Sandip Das

Others

5.0  

Sandip Das

Others

সাত এ শুভ

সাত এ শুভ

63 mins
1.4K


১.পরিবর্তনশীল আধুনিকা

২.আগুনের পরশমণি

৩.এবং সাহিত্য

৪.(কনফেসন - ১

ধর্ম ও অধর্ম)

৫.(কনফেসন - ২ 

হারানো চিঠি)

৬.ফিরে আসা দিনরাত্রি

৭.অন্যায়


পরিবর্তনশীল আধুনিকা 


গল্পটি শুরু করার আগে বলে রাখা ভালো , কারুর জীবনের ঘটনা এ প্রকার হতেও পারে আর নাও পারে । তবে হলে , লেখকের দায়িত্ব খুবই কম , কারণ এ নিছক এক পুরানো বন্ধুর থেকে শোনা তারই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । শুনে বিশ্বাস হয় না , সময়ের সাথে সাথে চেহারা এক থাকলেও মানুষ বদলে যায় কীভাবে ? কিভাবে একজন সহজে অস্বীকার করতে পারে কারুর সাহায্য , যা কোন একদিন জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকা কাউকে বাঁচিয়েছিলো । আজ সে সম্পূর্ণ সুস্থ , নতুন জীবন শুরু করার মুখে । সে আজ সুস্থ এক ব্যক্তি , তবু ভুলে গেছে সেদিনের শুভ কে । আজ্ঞে হ্যা ! আমার বাল্য বন্ধু শুভ দত্ত । দেখতে লম্বা , ছিমছাম চেহারা , কিন্তু ভাগ্য ততটাই ছোট । অপরের সাহায্যে কোন দিন পিছু পা হতে দেখিনি তাকে । আজ হঠাৎ দেখা ধর্মতলার মোড়ে । ব্যাস , সোজা তুলে নিয়ে গেলো আমায় তার বাড়ি , আমতলায় । বললো দু দিন থেকে যেতে হবে । না ! আবদার ফেলতে পারি নি আমি । আর এতো দিন পর কাকিমার হাতের রান্না আমিও চাই নি মিস করতে । সুতরাং থেকেই গেলাম । 

আজ শনিবার । ওদের আবার নিরামিষ । তবে কোলায়ের ডাল আর আলু পোস্ত দিয়ে ভাত ; উফ সে যেন অমৃত । এ যুগেও যে এভাবে খাওয়াতে পারে কেউ , না গেলে সে পুরোনো বাঙালিয়ানা খুঁজেই পেতাম না কোনদিন । যাই হোক , খাওয়া পর্ব শেষ । এবার বিশ্রামের পালা ।।

শীতের দুপুর , বাইরের রোদে বসে বসে দুই বন্ধুর সে এক জমজমাটি আড্ডা । বললাম , ভাই শুভ , কি করছিস এখন ? সেই এম সি এ করে কলেজ ছাড়ার পর এই দেখা । অনেক বদলে গেছিস এতো বছরে । 

শুভ এক গাল হাসি মুখ করে বলে উঠল , টি সি এস এ একাউন্টস সামলাই । দারুন চাকরি । কথায় কথায় অনেক কথাই হলো , অনেক কথাই বললাম তাকে । জানলাম , স্কুলের বন্ধুরা এক এক করে বিয়ে করে নিয়েছে , সবাই প্রায় ওয়েল সেটল । রাগ হচ্ছিলো নিজের ওপর । আমরা দুই বন্ধুই বুঝি দুটো পাকা ধ্যারোস । কিছুই পারি না । 

শুভ নিজের জীবনের অনেক অন্তরঙ্গ এপিসোড শোনাচ্ছিলো । হটাৎ ওকে থামিয়ে , আমি বলে উঠলাম , হ্যারে , সেই পাগলির কি খবর ? বেশ হত্চকিয়ে উঠে বসলো সে । শুভর মুখ দেখে মনে হচ্ছে , রাগে দাঁত কিরকির করছে ওর । বেশ জোরে বলে উঠলো শুভ , শুভশ্রীর কথা মুখে আনবি না আর । ওর মতো দু নম্বরি আর দুটো দেখি নি । জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম রে ওর , আজ এই পরিণাম দিলো । বেশ অবাক হলাম শুনে , যে শুভ এই শুভশ্রী কে প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসত , যাকে ছাড়া শুভর দিন হতো না , রাত হতো না , তার সম্বন্ধে এই মন্তব্য । তাও শুভর মুখ থেকে , ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিলো না আমার । কি এমন হয়েছিল , ঠিক করলাম এই দু দিনে জেনে ফিরবই ।

বেশ কবার এ বিষয়ে শুভকে জিজ্ঞাসাবাদ চালালাম , তবে ও এতটাই রেগে ছিল শুভশ্রীর নামে যে এক ফোঁটাও বেরোলো না ওর পেট থেকে । সুতরাং , দিবা নিদ্রা হয়ে যাক একবার , রাতে আবার ফেলু মিত্তির হওয়া যাবে ।।

সন্ধ্যে বাতি জ্বলে উঠেছে সারা আকাশ জুড়ে । এতো দিন পর দেখা শুভর সাথে আর হালকা নেশা হবে না , তা হয় নাকি । সন্ধ্যে বেলার আড্ডা তাই কে এফ সি র সাজানো বাগানেই কাটানো যাক । হাতে গোল্ড ফ্লেক বড় একটা । টেবিলে সাজানো গেলাস । অনেক দিন পর টান দিলাম । শুভর মুড দেখলাম এখন বেশ ভালো । মনে মনে গুনগুনিয়ে গান করে চলেছে । বেশ ফাইন গলা তো , আমি বলে উঠলাম । নীরব গলায় আস্তে করে শুভর জবাব , পাগলিটার এই টুকু স্মৃতি আজও রয়ে গেছে রে । বুঝলাম , ভালোবাসার ঝর্ণা এখনো ঝরে পরছে শুভর বুক থেকে , ভালো লাগলো তবে কৌতুহলটা আরো চেপে ধরলো আমাকে । দুপুরের ঘটনাটা কি নিছক কোনো ছলনা , নাকি সত্যি শুভর ঐ রূপ । জেদ চেপে ধরলো এবার , জানতেই হবে কি ব্যাপার ।।

সুরটা বেশ পরিচিত , " দেখা হলে বলে দিও আজও বেঁচে আছি "। একটু ডিসটার্ব করে শুভকে এবার একটু লেগ পুল করে বসলাম । " কিরে প্রেম যে আর ধরে না , তবে দুপুরে যে অভাবে দাঁত খিঁচিয়ে শুভশ্রী র চোদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিলিস যে " । শান্ত ভাবে শুভ বলে উঠলো , ভালো সে আজও বাসে ওকে , বাট , মাস খানেক আগে ও যে ভাবে ব্যবহার করেছিল শুভর সাথে , ঠিক বিশ্বাস হয়নি শুভর । এতটা বদলে গেল মেয়েটি । 

আমার ও বিশ্বাস হচ্ছিলো না , শুভর কথায় । শুভ মেয়েটির জন্য যা করেছিল , আমি তো দেখেছি । দিনের পর দিন ওর পাগলামো সামলেছে , বিয়ে না করেও মিথ্যা বরের অভিনয় চালিয়ে গেছিলো শুভ । নিজের ভালোবাসা ভুলে শুধু মেয়েটির জীবনের চিন্তা করে গেছিলো । এটা আজকের দিনে কজন করে , বলতে পারো ।।

রাত এখন দুটো বাজে , ঠিক ঘুম আসছে না । একদিকে নেশার ঘোর অন্যদিকে শুভশ্রীর আর শুভর সেই কলেজ দিনের গপ্প গুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে । কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে শুভশ্রী । ধপধপে ফর্সা , হেভি স্মার্ট । অন্যদিকে শুভ , লাজুক ছেলে , মেয়েদের ছোঁয়া থেকেও লজ্যা , এমন ছেলে জন্মে দেখি নি । তবে শুভশ্রীর প্রতি হেভি টান ওর । বন্ধুত্ব ও হয় , বেশ গভীর । একসাথে ওঠা বসা । দিন রাত তখন কলেজে একটাই চর্চা , শুভ আর শুভশ্রী । ভাবতেও পারছি না এই শুভ আজ ঐ নাম শুনলে রেগে যাচ্ছে । অবাক কান্ড ।।

দিন ঘুরতে লাগলো , সেদিন কলেজ ফাংশান । স্টেজে তখন শুভশ্রী উঠেছে , গান শোনাবে সে । অসাধারণ গলা , বলে বোঝাবো কি করে । আর অন্যদিকে একদম সামনের সারিতে সেই চেনা মুখ , মি.রোমিও , শুভ । ভাবতাম ব্যাটা বোর হয়ে যায় না , একেই বলে ভালোবাসা । ছেলে খেলাধুলায় ভালো , খেলার মাঠে তার চিয়ার লিডার , থাক আর বলছি না নামটা । যেন এরা মেড ফর ইচ আদার । তবে , দিন এগিয়েছে , বন্ধুত্ব আরো ঘন হয়েছে , কিন্তু শুভ আজ অবধি বলতে পারেনি তার মনের কথা শুভশ্রী কে । কে জানে কোনোদিন পারবে কি না বলতে !!

সেদিন সোমবার , কলেজের কমন রুমে শুভ দেখি বসে আছে । দু তিন বার ডাকলাম , শুনতে পেল না । কাছে গিয়ে দেখি মুখ ভার । জিজ্ঞাসা করলাম , কি হয়েছে । বললো গতকাল ও আর শুভশ্রী , সিটি সেন্টার গেছিলো । ভাবলাম এ তো ভালো খবর । শুভ তখন ও বলে চলেছে ওরা কি কি করলো , কেমন এনজয় করলো । ওর মুখ থেকেই শুনলাম , শুভশ্রী ওকে একটা শেরওয়ানি গিফট করেছে । কৌতূহল বসত: প্রশ্ন করলাম , শেরওয়ানি কেন ? এবার বেশ কাঁদো কাঁদো মুখ করে শুভ র জবাব , আগামী মাসে শুভশ্রীর বিয়ে । আমাকে বিয়ে বাড়িতে থাকতেই হবে , তাই । 

ধূস ! এতো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেলো । বলার সময়টাও পেলো না ও । কেঁদে আর কি লাভ । বললাম , ছেলে কী করে ? বললো ছেলের বহরমপুরে বিশাল ব্যবসা আছে । এদিকে শুভর চোখে জল , ওদিকে আমার মনে কৌতুহল , এতো হিট জুটি তাহলে শেষ ! এদিকে আমি ভেবে চলেছি , ওদিকে দুরে বিধাতা আড়াল থেকে হেসে চলেছে ...

রাত অনেক হলো । আজ থাক , ঘুমিয়ে পরা যাক , কাল ,পরশু করে বাকিটা শোনাবো ।।


নতুন ভোর হয়েছে । আমাদের জীবনে আর গল্পের প্রাণে । শুভ দেখলাম রেডি , বললাম কোথাও যাবি নাকি ? সে বেশ ইয়ার্কি মেরে বললো , চল না চড়ে আসি একটু । একদিকে আমার মাথায় তখনও সেই অতীতের ঘোর , টিকটিকিগিরিটা তখনও থামেনি আমার মাথায় ।

শুভ কিন্তু বেশ ফ্রেস মুডে , খালি গলায় গান ধরেছে , "ক্যাইসে মুঝে তুম মিল গ্যায়ী " । ভালো লাগছে ওকে এতটা খুশি দেখে । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম ফটাফট । আমাদের সকলের গন্তব্য , মেট্রো সিনেমা । তারপর বিগবাজারে শপিং আর বিকেলে কালকের মতোই কে এফ সি র সাজানো বাগান ।।

শুভ কাম মে দের কৈশি । আমিও তৈরি হয়ে নিলাম । শুভর বাইক তখন দুরন্ত গতিতে ছুটছে । না ! অন্য রাস্তা মনে হচ্ছে । আরে , এ যে দক্ষিণেশ্বর । গাড়িটা হটাৎ রাস্তার ধারে থামিয়ে দিলো শুভ । বেশ ভারি গলায় , শুভ বলে উঠলো , এইখানেই প্রথম শুভশ্রী কে একটা প্রপোজাল দিই । ক্যান আই কিস ইউ ? উত্তর না । আর তারপর সেই মর্মান্তিক সংবাদ শোনালো আমাকে । " আই এম গেটিং ম্যারেড বাই নেক্সট মান্থ , ইউ হ্যাব টু লিভ উইথ ফ্যামিলি । ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড । " আর তার দিন তিনেক পরেই সেই ঘটনা । সুইসাইড । এই প্রথম দেখলাম শুভর গলাটা ভারি আর চোখে জল । কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । শুধু ওর পিঠে হাত রাখলাম একবার ।।

সারা কলেজ জুড়ে শোরগোল । এম্বুলেন্স , পুলিশ ভোরে আছে কলেজ চত্বরে । রুটিন জানতে ফোন করেছিল শুভ । ওর আবার জ্বর , কলেজে আসতে পারেনি তাই । আমিও বললাম না তাই কিছুই । কিন্তু এ খবর কি আটকে থাকে , না রাখা যায় । দু দিন ধরে শুভশ্রীর কোন খবর পাইনি শুভ , ফোনটাও তুলছে না । জ্বর গায়ে একটা অস্বস্তি ভাব তাই । কিন্তু অন্যদিকে , তখন উৎকণ্ঠা , জীবন মৃত্যুর লড়াই লড়ছে শুভশ্রী । ডাক্তার ৭২ ঘন্টা টাইম দিয়েছে । কিছুই হতে পারে যে কোন মুহূর্তে । হাসপাতাল জুড়ে ভিড়ে ভিড় । ছাত্র , ছাত্রী , গার্জেন , টিচার পুলিশ সবাই অপেক্ষায় , কখন জেগে উঠবে শুভশ্রী । সবাই রয়েছে সেদিন , নেই শুধু শুভ আর দূরে বসে বসে আমার একটাই চিন্তা , কি করলো এটা শুভশ্রী , আর কেনই বা করলো ? কদিন পর বিয়ে আর...ছি: ছি:... এসব কেউ করে ! এক একবার মনে হচ্ছিলো শুভ এর জন্যে দায়ী নয়তো । আবার এই ভেবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম যে ছেলেটা কদিন আগে স্কুল রিইইউনিয়ণ পার্টি তে মদ্যপ অবস্থায় থাকা শর্মিলাকে সেবা করে যে ভাবে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলো , সে কিছু করেছে , মানতে পারলাম না ।।

দেখতে দেখতে তিন দিন কাটলো , হোস ফিরলো শুভশ্রীর । সবার মুখে একটা খুশির ভাব দেখা যাচ্ছিল যখন ডাক্তার বেরিয়ে এসে এই খবরটা দিলো । সবাই তখন শুভশ্রী কে একবার দেখা করার জন্য ব্যাকুল , এদিকে বাঁধ সাধলো ডাক্তার । ঘোষণা হলো , শুভশ্রী সবার আগে শুভর সাথে দেখা করতে চায় । 

পরিবারের মুখে একটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকার ছাপ , কে এই শুভ ? শুভশ্রীর সাথে ওর কি সম্পর্ক ? আর বাকিদের মুখে একটাই প্রশ্ন , সত্যি তো শুভ কোথায় ? এদিকে আমি তখনও ভাবছি , শুভকে কি একটা খবর দেব । 

এরই মাঝে দূরে একটা চেনা মুখ দেখলাম বলে মনে হলো , একটা চেনা গলা খুঁজছে যেন শুভশ্রীকে । এতো আতঙ্কের মাঝেও সবার নজর তখন সেই মুখটাতে এসে আটকালো , আর আমি অবাক দেখলাম যে শুভ হাজির । তবে, কে বলল ওকে শুভশ্রীর খবর ?


সত্যি সত্যি ওটা শুভ ছিল । আস্তে আস্তে রুমে ঢুকলো সে । শুভশ্রী তখন চোখ বুঝে শুয়ে আছে । শুভর ছোয়ায় চোখ খুললো । চোখ দুটো জলে ভর্তি , ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে । কাঁদতে কাঁদতে শুভর হাত দুটো চেপে ধরলো সে । অনবরত এক কথা , কেন তাকে বাঁচানো হলো , সে ওর কাছে যেতে চায় । শুভর মাথা যেন বন বন করে ঘুরছে । কি বলছে এ সব , কি হচ্ছে এ সব । রুম থেকে বেরিয়ে এলো শুভ । ওর মা কে ডেকে বললো একে বিষ দিতে বলুন আর ওর মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম । সবাই অবাক , এসব আবার কি উল্টো পাল্টা বকছে ছেলেটি ।।

এদিকে তখন শুভশ্রীর মায়ের চোখেও জল । কিছুক্ষন এই ইমোশনাল সিন চললো । তারপর মায়ের মুখ থেকে যা শুনলাম , আমরা সবাই তো অবাক ! কি বলছেন উনি । শুভশ্রীর যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা , সে অলরেডি দেড , তাও চার বছর আগে ।।

দক্ষিনেস্বর ছেড়ে আমরা এখন কফি হাউসে । আড্ডা আর গান , পুরো মেজাজে চলছে । হটাৎ বেশ নস্টালজিক হয়ে শুভ আমাকে বলে উঠলো , জানিস সেই ছেলেটি , আরে বহরমপুরের যার সাথে পাগলির বিয়ে হতো , তার দাদার সাথে সেদিন কথা হচ্ছিল । শুভশ্রী নতুন বিয়ে করেছে , মুম্বাইতে আছে । শুনেও ভালো লাগলো , মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠেছে । তবে এর পুরো কৃত্বিত্ব একা শুভর । মেয়েটি যেদিন সুসাইড করে তার কয়েক দিন আগেই সে ছেলেটির মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে পারে । তারপর রাতে হোস্টেলের রুমে বসে লিকুইড মোরটিন খেয়ে নিয়েছিল । ছেলেটিকে খুব ভালোবাসতো নাকি শুভশ্রী । এ সবই সেদিন হাসপাতালে তার মায়ের মুখ থেকে শোনা ।।

এদিকে শুভকে এক কোনায় নিয়ে এসে আমি জানতে চাইলাম যে ওকে এ বিষয়ে কে বলল । জানলাম , ও শুভশ্রী কে ফোনে দুদিন না পেয়ে ওর বান্ধবি তৃষা আগারওয়াল কে ফোন করে । ওই বলে যে শুভশ্রী নে সুসাইড কিই হ্যায় । এই খবর পেয়ে আর থাকতে পারে নি শুভ । ভোরের ট্রেনে চলে আসে সোজা হাসপাতালে আর বাকিটা তো শুনলেনই আগে । তবে শুভর সেদিনের ঐ মৃত্যু দায়িত্ব তুলে নেওয়া আমার একদম ভালো লাগে নি । আর বাড়াবাড়ি যাতে না করতে পারে , তাই ওকে নিজে সোজা বাড়ি চলে এলাম ।।

এদিকে বাড়িতে আরেক কান্ড । এসব ঘটনা শুনে শুভর বাবা তো রেগে আগুন । বলেই বসলেন , এবার কিছু হলে ছেলেকে পুলিশে তুলবে , দেখো ছেলের কান্ড । শুভর মা কিন্তু কিচ্ছু বললো না । ছেলেকে কতটা ভালোবাসে তা আজ রাতের খাওয়ার টেবিলে বুঝে গেলাম । মাংস করেছেন , তবে ছেলে খাসি ভালো বাসে তাই তার জন্য আলাদা রান্না হয়েছে । আমার জন্য নিরামিষ কারণ আমি আবার ওসব খাই না আজকাল ।।

রাত কাটলেই চলে যেতে হবে । তাই ব্যাগ টা গুছিয়ে রাখলাম । রাতে জমিয়ে আড্ডা হলো আজ । নতুন পুরোনো কত কথা , আর এই প্রথম শুভর মুখ থেকে শুনলাম শুভশ্রী কিভাবে তাকে অপমান করেছে । খুব খারাপ লাগলো শুনে । সাথে মনে হলো মানুষ কিভাবে পাল্টে যায় । পয়সা সবাইকে পাল্টে দেয় । সত্যি বড়োই বিচিত্র এ নিয়ম !!

রাত থেকেই জ্বর । কাল যে যাওয়া হচ্ছে না এটা তো সিওর । তবে রাত ভর এই পাগলামটা শুভ যে কি করে সহ্য করেছে তাই ভাবছি । অবশ্য এটাই প্রথম বার নয় । শুভশ্রীকেও ঠিক এই একই ভাবে সামলেছিলো শুভ । তাও দিনের পর দিন । ওর ক্রেডিট আছে বলতে হয় । এমনি অনেক কিছুই ভাবছি , এদিকে চায়ের কাপ হাতে হাজির শুভ । একদম নিজের স্টাইলে বলে উঠলো , টি ব্রেক ।।

চা খেতে খেতে অনেক ভাবনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো । এবার আর পারলাম না চেপে 

রাখতে । জিজ্ঞাসা করেই বসলাম শুভকে , তুই কি সত্যি শুভশ্রী কে লাইক করতিস ? বেশ চাপা গলায় উত্তর এলো হুম । আমি বললাম , তবে এত দিন শুধু অভিনয় করে গেলি কেন ? ওর মায়ের কাছে একবার মন খুলে বলতেই পারতিস !

শুভর গলাটা বেশ নরম মনে হলো । শুভশ্রীর সঙ্গে হবু স্বামীর অভিনয়টা তার কাছেও বেশ কষ্টকর ছিল এটুকু তো বুঝি , বাট , কি করে পারলো সে এই অভিনয় করতে । শুভ বললো , সেদিন ওর মা আর ডাক্তার বাবুর রিকুয়েস্ট ফেলতে পারিনি । শুরু করি শুভশ্রীকে সুস্থ করার অভিনয় । ওর মন থেকে সুইসাইড এর ভূত নামানোর অভিনয় । ওর কত চাহিদা হাসিমুখে পূরণ করেছি কে জানে , শুধু শরীর বাদ দিয়ে ।

জ্বর গায়ে শুনছি আর কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে । দিনে কত বার ফোন করতাম ,হিসাব নেই । যা তা বলে যেতাম , আর এটা কাজও করছিলো । ডাক্তার বললো এতো কুইক রিকভারি কোনোদিন দেখেনি সে , কিন্তু আমি তো জানি , কিছুই উন্নতি হয় নি । নাহলে সেদিন , বিগবাজারে দাঁড়িয়ে শুভশ্রী আবার সুসাইড করবে বলে ! বেশ অবাক করা হলেও এটাই সত্যি ।

এর পর কলেজ শেষ হলো ওদের এক মর্মান্তিক ভাবেই । শুভ পাস করলেও শুভশ্রীর পাস করা আর হলো না । আর এর পর শুভশ্রী আর এগোতেও চাইলো না ।। শুভ বেশ হারে হারে টের পাচ্ছিলো যে কেসটা বেশ জন্ডিস । কোন রাস্তাও পাচ্ছিলো না । শুরু হলো কাকিমার কাছে আরেক অভিনয় যে শুভশ্রী সম্পূর্ণ সুস্থ । ওকে বিবিএ ও এম বি এ পড়তে সাউথে পাঠিয়ে দেওয়া হোক । এটাই যেন ওকে সুস্থ করার শেষ উপায় শুভ দেখতে পাচ্ছিলো আর শুভশ্রীকে বোঝানোর দায়িত্ব শুভ নিজে নিলো ।।

না , দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে । আজ মেনু মাছের মাথা , তবে ওই যে বলেছিলাম যে আমি নিরামিশি , তাই আমার জন্য স্পেশাল ধোঁকার ডালনা হয়েছে । খেয়ে উঠে আর শরীর চলছিল না । অতএব , ফেলু মিত্তির কে সরিয়ে রেখে এক ঘুম এই দুপুরে ।।


রাত কেটে ভোর হল ।। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে শুভর গাড়ির পিছনে সোজা ধর্মতলা ।। বাস ছাড়বে ঠিক ৮.২০ ।। বাসের টিকিট কেটে দিলো শুভ নিজে , আমাকে পেমেন্ট করতেও দিলো না ।। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ও স্বাধীন ।। কারণ আজ ও এ জঙ্গলে এক নতুন পরিবার গড়ার কথা ভাবছে , সঙ্গী হিসাবে পেয়েছে এক বাঘিনী কে , দি রয়েল বেঙ্গল টাইগ্রেস ।। ভয় পাবেন না , এ বাঘিনী শুভর জীবনে নতুন প্রেম , এসেও এখনও ধরা দেয় নি ।। 

অনেক কিছুই জানতাম না , আজ জেনে ফিরছি ।। সেদিন তার চিরদিনের ভালোবাসাকে বেঙ্গালুরুর মাটিতে এম বি এ করতে পাঠিয়ে দেয় শুভ নিজে ।। নিজে বসে থেকে শুভশ্রীকে রাজি করায় সে ।। বিমান বন্দরের সেদিন আর এক মাস আগেকার দিনটা মোটেও এক ছিল না ।। সেইদিন শুভশ্রী ছিল শুভর নয়নের মনি আর এই মাস খানেক আগে কলকাতায় যখন ফিরলো তখন তার হাতে অন্য একটি হাত ।। বিয়ে করেছে শুভশ্রী ।

শুভর কিন্তু আগে ভাগেই এয়ারপোর্টে হাজির হয় ।। তবে , তাকে দেখেও না দেখার ভান করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় শুভশ্রী ।। আমি বসে আছি বাসে , কিন্তু মনে মনে অনুমান করতে পারছি কতটা কষ্ট পেয়েছিল শুভ ।। 

বিকেলে ফোন করলে শুভশ্রী তাকে চিনতে অস্বীকার করে এবং সতর্ক করে দেয় যে এর পর ফোন এলে বা ডিস্টার্ব করলে সে এফ আই আর করবে শুভর নামে ।। শুভ কিছু বলেনি সেদিন , কাউকে না ।। হয়তো আমাকেও বলতো না যদি কাল রাতে প্রচন্ড চাপ দিয়ে ঝগড়া না করতাম ।। আই এম সরি , শুভ ।। ঝগড়া না করে উপায় ছিল না রে ।।

শুধু শুভশ্রীর শেষ কথাগুলো ... না , আজও ভোলেনি শুভ ।। 'সেবা করেছে বলে গায়ে পরার কি আছে , দাম টা নিয়ে নিলেই পারে '?

আমার বাস আসানসোল ঢুকছে ।। একটু পরে নেমে যাবো , রোজকার কাজে ভুলেই যাবো হয়তো এত ঘটনা , তাই লিখে ফেললাম ।। কিছু মনে করিস না ভাই ।। তোর মতন ভালো ছেলের জীবনে ভালোই হবে ।। যে খারাপ তাকে যেতে দে ।। 

দূর থেকে মনে মনে শুধু এটুকুই বলে যাচ্ছিলাম ।



আগুনের পরশমণি 


১।।

শুভ র সাথে দ্বিতীয়বার দেখা গত বছর অষ্টমীতে । আমি তখন কলকাতায় । পুজোর ছুটি কিন্তু এবছর তেমন উপভোগ্য হচ্ছে না কোন ভাবেই । চিত্তরঞ্জনে এত বছর পুজো কাটানো ছেলেটির কাছে কলকাতার পুজো কোনদিনই উপভোগ্য হয় নি । আর এবছর তার ওপর উপরি পাওনা বৃষ্টি । বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না , চারিদিক জলময় । ঠিক এমন একটা সময় মহাঅষ্টমীর সকালে শুভর ফোনটা মনে একটা অদ্ভুত শান্তি সঞ্চার করেছে । বিকেল থেকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ । পুজোর বাকি দিনগুলো ওখানেই কাটাবো । আর শুভর সাথে কাটানো মানেই আমার মনে সেই শুভশ্রী এপিসোড ধরা দেয় । আজকের শুভ হয়তো অনেক ম্যাচিয়র কিন্তু সেই ছেলেমানুষি ভাব , পার্টিওয়ালা স্বভাব এসব কিছুই বদলায়নি তার মধ্যে । অনেক আশা একটা ছোট্ট ব্যাগবন্দি করে অষ্টমীর বিকেলে রওনা দিলাম মামাবাড়ি ছেড়ে শুভর বাড়ি । ওলার পিছনের সিটে বসে বসে আজ যখন এই কথাগুলো লিখছি তখন মনের কোন এক কোণে একটা চিন্তা জট পাকিয়ে রয়ে যাচ্ছে -- রহস্য । শুভর সাথে দেখা করবো আর রহস্যের রস পাবো না তা কি করে হতে পারে । সুতরাং একটু ধৈর্য্য আর অনেকটা অপেক্ষা নিয়ে ওলার সাথে এগিয়ে চললাম শুভর বাড়ি আমতলার দিকে । 

ঘড়িতে এখন পাঁচটা দশ । রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় , মানুষের লম্বা লাইন আর অন্য দিকে মোবাইলে কললিস্ট লম্বা হয়ে ভিড় জমিয়েছে । শুভ প্রায় পঁচিশ বার ফোন করেছে এখনো পর্যন্ত , হুমকি দিয়েছে ম্যাসেজে আরো অনেকবার যে জলদি ঢুকতে হবে । আজ নাকি ওর টিম ভুরিভোজ অন হুইলসের পক্ষ থেকে স্পেশাল খাওয়াদাওয়া আছে , শুভর ভাষায় ভুরিভোজ আর সে চায় আজ ও আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে । আমি সব অভিযোগ নীরবে শুনেছি ও পড়ে যাচ্ছি কিন্তু করবার কিছুই নেই কারন মা এসেছে বাড়িতে , আর তার বন্ধুরাও ভিড় জমিয়েছে রাস্তায় । দেখলে মনে হচ্ছে কলকাতা শহর জুড়ে আজ অঘোষিত মহামিছিল । 

অবশেষে , গরুর গাড়ির থেকেও কম গতিতে ,হেলে দুলে আমতলা পৌঁছাতে প্রায় পৌনে সাতটা বেজে গেল । শুভ দত্তের বাড়ি চুপচাপ , যেন মুখভার করে অভিমানে দেখছে আমায় । ওলার কড়ি মিটিয়ে দিয়ে গেটটা আস্তে করে খুলতেই সামনে থেকে উন্মাদের মত দুই প্রহরীর চিৎকারে থমকে দাঁড়ালাম । আরে মশাই দাড়ালাম কি গেট বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম । 

এদিকে ওদের চিৎকার গর্জনে রূপান্তরিত হয়ে উঠলো । অবশেষে সমস্ত অভিমান ভেঙে বাইরের আলো জ্বলে উঠলো , আর তারপর শুভর লম্বা শরীরটা এগিয়ে এলো ওদের দিকে , ওদের শান্ত করলো আর তারপর দরজা খুলে গেল আমার জন্য । ভিতরে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে জানলাম ওরা দুজন শুভর দুই নতুন বন্ধু কাম চৌকিদার ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম , ফেয়ার হল মা কুকুর আর হ্যান্ডসাম তার ছেলে । 

দেরি করা যাবে না আর , শুভর ফরমান আছে তাই চটজলদি বদলে ফেলা যাক নিজেকে । তারপর শুভর রথে দুজনে উড়ে যাবো পার্ক স্ট্রিট , ভুরিভোজ অন হুইলসের আড্ডায় । আপাতত চললাম , আবার রাতে ফিরে শুভর কথা বলবো , কেমন .... 



২।। 

ভুরিভোজ অন হুইলস আর কিছুই নয় , খাদ্যরসিক বাঙালির একটি টিমওয়ার্ক যার মূল লক্ষ্য হল খাওয়া দাওয়া আর কিছুই নয় । মহাঅষ্টমীর এই রাতে পুরো টিম এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো শুভ । সেখানে ছিল অক্ষয় , পারমিতা , সুন্দরী লাবণ্য , সঞ্জয় ও আরো অনেকে । হঠাৎ পারমিতা শুভর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলো যে পরিণীতি আসে নি । জাস্ট এই নামটা শোনা মাত্র শুভকে দেখলাম কেমন যেন সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল । আমরা তখন পার্ক হোটেলে দাঁড়িয়ে আর শুভ এ সব ছেড়ে বেরিয়ে এলো পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় । ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকলো আমার । বাকিদের এক মিনিটের অনুমতি নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলাম । বেরিয়ে এসেছিলাম স্রেফ কৌতূহল বসত্ব কিন্তু এসে যা দেখলাম তা সত্যিই খুব বেদনাদায়ক সত্যি । অষ্টমীর রাতে এই আনন্দের সময়ে শুভর চোখে জল । 

সবে গোল্ড ফ্লেকে দুটো টান দিয়েছে শুভ । একটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো সে । যদিও হাতটা আমার ছিল কিন্তু ওর চোখ মুখ যেন অন্য কাউকে সেই ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে খুঁজে চলেছিল আজ । হয়তো পরিণীতি !! কিন্তু যে শুভকে আমি চিনতাম অথবা যে শুভকে আমি কয়েক বছর আগে শুভশ্রীর গল্প লিখতে বসে দেখেছিলাম তার সাথে আজকের শুভর অনেক আকাশ পাতাল ফারাক । সেদিন শুভর মধ্যে একটা রাগ ছিল আর আজ যন্ত্রনা আছে । সেদিনের শুভ হাসতো , গালাগালি করতো কিন্তু সবটাই মুখ থেকে আর আজ শুভর চোখে মন ভাঙা চোখের জল । এটাই বোধহয় পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ নমুনা । এটাই বোধহয় ভালোবাসা । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন আর তারপর বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে তার চোখ থেকে , আমার বুক ভিজিয়ে দিয়ে ।



৩।।

সেরাতে শুভকে সামাল দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল সবাইকে । পরিণীতি নামটা শুভর জীবনে যে এতটা উল্লেখযোগ্য হতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি । আজ সারা রাত ঘুম আসবে না এটা জানতাম কিন্তু শুভও যে ঘুমাতে পারবে না এটা ঠাহর করতে পারিনি । অবশেষে শুভ উঠে গিয়ে নিজের ঘরের দরজায় ছিটখিনি লাগিয়ে , আস্তে করে ড্রয়ার থেকে ক্যাপ্টেন মর্গ্যানের বোতল টা বের করে আনলো । ওকে এই অবস্থায় কোনদিন দেখিনি । দেখবো বলে ভাবিওনি । গেলাসে প্রথম চুমুক মারার আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম শুভর পাশে থাকা উচিত । আর তাই ওর সমস্যা না জেনে সেটার সমাধান না করে এখান থেকে চলে যাওয়াটা কোনদিন উচিত হবে না । প্রায় রাত সাড়ে তিনটে অবধি মদের আসর চললো , শুভর সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা হল কিন্তু পরিণীতি নিয়ে কোন কথাই সে বললো না । এক দুবার প্রশ্ন করে দেখলাম , ও কিছু বলতে রাজি নয় । বারবার নানা কথার অজুহাতে সুকৌশলে মূল বিষয়টি এড়িয়ে গেল একাউন্টেন্ট বাবু । অবশেষে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম । 

ঘড়িতে তখন চারটে । দুজনে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক সেই সময় শুভর মুখের একটা কথা আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো । কোন প্রশ্ন করিনি , শুধু চুপ করে শুনে গেলাম শুভ নিজের মনে নেশার ঘোরে বলে চলেছে, তিনবার , " আই লাভ ইউ " .... সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়লেও মনে মনে ঠিক করলাম পারমিতার সাথে দেখা করবো কালকেই । কিন্তু সমস্যা হল তার নম্বর কোথায় পাই ? 

ঘড়িতে তখন আটটা বাজে । ঘুম থেকে উঠে দেখি শুভর ঘুম তখনও ভাঙেনি । হঠাৎ চোখ পড়ল শুভর মোবাইলে । শুভর পাশেই শুয়ে আছে । হাতে তুলে দেখি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে । যাই হোক অতো ভেবে লাভ নেই । কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘেঁটে পারমিতার নম্বরটা চুরি করে আবার মোবাইলটা তার জায়গায় শুইয়ে দিলাম । শুভর ঘুম ভাঙল তখন দশটা বাজে । নেশার ঘোর কাটাতে আরও আধ ঘন্টা । আমাকে ড্রেস পড়ে তৈরি হয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বড় বড় চোখে একবার তাকালো আর তারপর হাই তুলতে তুলতে আমাকে প্রশ্ন করলো , " কোথায় যাচ্ছিস ? " ভাবলাম সত্যিটা বলি ওকে কিন্তু তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে শুভকে বললাম , বালিগঞ্জ , একজন প্রকাশকের কাছে । 

" কোন প্রকাশক ? আমিও যাবো । " শুভ উঠে বসে বলে উঠলো ।

" না । " , আমি বললাম ।

আমার এভাবে মানা করে দেওয়াতে শুভ কিছুটা হতাশ হলেও , অবশেষে রাজি হল কিন্তু একটা শর্তে । দুপুর তিনটের মধ্যে ফিরতে হবে । ওর কথায় , " মাংস ভাত , তারপর পাঁচটায় ব্যোমকেশ আর তারপর আটটায় ভুরিভোজ মিট " । আমি একটা মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে পড়লাম । ওলা বুক ছিল আগেই , মেন রোড অবধি হেঁটে গিয়ে তাতে করেই রওনা দেবো পার্ক স্ট্রিট , মিশন পারমিতা মিট ।


৪।।

পারমিতার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল । আমি অবিশ্যি আগে ভাগেই হাজির হয়েছিলাম এবং ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম পার্ক হোটেলের বাইরে । কেউ দেখলে ভালো ছেলে না বলে যেতে পারবে না । নবমীর সেই সকালটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে পড়েছিল । শুভর কাল রাতের কান্ডকারখানা আমার চোখের সামনে এখনো ভেসে উঠছে আর পারমিতার সাথে দেখা হবার পর পরিণীতি নিয়ে যে তত্ব জানতে পারলাম তা আমায় অবাক করে নি শুধু , শুভর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল । পার্ক স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে সোজা আমতলা । বাড়ি গিয়ে দেখি শুভ বাইরে খালি গায়ে বসে তেল মাখছে । খেয়াল হল সময়ের আগেই আমি বাড়ি ফিরে এসেছি । এখন ঘড়িতে সবে দুটো বাজে । দুপুরে নবমীর মাংস দিয়ে ভাত খেতে বসে শুভকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম , " কিরে । আজ কি প্ল্যান তোর ? " 

সে মাংসের হাড় মুখে নিয়েই বলে উঠলো , " ওই যে বয়েছিলাম , বমকেত " .... 

আমি ওকে এখানে থামিয়ে মাথা নেড়ে বললাম , না । বমকেত নয় , ঠাকুর দেখবো আজ । রাত জেগে । গাড়ি বলা আছে । ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় । হাওড়া , হুগলি , আর শেষে বর্ধমান । " 

শুভ আমার প্রস্তাবটাকে মানা করতে পারলো না ঠিকই কিন্তু ওর চোখ মুখ দেখে পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম ও মোটেও রাজি ছিল না । তার কারণটা অবিশ্যি আজ সকালেই জেনে গেছি আমি আর ধারাবাহিক ক্রমে আপনাদের সমস্ত গল্পটা শুভর মুখ থেকেই জানাবো আর সেটা না হওয়া পর্যন্ত আমি ওকে ছাড়ছি না । 

জীবনের পিছনে এমন অনেক গল্প থেকে যায় যা মানুষকে খুবই অসহায় করে তোলে । আমার আপনার সবার আছে । শুভরও আছে আর থাকাটা কোন দোষের তো নয় , বরং না থাকাটাই আশ্চর্যের । এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো ঘরের বাইরে আর ভেতরে শুভর কর্কশ স্বর , " রেডি হবি তুই "....


৫।।

রহস্যের জাল ছিঁড়ে গেছে সব । জানিনা পারমিতার সাথে আমার দেখা করতে যাওয়ার ব্যাপারটা শুভ জানতে পেরেছিল কি না কিন্তু তার পরেও শুভ আমাকে আজ সব বলে গেল গাড়িতে যেতে যেতে । পরিণীতি শুভর প্রেম নয় , শুভর হৃদয়ের সম্পর্ক ওর সাথে । পরিণীতির ব্লাড ক্যানসার । শুভ সব জানতো , আর তার পরেও শুভ তার দায়িত্ব নিয়েছিল । বিয়ে না করলেও , পরিনীতিকে কোনদিন একা ছাড়ি নি শুভ । পরিণীতির বাবা মা কেউ নেই , থাকে হাওড়ার বাঁকরার এক অনাথ আশ্রমে । পৃথিবীর চোখে পরিণীতি যা হয়ে উঠেছিল , শুভর চোখে তার ওপরের স্থানটা শুভ রেখে দিয়েছিল তার জন্য । ভেবেছিল মেয়েটি সুস্থ হলে সে বাড়িতে সব জানাবে । কিন্তু সে সুযোগ হল না আর । একমাত্র পারমিতা সব জানতো । 

আমি আগ্রহ দেখিয়ে শুভকে প্রশ্ন করি , " কি জানতো ? " 

নিজের দুচোখ মুছে শুভ জানায় ষষ্ঠীর দিন রাতে পরিণীতি .... 

এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমার আর বলা সম্ভব নয় । কাল দশমী । বিসর্জনের আগে মায়ের কাছে আমার অনুরোধ শুভর মত ছেলে যেন আরো জন্ম নেয় এই বাংলায় । 











  

এবং সাহিত্য   


১।।

পত্রিকার আফিসে এই প্রথমবার যাচ্ছেন শুভ ।। শুভ দত্ত , ছোটখাট চেহারার ছেলেটি কলেজ জীবন থেকেই লেখালেখি করে আসছে ।। প্রথম প্রথম বিষয়টা গোপনেই রেখে দিলেও পরবর্তী কালে ধিরে ধিরে বিষয়টা প্রকাশ পায় , সবার সামনে আসে আর এখন তো শুভ সোদপুরের  একজন নামকরা কবি ।। লোকাল কাগজ , ম্যাগাজিন গুলোতে এখন নিয়ম মাফিক তার কবিতা ছাপে , লোকাল কবি সম্মেলনেও দু একবার গেছে কিন্তু এতে তার মন একটুও ভরে নি , খিদেটা রয়েই গেছে ।। এগুলো তো ছোট ছোট পত্রিকা , বড় বড় ম্যাগাজিনে লেখা ছাপানোটাই আসল , কিন্তু প্রশ্ন হল তাদের কাছে কিভাবে পৌঁছাবে সে ।। এক সামান্য মধ্যবৃত্ত সংসার তার ।। বাবা মারা যাওয়ার পর , পরিবারের দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়েছে ।। এতে লেখালেখির দিকটায় বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে এটা বলতে বাকি থাকেনা ।। সারাদিন দোকানের দায়িত্ব সেরে রাতে লেখার খাতায় দু কলম লিখতে তার মন একটুও চায় না ।। দিন দিন চোখের সামনে স্বপ্ন গুলো জল হয়ে যেতে দেখা ছাড়া তার কিছুই করার ছিল না ।। মাঝে মাঝে দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লেও সেগুলো শুভ এই ভেবে মুছে নিত যে , সব স্বপ্ন জীবনে পূরণ হয় না ।।

এভাবেই দিন কাটছিল তার ।। ম্যাগাজিন , কবি সম্মেলন এসব এখন বেশ ফিকে হয়ে পড়েছিল ।। একসময়ের শ্রেষ্ঠ আজ ভাগ্যের পরিহাসে সবার মন থেকে মুছে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে ।। কিন্তু কি করবে সেটা জানা ছিল না তার আর তাই এ নিয়ে ভাবতেও ছেড়ে দিয়েছিল সে ।। তবু যেদিন দোকান বন্ধ থাকত সেদিন একলা বসে থাকলে পুরোনো দিন গুলো খুব মনে পড়ত তার ।। সেই গ্ল্যামার আবার যে ফিরবে না এটা প্রায় যখন নিশ্চিত , তখন হঠাৎ একদিন পরিচয় হল তার বসন্ত সরকারের সাথে ।। বাঁকুড়ায় বাড়ি বসন্তের , রূপনারায়নপুর এসেছিল মাস খানেকের জন্য তার জেঠুর বাড়িতে ।। তার জেঠু নিললোহিত সরকার - শুভর পাড়াতেই বাড়ি , বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ আর তাই বসন্ত এসেছে ।। 

কথায় কথায় দু জনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে ।। প্রায় রোজ নিয়ম করে সকাল বিকেল আড্ডা চলত আর এই কারনে শুভ নিজের কষ্ট গুলো ভুলে গেছিল প্রায় কিন্তু সমস্যা হল বন্ধুত্ব ।। অনেক গোপন কথা বন্ধুত্বে আমরা বলে ফেলি , সেখানে গোপন প্রতিভা তো অনায়াসে বেরিয়ে আসবে ; এটা তো স্বাভাবিক ।। আর এক্ষেত্রেও শুভ ের গোপন প্রতিভা , তার স্বপ্ন ও কষ্ট গুলো প্রকাশ পেয়ে গেল হঠাৎ করে বসন্তের কাছে ।। ব্যাস !! তরুণ কবির কবিতা পড়তে আগ্রহ দেখিয়ে বসল সে ।। কিন্তু সে সব তো বাড়িতে , দোকানে তো নেই ।। সুতরাং , ঠিক হল একদিন ফাঁকা দেখে শুভ ের বাড়িতে আসবে বসন্ত ।। সেদিন এ বিষয়ে আরো গল্প আড্ডা হবে আর অবশ্যই হবে কবিতা পাঠ ।।


২।।

রোদের মধ্যে ঘামে ভেজা অচেনা কলকাতার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে শুভ ।। কত দিনের স্বপ্ন ছিল তার , কোন বড় প্রকাশনিতে তার লেখা বেরোবে ।। আজ যেন সেই স্বপ্নটাই পূরণ হতে চলেছে 

।। শুভর মনে হচ্ছে , আকাশের সমস্ত দেব দেবীরা তাকে আজ হাত তুলে আশীর্বাদ ঢালছে ।। কিন্তু এই অভাগার কদত্ত ে হঠাৎ এত আশীর্বাদ এর কারণ নিয়ে তার মনে কিন্তু সংশয় রয়েই গেছে ।। এটুকু ভেবে সে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছে যে সেদিন বাড়িতে প্রথমবার বসন্ত তার কবিতা পড়ে বেশ প্রশংসা করেছিল , অবশ্য এই প্রশংসা বাক্যের ফাঁকে ফাঁকেও বসন্তের আড় চোখটা সে বেশ লক্ষ্য করেছিল সেদিন ।।

তার পর মাস ছয়েক কেটে গেছে , বন্ধুত্ব আরো ঘন হয়েছে দুজনের মধ্যে ।। ইতিমধ্যে শুভ জানতে পেরেছে যে বসন্তও কবিতা লেখে তবে তার লেখা পড়ে দেখবার সুযোগ হয়নি তার কোনদিন ।। তাই বিনা অভিজ্ঞতায় তাকে ভাল বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে শুভ ।। আজ কের পথটাও শেষ হচ্ছে না ।। আগে কি হবে , কতদুরের পথ সে কিছুই জানে না ।। দুদিন আগে হঠাৎ কলকাতার সেরা প্রকাশকের কাছ থেকে তার কাছে ফোন এলে সে সাবধানে ঠিকানা লিখে নিয়েছিল ।। এটুকুই রয়েছে তার কাছে ।। আজ হাওড়াতে নেমে বাসে ভিড় দেখে সে হাঁটা শুরু করে ।। আর তখন থেকেই এই অনিশ্চয়তার ভবিতব্যের মধ্যে এগিয়ে চলেছে শুভ ।।

হালকা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বসন্ত বলে উঠল , " এবার দেখি তো তোমার লেখায় কত জাদু আছে ।। ভাল লাগলে তুলে নিয়ে যাব কিন্তু ", বলেই হেসে ফেললো সে ।। কথাটার মধ্যে কতটা ব্যঙ্গ লুকিয়ে আছে তা হাসির আড়ালে খুব লুকিয়ে পড়ল ।। সৎ মনে শুভ সেদিন বসন্তের সমস্ত কথা হজম করে নিয়েছিল আর তারই সাথে নিজের সমস্ত লেখা এর পর থেকে বসন্তকে পাঠাতে থাকে ।। যত দিন যেতে লাগল শুভ ের খাতা আরও সেজে উঠতে শুরু করল ।। প্রতিবাদ , প্রেম কি ছিল না তার মধ্যে আর যত কবিতা লিখত সে ভালোবেসে পাঠাত বসন্তের ঠিকানায় ।। উল্টো দিকে বসন্ত নিজের লেখা পাঠাবে পাঠাবে করেও কোন দিন পাঠিয়ে উঠতে পারে নি শুভ ের কাছে , তবে শুভ ের কবিগুলির প্রশংসা করে তার কাছে উত্তর অবশ্যই লিখত সে প্রতিবার ।। এভাবেই দিন এগোতে লাগল , শুভ ছোট খাট পত্রিকায় নিজের লেখা আবার পাঠাতে শুরু করল ।। পুরোনো হারিয়ে যাওয়া নামটা আবার গুটি গুটি পায়ে ফিরে আসতে লাগল তার কাছে ।।

৩।।

চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ ।। দোতলার ওপরে ঘরগুলো ছোট ছোট হলেও , শুভ ের চোখে পুরোটাই ঐতিহাসিক একটা জায়গা ।। কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই এক মহিলা জিজ্ঞাসা করে উঠল , " কার সাথে দেখা করবেন ?" তিনি সমস্ত কিছু খুলে বলতেই তাকে জানান হল পান্ডুলিপিটি চার নম্বর ঘরে জমা করে দিতে ।। সাত দিন পর তাকে ফোন করা হবে ।। 

এক বুক স্বাস নিয়ে পান্ডুলিপি জমা করে রাস্তায় এসে দাঁড়াল সে ।। হঠাৎ পিছন থেকে প্রকাশক ও একটি সুন্দরী যুবতি একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গেলেন ।। যদিও প্রকাশক কে সে চিনত না তবু দারোয়ান এর কাছ থেকে জানতে পারে ইনিই প্রকাশক ।। দারোয়ান তাকে আরও জানায় যে এই মেয়েটিকে কাল রাতে বসন্ত বাবুর সাথে স্যার এর রুম থেকে সে বেরিয়ে যেতে দেখেছে ।। বসন্ত লেখালিখি করে তাই বড় প্রকাশকের আফিসে আসা যাওয়া থাকবে এটা তো স্বাভাবিক , এই ভেবে আর কিছু ভাবলো না সে , বরং হাঁটা লাগলো স্টেশনের দিকে ।।

সাত দিন পর সারা গ্রামে হৈ হৈ পড়ে গেল যে শুভ এরেস্ট হয়েছে ।। কে অভিযোগ করল তার বিরুদ্ধে , কি অভিযোগ এসব কিছুই জানতে চাইল না সেদিন ।। যেন সবটাই জানা ছিল তার -- শুধু একটাই প্রশ্ন কবিতাগুলো কার নামে ছাপা হল ?? উত্তর তেমন না এলেও ইন্সপেক্টর শুধু এটুকু বলে থেমে গেল ; আসল মালিক যিনি , তারই ..... 







কনফেসন - ১

ধর্ম ও অধর্ম


আমার বয়স ত্রিশ । বাড়ি নিউ আলিপুর , পোর্ট কলোনি । বন্ধুদের কাছে তারকাটা বলে বেশি পরিচিত হলেও , আমার একটা ভালো নাম আর একটা বাজে নাম আছে । ভালো নাম শুভ দত্ত আর বাজে নাম পচা । ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় স্টার ছিলাম । উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি উইথ 98% মার্ক্স , এ মার্ক্স ছিল নম্বর আর তারপর মার্ক্স আমার চিরসাথী হয়ে উঠলো । বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম , ফিজিক্স নিয়ে ভর্তি হলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে । ভাবছেন , আজকের এই শুভ দিনে আমি এসব কেন বলছি ? কারন আমি চাই না আমার মত তরুণ কোন প্রতিভা শেষ হয়ে যাক । অবাক হলেন দেখছি । অবাক না হয়ে বকবকটা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন , কাজে দেবে আপনাদেরই । 

হ্যাঁ , কোথায় যেন ছিলাম আমি ? ভিড়ের মধ্যে একজন বললো মার্কে । কথা থামিয়ে ভিড়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছেলেটি চিৎকার করে বলে উঠলো , কে বললেন ? কে বললেন এটা ? হাতটা তখন পকেটের ভেতরে , খামচা খামচি করছে তার । কিছুক্ষন পরে একটা সিগারেট বার করে সেটা তুলে ধরলো সবার সামনে , বললো , এ কি জানেন ? সিগারেট নয় । এটা গাঁজা । আর ওটা মার্ক্স ... কার্ল মার্ক্স । এই গাঁজা খাওয়া শিখেছিলাম উনার কাছে । আমি তখন ইউনিয়ন করি ; এস এফ আই । বিরোধি দল ইলেকশন জিততে সে বছর মরিয়া আর আমরা ... এক ইঞ্চি জায়গা দেব না । জীবনে প্রথম বার মার দিয়েছিলাম আর শক্তি পেলাম কোথায় জানেন - এই গাঁজায় । ততক্ষনে লাইটারের আগুন গাঁজার ওই কাগজটাকে গ্রাস করে ফেলেছে । দু টান দিয়ে বললো , এই যে মাথা দেখছেন , সেদিন এটা ফেটে গেছিল । সবাই জানলো , পুলিশ জানলো বিরোধী নেতা সৌমিত্র আমাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে । ওকে শালা পুলিশ বোকা... থানায় তুলে নিয়ে গেল । ওরা শালা জানলো না যে আমার মাথাটা আমি নিজে ফটিয়েছিলাম ... ইয়া বড় ইট না পাথর মেরে । জীবনটা চলে যেতে পারতো সেদিন । ভয় পায়নি একটুকুও । মার্কের আদর্শের জন্য জীবন দিয়ে দিতেও রাজি ছিলাম সেদিন আর এই বাবা গঞ্জিকা আমায় শক্তি দিয়েছিল । তারপর এস এফ আই জিতল । বিরোধীরা একটা সিট পাইনি । কলেজে লাল আবির আর লাল সেলাম । গাঁজার জ্বলন্ত রোলটায় দুটান টেনে আবার মাইকটা চেপে ধরলো শুভ । 

আর শুনবেন ? চিৎকার করে বললো সে । আমি কলেজে কত পেয়েছিলাম জানেন ? ৪২% ... ট্যালেন্ট বেড়িয়ে গেল সব । আর ওই সৌমিত্র , শালা ৮৫% ... তিনদিন খাবার খাইনি । মনের দুঃখে মদ গিলেছিলাম । জানেন , আমি বুঝতে পারছিলাম যে আই এম বিকামিং ওয়ার্স্ট । রোহিত , রাজা , রোমিও , নুপুর .... ছেলেটির চোখে জল । সে আবার বললো নুপুর , মাই লাভ , এদের সবার জন্য । যে ছেলেটা কিছুই চিনতো না , বুঝতো না , সে ... হাহা করে হেসে উঠে বললো হি হ্যাড ডন সেক্স । বিশ্বাস করেন , আই হ্যাড ডন সেক্স নট উইথ নুপুর বাট হার ... সোনিয়া । কি দেখতে মাইরি । আর এসব কিভাবে হল জানেন ? 

মদ । নেশাটা জোর করে ওই পার্টির ছেলেগুলো শুরু করিয়েছিল । আস্তে আস্তে মদ আমাকে খেতে লাগলো আর আমি সোনিয়ার শরীরটাকে । একদিন ধরা পড়ে গেলাম । কলেজ থেকে শালা টার্মিনেট করে দিল । কেরিয়ারে ফুল স্টপ আর নুপুর আমাকে থাপ্পড় মেরে চলে গেল । এখানে কেউ নুপুর কে চেনেন । চেনেন না বোধহয় ।

 বেশ । 

ঘটনায় ফিরে যাই । কেরিয়ার ... দি এন্ড । কলেজ ... ফিনিশ । জি এফ ... গন । আর বাড়ি ... নিকাল দিয়া মেরে ভাই । পার্টিও চিনলো না , রভি , রোমিও কেউ না । কি করবো জানিনা । একটা ফাঁকা মাঠে বসে ছিলাম । দর্শকরা হা করে শুনে যাচ্ছে যদিও শুভ এখন সম্পূর্ণ নেশার কবলে ।

ছেলেটি হাতে মাইক তুলে নিল আবার একটু সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে । মাইকটাকে স্বযত্নে মুখের কাছে টেনে নিল এইবার । আবার সেই চেনা গলায় গর্জে উঠলো ভাষা ইনকিলাব । দর্শক আসন থেকে সাথে সাথে প্রত্যুত্তর এল জিন্দাবাদ । হাহাহা , হেসে উঠল এবার সে । বলল যাক মনে রেখেছেন তাহলে । মার্ক্স , কার্ল মার্ক্স আর ম্যাক্সিম গোর্কি আমাকে রাস্তা দেখালো আবার । সমর্থকরা ছেড়ে গেলেও হঠাৎ দেখা হয়ে গেল একদিন বিনোদ বাবুর সাথে । বিনোদ চক্রবর্তী , আমার স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন । এখন সদ্য ষাট এ পা দিয়েছেন তিনি । আমাকে মাঠের ধারে একলা বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে বসলেন কেমন আছো ? আমি তখন নেশার সাথে প্রেম করছি আর সিগারেটে ভরা গাঁজা কে চুমু খাচ্ছি । রীতিমত নেশাখোরদের মত মাথা হেলিয়ে বললাম , কে গুরু ? তারপরই চিনতে পেরে আবার বললাম , হায় গুড়ি , চলে নাকি ? বলেই গাজার ছিলিমটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে । সেদিন স্যার আমায় একটা কষে থাপ্পড় .... না লাগাননি । উল্টে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় । একটু হোসে ফেরার পর আমার সব গল্প মন দিয়ে শোনে । তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করে মার্ক্স এর থিওরি জানো ? আজ এই একই প্রশ্ন আপনাদের করছি । আপনারা কেউ বলতে পারবেন ? একজন মেয়ে পিছন থেকে হাত তুললো কিন্তু শুভ নিজের মেজাজে তাকে ধমকে বসিয়ে দিল । 

তারপর স্যার আমাকে দাস ক্যাপিটাল আর মা বই দুটো দিয়েছিল । বলেছিল , এটা মন দিয়ে পড় । মনে রাখবে কম্যুনিসম মানে গাজা , মদ আর দালালি নয় । আজকালরা সস্তা কমিউনিস্ট রা জানেই না কম্যুনিসম কি ? তুমি শিক্ষিত হও , মানুষের পাশে দাঁড়াও । মনে রেখো কম্যুনিসম কোন অন্যায় নয় । আমি হাঁ করে স্যারের কথাগুলো গিলেছিলাম । 

সেদিন রাত থেকে বই দুটো পড়তে শুরু করলাম । পড়ার প্রতি ছেড়ে যাওয়া নেশাটা আজ আবার ফিরে আসছিল । ধীরে ধীরে চে র বই পড়লাম । বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ , নজরুল , সুকান্ত , সুনীল , বিনয় -- এক এক করে সব পড়তে লাগলাম । আমি স্যারের বাড়িতেই থাকতাম আর স্যারের বইগুলো পড়ে যেতে লাগলাম । বুঝলাম , কম্যুনিসম মানবতার কথা বলে । মানুষের সাথে মানুষের যে বিভেদ তার কথা বলে । স্যারের আশীর্বাদ নিয়ে আমি মানুষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । আমার সমর্থক তৈরি হতে থাকলে রাজনীতিতে আসার অফার পেলাম । না , যায়নি । 

আজ আমি আমার প্রথম বই প্রকাশ করার জন্য মঞ্চে দাড়িয়ে আছি । বইটির নাম ধর্ম ও অধর্ম । মানবাধিকার যে দিক আমি অভিজ্ঞতায় শিখেছি তাই বইতে তুলে ধরেছি । আশা করবো আজ থেকে আগামী দিনে পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি পূর্ণ কম্যুনিস্ট । বর্তমান কম্যুনিস্ট নেতাদের মত মুখোশধারী নয় আর এই গাজার প্যাকেট আমি আপনাদের মাঝে তুলে দিলাম । মনে রাখবেন যেখানে দেখবেন রাজনীতি আপনাকে গাজা আর মদ খাওয়া শেখাচ্ছে , মেয়েদের শরীর চেনাচ্ছে , সেখানেই কোন না কোন বিনোদ স্যার ও থাকবে । তাকে খুঁজে নেবেন । সেই আপনাদের কম্যুনিসম ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত মেলবন্ধন শেখাতে পারবে । 

আচ্ছা , আমি আসি । বাইরে ওরা অপেক্ষা করছে আবার , ওই পথের কোন একটা পয়েন্টে । ওরা মানবিক মুখেদের তোষামোদ করে না । তাই আজই হয়ত আমার শেষ দিন । অপরাধ এই ধর্ম ও অধর্ম ।

ইনকিলাব .... শ্রোতাদের মধ্যে থেকে সমবেত কণ্ঠে ভেসে এল এবার 

জিন্দাবাদ ।।




কনফেসন - ২ 

হারানো চিঠি


১।।

আমার ছোটবেলার বন্ধু শুভর নারি নক্ষত্রের সাথে আপনারা এতদিনে নিশ্চই বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন । শুভ মানেই এক একটা উল্লাস , শুভ মানেই ঘটনাদের ভিড় , শুভ মানেই সর্বোপরি আমার চোখে এক একটা রহস্য -- সাইকোলজিক্যাল রহস্য আর তাই তো সুযোগ পেলেই ছুটে যাই ওর কাছে । কত বার কত কিছু জেনেছি তা বলে বোঝাতে পারবো না । তবে শুভ র মুখ এই প্রথম এমন কিছু জানলাম , অবশ্যই তার নিজের ব্যাপারে , যা শুনে মাথা বন বন করে ঘুরে গেছিল আমার । ঘটনাটা এবছর এপ্রিল মে মাসের । শুভ আমায় হঠাৎ ফোন করে জানালো যে সে কাল পুরুলিয়া আসছে , আমার কোয়ার্টার এ উঠবে । আমি তখন চাকরি সূত্রে পুরুলিয়া ইরিগেশন এর কোয়ার্টার এ থাকি । খবরটা শুনে বেশ আনন্দিত হলাম । আজ কত দিন পর শুভর সাথে দেখা হবে আবার । কিন্তু পাশাপাশি মাথায় নতুন প্রশ্ন জেগে উঠছিল । শুভ মানেই তো নতুন রহস্য । এবার তবে কি ???? 

যাই হোক নিজের ভাবনার ওপর লাগাম লাগিয়ে ঘর গোছাতে ব্যস্ত হলাম । ব্যাচেলর সংসার , বুঝতেই পারছেন । শুভ আবার একটু গোছানো জীবনযাত্রা পছন্দ করে , তবু ওর জীবনটাই এত অগোছালো কেন কে জানে !! বিছানার চাদর থেকে দরজার পর্দা , বালিশের ওয়ার থেকে জামা প্যান্ট সব বদলে ফেলা হল । হাতে সময় মাত্র এক দিন । রাত পোহালেই শুভ হাজির ।


২।।

বন্ধু আসার উৎকণ্ঠা চেপে রাখা খুবই কষ্টকর তা বেশ বুঝছিলাম । কিন্তু গোড়াতেই গন্ডগোল যখন তখন সমস্যা না হয়ে যায় কোথায় ? কাল ওর সাথে এত কথা বললাম আর কখন কিসে , মানে কোন ট্রেনে আসছে এই ছোট্ট প্রশ্নটাই করতে ভুলে গেছি । অবশ্য ভেবেছিলাম হয়ত রূপসী বাংলা ধরবে ও সবার মত । সাধারণত্ব সবাই ওই ট্রেনটাই ধরে থাকে । শুভ যে সাধারণ নয় , অঅসাধারন এটা ভুলে গেলে চলবে না । আজ সকাল থেকে তিনবার ফোন করেও পাই নি । বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম । নতুন এই পথে শুভ কোথায় , কি করছে কে জানে !! ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলটা বেজে উঠলো । দেখি শুভ ফোন করছে । ফোনটা তাড়াতাড়ি রিসিভ করেই প্রশ্ন করলাম , " কিরে কোথায় আছিস এখন ? কতক্ষন ধরে ফোন করছি , ধরতে নেই বুঝি " ? শুভ র মধ্যে আজও কোন পরিবর্তন দেখলাম না । একদম নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল , " গাড়ি চালাচ্ছি । এই ডানকুনি পার হলাম । সন্ধ্যের আগেই পুরুলিয়া ঢুকে যাবো বলে আন্দাজ করছি " । 

ওর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলেই ফেললাম , " গাড়ি ! কোন গাড়ি ? ট্রেন ধরিস নি তুই " ? নিজের কায়দায় হেসে ওপাশ থেকে উত্তর দিল , " আমার নতুন স্কর্পিও টা রে । ট্রেনে ধাক্কা খেতে আর ভালো লাগে না আমার । তাই ফোর হুইলার " । আমি জানি ও গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন করছে । তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে ওকে বলে ফোনটা কেটে দিলাম ।  




৩।।

সন্ধ্যে সাতটা । কোয়ার্টার এর নিচে একটা চার চাকার গাড়ি এসে দাড়ালো । ওহ বলা হয়নি , আমার কোয়ার্টার টি ফ্ল্যাটের মত , ২বিএইচকে , বাইরে একটা ব্যালকনি দোতলায় । ওপরে উঠে আসা জুতোর আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করেছিলাম এ নির্ঘাত শুভ । গলার শব্দ শুনে নিশ্চিত হলাম । ঘরে আজ আবার কারেন্ট নেই । এ এলাকায় এই একটা বড় সমস্যা । কথায় কথায় লাইন চলে যায় । অগত্যা মোমবাতি হাতে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে ।  

আজ এক বছর পর দুই বন্ধুর দেখা । ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই গলা মেলানোটা তাই খুব জরুরি । এরপর ঘরে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুরু হলো আড্ডা । কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়ে দেখতে কাল ও চিত্তরঞ্জন যাবে । এপথে আসছিল তাই চলে এসেছে এদিকে । শুভ আমার বয়সী কিন্তু বিয়ে করেনি এখনো । তার জন্য অবশ্য শুভ নিজেই দায়ী । কোন মেয়ে পছন্দ হয় না ওর । শুভর কথায় , " এরা কেউ পদের নয় " । আপনারা নিশ্চই জানেন শুভ ভালো কবিতা লেখে আর এই লেখালিখিকে কেন্দ্র করে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছিল তাকে । তবে এখন দিন বদলেছে । ওকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় শুভ বললো , " প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে । নানা রকমের । নানা ধরনের । এখন বই ছাপলে পাঠকের ভিড় উপচে পড়ে যখন , তখন মনে হয় লেখক হতে কত লোক ছুটে আসে । কিন্তু পাঠক এখানে শেষ কথা । তারা কাউকে বড় করে তোলে , আর কাউকে ফিনিস ....

চায়ের কাপটা নীচে রেখে এবার একটা সিগারেট ধরালো সে । আমিও সুযোগ দেখে একটা ধরালাম । শুভ দু টান দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো । " জানিস এই লাইনে কত ভুল বোঝাবুঝি হয় । কবি , প্রকাশক কেউ কারুর বন্ধু নয় । সবার টার্গেট সবাই । আজ তোকে দুটো ঘটনা শোনাবো । মন দিয়ে শুনিস । বুঝবি কত জঘন্য মানুষ আমরা যারা সাহিত্য চর্চা করি । প্রথম ঘটনার সাথে তো আমি নিজে জড়িয়ে আছি । 

সে এদিকে সিগারেট টা শেষ করে নিল এই ফাঁকে ও ঘটনাটা শুরু করবে বলে ঠিক করে বসলো । ওদিকে আমি সিগারেট ভুলে অবাক হয়ে গিলছিলাম বন্ধুর কথাগুলো । 


৪।।

লেখক হওয়ার শখ সেই কলেজজীবন থেকে ।। যেমন নাম তেমনি লেখা , প্রতিবাদে জ্বলজ্বল করে অক্ষরগুলো তার , নাম নজরুল পন্ডিত ,বয়স ওই ২১ কি ২২ হবে , দেখতে বেশ লম্বা , গায়ের রঙ কুচকুচে কালো ।। দেখলে যে কেউ ওকে আফ্রিকান ভেবে বসতে পারে ।। আমার সাথে পরিচয় লেখালিখি সূত্রেই ফেসবুকেতেই ।। তারপর দিন দশেক ম্যাসেঞ্জারে কথা হয় ।। অদ্ভুত মিশুকে স্বভাব , এই কয়েকদিনের পরিচয় কিন্তু তাতেই মনে হয় যেন কত দিন থেকে চিনি ।। এর মধ্যে নম্বর আদান প্রদান হয়েছে , ফোনে কথা হয় প্রায়ই ।। আমাকে বলেছিল ওর বাড়ি জলপাইগুড়ি , সেখানে একটি কলেজে ইংরেজি অনার্সে তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করে ।। 

সেদিন রাতে কথা বলতে বলতে আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল , " বই বের করবে " ? আমি তো ভেবে দেখলাম ভাল খবর , তাই রাজি হয়ে গেলাম ।। কিন্তু সমস্যা হল আমি কর্মসূত্রে মুম্বাইতে থাকি , তাহলে দায়িত্ব কে নেবে কাজের ।। নজরুল তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল ।। ও জানিয়েছিল , ও এখন বর্ধমানে মামার বাড়ি এসেছে , তাই এই ফাঁকে সব কাজ রেডি করে রাখতে ওর কোন সমস্যা হবে না ।। তারপর পুজোতে বইটি প্রকাশ করা যাবে ।। যদিও কোনদিন নজরুলকে সামনাসামনি দেখি নি , তবু ওকে অবিশ্বাস করতে মন চাইল না ।। রাজি হয়ে গেলাম ।।

ফেসবুকে এড দেওয়া হল , 20 জন কবির খোঁজে ।। এত সহজে আমাদের খোঁজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে আমরা ভাবতেও পারি নি ।। প্রচুর জমা পড়া লেখার মধ্যে থেকে 20 জনকে বেছে নেওয়া সোজা কাজ ছিল না , কিন্তু এই কঠিন প্রক্রিয়াটিও হাসিমুখে করে গেল নজরুল ।। এত বড় দ্বায়িত্ব ওর ওই ছোট্ট কাঁধে যেভাবে তুলে নিয়েছে , তাতে ওর প্রতি সম্মান আরও বেড়ে গেল আমার ।। 

এর মধ্যে কথা হত রোজ , তার জন্য নজরুলের প্রতি আমার ভালবাসা ও বিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিল ।। আমার চোখে ধীরে ধীরে ও ছোট ভাইয়ের মত হয়ে উঠছিল ।। নিজের অনেক গোপন কথা , সফলতা , ব্যর্থতা কত সহজে ওর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরেছি , তা ভাবলেও অবাক লাগে , আফটার অল ও আমার কাছে বাস্তবে কিন্তু অপরিচিতই একজন ।।

লেখক বাছাই শেষ হলে নজরুল নিজের দায়িত্বে প্রত্যেক লেখকের কাছ থেকে প্রকাশনী খরচ , নিজের ব্যাংক একাউন্টে তোলা শুরু করবে বলে মনস্থির করল ।। সমস্ত হিসাব করে সে প্রত্যেক কে জানিয়ে দিল যে 2000 করে টাকা লাগবে এবং সেটি আগামি 7 দিনের মধ্যে জমা করতে হবে ।। আমি ওর কাজ দেখে যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিলাম এবং তাই বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করি নি ।। তবে , ও কিন্তু প্রতিদিনের খবর আমাকে দিত ।। এরই মধ্যে জানতে পারি এক গরিব লেখিকা এই টাকা দিতে পারবে না , ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আমাকে জানান ।। আমি খবরটি নজরুলকে জানাই যখন ; তখন যথেষ্ট সংশয় ছিল , ও হয়ত লেখিকাকে বের করে দেবে সংকলন থেকে ।। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম ওকে দেখে ।। বের তো করেই নি , বরং নজরুল ওর সমস্ত খরচ নিজে বহন করবে বলে দিল ।। এতে ওর প্রতি আমার সম্মান আরও বেড়ে গেল ।। ভাইয়ের এই চিন্তা ভাবনা দেখে দাদা হিসাবে বেশ গর্ব হচ্ছিল ।। পাশাপাশি , নজরুলকে একটিবার দেখা করার ইচ্ছাও হচ্ছিল ।। 

সেদিন শনিবার , ঘুমাতে বেশি রাত হলেও কোন অসুবিধা নেই ।। তাই ফোন করলাম ওকে ।। প্রায় দু ঘন্টা আড্ডা মেরেছি , জিও ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে এটা মানতেই হবে ।। কত কিছু জানলাম নজরুল এর জীবনে বলে শেষ করতে পারব না ।। তবে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সেটা হল কঙ্কনা বোসের এপিসোডটা ।। কঙ্কনা হল , নজরুলের প্রেম ।। খুব ভালবাসত দুজন দুজনকে ।। একই কলেজে পড়ে , শুধু এক বছরের ছোট বড় ।। বছর দুই আগে কঙ্কনা নজরুলের নামে মিথ্যা অভিযোগ লাগিয়ে ওকে ছেড়ে চলে যায় ।। ওর কথা ও লেখা শুনে বোঝা যায় নজরুল আজও কঙ্কনাকে কতটা ভালবাসে এবং শুধু তাই নয় , বিশ্বাস করে এখনো যে কঙ্কনা একদিন ঠিক ফিরে আসবেই ।। নজরুলের যতগুলো লেখা সেই রাতে পড়ে শুনিয়েছিল আমাকে , তার মধ্যে লেখা হৃদয়ের ডায়েরি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ।। ও আমাকে জানায় যে লেখাটি ও কঙ্কনা চলে যাওয়ার পরের দিন লিখেছিল এবং এর একটি শব্দও মিথ্যে নয় ।। 

সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে কত কারবার চারিদিকে ঘটতে দেখছি , তাতে সত্যিই এক অপরিচিত কে বিশ্বাস করা উচিত নয় , বিশেষ করে যখন কিছুদিন আগেই এক প্রকাশকের বিরুদ্ধে টাকা চুরির অভিযোগে পুরো ফেসবুকে হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছিল , তখন নজরুল কে প্রতি মুহূর্তে সমর্থন করছি দেখে অনেকের চোখে বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল এটা বলতে বাকি থাকে না ।। সত্যি কথা বলতে , ওর মত চরিত্র আমি দ্বিতীয় কাউকে আজ অবধি খুঁজে পাইনি ।। প্রতিবাদ ও প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে নজরুল নামক এই সমুদ্রে ।। তাই , বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে ও কোন রকম দুনম্বরি করতেই পারে না ।।

কিছুদিনের মধ্যে লক্ষ্য করছিলাম , এই বিশাল 20 জন লেখক বা লেখিকা কে কন্ট্রোল করা খুব অসুবিধেজনক হয়ে উঠছে , আমি নজরুলকে তৎক্ষণাৎ জানাই এ বিষয়ে ।। নজরুল একটা মুচকি হেসে আমাকে বললো , " এ আর বড় কি , আজই হোয়্যাটসেপ এ একটা গ্রুপ বানাচ্ছি ।। ওখানে সবাইকে যুক্ত কর ।। এবার থেকে ওখানেই কথা হবে "।। 

আমি খুবই আনন্দিত ছিলাম এই ভেবে যে আমি এমন একজনকে পেয়েছি সম্পাদক হিসাবে , যার কাজের ইচ্ছে আছে এবং ভরসাও করা যায় ।। প্রতিদিনই কিছু না কিছু প্রশ্ন আসত আমার কাছে , কিন্তু গ্রুপ তৈরির পর থেকে সবাই যেন কেমন ঘুমিয়ে পড়েছিল ।। নজরুল এবং আমি বেশ বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম এবার ।।

সেদিন শুক্রবার , ৮ই জুন ।। নজরুল আমাকে রাত 10 টা নাগাদ হঠাৎ ফোন করছে দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলাম ।। হকচকিয়ে আরো গেলাম কারন গতকাল থেকে নজরুল নিখোঁজ ছিল ।। ও প্রকাশনীর কাজে কলকাতা গেছিল , সকাল ১০টার সময় ও স্থানীয় একজনকে ফোন করেছিল এবং সে কথা জানিয়েছিল ।। দুপুর 1টা নাগাদ সেই মহিলার ফোন আসে , তার থেকেই জানতে পারি সকাল 10টার পর থেকে নজরুল কে পাওয়া যাচ্ছে না ।। 

সঙ্গে সঙ্গে বাকি সহ লেখকদের ফোন করে জানাই খবরটি ।। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল , তখনও নজরুলের কোন খবর পাওয়া যায় নি ।। সবার মুখে একটা ভয়ের ছাপ ।। আমার কাছে ঘন ঘন ফোন আসতে থাকে যে নজরুলের কি খবর ।। একজন আমাকে বলে ," তুমি ওর কাছের ছিলে .. তোমার কি মনে হয় , ও কোথায় ..."।। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছু , এই প্রথম নজরুলের ওপর আমার সন্দেহ জন্ম নেয় ।। আমি বেশ কিছু জায়গায় খবর দিয়ে দি যে নজরুল আমাদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে ।। কেউ কেউ আমার কথায় এবার বিশ্বাস করলেও অধিকাংশ জন করে নি ।। 

গ্রুপ ছাড়াও গ্রুপের বাইরে আগুনের মত খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং সেই আগুনে ঘি ঢেলে চলেছিলাম আমি নিজে দায়িত্ব সহকারে , শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচাতে ।।

আজ নজরুলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই আমার এবং সেদিনের ঘটনার জন্য শাস্তি পেতে হয় এবং নজরুল সেই সংকলন থেকে আমাকে নির্বাসিত করে দেয় ।। এর জন্য আফসোস নেই , ওটা আমার প্রাপ্য ছিল ।। খারাপ আজও লাগে নজরুলের জীবনের সেই দিনটার জন্য , ওর চুরি যাওয়া মোবাইল , ল্যাপটপের জন্য আর ওর হারানো চিঠিগুলোর জন্য ।।




৫।।

গল্পের মধ্যে কটা সিগারেট খাওয়া হয়েছিল আজ গোনা হয় নি । অন্যদিকে ঘড়ির কাঁটাও দশ ছুঁই ছুঁই । কারেন্ট এসে গেছে এর মধ্যে দেখে শুভকে ডিনার সেরে নেওয়ার প্রস্তাব দিলাম । সে চোখ মুছছিল । পুরোনো তার চোখের কোনায় কখন বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা বুঝতে পারিনি আর হবে নাই বা কেন !! আমারই খারাপ লাগছে শুনে আর ওত নিজে ভুক্ত ভোগী । 

আমার এই ভাবনাগুলোকে মাঝপথে বিরাম লাগিয়ে দেখি শুভ ডিনারের জন্য তৈরি হয়ে গেছে । বেশ হুংকার দিয়ে লম্বু বলে উঠলো এবার , " চল । রাত্রি ভোজন করবি বলছিলিস । আমি রেডি । খাবার খেয়ে নিয়ে এসে আবার বসবো । দ্বিতীয় গল্পটা শুনবি না " ? 

আমি আর বিশেষ কিছু বললাম না , শুধু চল ছাড়া । ঘরে তৈরি চিকেনগুলো আজ সেভাবে টানছে না আমায় । চোখের সামনে গল্পের চরিত্রগুলো বাস্তব হয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে । বিশ্বাস হচ্ছে না যে সেই শুভ এই জঘন্য কাজটা করতে পেরেছিল যে একদিন মানুষকে বিশ্বাস করত । ফলে ঠকতো বারবার । 

শুভ কিন্তু দিব্যি সাঁটিয়ে চলেছে । মাঝে মাঝে এক দুটো প্রশ্ন করছে , কথা বলছে ; আমি যার প্রত্যেকটাই হ্যাঁ , না , হু ইত্যাদি বলে এড়িয়ে চলেছি । একসময় তো প্রায় ধমক দিয়ে বলে উঠলো শুভ , " তোকে দেখে মনে হচ্ছে , আমি আসাতে খুশি নোস । বেশ তাহলে আসবো না আর " । নিজেকে কল্পনার পৃথিবী থেকে চাগার দিয়ে তুললাম কোনরকমে এই বার । বললাম , " না রে । এমন কোন ব্যাপার নয় । ভাবছিলাম শুভ এমন পারলো কি করে ? ইমোশনাল শুভ , বোকা ছেলেটা পারলো .....( কয়েক মুহূর্তের পস দিয়ে আবার বলে চললো সে ) ..... সেই ছেলেটা যে শুভশ্রীর জন্য কাতর , সেই ছেলেটা ..... " 

মুখে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে , মাঝপথে থামিয়ে , সে বলল , " সে শুভ আর নেই । শুভ বদলে গেছে অনেক । ভালোবাসা এখনো আসে । প্রায় .... তিন তিন টে এগিয়েছিল অনেকদূর .... ফরম কিস টু সেক্স । তারপর সব ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছি " । 

"সেক্স ! অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে । শুভ হ্যাড সেক্স" !! 

" ইয়েস । সেক্স । আই হ্যাড সেক্স উইথ থ্রি । খেয়ে ফেলে দিয়েছি । দা ওয়ার্ল্ড ডিসার্ভ দিস । পৃথিবী যেমন আমি এখন তেমন হয়ে গেছি " । অবাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনে যাচ্চি । 

সিগারেট টা শেষ দুটান মেরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো ও । আমিও সেই ফাঁকে এঁটো বাসন নামিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলাম । দেখলাম রাতের আকাশের দিকে দেখলাম এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে । নির্বিকার , নতুন একটা ছবি । একটা সিগারেট হাতে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো , " জানিস । আমিও বুঝি এ রাস্তা সঠিক নয় । হতেই পারে না । আমিও জানি । অন্যায় করেছি । কিন্তু এটাই তো আজকের সমাজ জানে । ভালোবেসে আগলে রাখতে চাইলে দূরে সরে যেত । কিন্তু দেখ ওরাও তো বোঝে সব , তবু কেমন জড়িয়ে ধরে । গোপনীয়তা থেকে মুক্ত করে নিজেকে । অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই সমাজ এই সময়ে এটাই বোঝে । আমিও সেই পথ মেনে এগিয়েছি । তুইও এগোবি একদিন এই পথেই । 

কথা বলতে বলতে রাত কখন গভীর হয়ে গেল বুঝতেই পারি নি । কলোনির গেটে এগারোটা ঘন্টা পড়া শুনে হোস এলো দুজনেরই । ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু আড্ডা চলতে লাগলো আগের মতোই । 

" দ্বিতীয় ঘটনাটা বলবি না ? " , আগ্রহ দেখিয়ে শুভকে প্রশ্ন করলাম । ও নতুন একটা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করতে করতে উত্তর দিল , হু । আমিও একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে বসলাম ঘটনাটা শোনার জন্য । অন্যদিকে বারমুডা আর স্যান্ডো মোড়া আমার বাল্য বন্ধুটিও তৈরি তার অভিজ্ঞতাটি মেলে ধরার জন্য । 


৬।।

সাহিত্যের বাজারে প্রকাশকের টাকা মেরে পালিয়ে গেছে , ব্যাপারটা ঠিক হজম হল না প্রথমবার শুনে , কিন্তু তারপর যখন চারপাশে রব উঠল তখন না বিশ্বাস করে পারছিলাম না ।। আফটার অল বইটি প্রকাশ করতে যে সমস্যা দেখা দিল তাতে লোকসান আমারও , কারন আমার নিজের লেখাও তো বইটিতে প্রকাশিত হয়েছিল আর বইটি বাজারে যেহেতু আসতে পারছে না তাই এই ক্ষতির সমপরিমাণ ভাগ আমারও থেকে গেল ।। তবু , এত কিছুর পরেও একটা জায়গা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ।। মোট কুড়ি জন লেখক , প্রত্যেকে দুই হাজার করে সম্পাদক সৌমেন ঘটক কে দিয়েছিল ।। প্রকাশক এর কথা অনুযায়ী আর হাজার তিনেক টাকা তার প্রাপ্য ।। যদি সৌমেন চাইত সে সম্পূর্ণ অথবা বেশির ভাগ টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতেই পারতো , কিন্তু সে তো তা করেনি ।। এই জায়গাটাই সমানে ভাবিয়ে চলেছিল আমায় ।। আমি বিশ্বাস কোনদিনই করতে পারি নি যে সৌমেন টাকা ঝেড়েছে , সংক্ষেপে সাহিত্য জগতে একজন চোর এর জন্ম হয়েছিল সেদিন ,কবি সম্পাদকের নামে ।।

অন্যদিকে দিন দিন পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ আকার ধারণ করছিল ।। লেখক বন্ধুদের অনেকে রীতিমত থানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত , এই অবস্থায় সহ সম্পাদক গোবিন্দ না থাকলে যে কি হত তা ভাবতেও পারিনা ।। ওই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে নিজের গ্যারান্টি তে নেমে জল ঢালার কাজ শুরু করল গোবিন্দ ।। এতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করল ।। গোবিন্দ জানায় , " সৌমেন পালায় নি ।। তাকে ফোনে এক দু বার পাওয়া গেছে ।। সে কোন একটা গুরুতর সংকটের মধ্যে আছে এবং কথা দিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ।। " 

তার এই কথার প্রেক্ষিতে সিনিয়র লেখক সুবাশিষ মারান্ডি জানতে চাইল , " কিসের সমস্যা " ? 

গোবিন্দ জানায় যে এ বিষয়ে সৌমেন তাকে কিছুই জানাই নি ।। 

এই ঘটনার পর প্রায় পাঁচ ছ দিন ধরে সকলে বিভিন্ন নম্বর থেকে সৌমেনের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে তার ফোন সুইচ অফ পাওয়া যায় ।। এটা যেন নিভে যাওয়া আগুনে আবার ঘিয়ের সঞ্চার করল ।। সবাই প্রায় তৈরি হয়ে গেল এবার কলকাতা পুলিশে একটা এফ আই আর করবে সৌমেনের নামে ।। অধিকাংশ জন এই বিষয়ে সায় দিলেও , অনেকে সৌমেনের বিপদের ব্যাপারটি মোটেই উড়িয়ে দিতে চায় নি ।। তাদের কথায় , " আমাদের একবার ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত , ও সত্যি কোন বিপদে থাকতেও তো পারে !! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলটা একপ্রকার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল ।। আমি ও গোবিন্দ সেদিন ব্যক্তিগতভাবে চাইনি কোন পুলিশের ঝামেলা হোক সেদিন , কারন মনের কোন এক কোনায় এখনো বিশ্বাস ছিল সৌমেন একদিন ফিরে আসবেই ।। 

আজ এই ঘটনার দু বছর অতিক্রান্ত ।। ব্যাপারটা মোটামুটি থেমে গেছে ।। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের কাজ নিয়ে ।। ঠিক এমন এক গরমের দুপুরে একটি অচেনা নম্বর থেকে কল এল আমার মোবাইলে ।। 

~ হ্যালো , কে বলছেন ?

~ সন্দীপ দা আমায় চিনতে পারছো ? , অচেনা কন্ঠস্বরটি এবার কিছুটা চেনা মনে হল আমার , কিন্তু ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না ।। 

সে ওদিক থেকে বলে চললো , " আমি সৌমেন , চিনতে পারছো না দাদা , সেদিনের চোর গো আমি ।। " 

চোখটা জলে ভরে এল ।। বিশ্বসটা সত্যি হয়েছে আমার ।। আজ আমি সত্যিই খুশি ।। ওকে একবার জিজ্ঞেস করলাম , " কি হয়েছিল তোর ? কোথায় ছিলিস এতদিন ? '

~ দাদা , আমি ভারতীয় রেলে চাকরি পেয়েছি , পোস্টিং চেন্নাই ।। 

শুনে মনটা ভরে উঠল ।। আজ সৌমেন সত্যিই স্বার্থক ।। আজ ওকে চোর বলাও অন্যায় ।।

এরপর আরও হপ্তা খানেক কেটে গেছে ।। সৌমেনের সাথে দেখা করতে না পারলেও , ফোনে প্রায় রোজই কথা হত ।। এরই মধ্যে চলতো পুরোনো দিনের অনেক কথা , অনেক প্রসঙ্গ ।। কবিতা গল্প প্রভৃতি নিয়ে আলাপ আলোচনা তো ছিলই , ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও সে অনেক কথা বলতো সে আমায় ।। একদিন সন্ধ্যায় এমনই এক আলোচনা চলছিল ।। তাকে বললাম , " হ্যারে , কেমন দিন কাটে তোর এখন ।।" সঙ্গে সঙ্গে একদম নিজের পুরোনো ছন্দে উত্তর দিল , " কেমন আছি , এসে দেখে যাও না ।। তবে রবিবার এর মধ্যে এসো ।। রবিবার আমি চলে যাবো ।। " তার কথা মতোই ঠিক করলাম শনিবার সৌমেনের বাড়ি যাবো ।। এটুকু জানতাম সৌমেন বাঁকুড়ার সোনামুখিতে থাকে , ডিটেল্ড এড্রেস ফোনে জেনে নিলাম তাই ।। কিন্ত সময়ের বড়ই অভাব যে আমার ।। শনিবার একটি বিশেষ কাজে আমাকে আসানসোল যেতে হলো , ফলে রবিবার শেষমেস সৌমেনের বাড়ি যাবো বলে ঠিক করলাম ।। সকাল সকাল বেরোতে হবে , তাই সৌমেনের সাথে শনিবার আর কথা বলাই হলো না ।। 

রবিবার সকালে ট্রেনে উঠেই ওকে ফোন করেছিলাম , প্রায় বার দশেক ।। কিন্তু ফোন সুইচ অফ আসছিল ।। অতঃপর রাস্তা একটাই , তার বলে দেওয়া পথে এগিয়ে যাওয়া ।। সেই মত বাঁকুড়া স্টেশনে নামলাম ।। ইস !! ভুলেই গেছিলাম , সৌমেন তো আজ চলে যাবে বলেছিলাম ।। আর এটা মনেও পড়ল বাঁকুড়ায় নেমে ।। কি করি !! ফিরে যাব ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম ।। অবশেষে ঠিক করলাম , ওর বাড়িটা দেখেই আসি ।। পরের বার না হয় মিট করা যাবে ।। সেই মত বেরিয়ে এলাম সৌমেনের বাড়ির উদ্দেশ্যে ।। 

বাড়ির পাশেই একটা বটগাছ আছে বলেছিল ।। দূর থেকে দেখে লোকেশন তো ঠিকই মনে হচ্ছিল , কিন্তু আজ অস্বাভাবিক ভিড় ওই বট গাছের সামনে ।। একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম সেই পানা পুকুর , যেটার কথা সৌমেন বলেছিল ।। আর কিছুটা এগিয়ে যেতেই শরীরটা হিম হয়ে গেল ।। গাছের নিচে শুয়ে আছে সৌমেন , সামনে সকলের চোখে জল আর বুক ফাটা কান্নার শব্দ ।। সত্যিই সে চলে গেছে , কথা রেখেছে ছেলেটি ।। একজন মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল , মোবাইলটা খুলে একটা ছবি আমার সাথে দু তিনবার মিলিয়ে নিলো আর তারপর কিছু না বলে , একটা ডায়েরি আমার দিকে এগিয়ে দিয়েই ছুটে চলে গেল ।। প্রায় ঘন্টা দুয়েক গাছটার পাশে মাটিতেই বসে ছিলাম ।। কিছুই বোঝাবার বা নিজেকে বোঝাবার অবস্থায় ছিলাম না এতক্ষন ।। আস্তে আস্তে হোস ফিরল যখন তখন দুপুর ।। 

এখন আমি আমার ঘরে বসে সেই ডায়েরিটাই পড়ছি ।। যে ঘটনা তার থেকে জানতে পারছি তা সবই বিশ্বাসের বাইরে ।। তবু ডায়েরির কভার পেজটা .... বিশ্বাসের বাইরে আমার - " এক প্রতারক , ঠগবাজের ঠকে যাওয়ার গল্প " ।। হঠাৎ হাতে কি যেন একটা ঠেকল , চেয়ে দেখি উঁকি মারছে একটা বিয়ের কার্ড ।। খামের ওপর স্পষ্ট লেখা বিশে সেপ্টে...

বুঝতে বাকি থাকলো না ওটা বিশে সেপ্টেম্বর লেখা ।। খুব অবাক হলাম , ভাবলাম সৌমেন বিয়ে করছে আবার ।। কেউ জানুক আর না জানুক , আমি তো জানতাম সবটাই , কিন্তু কি এমন হল !! 

কৌতূহল নিয়ে কার্ডটা খুলে দেখলাম ।। পুরো পৃথিবীটা আমার কাছে মনে হল উল্টে গেলো ।। নন্দিনীর বিয়ে , কার্ডে বড় বড় হরফে লেখা , " জীবন মজা করার নাম , আনন্দ করার নাম , মস্তি করার নাম ।। সব পেয়েছি এতদিন ।। ধন্যবাদ ।। চোখটা মুছতে মুছতে পাশে রাখা আর একটি খাম খুললাম ।। তিন হাজার টাকা রয়েছে আর একটা চিঠি যাতে লেখা আছে , " প্রকাশককে আমার 'ল সেলাম ।। " হেসে উঠলাম লেখার কায়দা দেখে ।। কিছু বলার ভাষা পেলাম না আর শুধু আকাশে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলা ছাড়া , "বন্ধু লাল সেলাম " .....




৭।।

শুভ র মুখ থেকে এমন অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলাম । সীমাহীন লোভ আজকের মানুষের মধ্যে । দাম খোঁজে সব কিছুর মধ্যে তারা । অথচ মানুষের জীবনের মূল্য নেই এদের কাছে । অধিকারের নামে তারা মানুষের কষ্ট অনুভব করতে চায় না পর্যন্ত । মানুষ জন্ম থেকে রাজনৈতিক নয় , স্বার্থপর । আর তাই নিজের টুকু খুব বোঝে তারা । 

আমার বাল্য বন্ধু শুভ র জীবন আজ সেই স্বার্থ পরিচালিত । নানা ঝড় ঝাপটা দেখতে দেখতে সে পাল্টে ফেলেছে নিজেকে । হি টেস্টস এভরিথিং বাট সাক্স নন । বদলে যাওয়া শুভর পাশে শুয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু তার কথাগুলো বড্ড প্রাসঙ্গিক । রাত পেরোলেই তার বিদায় । বদলে যাক শুভ আবার । ফিরে আসুক নিজের আসল চেহারায় । এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে গেছে আমার বুঝতে পারিনি আর শুভ সে তো কখন ঘুমিয়ে গেছে দিব্যি । 

মধ্য রাতের এই ঘরে আজ দুজন পুরুষ ছিল আর ছিল একটা কথা , প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল আমার স্বপ্নে সারা রাত --


" ইয়েস । সেক্স । আই হ্যাড সেক্স উইথ থ্রি । খেয়ে ফেলে দিয়েছি । দা ওয়ার্ল্ড ডিসার্ভ দিস । পৃথিবী যেমন আমি এখন তেমন হয়ে গেছি " , আমার বাল্য বন্ধু শুভদীপ গাঙ্গুলি ওরফে আমাদের শুভ ।



ফিরে আসা দিনরাত্রি 


সোদপুর থেকে শিয়ালদহ লোকাল সেদিন বেশ ভিড়ে ঠাসা , তার মধ্যে জায়গা পেয়ে গেলাম এটা কপাল ছাড়া আর কি বলা যায় আর তাছাড়া রোজ যাতায়াতের সুবাদে কিছু চেনা পরিচিত মুখ তৈরি হয়েই গেছে এতদিনে ।। ট্রেন চলতে শুরু করার প্রায় মিনিট দুয়েক পরেই চোখটা যখন ওর দিকে পড়ল , কেমন যেন মনে হল ।। কোথাও দেখেছি ওকে , কিন্তু মনে করতে পারছি না ।। হা করে তাকিয়ে আছি , ওই প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বয়সি মুখটার দিকে ।। বেশ সুন্দরী চেহারা , মাঝারি গড়ন , গায়ের রং সাদা , গায়ে একটা নীল টপ ও কালো জিন্স ।। 

অবাক হয়ে মিনিট পনেরো তাকিয়ে আছি দেখে , একবার ও আমার দিকে ফিরে তাকাল ।। তারপর আমাকে বেশ খুঁটিয়ে একদুবার দেখে বলে উঠল , " আমায় চিনতে পারলে না !! তুমি সোদপুরের শুভ না ? 

আমি ভাবলাম যে তাহলে তো ঠিক ই ভেবেছি , আস্তে করে বললাম ; " সেটাই তো ভাবছি , কোথায় দেখেছি বলত ?" এবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল , " আমি পায়েল , হাসপাতালে পরিচয় , মনে পড়েছে এবার "?? আমি লজ্জায় জীব কেটে ফেললাম ।। সত্যি চিনতে পারিনি , আমার সেদিনের না পাওয়া ভালবাসাকে ।। এরপর নানা কথা জুড়ে দিল আমার সাথে , কিছু বেশি বলে ফেললাম আর কিছু উত্তর দিলাম না ।। কথায় কথায় বুঝতেই পারিনি ট্রেনটি কখন উল্টোডাঙ্গা পৌঁছে গেল ।। আমি নেমে যাব এখানেই ।। 

ও বললো , ওর গন্তব্য শিয়ালদহ ।। রোজ এই ট্রেনেই ব্যারাকপুর থেকে আসে , এই কোম্পার্টমেন্ট ওর ফিক্সড ।। আবার দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি বিনিময় করে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে ।। তারপর থেকে রোজ এই আধঘন্টা জমিয়ে আড্ডা চলে ।। বন্ধুত্বটাও বেশ জমছে ধিরে ধিরে , যদিও বছর তিনেক আগেই বন্ধুত্বর হাতেখড়ি হয় ও ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিলাম ।। এই যেমন , ও একটি সরকারি হাসপাতালে নার্স , বাবা ভর্তি ছিল তখন প্রথম আলাপ হয় ।। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে যায় ।। ফেসবুক তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে বের করি ওকে , পায়েল চৌধুরী , নামে ছিল একাউন্টটি ।।

অফিসে বসে বসে এসব নানা পুরোনো কথা মাথায় ঘুরতে থাকে কিছু দিন ধরেই ।।অবশেষে একাউন্টটা আবার একবার সার্চ করতে শুরু করলাম আর মজার কথা হল , এক চান্সে পেয়েও গেলাম ।। ফেসবুক আমাদের ইমোশন কিন্তু বেশ বোঝে ।। তারপর আর কি !! দেরি না করে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম , মিনিটের মধ্যে একসেপ্ট হয়েও গেল ।। এখন আর কোন বাঁধা নেই , দিনে রাতে কথা হবে ।।

অবশ্য এই প্রথম বার রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি না ওকে ।। আগের বারও পাঠিয়েছিলাম , কিছু দিন অপেক্ষা করিয়ে তারপর একসেপ্ট করে সেবার ।। তারপর কথা হত , অনেক জানা অজানা কথা নিজেদের সম্পর্কে আদান প্রদান হত , সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়ে উঠছিলাম আমরা ।। নানা কথা বার্তার মধ্যে দিয়ে ওর খুবই কাছে চলে আসি আমি ।। এরই মধ্যে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারি নি , একদিন বলেই ফেলেছিলাম পায়েল কে যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি ।। একটাই উত্তর দিল , "নিজেই তো বাবা মা র ওপর নির্ভরশীল , আমাকে চালাবে কি করে " ?? তারপর থেকে আর কোনদিন রিপ্লাই দেয় নি ।। 

সত্যি আমার তখনও কোন চাকরি জোটে নি হাতে , তবে চেষ্টা করছিলাম আর যা কোয়ালিফিকেশন ছিল তাতে বিশ্বাস ছিল , খুব তাড়াতাড়ি জুটেও যাবে ।। সেদিন সে কথা ওকে মেসেঞ্জারে টাইপ করে লিখে পাঠিয়েওছিলাম , হয়ত আর শুনতে চাই নি বা ভাল লাগেনি শুনতে আবার ।। এর পর নিজের জগৎ টা অন্য ভাবে সাজিয়েছি , গেল বছরের প্রথম দিকে একটা চাকরিও জুটেছে ।। মাস গেলে হাতে এখন 30000 টাকা পাই ।। বাবার শরীর আবার খারাপ হলে , তার জন্য চিন্তা করতে হয়েছে , এই সব মিলিয়ে জীবনটা এক অন্য মাত্রায় এনজয় করেছি এতদিন ধরে ।। সে এপিসোডগুলোতে কোন পায়েলের জায়গা ছিল না ।। এত দিন পর ট্রেনে ওর সাথে দেখা হওয়াতে সেই দিন গুলো ফিরে পেলাম তবে একটা ভয় মিশ্রিত আনন্দ মনে থেকেই গেল ।।

তখন রাত বারোটা ।। অফিস থেকে বাড়ি ঢুকতে আজ একটু দেরি হয়ে গেল , মার্চ মাস , তাই প্রচুর কাজের চাপ ।। এই সময়ে একাউন্টেন্টদের যে কি অবস্থা হয় বলে বোঝাতে পারব না ।। বাড়ি ফিরে সেদিন আর শরীর একদম চলছিল না ।। এরই মধ্যে ফেসবুকে হঠাৎ পায়েলকে অনলাইন দেখে নতুন একটা এনার্জি পেলাম মনে হল ।। ছোট্ট করে হায় লিখে পাঠালাম ।। সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাইও দিল ।। এত তাড়াতাড়ি রিপ্লাই পেয়ে একটু অবাক হলাম , আমার মেসেজের জন্যই বসেছিল না তো !! পরক্ষণেই ভাবলাম , তাই আবার হয় নাকি ।। যাই হোক , এভাবে কথা এগোতে শুরু করল ।। সেদিন থেকে রোজ রাতে প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে ওর সাথে চ্যাট করা অভ্যেস হয়ে গেছিল ।। রাতে চ্যাট , অফিসে ফাঁকা সময়ে চ্যাট , দিনে ট্রেনে আড্ডা যেন আমার জগৎটা পাল্টে দিয়েছিল ।। 

অফিসে সায়নী ছিল আমার ফেবারিট কলিগ ।। আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসতে দেখে ও একদিন জিজ্ঞেস করেই বসল যে ব্যাপার কি ।। সব শুনে ও বেশ খুশি হল , বললো , " ভগবান , মুখ তুলে চেয়েছে তোর ওপর "।। আমি আবার নাস্তিক , সবাই জানে সেটা ।। ভগবানের নাম শুনে খুব রেগে গেলাম সায়নির ওপর ।।

সেদিন ছিল শনিবার ।। সকাল থেকে চ্যাট আদানপ্রদান চলছিল ।। হঠাৎ দেখি মেসেঞ্জারে রিং হচ্ছে , পায়েল কলিং ।। ফোনটা দুবার কেটে গেল , শেষ মেস তৃতীয়বার ফোন ধরলাম ।। প্রায় ঘন্টা খানেক কথা হল দুজনের মধ্যে ।। মোবাইল নম্বরও আদানপ্রদান সেরে নিলাম এর মধ্যে ।। ব্যাস আর কি !! এর থেকে ভাল প্রমোশন কারুর জন্য হতে পারেই না ।। প্রায় ফোন করত আমায় ।। খেয়েছি কি না , কি খেয়েছি , কেন খেয়েছি , কখন ঘুমালাম এরকম হাজার ছোট ছোট কথায় ফোন করত ।। প্রথম দিকে সেরাম কল করতাম না আমি , ঐ মাঝে মাঝে কল করতাম , বেশি ফোন তো ওই করত ।। তবে যত সময় যেতে লাগল , আমারও আগ্রহ বেশ বাড়ল ।। 

এখন দিনে অন্তত দশ বারো বার ফোন তো হয়েই যায় পায়েলকে , আর দুদিক মিলিয়ে ধরলে সংখ্যাটা ত্রিশ তো ছাড়াবেই ।। একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারছিলাম এখন যে পায়েল আমার প্রতি বেশ ইন্টারেস্টেড ।। ওর কথা, বার্তা , হাব ,ভাব দেখে স্পষ্ট অনুমান করাই যায় ।। এর মধ্যে একদুবার দেখা করার কথাও বলেছে কিন্তু আমার এত কাজের চাপ যে সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি ।।

সেদিন ২৫শে বৈশাখ , রবীন্দ্র জয়ন্তী ।। দুদিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল আজ অফিস ছুটি নিতে , দেখা করতেই হবে , ওর খুব জরুরি কিছু কথা বলার আছে ।। হাজার বুঝিয়েও যখন বোঝাতে পারলাম না , তখন রাজি হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না ।। বলেই রেখেছিল , সকাল দশটার লোকাল ধরে দমদম , ওখান থেকে মেট্রো ধরে ময়দান ।। তারপর সারাদিন ঘুরবে আমার সাথে ।। ব্যারাকপুরে ট্রেনে চেপেই ফোন করেছিল আমায় ।। জানতে চাইল , আমি বেড়িয়েছি কি না ।। আমি বললাম , বেড়িয়ে গেছি ।। 

ট্রেন এল ঠিক দশটা ।। ট্রেনে চেপে বসলাম ।। সিট রেখে দিয়েছিল তাই অসুবিধা হয় নি ।। পথে নানা কথা বলে চলেছে , নতুন পুরোনো নানা কথা , আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছি আবার কখনো উত্তরও দিচ্ছি ।। কথামত দমদম নেমে বাইরে বেরিয়ে মেট্রো ধরলাম ।। ময়দান যখন নামলাম তখন ঘড়িতে এগারোটা দশ ।। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ভিক্টরিয়া , মনুমেন্ট ঘুরে মাঠে এসে বসলাম ।। 

সকালে সেই ট্রেনে ওঠা থেকে ওর অনেক কথাই শুনে চলেছি ,কোনটাই সেরাম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না ।। ভাবছিলাম আমার সাথে সময় কাটাতেই এই মিথ্যা বলেছে হয়ত ।। তবে ওর চোখ , মুখ যেন অন্য কিছু বলতে চাইছিল ।। ঠিক কি ঠাহর করতে পারছিলাম না ।। বিকেল হয়ে এল এদিকে আকাশে কাল মেঘ জমেছে , তাই বললাম , এবার আমাদের বাড়ি ফেরা উচিত ।। ও রাজি হয়ে গেল , বললো , " ঠিক বলেছ "।। এই টুকু বলেই বলে উঠল , " দাড়াও , দরকারি কথাটা তো বলাই হল না " ।। শোনার জন্য দাঁড়ালাম , এদিকে আকাশ কালো করে এসেছে দেখে জলদি বলতে বললাম ।। 

নিজের মধ্যে একটু সাহস জুগিয়ে নিল , তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল , "তুমি কি আমায় এখন ভালবাসতে পারবে ? আমি কিন্তু এখন তোমাকে খুব ভালবাসি ।। দুজনেই চাকরি করি ।। এখন তো আমাদের কোন সমস্যা নেই এক হতে" ।। শুনে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম আর পিছনে পড়ে রইল পায়েল ।। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে একদিকে , অন্যদিকে দুরথেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুর ;

" তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও।

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে

আর কিছু নাহি চায় গো...." ।।








অন্যায় 


( গল্পটি সম্পূর্ণ সত্যি এক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা , নাম ও স্থান পরিবর্তন হলেও , ঘটনাটি কাল্পনিক নয় ) 



গল্পটা পড়তে পড়তে আপনাদের স্রেফ একটা গল্প বলে মনে হতে পারে , কিন্তু তারই পাশাপাশি বলে রাখি এই গল্পের প্রত্যেক অক্ষরে যে নাম লেখা আছে তা কোন গল্প নয় , একটা বাস্তব । আর এই বাস্তব গল্পটা আজ প্রেস ক্লাবের বদ্ধ কেবিনে বসে যখন শুনছিলাম তখন মনে হচ্ছিল , এই পৃথিবী জুড়ে আজও কত প্রকারের প্রতারক ঘুরে বেড়াচ্ছে । আজও শ্রেণী বিভাজনের সত্যিটা জ্বলজ্বল করে এই পৃথিবীতে । মালিক শ্রেণী আজও তার কর্মচারীর কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতে চায় শুভের মত নিরীহ ছেলের অধিকার । আজ সন্ধ্যায় কথায় কথায় শুভ নিজের অতীত অভিজ্ঞতা আমার সামনে যখন খুলে রাখতে শুরু করলো তখন একজন প্রকাশক নয় মানুষ হয়ে হাঁ করে সব শুনছিলাম । আর সেই অভিজ্ঞতাই কলমের ডগায় ফুটিয়ে তুলতে প্রকাশক স্বত্বা থেকে নিজেকে লেখক সত্বায় পরিবর্তন করলাম আজ । 

গল্পটা শুরু আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে । দীর্ঘ ৫ বছর ধরে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে শুভ । দেখতে দেখতে ২০০ র বেশি পরীক্ষাও দিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই , কিন্তু কোন জায়গায় আজও কোন দাগ কাটতে পারে নি । রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়া ছেলেটি সেদিন কিন্তু হাল ছেড়ে দেয় নি , বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও সে একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলেছে । কথায় আছে যে খাটে সে অবশ্যই ফল পায় , আর শুভের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছুই হয় নি । ২৬ বছর বয়সী শুভের ভাগ্যের সিঁকে আজ ছিঁড়লো অবশেষে । তার নাম নতুন ভারত বীমা কোম্পানিতে প্রশাসনিক অফিসার পদে নির্বাচিত হয়েছে বলে সে ইন্টারনেট মারফত জানতে পারে । প্রথমে নিজের চোখের ওপর বিশ্বাস হচ্ছিল না তার ; তাই বারবার সে একই লিস্ট নেড়ে ঘেঁটে দেখতে লাগলো । জীবনের এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শুভ এক বুক ভরা স্বপ্নকে স্বার্থক হতে দেখতে পাচ্ছে । আফসোস একটাই , এমন এক খুশির খবর তার বাবা কিছুই বুঝতে পারবে না । তিনি আলজেইমারের শিকার , ফলত্ব বর্তমান সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন সেই রোগের প্রভাবে । 

শুভ দিন গুনছে এখন কোম্পানির অফার লেটার পাওয়ার ও তারপর বাকি টুকটাক ফর্মালিটিস শেষ হলেই তার লক্ষ পূরণ হয়ে যাবে । সাতদিন পরে কোম্পানির তরফ থেকে মেডিক্যালের জন্য ডাক পড়লো আর তার সাথে একটি এগ্রিমেন্ট কপির বয়ান পাঠানো হয়েছে যেটা ওই নির্দিষ্ট দিনে জমা দিতে হবে শুভকে । এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী কোম্পানি শুভের সঙ্গে চার বছরের এগ্রিমেন্ট করবে , অর্থাৎ চার বছর না হলে শুভ এই চাকরি কোনমতেই ছাড়তে পারবে না ( যার মধ্যে এক বছরের ট্রেনিং পিরিয়ড ও ধরা আছে ) । যদি কোন কারনে শুভকে চার বছরের আগে চাকরি ছাড়তে হয় তবে তাকে জরিমানা স্বরূপ এক বছরের গ্রস মাইনে ও ট্রেনিং ফি বাবদ পঁচিশ হাজার টাকা কোম্পানিকে ফেরত দিতে হবে । এগ্রিমেন্টে আরো লেখা আছে যে কোম্পানি যে কোন সময়ে কোন নোটিস ছাড়াই শুভকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে এবং এমন এক অবস্থায়ও শুভ আগের নিয়ম অনুযায়ীই ক্ষতিপূরণ ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে । উপরের দুটি ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ না দিলে কোম্পানি শুভর বিরুদ্ধে আইন মাফিক ব্যবস্থা নিতে পারে ।

প্রথম চাকরি পাওয়ার আনন্দ মানুষকে পাগল করে তোলে । এতটাই পাগল করে দেয় যে তখন তার ওপর হতে চলা অন্যায় সে কোন দিন ঠাহর করতে পারে না । আমার শুভও তো রক্ত মাংসের একজন মানুষ । তার চিন্তা ভাবনা এসবের বাইরে না হওয়াটাই স্বাভাবিক - তাই না ? শুভ সেদিন অত ভাবেনি । ভাবেনি যে কোম্পানি তার ওপর কি রকম অত্যাচার করতে পারে । ভবিষ্যত নিয়ে যতটা কম ভাবা যায় ততই ভালো , ছেলেবেলা থেকে শুভ তাই শিখে এসেছিল বড়দের থেকে । কিন্তু ভাবনার দৌড় যে বাড়ানো উচিত এটা কেউ বলেনি তাকে । মেডিক্যাল ও অন্যান্য ফরম্যালিটি বেশ ভালো ভাবে পূর্ণ হল তার । এখন শুধু জয়েনিং লেটার হাতে পাওয়া বাকি । 

আমাকে গল্পের এতদূর বলে মিনিট খানেক চুপ করে বসলো সে । বেশ বুঝতে পারছিলাম এর আগের অনুভূতিটা বলা তার কাছে আরও কষ্টের । কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করলো শুভ । 

" ১৯ মে ২০১৫ সালে আমার জয়েনিং হয় । মেল আই ডি তে জয়েনিং লেটার কোম্পানি থেকে মেল করা হয়েছিল । জয়েনিং লেটার অনুযায়ী আমায় বর্ধমানের অফিসে জয়েন করতে বলা হয় । নির্দিষ্ট দিনে আমি অফিসে হাজির হই । সকাল দশটায় অফিস খুললে আমায় ভেতরে বসতে বলা হয় । প্রায় এগারোটা নাগাদ ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার বি. রাহা অফিসে প্রবেশ করে ও আমাকে নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠায় । সেখানে আমার ডকুমেন্টস এর জেরক্স ও সার্ভিস এগ্রিমেন্ট জমা নেওয়া হয় । এর পর তিনি নিজে আমার সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দেন । 

অফিসের কলিগরা আমার থেকে অনেক সিনিয়র । তবে তাতে আমার কোনদিন অসুবিধা হয় নি । তাদের সঙ্গে থেকে আমি বিমার বিভিন্ন বিষয়ে কাজ শিখতে শুরু করি । দিন পনেরো পরে কোম্পানি থেকে আমাদের নতুন জয়েন করা সকলকে ট্রেনিংয়ের জন্য পুনে পাঠায় । সেখানে ন্যাশনাল ইনসিউরেন্স একাডেমিতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয় । সেখানেই ট্রেনিং চলতে থাকে আমার । " 

আমি এতক্ষন সব শুনছিলাম মন দিয়ে । এবার শুভকে আমি একটু থামিয়ে প্রশ্ন করি ; " পুনের দিনগুলো কেমন ছিল " ? প্রশ্নটা নেহাত আগ্রহ নিয়ে করেছিলাম কিন্তু শুভ মানেই ঘটনা এটা ভুলে গেছিলাম । আর পুনে মানে কত অভিজ্ঞতা কি আর বলবো । সব শুধু শুনেই যাচ্ছিলাম , বলতে পারেন গিলছিলাম । 

ইতিমধ্যেই গরম সিঙ্গারা নিয়ে হাজির অফিসের কেরানি । সাহেবের গেস্ট এসেছে দেখেছিল বেশ আগেই । তাই সাহেবের হাঁক ডাকের অপেক্ষা করেনি সে আর । ওয়াচম্যান তন্তুকে ডেকে নিজের পকেট ভাঙিয়ে গরম দশটা সিঙ্গারা আর বড় কাপে দু কাপ চা ট্রে তে সাজিয়ে সে সোজা চেম্বারে এসে উপস্থিত । একটা সিঙ্গারা হাতে তুলে নিয়ে কামড় বসালো শুভই এবার । মেজাজটা বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে ওর । পুনের জীবনী বলতে গিয়ে শুরু করলো এন আই এ র বিকেলের চা পান দিয়ে । বললো , " বুঝলি পুনের বিকেলগুলো বেশ রসালো ছিল । কোনদিন আলু পকড়া , কোনদিন কচুরি , কোনদিন পাও ভাজি আর কোনো কোনো দিন সৌমিকের সাথে কে এফ সি , ম্যাকডোনাল্ডের স্বাদ আজও ভোলার নয় " । 

সিঙ্গারায় আরও একটা কামড় বসিয়ে শুভকে সৌমিকের ব্যাপারে জানতে চাইতেই ওর মুখ দিয়ে একটা ছোট্ট হাসি আর ইডিয়ট বেরিয়ে এল । তারপর কিছুক্ষন থেমে বললো , " একটা বাচ্চা ছেলে । ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বেরিয়েই চাকরি পেয়ে গেছে । বিদেশ ভুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা তেমন নেই । ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে দুর্গাপুর থেকে । বাড়ির কাছেই তাই হোস্টেল লাইফ কাটাতে হয় নি কোনদিন । পুনেতে তার বন্ধু বলতে আমি আর সোরেন । সোরেন অবশ্য অন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল । হোস্টেলের বাইরের খাবার বলতে মদ আর মাংস ছাড়া কিছুই চিনতো না । সৌমিক বড়ুয়া অবশ্য মদ সিগারেট ছুতো না আর তাই আমাকেই বগল দাবা করে নিয়ে যেত প্রায়ই ক্লাস শেষ হবার পর কে এফ সি , ম্যাকডোনাল্ড , পিজা হাট প্রভৃতি দোকানে । একদিন তো আবার আমাকে নিয়ে হাজির মেনল্যান্ড চায়নাতে । জানিস খুব আনন্দ করে দুজনে ল্যাম্ব খেয়েছিলাম । এই ভাবেই দিন কাটছিল দুজনের । সকাল থেকে ক্লাস আর বিকেল হলেই পুরো দমে মজা , খাওয়া দাওয়া আর শনি রবিবার --- সেটা না বললেই নয় । সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম দুজনে " । 

শুভ ও তার পুনের দিনগুলো শুনতে শুনতে চা সিঙ্গারা কখন শেষ করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি । বদ্ধ কেবিন ছেড়ে দুজনে এবার বেরিয়ে পড়লাম আমার চার চাকা গাড়িতে সামনাসামনি কোথাও । নন্দনের পিছন দিক করে নামলাম দুজনে । মন ভরছে না এটুকুতে । গাড়ির ড্রাইভারকে ফেরত পাঠিয়ে দুজনে গিয়ে বসলাম একটা গাছ তলায় । একটা সিগারেট ধরিয়ে শুভকে বললাম , তারপর ?? ব্যাস শুভ শুরু হয়ে গেল অমনি । 

" আমাদের প্রথম ট্রেনিং এক মাসের ছিল । আর এই এক মাস জুড়ে অত ছেলে মেয়ের মহা মিলন তীর্থে এক মুহূর্ত একা অনুভব করি নি এক মুহূর্ত । প্রথম মাইনে পেলাম এই ট্রেনিং চলা কালীন । ৫৮০০০ টাকা । ভেবে পাচ্ছিলাম কি করবো এই টাকা নিয়ে । পুনে থেকে কিছু শপিং করলাম সবাই । বড়ুয়াটা অবশ্য কিছুই কেনেনি । পুরো টাকাটাই জমিয়ে রেখেছিল । আর এভাবেই এক মাস কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম নিজের নিজের অফিসে অন জব ট্রেনিংয়ের জন্য । 

অবশ্য পুনের দিনগুলো বলা হলে আরও একটা কথা বলতেই হয় । দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের গল্প । সেটা ছাড়া ওই দিনগুলো অসম্পূর্ণ ছিল । এক এক করে ধরে ধরে বলছি , মন দিয়ে শোন । তবে তার আগে এক কাপ চা হয়ে যাক " ?? 

চায়ের গরম ভাঁড়ে হালকা চুমুক দিতে দিতে শুভর মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো পূজা , মৌসুমী র মত নাম না জানা কত নাম । পুনের সেই ছোট্ট জগৎ ঘেরা তাদের গল্প । অল্প অল্প প্রেম ধরা পড়ছিল শুভর চোখে মুখে । এরা এসেছিল অল্প সময়ের জন্য আর তারপর হারিয়ে গেছিল শুভর জীবন থেকে । তবু এসবার মধ্যিখানে যার নাম শুভর মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল বারবার সে হল মঞ্জলি । ঝাঁসির গলি যেন তার ছোঁয়ায় পুনের বাতাসে মিশে গেছিল প্রতিবার । আর এমন অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে দুরন্ত এক্সপ্রেস হাওড়া ফিরে এলে কেমন যেন গতিতে ভাঁটা দেখতে পাই । শুভর গল্পগুলো কিন্তু এখানে 

শেষ হয় না । বরং শুরু হয় নতুন করে মাস খানেকের প্রতীক্ষার পরে । আগস্ট এর আহ্বান এর অপেক্ষা নিয়ে ফিরে এলো সবাই নিজের নিজের অফিসে অন জব ট্রেনিং নিতে । শুভ হাওড়া নামার পরের দিন ই ফিরে এলো বর্ধমানে , বিরহাটার চার দেওয়ালে । শুরু হল কাজের মধ্যে কাজ শিখে নেওয়া তার । এক মাসের দীর্ঘ এই পথে শুভর উন্নতি চরমে পৌঁছায় । নানা প্রকার আন্ডার রাইটিং এবং ক্লেমস শুভ বেশ ভাল ভাবেই করায়ত্ত করে ফেলেছিল । সিনিয়ার কলিগদের ভালোবাসা ও এজেন্টদের বিশ্বাসকে সম্বল করে শুভর প্লেন পুনে বিমানবন্দরে যখন অবতীর্ণ হল তখন প্রায় রাত দশটা । এত কিছু শুনছিলাম , তবু একটা প্রশ্ন এখনও পিছু ছাড়ছিল না কিছুতেই আর এই উৎকন্ঠার মধ্যেই শুভকে প্রশ্নটা পেরেই ফেললাম , " তোর দিন গুলো এত সুন্দর ছিল , তাহলে আফসোসটা কোথায় ছিল ? তুই যে অন্যায়ের কথা বলবি বলেছিলিস সেটা কি ছিল ? কেই বা দোষী " ? 

শুভ জ্বলন্ত নিকোটিনের মধ্যে নিজেকে ঢেকে নিয়েছে ততক্ষনে । শুধু তার গলা শোনা গেল ধোঁয়ার মধ্যে থেকে --- 

" যা ছিল তা আমাদের তৈরি । অন্যায় এর পর্ব আসছে আগে । আমার ভালোর মূল্য পেয়েছি কত । কিছু যন্ত্রনা অবশেষ " । 

কিছুই বুঝতে পারলাম না । তবে কি প্রেম ঘটিত কিছু ! নাকি অন্য কোন ঘটনার দিকে তার ইঙ্গিত । শুভর জীবনে প্রেমের আঘাত নতুন কিছু নয় , কিন্তু সব সময় কি প্রেম তাকে আঘাত দিয়ে যাবে । আজ সন্ধ্যা নেমে আসায় সে বাড়ি ফিরে গেল । তবে কাল আসবে কথা দিয়েছে । গল্পটা বলাটা তার জন্য খুব জরুরি । আমিও অপেক্ষায় রইলাম । শুভকে জানাটাও তো কম জরুরি নয় !!! 

দ্বিতীয় দিন অপেক্ষা আর সইল না আমার । ঘড়িতে দশটা বাজতেই গাড়ি নিয়ে হানা দিলাম সোদপুর , শুভর বাড়িতে । আমাকে দেখে শুভর দুই প্রহরীর তো আনন্দের বাঁধ মানে না । ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম তো রীতিমতো চিৎকার শুরু করে দিল । অবশেষে শুভ নিজে এসে আমাকে এসকর্ট করে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল । সকালের জলখাবার তাও শুভর বাড়িতে -- এ যেন এক পরম প্রাপ্তি । লুচি আর আলুরদম খেয়ে দুজনে ছাদে গিয়ে বসলাম । শুভর হাতে একটা ঝোলানো ব্যাগ আর ব্যাগ থেকে সে এক এক করে কাগজগুলো বার করে চলেছে । কিছুক্ষন এভাবে চলার পর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ বললো , " গল্প অনেক শুনলি কাল থেকে । আজ আসল জায়গায় আসা যাক । একাউন্টেন্ট পদের জন্য আমি যেদিন ফর্ম ভরেছিলাম তার পাঁচ দিন পর আমি ইনসিউরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করি । তাই কোম্পানির নাম জানাই নি আমার এপ্লিকেশনে । স্বাভাবিক ভাবেই কোম্পানীকেও কিছু জানাই নি আমি এবং একদম গোপনে ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে যেতে থাকি । 

যেদিন কোম্পানি ছাড়ি সেদিন ব্যক্তিগত কারন দেখিয়েছিলাম ও আমার ম্যানেজার সেটি গ্রহণ করেছিল । আমি কোম্পানির এগ্রিমেন্ট এর টাকা ফেরত দেবো বলেছিলাম কারন কোম্পানির এগ্রিমেন্ট এ পরিষ্কার বলা ছিল --- এক বছরের গ্রস মাইনে ও ট্রেনিং ফি বাবদ পঁচিশ হাজার টাকা কোম্পানিকে ফেরত দিতে হবে যদি চার বছরের আগে আমি কোম্পানি ছেড়ে দিই । 

কোম্পানির রিজিওনাল অফিসে টাকার অংকের বিষয়ে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম । ওরা কিছু জানাতে পারেনি । এরপর এগ্রিমেন্ট কপি দেখে আমি নিজেই হিসাব করি আমাকে প্রায় ছয় লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে । যদিও এক বছরের মধ্যে কিছু ছেলে কোম্পানি ছেড়ে দিলে তাদের অনেক কম টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল । আর আমার বেলায় কোম্পানি নির্দেশ দেয় আমি যত দিন কাজ করেছিলাম তত দিনের গ্রস মাইনে ফেরত দিতে হবে আমায় । 

আমি ওর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রয়েছি । কিছু বলার ভাষা নেই আর । শুভর দু চোখ দিয়ে জল ঝরছে । কথা বলতে পারছে না , তবু বলে চলেছে শুভ ; 

" ১৯ মাস চাকরি করলাম নাকি বেগার খাটলাম । শালা এরা মানুষের বাচ্চা যে কর্মচারীদের খেতে পড়তে দিতে পারে না । কত বড় ভিখারি এরা যে এক হাতে টাকা দেয় , মাইনে দেয় আর অন্য হাতে সব নিয়ে নেয় । সাধারণ লোক আদালতে যেতে পারে না কারন তাদের প্রচুর টাকা নেই । নাহলে কবে জেল খাটতো হারামির বাচ্চাগুলো । " 

শুভকে কোন মতে থামালাম আজ । একদিকে সদ্য বাবা হারানোর যন্ত্রনা অন্যদিকে এভাবে শোষিত হওয়ার জ্বালা । বেশ বুঝতে পারছিলাম সেই সব যন্ত্রণাগুলোই মিলিয়ে মিশিয়ে সে লিখেছিল সেদিন নিজের শেষ প্রার্থনায় আর আজ আমি চেষ্টা করলাম সেটাই তুলে ধরতে নিজের লেখার পাতায় : 


"

Sir , humanity is the greatest thing in the earth and you had proved it repeatedly from time to time . Please consider and reply me soon that can an employee's salary be made zero only in the name of a bond ?

                                     "


Rate this content
Log in