চৌকি
চৌকি


প্রত্যাশা মতোই এ বছর বামপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে অসাধারণ রেজাল্ট করেছে অর্ক। অজ পাড়া গাঁয়ের যে এলাকায় রেশন দোকান সংখ্যাও ফার্স্ট ডিভিশনপ্রাপ্ত ছাত্রের সংখ্যাকে হার মানায় ; সেখান থেকেই জেলায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে পেশায় ছুতোর গোপালবাবুর একমাত্র সন্তান অর্ক । সব বিষয়ে লেটার মার্কস সমেত তার সর্বমোট প্রাপ্ত নম্বর ৯৫%। জেলা জুড়ে কেবলমাত্র কৃষ্ণনগর কলেজিয়েটের ফার্স্ট বয় সন্দীপ সেনের সামান্য পিছনে সে , ডিস্ট্রিক্ট টপারের স্কোরকার্ডে লেখা ৯৫.২% । কিন্তু এত কিছুর পরও বামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনে কাঁটার মতো বিঁধছে একটা প্রতিবন্ধকতা । দশম শ্রেণিই তাদের স্কুলে শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ । এরপর আর পঠনপাঠনের সুযোগ নেই সেখানে। তাই বাধ্য হয়েই অর্ক এবার কলকাতাগামী । ২১শে জুন চোখের জলে স্কুল থেকে বিদায়ী সম্বর্ধনা দেওয়া হল অর্ককে। পয়লা জুলাই বাবার হাত ধরে সে হাজির প্রেমের শহর কলকাতায়। কেবল ভালো স্কুলে পঠনের আশাতেই এই রাজধানী পাড়ি। পড়াশোনায় মনোযোগী অর্কের কাছে মেস বরবারই বড়ো অপছন্দের ; ওর মতে, পরিবেশ সেখানে বিদ্যার্জনের অন্তরায়। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা অর্ক তাই মেসে থাকতে নারাজ। স্বল্প উপার্জনকারী বাবা অবশ্য অনেক খুঁজে এক কামরার একটা ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে সমর্থ হলেন ওর জন্য। অর্কের সমস্যাও এতে দূর হল। আবাল্য লড়াই আর অর্ক যেন একে অপরের পরিপূরক । গ্রামের বাড়িতেও চুনখসা দেয়ালই ছিল ওর সাধনাক্ষেত্র ।
গোপালবাবু কলকাতাতেই থেকে গেলেন ওইদিন । বিকেলে ওরা বেরোবে একটা খাট আর টুকটাক কিছু জিনিসপত্র কিনতে । পরদিন ভোরে বামপুরের ট্রেন ধরবেন গোপালবাবু ।
সন্ধ্যায় গোপালবাবু আর অর্ক বেরিয়ে পড়ল রাস্তায় । জীবনে এই প্রথমবারের জন্য একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে থাকতে হবে কাল থেকে । ভাবতেই একটা অজানা দুঃখ মোচড় দিয়ে উঠল বুকের মাঝে । গোপালবাবু বেশ উদাসীন আজ। একটু এগোতেই বড় রাস্তার মোড়ে অর্ক দেখলো সারি বেঁধে খাটের দোকান । কিন্তু , সবগুলোই কেমন ন্যাড়া-ন্যাড়া । হয়তো দামেও কম হবে! কিনে তবে নেওয়াই যাক না , ক্ষতি কী ! ততক্ষণে গোপালবাবু বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছেন । " তবে কি বাবা ওগুলো খেয়াল করেনি ! " --- মনে মনে ভাবতে থাকে অর্ক । "বাবা , ও বাবা , আরে দাঁড়াও গো । এ দেখো , খাট । ও বাবা ……. " --- চেঁচিয়ে ওঠে অর্ক ।
---" ধুর বোকা ছেলে। ওগুলো তো মরা নিয়ে যাওয়ার খাট রে বুদ্ধু ।" -- অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া আনমনা গোপালবাবু , ছেলের হঠাৎ ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে খেয়ালই করেননি সামনে চলে আসা দশ চাকার লরির দিকে । রক্তের স্রোতে লাল হয়ে গেছে সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা কল্লোলিনীর রাস্তা ।খবর পেয়ে ওদিন রাতেই কলকাতায় উপস্থিতি হল গোপালবাবুর পরিজনেরা । বড় রাস্তার মোড়ের সেই দোকান থেকেই কেনা হল খাট, তবে অর্কের থাকার জন্য নয়, কেনা হল গোপালবাবুর শেষকৃত্যের জন্য ।