই ভেবে যে সে বাড়িতে আজ সব বলবেই কিন্তু বহুবার চেষ্টা করলেও ফল কিছুই হয়নি । সাহস করে সত্য তার মা বাবাকে মনের জমানো কথাগুলো আজও বলতে পারলো না । ভয় একটাই যদি তারা রাজি না হয় , তাহলে কি হবে ? নিজের রাখা শর্তের জালে আজ নিজেই ফেঁসে গেছে সত্যবতী । 

এভাবে দিন পেরোতে লাগলো এবং প্রতিটা বয়ে যাওয়া দিন দু দিকেই হতাশা বয়ে নিয়ে আসতে থাকলো আরো বেশি বেশি করে । ঈশ্বরের মা , ঈশ্বরের দুঃখে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । তিন দিন জল স্পর্শ করে নি মুখে । ফলে দুর্বল হয়েছে শরীর । তার এই অবস্থা দেখে অজিত আর রজত তার কাছে এগিয়ে এসেছে বহুবার । বলেছিল ,  

" আন্টি কুছ খা লিজিয়ে । এয়েসে তো আপ বিমার পর জাওগে " । বাড়ি করে খাবার এনেছিল বহুবার । কিন্তু তিনি রাজি হননি । চুপ করে হাসপাতালের বাইরের বেঞ্চে বসে আছেন ক্রমাগত । দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি অনশনে বসেছেন ভগবানের বিরুদ্ধে । তার এ লড়াই দীর্ঘ আর কঠিন , তবু তিনি হার মানতে নারাজ । 

অন্যদিকে সত্যবতীর মানসিক অবস্থাও প্রায় একই রকম । খাবার ইচ্ছে নেই , তবু কিছু কিছু খেয়ে নাটকটা চালিয়ে যাচ্ছে সে । তবে এই টুকুতে কি আর চলে না শরীর মেনে নেয় !! ধীরে ধীরে সেও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং একদিন মন্দির থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাথা ঘুরে পড়ে যায় মাঝ রাস্তায় । কলকাতার বড় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সত্যকে । স্যালাইন এর তার লাগিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয় তার । 

দু বোতল স্যালাইনে বেশ কাজ দিয়েছে । সত্য এখন অনেকটা সুস্থ । আর তাই হাসপাতালের বিছানায় চুপচাপ ঘুমোচ্ছে আজ । পাশে একটি টুলে বসে আছে তার মা । এভাবে বসে বসে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল টের পায়নি তারা । হাসপাতালে রাখা পুরোনো দিনের বড় ঘড়িটা ঢং ঢং করে বারোবার বেজে উঠলো এবার । একটু পড়ে হাসপাতাল থেকে দুপুরের খাবারে - ভাত , ডাল , মাছ , ডিম ও দুধ দিয়ে গেল এক সিস্টার । সত্যর মা আস্তে করে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো , " ওঠ মা । খেয়ে নে এবার । দেখ বারোটা বেজে গেছে , এখনো ঘুমোবি " । 

চোখটা একটুখানি খুলে মায়ের দিকে কোনরকমে মুখ ঘুরিয়ে সত্য উত্তর দিল শুধু , " ঊঊঊঊ " ..... তারপর সে আবার চোখদুটো বুজিয়ে নিল আগের মতো । মা উপায় না দেখেও এক দুবার নাড়া দিলেন , কিন্তু মেয়ে প্রতিবারই তার হাতটা দূরে ঠেলে সরিয়ে দিলেন । পরাজিত মা পাশের টুলটায় গিয়ে বসে পড়লেন আবার । ঠিক এই সময় দরজার বাইরে থেকে ভিতরে এসে ঢুকলেন সত্যর বাবা , লম্বা চেহারা , বয়স ওই পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে , গায়ের রং মাঝারি , মাথায় চুল না থাকলেও গোঁফ আছে বেশ মোটা । ভিতরে ঢুকেই সত্যর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বললো , " মেয়ে কেমন আছে এখন ? কিছু খাইয়েছো তাকে " ? এদিকে লাঞ্চ টাইমে মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ ঢুকেছে দেখে এক অবাঙালী ট্রেনি নার্স এগিয়ে এসে বললো , " এই যে মুচ্ছর দাদা বাইরে যান , এটা লাঞ্চ টাইম " ..... মুচ্ছর শব্দটি শুনে তার চোখ লাল হয়ে গেল । " মাইন্ড ইওর ল্যাংগুয়েজ " , চিৎকার করে উঠলো সে আর তারপর সিস্টার সিস্টার করে হাঁকতে হাঁকতে এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে । 

সত্যবতী এতক্ষন চুপ করে মুখ গুজে শুয়ে ছিল । এবার চোখ খুলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো , " পাপার গলা মনে হল । কি হয়েছে মা ? পাপা অতো চ্যাচাতে চ্যাচাতে কোথায় গেল " ? 

" সব বলবো , তার আগে কিছু খেয়ে নাও " । 

খাওয়ার নাম শুনেই সত্যবতী আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল মায়ের থেকে । তবে মা এবার ছেড়ে দেওয়ার নয় । সত্যর পিঠে হাত রেখে মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে উঠলো , 


" কার জন্য এত ব্যস্ত , কার জন্য চিন্তায় বয়ে যায় স্রোত 

ভালোবাসলে হারতে শেখো 

হারানো দিনের কান্না এখন জমাট হোক " । 


কবিতাটা শুনেই সত্য অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো । মা কবিতার ভাষায় তো কথা বলে না কখনো । হাজার হাজার প্রশ্ন তার মাথায় তোলপাড় করে যাচ্ছে । কবিতার মধ্যে দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা সে জেনেছে তার ঈশ্বরের থেকে । তবে কি ????? 

সত্যবতী মায়ের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করলো আর তারপর 'হারতে ! ' , এটুকু বলেই মুখ নামিয়ে নিল আবার । মা আবার সত্যর কানের কাছে মুখ ঝুকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , সে কে ? 

কে সে ? , সত্যবতী মায়ের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো এবার । মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো , " ছেলেটি কে ? কোথায় থাকে ? কি করে " ? 

মায়ের সব প্রশ্ন বুঝেও অবুঝ মানুষের মত মাথা নাড়িয়ে সত্য বললো , " কোন ছেলেটি , মা " ? 

মা আর কিছু জিজ্ঞাসা করতো ঠিক সেই সময় , মি. মুখার্জি , তার বাবার গলায় ভেসে এলো একটা সুন্দর কবিতা । হাতে ফোন আর তিনি সেই ফোন দেখে দেখে কবিতাটি পড়তে পড়তে এগিয়ে আসছেন ---


" হ্যাঁ । ভালো আমিও বেসেছি 

সুখে দুখে পাশে থাকার সারি সারি অঙ্গীকার 

তুলে নিয়েছি কাঁধে । তবু , 

ভয় হয় জানো --- 

ভয় হয় ভাবনা এলেই 

যদি হঠাৎ চলে যাই কোথাও 

যদি হঠাৎ হারিয়ে যাই কোনদিন , অনেকদুরে 

যদি বদলে ফেলি হাত অন্য কোথাও 

যদি মন ভেঙে দিই তোমার , কিছুই না বলে ।

সেদিন কি সেদিন অপেক্ষা করবে আমার 

চোখ দুটো ওই ভিজবে কি সেদিন 

নাকি ঘৃণায় ভুলে যাবে সব ।

যদি তাই হয় , তাই যেন হয় তবে 

কোনদিন কেঁদো না গো ----

তোমার চোখের জল বড়ই পবিত্র 

পায়ে লাগা মহা পাপ । " 

কবিতাটা ঈশ্বর একদিন পাঠিয়েছিল তার হোয়্যাটসেপে । সত্যর বুঝতে বাকি নেই আর যে ঈশ্বরের সব কবিতা ও চ্যাট , মা ও পাপা পড়ে ফেলেছে । যে বিষয়টা সে এতদিন ধরে বলবে বলবে করেও বলতে পারে নি , তার অনেকটাই এখন তার বাড়িতে জানে । আর এতেই চিন্তা আরও বেড়েছে তার । 

দুদিন পর সত্যকে হাসপাতাল থেকে মুক্ত করে দেওয়া হল , কিন্তু তার পাশাপাশি ডাক্তারবাবু প্রচুর পরামর্শ দিলেন প্রচুর খাবার খাওয়ার । হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সত্যবতী কে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে তার বাবা মা বাড়ি নিয়ে চলে এলো । পথে আসতে আসতে ছেলেটির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে , সত্যবতী প্রথমবার সব খুলে বলে তাদের কাছে -- ঈশ্বরের সাথে পরিচয় , কথোপকথন , কবিতা , প্রেম সব কিছু । তার মা ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করবে জানায় । 

রাত এগারোটা । সত্যবতী তার মোবাইলটা খুলে বসলো । ফেসবুক ও হোয়্যাটসেপে কত চেনা মানুষের ভিড় । ম্যাসেজগুলো জঞ্জাল হয়ে স্তুপ হয়ে আছে । কিন্তু ঈশ্বর আজও অফলাইন । মোবাইলে তার নাম্বার ডায়েল করলে সেটিও আজ নীরব থেকে যায় । বিশ্বাস অবিশ্বাসের জালে জর্জরিত সে আজ । 

গাড়িতে আসার সময় বিকেলে মা ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে চাইলে সত্যবতী সব জানিয়েছিল তাদের । তার সব কথা দুজনে মন দিয়ে শুনেছিল ওরা আর তারপর মা আর পাপা যা বলেছিল তা তার কল্পনাতেও আসে নি কোনদিন । 

মায়ের কথাগুলো ভেসে উঠছে তার মনে বারবার । তাদের চোখ মুখ সে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই । সাহস করে ঈশ্বরকে একটা ম্যাসেজ করলো সে , যদিও তার জানা নেই ঈশ্বর কোনদিন উত্তর দেবে কি না তাকে । 

দিল্লির হাসপাতাল জুড়ে আজ সকাল থেকেই ভিড়ে ভিড় । আই সি ইউ থেকে জানানো হয়েছে গতকাল রাতে কোমা অবস্থাতেই ঈশ্বরের দুটো মাইল্ড এটাক হয়ে গেছে । অবস্থা খুবই শোচনীয় । খবরটি পাওয়া মাত্রই আগুনের মত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আত্মীয় পরিজনের মধ্যে । আর তাই ঈশ্বরের দিদিরা , জামাইবাবুরা সবাই ভিড় করেছে দিল্লির এই ছোট্ট নার্সিংহোমে । এজি অফিসের কর্মী ও কলিগরাও ভিড় করেছে সবার সাথে । 

বিকেল ৫ টা । আই সি ইউ থেকে শুকনো মুখে বেরিয়ে আসা ডাক্তার জানালো ঈশ্বর পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে রওনা দিয়েছে । পাগলের মত কান্নায় ভেঙে পড়ল ঈশ্বরের মা । জীবনের শেষ সম্বল হারিয়ে আজ তিনি একা । অজিত ও কিছু ছেলে এগিয়ে এলো । হাসপাতালের বাইরে একটা বেঞ্চে বসিয়ে জল খাওয়ানো হল । পুত্র - পুত্রী হারানো শোকের যন্ত্রনা মা বাবার কাছে কতটা কষ্টের সে যে হারিয়েছে সেই বুঝবে । 

আকাশের কালো মেঘ কাটতে আরো ছ মাস লেগে গেল । সেদিন ঈশ্বরের বড়দি এসেছে ওদের বাড়িতে । কথায় কথায় চন্দননগরের মেয়েটার কথা উঠে আসতেই , মা বললো , " আমার ছেলেটা সত্যকে খুব ভালোবাসতো । প্রায় ছ মাস কোন যোগাযোগ করা হয়নি ওর সাথে । দেখো না অনিলা ওর মোবাইল থেকে সত্যবতী র নাম্বার টা নিয়ে ওকে খবরটা জানানো যায় কি না ? যে যাওয়ার সে গেছে , কিন্তু খবরটা .... ওকে জানানো উচিত একবার ।

মোবাইল খুলতেই স্ক্রিনে ভেসে এলো হোয়্যাটসেপে পাঠানো সত্যবতী কবিতাটা --- প্রায় ছয় মাস আগে পাঠানো ---- 


" চোখে জল এসে গেল 

অনেক কথা গল্প হয়ে ভেসে এলো 

ক্ষমা করে দিও যদি সে তোমাদের কারুর হয় 

আমি আজও ভাবি , আমার ছাড়া সে কারুর নয় ।

জানিনা ভাগ্য কোথায় নিয়ে চলছে 

ব্যাস , মোড়টা আজ হারিয়ে গেছে 

অনধিকার প্রবেশ আমার নিষিদ্ধ হয়েছে ।

হয়তো কারুর বুকে জ্বলে আছে তার প্রদীপ 

ক্ষমা করে দিও আমায় তবে ; সুখে থেকো দুজনে

বিদায় , বন্ধু বিদায় ।।


অনিলা দিদি , ভাইয়ের মোবাইলটা চুপচাপ বন্ধ করে দিল । কাকিমা কে মিথ্যে বললেও সে ভেতরে ভেতরে বেশ জানতো ছয় মাস আগে একজন নয় , পৃথিবী ছেড়েছিল দুজন । মোবাইলটা চিরকালের মত বন্ধ করতে করতে একটাই প্রশ্ন তার মাথায় সমানে ঘুরে ঘুরে আসছিল - 

ভালোবাসার আকাশ পথে দিল্লি আর কলকাতা কি খুব দূর ? 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract