Manasi Ganguli

Tragedy

4.7  

Manasi Ganguli

Tragedy

চিরকুট

চিরকুট

4 mins
827



  

  'অরুণকুমার সেবাসদনে'র চারপাশে আজ লোকে লোকারণ্য,প্রেস, ফটোগ্রাফার সব হাজির। বিভিন্ন খবরের কাগজে কাল বড় আর্টিকেল হবে,দারুণ কভারেজ। বাইরে জটলা,ভিতরে ব্যস্ততা,ডাক্তাররা হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ভিড় ক্রমে গাঢ় হচ্ছে।

   অজয় রায়,তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান অরুণকে নিয়ে বাস করতেন এই বাড়ীটায়,আজ যেটা হাসপাতাল,'অরুণকুমার সেবাসদন' নামে পরিচিত। সখ করে অজিতবাবু এত বড় বাড়ী করেছিলেন চাকুরীরত অবস্থায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে,ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে,নীচটা হবে ছেলের নার্সিংহোম আর ওপরটায় নিজেরা থাকবেন। বস্তুতঃ ছেলে অরুণ মেধাবী ছাত্র ছিল বলে এমন স্বপ্ন দেখার সাহস তাঁর হয়েছিল। নিজেও তার জন্য ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন কোচিনে ছোটাছুটি করতে কসুর করেননি আর তাই আজ তাঁর স্বপ্ন সফল। ছেলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স কোয়ালিফাই করে MBBS এ ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে অজিতবাবু বলে দিয়েছেন,"যতদূর তুই পড়তে চাস,আমি পড়াবো তোকে,বিলেত থেকে ডিগ্রী আনতে চাইলে তাও পাঠাবো,বড় ইচ্ছে আমার তুই অনেক বড় ডাক্তার হবি,অনেক নামডাক হবে তোর,একডাকে সবাই চিনবে ডাক্তার অরুণ রায়কে। আমার নিজের বড় সখ ছিল ডাক্তার হবার,সে সুযোগ আর পেলাম কই?" "কেন বাবা,সুযোগ পাওনি কেন?", অরুণ জানতে চায়। অজিতবাবুর উত্তর, "ডাক্তারিতে চান্স পেলাম,ভর্তি হবার আগেই বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে মা তখন অকূলপাথারে। আমিই বড়,তাই সেই ১৮ বছর বয়সেই সংসারের জোয়ালটা ঘাড়ে এসে পড়ল, পড়াশুনোয় ইস্তফা দিয়ে রোজগারের ধান্ধায় পথে নামতে হল"। অরুণ বাবার বেদনাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে," তোমার কথা শুনেই আমি বুঝতে পারছি,তার জন্য তোমার মনে কত আক্ষেপ জমা হয়ে রয়েছে। আমি ডাক্তারি পড়ব বাবা,তাতে যদি তোমার মনটা একটু হলেও আনন্দ পায়"। "সে তো পাবেই,তবু তোকে ডাক্তারি পড়তে আমি জোর করিনি কোনোদিনও,তুই নিজেই যখন পড়তে চাইলি খুব খুশি হয়েছিলাম রে আর তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম,তুই যতদূর এগোতে চাস,আমি তোর সঙ্গে থাকব"। অরুণ বলে," আমি পড়ব বাবা,তোমার সব আশা আমি পূর্ণ করব,তোমার কোনো দুঃখ রাখব না।" বরাবরের ভাল ছাত্র অরুণ প্রতি পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হয়ে,দারুণ রেজাল্ট করে MBBS কম্পলিট করে। MD তে admission নেওয়া হয়ে গেছে। সপ্তাখানেকের জন্য বাড়ী আসছে,থাকবে এই কটা দিন। কতদিন পর একটানা এতদিন ও বাবা-মায়ের কাছে থাকবে। আবার দুটো বছর পড়ার চাপ। ছেলে ক'টাদিন কাছে থাকবে,মায়ের কত আয়োজন,গুছিয়ে রাখছেন সব,ছেলেকে রান্না করে করে খাওয়াবেন। কত খেতে ভালবাসে,কিছুই তো খাওয়াতে পারেন না। বস্তুত,ছেলে হোস্টেলে চলে যাবার পর মা আর ভালমন্দ তেমন রান্না করতেন না নিজেদের দুজনের জন্য । এই কদিন উনি মনের সুখে রান্না করবেন,যা যা ছেলে ভালবাসে সব। মায়ের এত আশায় জল ঢেলে দিয়ে সে ছেলের আর বাড়ী আসা হল না,না আর কোনোদিনও না। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছিল বলে ছুটে এসে ট্রেন ধরতে গিয়ে হাত ফসকে একেবারে লাইনে,ট্রেনের নিচে,হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।

