সারোণ্যা
সারোণ্যা


টেবিলের বাকি ফাইলগুলো ঝড়ের বেগে চেক করে আমরির উদ্দেশ্যে রওনা হল টাটার রিজিওনাল ম্যানেজার অরণ্য সিনহা। পিতৃত্বের এই স্মরণীয় মুহূর্ত থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করতে নারাজ। গত পাঁচ ছয় মাস এই ব্যাপারে একরকম উদাসীনতা দেখালেও আজ যেন উত্তেজনা ফারেনহাইটে ফুটছে । এই সময়টায় আন্তরিকভাবে সে চাইছে নিজের স্ত্রী আহেলির পাশে থাকতে।অরণ্য এবং আহেলির বিয়ের দেড় বছরের মাথায় শহরের প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ তপতী মিত্র আহেলিকে পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন যে, জরায়ুতে সমস্যা থাকার কারণে আহেলি সন্তানধারণে অক্ষম। জোর করে কিছু করতে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অদৃষ্টের লিখন মেনে নিয়ে দাম্পত্যের দশটা বসন্ত বেশ সুখেই কাটিয়ে দেয় নিঃসন্তান এই যুগলবন্দি।
কিন্তু ইদানীং আহেলি যেন খুব বেশি করে অনুভব করতে শুরু করেছিল একটা বাচ্চার অভাব, ধীরে ধীরে এই অভাব মোড় নেয় মানসিক অসুস্থতায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অরণ্য দত্তক নেওয়ার কথা বললেও আহেলি তাতে দুশো শতাংশ নারাজ। অন্য কারো সন্তানকে মাতৃস্নেহ দানে কিছুতেই সে নিজে স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারবে না, আর তাছাড়া মাতৃত্বের পাশাপাশি সে চায় নিজেদের জিনের উত্তরাধিকার.
দুধ সাদা বি.এম.ডব্লিউ. নিয়ে অরণ্য হাজির হয়েছে আমরির গেটে। প্রায় দু'ঘন্টা ধরে আহেলি অপেক্ষা করছে সেখানে। অরণ্য আসতেই তাকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে গেল সে। পড়ে অবাক হচ্ছেন, না ? ভাবছেন, সন্তানসম্ভবা আহেলির তো এখন ওটিতে থাকার কথা! তাহলে কোন মন্ত্রবলে সে উপস্থিত হল হাসপাতালের গেটে? আসলে, আহেলি অরণ্যের দত্তক নেওয়ার সেই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে ডাক্তারের সাথে কথা বললে, তিনি এক বিশেষ পরামর্শ দেন -- ধাত্রীমা বা স্যরোগেট মাদার। অর্থাৎ, আহেলির ডিম্বাণু এবং অরণ্যের শুক্রাণুর মিলনে টেস্টটিউবে উৎপন্ন জাইগোট প্রতিস্থাপন করা হবে অপর এক মহিলার জরায়ুতে, আহেলিদের জেনেটিক সন্তান আস্তে আস্তে বেড়ে উঠবে সেই মহিলার জঠোরেই এবং দশমাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে তুলে দেওয়া হবে সিনহাদম্পতির কোলে।
বিনিময়ে ওই মহিলা পাবেন এক বড়ো অঙ্কের পারিশ্রমিক। প্রথমদিকে বিপুল খরচের কথা ভেবে অরণ্য পিছিয়ে গেলেও শেষমেষ সে রাজি হতে বাধ্য হয় আহেলির জোরাজুরিতে। তবুও তার মন যেন কিছুতেই আহেলির এই সাহসিকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারছিল না। তাই পুরো প্রক্রিয়ার সমস্ত খরচ বহন করলেও আজ অবধি একবারও ধাত্রীমার মুখ দেখা তো দুরস্ত, নামটুকুও জিজ্ঞাসা করেনি সে। ডাক্তার তপতী মিত্রের সহায়তায় সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা করেছে আহেলি নিজেই। অরণ্য কেবল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দুই নম্বর কেবিনের গেটে পৌঁছনোর দশ মিনিটের মধ্যেই ওটি থেকে বেরিয়ে এলেন তপতী মিত্র। " কনগ্রাচুলেশনস অরণ্যবাবু। আপনি ঠিক পরীর মতো মিস্টি একটি ছোট্ট মেয়ের বাবা হয়েছেন। যান, আহেলিকে নিয়ে চটজলদি নিজেদের বেবিকে একবার দেখে আসুন প্লিজ।" --- হাসিমুখে বললেন লেডি ডাক্তার। দরজা খুলে কেবিনে ঢুকতেই অরণ্যের পায়ে কে যেন পড়িয়ে দিল এক অদৃশ্য বেড়ি। পায়ের নিচ থেকে ক্রমশ মাটি সরে যাচ্ছে তার।
"কি গো আহেলিদি! দাদা অমন গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? মেয়ে হওয়াতে অখুশি নাকি? " --- বিছানায় শুয়েই প্রশ্ন করে ধাত্রীমা সুতপা.
"বাদ দাও তো ওর কথা। গোমড়ামুখো, হাঁড়িচাচা। দা , মেয়েকে আমার কোলে দাও । " --- মুখ বেঁকায় আহেলি
"তা মেয়ের কি নাম রাখবে ঠিক করলে দিদি ?" -- প্রশ্ন করে সুতপা।
"সারোণ্যা!" আহেলি উত্তর দেবার আগেই শব্দটা বলপূর্বক দরজা খোলার মতো করেই দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে এল অরণ্যের মুখ দিয়ে। চোখ ভিজে গেছে সুতপার। অরণ্যের চশমার কাঁচেও বাষ্পের আভাস।
বছর কুড়ি আগে বি.টেক. পাস করে একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিল মেধাবি ছাত্র অরণ্য সিনহা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছিল না। একের পর এক কোম্পানির রিজেকশন ! তার সেই হতাশা জড়ানো ব্যর্থতার আঁধার দিনে আলোর একমুঠো জোনাকি ছিল প্রেমিকা সুতপা। প্রতিটি ব্যর্থতার পর বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল নিজের বেকার প্রেমিককে। অবশেষে একটি মাঝারি মানের বেসরকারি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ-এর ডাক এল অরণ্যের। চাকরিটা হয়েও গেল। অফিস জয়েনের দিন সাতেক পর, এক রাতে বসের বাড়িতে ফাইল জমা দিতে গিয়ে বিছানায় সে আবিস্কার করল অর্ধনগ্না সুতপাকে। এরপর হাজার চেষ্টা করেও সুতপা আর কোনোদিন যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি অরণ্যের সাথে। অরণ্য আজও জানে না --- তার ব্যর্থ, বেকার জীবনের প্রথম চাকরির মূলে ছিল সুতপার সতীত্বের বলিদান.
তবে প্রথম প্রেমের সেই বসন্তদিনগুলোতে অরণ্য সারা জীবন পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিল সুতপাকে। কথা দিয়েছিল তাদের মেয়ে হলে নাম রাখবে -- " সারোণ্যা। "