   একমাত্র সন্তান সমস্ত স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে এভাবে চলে যাওয়ায় বাবা পাথর,মা শয্যাগত। সময়ের সাথে সাথে আবার উঠে দাঁড়ালেন তাঁরা,খাওয়া,শোয়া চোখের জল ফেলা,সবই চলতে লাগল নিয়মমাফিক। খেতে হয় তাই খাওয়া,চলতে হয় তাই চলা।

    একদিন অজিতবাবু তাঁর স্ত্রী সরমাদেবীর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করেন বাড়ীটা দান করে দেবেন হাসপাতাল করার জন্য,তাঁরা তো ঠিক করেই ছিলেন নীচটা নার্সিংহোম হবে,তা ছেলেই যখন থাকল না,কি হবে তাঁদের আর এতবড় বাড়ী দিয়ে। সেইমত শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন অজিতবাবু,যাঁরা সেই হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা করবেন বিনা পারিশ্রমিকে আর অজিতবাবু পুরো বাড়ীটা আর তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় ৭০লক্ষ টাকা হাসপাতালের জন্য দিয়ে যেতে চান। তাঁর যা পেনশন,তাতে দুটো মানুষের চলে যাবে। সেইমত সব ব্যবস্থা হল। কেবল একটাই ওনার বক্তব্য হাসপাতালের নাম হবে তাঁর ছেলের নামে আর গেট দিয়ে ঢুকে সামনেই ছেলের একটি প্রস্তর মূর্তি থাকবে।

    এরপর উনি বাড়ী ছেড়ে দিয়ে কাছেই একটি বাড়ী ভাড়া নিলেন।বাড়ীটিকে হাসপাতালের উপযোগী করতে ২-৩ জন ডাক্তার উঠে পড়ে লাগলেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট দিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়ে চালু হল 'অরুণ কুমার সেবাসদন' দাতব্য চিকিৎসালয়। এদেশে গরীব মানুষের অভাব নেই। হাসপাতালে আস্তে আস্তে বেশ ভিড় হতে লাগল। বহু গরীবমানুষ উপকৃত হতে লাগল আর রোজ সন্ধ্যায় অজিতবাবু ও সরমাদেবী এসে ছেলের মুর্তিতে মালা পড়িয়ে ধূপ দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফিরে যান।

    শোকে দুঃখে বাড়ীঘর,টাকাপয়সা যা সম্বল ছিল সব তো দান করে দিলেন তাঁরা,এদিকে পেনশনের টাকায় বাড়ী ভাড়া দিয়ে তাঁদের যে সামলানো দায় হয়ে উঠল। দু'জনেরই বয়স হয়েছে,ওষুধের খরচ বেড়েছে,সরমাদেবী বাতের ব্যথায় কাজকর্ম বিশেষ করতে পারেন না,রান্না করার ক্ষমতা নেই অথচ রান্নার লোক রাখার সামর্থ নেই।বাজারদর বাড়তে লাগল,ক্রমে অবস্থা এমন হল,কাজের লোককেও ছাড়িয়ে দিতে হল। অজিতবাবু যথাসাধ্য সাহায্য করেন। এভাবে দুটো বছর কাটল,হাসপাতাল বেশ জমে উঠেছে,লোকের মুখে মুখে অজিতবাবুর নাম। কিন্তু ক্রমে বিষণ্ণতার মেঘে ছেয়ে যেতে লাগল তাঁদের আকাশ,প্রায়ই মনে হত এ কি বাঁচা! শুধু বাঁচার জন্য এত কষ্ট করে বাঁচা! কার জন্য এভাবে বাঁচা! অহরহ মৃত্যু কামনা করেন তাঁরা,কিন্তু চাইলেই কি তা হবে?এরপর একজন একা হয়ে গেলে অন্যজন কি নিয়ে বাঁচবে?সাতপাঁচ ভেবে দু'জনে স্থির করেন স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষা না করে স্বইচ্ছায় তাঁরা মৃত্যুবরণ করবেন। সেইমত গতরাতে তাঁরা পর্যাপ্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুলেন যা অজিতবাবু পরিকল্পনামাফিক একটু একটু করে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন আর মাথার কাছে একটা চিরকুটে লিখে গিয়েছিলেন 'ছেলের কাছে চললাম'।

      সকালে দুধওয়ালার চেঁচামেচিতে সবাই এসে ভিড় করে,দরজা ভেঙ্গে তাঁদের 'অরুণ কুমার সেবাসদনে' নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। তাই আজ হাসপাতালের ভেতর বাইরে লোকে লোকারণ্য,ভিড়ে ভিড়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy