Chiranjit Saha

Thriller

1.0  

Chiranjit Saha

Thriller

প্রতিশোধ

প্রতিশোধ

15 mins
1.2K


 সাল ২০০৯,


বেজে গেল ভোটের দামামা । কাকদ্বীপ টু নবদ্বীপ , ধূলাগড় টু শক্তিগড় --- গোটা বাংলা নিজেকে মুড়ে ফেলেছে ভোট-উৎসবের চাদরে । প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন , ব্যানারে ছেয়ে গেছে সারা রাজ্য । উৎসবের মশালে এ যেন এক গনগনে আঁচ --- দেয়াল জুড়ে শুধুই স্লোগান , চায়ের কাপে উঠছে তুফান ; বিশেষজ্ঞ দিচ্ছে নিদান , ভোটার লিখুক নেতার বিধাবাংলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলের সংখ্যা প্রায় আটটি হলেও লড়াই এবার মূলত দ্বিমুখী । তাই প্রতিটি কেন্দ্রেই প্রগতি ও একতা দলের মধ্যে দেয়াল দখলের লড়াই চলছে সেয়ানে সেয়ানে । যুযুধান দুই দলের যুদ্ধে লালবাড়ি যেন হয়ে উঠেছে সমুদ্রমন্থনকালীন মন্দার পর্বত । শাসক প্রগতি দল আবারও গোটা রাজ্য জুড়ে তাদের প্রতীক মোমবাতিকে প্রজ্জ্বলিত করতে বদ্ধপরিকর । পিছিয়ে নেই একতাও --- " মোমবাতিতে আস্থা নেই আর , প্রতিশ্রুতিই হোক শপথ ; একতার এই কলম লিখুক সম্প্রীতির এক মহাভারত । " অর্থাৎ জনগণের সমস্ত ভোটকে নিজেদের প্রতীক কলম চিহ্নে আনতে অন্তহীন পরিশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন একতা কর্ভোটের আগুনে নিজেকে সেঁকতে ব্যস্ত শ্রীধাম নবদ্বীপও । নদীয়ার এই শহরে প্রগতির অশ্বমেধের অবাধ দৌড় চলছে আজ কুড়ি বছর ধরে । লোকসভা থেকে বিধানসভা --- জয়ের ব্যবধান আকাশচুম্বি না হলেও বিগত দুই দশকে এলাকায় একবারের জন্যও ম্লান হয়নি মোমবাতির আলো । চারবারের জয়ী বিধায়ক , অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নৃপেন সিংহ এবারও জয়ের ব্যাপারে অতিরিক্তিই আত্মবিশ্বাসী কিন্তু প্রচারে কোনোরকম আত্মতুষ্টিকে জায়গা দিতে তিনি নারাজ। নিজের গড় রক্ষার্থে প্রখর সূর্যের তোয়াক্কা না করেই ছুটে চলেছেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি । প্রগতির রাজ্যসম্পাদক পার্থপ্রতিমবাবুকে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসাতে আন্তরিকতার কোনো ত্রুটি রাখছেন না মফঃস্বল শহরের এইশাসকের ন্যায় বিরোধী দল একতাও এবার প্রস্তুত তাদের সর্বশক্তি নিয়ে । শীত শহরে এসে গেলে বসন্ত যেমন নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না , তেমনই শাসকের প্রচারধ্বনি সূচিত হলে বিরোধীরাও আর বদ্ধ থাকে না চার দেয়ালে । নদীয়া জেলার প্রখ্যাত কবি সৌমেন পাল এবার নবদ্বীপ বিধানসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন একতা দলের হয়ে । ' সাহিত্য আকাদেমি' পুরস্কারজয়ী কবি , দলীয় প্রতীককে কাজে লাগিয়ে আসন্ন নির্বাচনে মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী দাগ কাটতে দৃঢ়সংকল্প । তার বাগ্মিতা ও মনমুগ্ধকর বক্তৃতায় কাষ্ঠপুত্তলিকা হয়ে যাচ্ছে আঠারো থেকে আশি সকলেই । সব মিলিয়ে নবদ্বীপের ভোট উত্তাপ কলকাতার ফুটবল ডার্বিকেও হার মানাতে বাধ্য , মোমবাতি আর কলমের এই লড়াইয়ে শহরের মানুষও যেন পুরোপুরমিটিং-মিছিল-প্রচার-ফেস্টুন-ব্যানারের মাঝেই শহরে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা৥; রাজনৈতিক উত্তাপে কেটলির চায়ের পাতা অবধি ফুটে গেলেও ভোটকেন্দ্রিক রক্তপাত কোনোদিনই ছুঁতে পারেনি প্রেমের শহর নবদ্বীপকে । প্রগতির বরাবরের জেতা এই আসনে ছিল এক অকৃত্রিম সম্প্রীতির আবহ । কিন্তু গতকাল রাতে প্রগতির তেইশ নং ওয়ার্ডের পার্টি অফিসে হঠাৎই চড়াও হয় একতা কর্মীরা । অভিযোগ --- একতার নির্বাচনী মিছিল লক্ষ্য করে নাকি পাটকেল উড়ে এসেছে প্রগতির পার্টি অফিস থেকে। হালকা হাতাহাতি কয়েক মিনিটেই রণক্ষেত্রের রূপ নেয় , চলে গুলিও । গুলিবিদ্ধ শ্যামল শীলকে তৎক্ষণাৎ শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন । অবশেষে পুলিশ এসে মাঝরাতে গ্রেফতার করে দু'দলের মোট সতেরো জন সদস্যকে । পেশায় কৃষক শ্যামল এলাকায় প্রগতি দলের কর্মী হিসেবেই পরিচিত। গত পৌরনির্বাচনেও প্রগতির তেইশ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গৌর রায়ের পোলিং এজেন্ট ছিল মিতভাষী এই কৃষক । পরোপকারী, নির্বিবাদী , এলাকায় তুমুল জনপ্রিয় ছেলেটা দুই দলের ঝামেলা মেটাতে গিয়েই হয়তো বলি হল গুলিযুদ্ধের --- এমনটাই অনুভোরের আলো ফোটার আগেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত নৃপেন সিংহ ও সৌমেন পাল --- পালা করে চলল দোষারোপ আর পাল্টা দোষারোপ। আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে যেন মগ্ন দুজনেই । উত্তেজনার পারদ তাতে কয়েক সেমি চড়লেও শেষমেষ এলাকায় মোতায়েন বিশাল পুলিশবাহিনীর তৎপরতায় অবশ্যম্ভাবী অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভবপর হয় ইতিমধ্যেই শ্যামলের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে প্রগতির তেইশ নম্বর ওয়ার্ডের পার্টি অফিসে । দলের একনিষ্ঠ কর্মীর নিথর দেহের ওপর ক্রমেই ভারী হচ্ছে শেষ শ্রদ্ধার স্মারকসমূহ । পার্টিঅফিসে রীতিমতো জনপ্লাবন , তিলধারণের জায়গাটুকুও নেই । প্রগতি কর্মীদের অশ্রুস্রোত ভরা বর্ষার ভাগীরথীকেও হার মানাতে বাধ্য । ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে দেখা গেল শ্যামলের বছর দশ-এর ছেলে বিদেশকে । এক বছর আগে অজানা জ্বরে মাকে হারানোর পর গতরাতে বাবা ! যমরাজ যেন ক্রোধ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এই একরত্তি ছেলেটাকেই বেছে নিচ্ছেন বারংবার । বিদেশের চোখের মণিতে আজ পাথরসুলভ স্থিরতা , দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শূন্যতা , নিদারুণ মৌন অভিব্যক্তি এবং প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট চরম ক্লান্তিজর্জর উদাসীনতা । তার প্রবেশের সাথেসাথেই সমবেত জনতার কান্নার রোল উন্নীত হল আরও উচ্চগ্রামে । বাপ-মা মরা ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যেক প্রগতি কর্মীর হৃদয়ে উঁকি দিচ্ছে আশঙ্কার কালো মেঘ ।অবশেষে প্রগতির পতাকায় মোড়া শ্যামলের মৃতদেহ এসে পৌঁছলো নবদ্বীপ শ্মশানে , পিছনে শোকাতুর শহরবাসীর মহামিছিল । মুখাগ্নি করল বিদেশ । আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। চিতার গনগনে আগুন পেরিয়ে শ্যামলকে এখন পাড়ি জমাতে হবে চিরশান্তির দেশে , তাই হয়তো দীর্ঘ যাত্রাপথের রুকস্যাকে ভগবান ভরে দিলেন এক পশলা বৃষ্টির স্বস্তি । ক্রমে ফাঁকা হয়ে এল শ্মশান । পড়ে রইল শ্যামলের চিতাভস্ম আর বিদেশ সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র বিদেশ । বছর বারো আগে বৌ-ছেলেকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে নবদ্বীপে আসে শ্যামল । এখানে ওর না ছিল জমিজমা , না দোকানপাট -- লোকের জমিতে চাষ করেই দিন গুজরান হত এই ভাগচাষির । অর্থের অভাবে বৌ-টাও একরকম বিনা চিকিৎসায় দেহ রাখল গত বছর । এহেন শ্যামল বছর তিনেক আগে যোগ দেয় প্রগতি দলে , তারপর থেকে দলের প্রতিটি মিটিং মিছিলে ঝান্ডা হাতে , লুঙ্গি পরা শ্যামলের উপস্থিতি ছিল সূর্যোদয়ের মতোই সত্য ।সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই শ্যামলের কুঁড়েঘরে হাজির নৃপেনবাবু ,সাথে প্রগতির জেলাস্তরীয় নেতৃবৃন্দ । সকলের সামনে বিধায়ক মহাশয় ঘোষণা করলেন --- " দলের একনিষ্ঠ কর্মী শ্যামলের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকপ্রকাশ করছি । শান্ত নবদ্বীপকে অশান্ত করার যে চক্রান্ত একতা করছে , তারই বলি হল আমাদের এই ন্যায়পরায়ণ সদস্য । ওর দশ বছরের ছেলেটাকে অনাথ করে দিতে একবারও হাত কাঁপলো না নীতিহীন একতা কর্মীদের । ওনাদের কবি-প্রার্থী হয়তো এখন কল্পনার ককটেল বুনে কবিতা লেখায় মগ্ন । কিন্তু প্রগতি সুখে-দুঃখে , বিপদে-আপদে সর্বদায় থেকেছে শহরবাসীর পাশে, এক্ষেত্রেও তার কোনোরূপ অন্যথা হবে না । বিদেশকে আজই আমি নিয়ে যাব আমার সাথে , আমার বাড়িতে । আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবেই বেড়ে উঠবে ও । " সমবেত জনতার হাততালির রোলে শ্যামলের পলকা ঘর তখন রীতিমতো কম্পমান । বিকেলেই নৃপেনবাবুর হাত ধরে বিদেশ এসে উঠলো তার সুবিশাল বাড়িতে । প্রগতি বিধায়কের এহেন দরদি পদক্ষেপের কোনো প্রত্যুত্তর একতার কাছে ছিল না । ভোটে বিপুল ভরাডুবি হল সৌমেন পাল ও শুধু নবদ্বীপ নয় , গোটা রাজ্য জুড়েই প্রগতি-ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল একতা । মুখ্যমন্ত্রীর মসনদ আবারও একবার আলোকিত করলেন পার্থপ্রতিমবাবু । তার অত্যন্ত আস্থাভাজন নৃপেনবাবুও শপথগ্রহণের মুহূর্তে সুদূর নবদ্বীপ থেকে হাজির হলেন কলকাতায় এদিকে বিদেশকে পেয়ে নৃপেনবাবুর স্ত্রী অঞ্জলিদেবী তো বেজায় খুশি । পার্টির কাজে অধিকাংশ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকেন বিধায়ক-স্বামী ;ছেলে রাতুলও আজ প্রায় ছয় বছর ধরে ডাক্তারি পড়তে ব্যস্ত লন্ডনে । বাড়িতে ঝি-চাকরের অভাব নেই বটে , কিন্তু অঞ্জলিদেবীর অভাব রয়েছে মানসিক স্বস্তির । সারাদিনে মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার একটা মানুষ অবধি বাড়িতে পান না তিনি, একাকীত্ব গ্রাস করতে শুরু করেছিল তাকে; মনোরোগ বিশেষজ্ঞও সঠিক পথনির্ধারণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ । ঠিক সেই সময়ে বিদেশের আগমন যেন সাহারায় শীতলস্রোত , বিদেশের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন ছেলেবেলার রাতুলকে । অঞ্জলিদেবীর নির্দেশেই বিদেশকে ভর্তি করা হল শহরের সেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে । গাড়িতেই এখন যাতায়াত তার । এক অকৃত্রিম অপত্যস্নেহে নিজের হাতে টিফিন বানিয়ে অঞ্জলিদেবী যত্নে রোজ ভরে দেন বিদেশের স্কুলব্যাগে । সন্ধ্যে হলে বিদেশকে পড়াতেও বসেন । শ্যামলের দশ বছরের ছেলেকে ঘিরেই এখন আবর্তিত বিধায়ক-পত্নীর পৃথিবী । তবে অঞ্জলিদেবীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পড়াশোনাটাকে যেন কিছুতেই আয়ত্ত করে উঠতে পারছে না বিদেশ । তবে হাল ছাড়ার পাত্রী নন তিনিও । মূলত তার পড়ানোর ওপর ভর করেই বাংলা মিডিয়াম থেকে এসেও পরপর দুবারই ফাইনাল পরীক্ষায় উতরে গেল বিদেশ । মার্কস হয়তো তেমন আহামরি নয় , কিন্তু অঞ্জলিদেবীর মাতৃস্নেহ, যত্ন ও তত্ত্বাবধান ছাড়া অমন নিম্ন মেধার ছাত্রের পক্ষে পাশ করাও ছিল অসম্ভব । বিদেশের প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে অঞ্জলিদেবীর নিজেরও বিন্দুমাত্র আফসোস নেই । নিজের ছেলে রাতুলকেও একইভাবে পড়াতেন তিনি ; প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্টও হত । আনন্দে তখন আত্মহারা রত্নগর্ভা মাতৃহৃদয় । এরপর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ থেকে গোল্ড মেডেল নিয়ে এম বি বি এস ডিগ্রি অর্জন করল রাতুল । কলকাতায় পড়তে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের প্রতি ক্রমশ কমে আসছিল ছেলের টান , কিন্তু এই মানসিক দূরত্বই অলোকবর্ষে রূপান্তরিত হল এম বি বি এস শেষ করে লন্ডনে পড়তে যাওয়ার পর । শেষ আট বছরে সে বাড়ি এসেছে মাত্র একবার , ফোনও করে কালেভদ্রে । অঞ্জলিদেবীর একাকীত্বজনিত অসুস্থতার প্রাথমিক ধাপে নৃপেনবাবু ছেলেকে ফোন করে দেশে ফেরার অনুরোধ জানালেও সে পড়াশোনার অজুহাতে তা প্রত্যাখ্যান করে বারংবার এবং মাকে বড়ো ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেয় । রাতুলের ফিরতে এখনও বছর দুই বাকি । অর্থাৎ শেষ আট বছরে মাত্র একবার নিজের কৃতি পুত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া অঞ্জলিদেবী বাস্তবিক যেন নিঃসন্তান । ছেলে আছে বটে , কিন্তু জীবনের ইঁদুরদৌড়েইদানীং নৃপেনবাবুর সঙ্গেও একটা উচ্ছ্বল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিদেশের । পড়াশোনায় দুর্বল হলেও ক্রিকেট ব্যাটটাকে অনায়াসেই তুলিতে রূপান্তরিত করে বছর বারোর ছেলেটা । সবুজ গালিচায় এঁকে ফেলে একের পর এক নিখুঁত কভার ড্রাইভ । বিকেলের দিকে একটু ফাঁকা সময় পেলেই নৃপেনবাবুও ব্যাট-বল নিয়ে মজে যান বিদেশের সাথে । আই পি এল থেকে ব্রিটিশ কাউন্টি --- ডাইনিং টেবিলে রোজ রাতেই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নবদ্বীপের প্রবাদপ্রতিম বিধায়ক ও বিদেশ । গত দু'বছরে বিদেশ যেন হয়ে উঠেছে সিংহ পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অঙকিন্তু এই মায়ার বাঁধন স্থায়ী হল না বেশিদিন । ক্লাস সেভেনে ওঠার দিন সাতেকের মাথায় হঠাৎই একদিন নৃপেনবাবুর সাথে খেলতে খেলতে বাগানে জ্ঞান হারায় বিদেশ । উদভ্রান্ত নৃপেনবাবু তৎক্ষণাৎ ফোন করেন প্রগতির দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা চিকিৎসক উৎপল সেনকে । ততক্ষণে বাড়ির কাজের ছেলে ভোলা ওকে নিয়ে গিয়ে শুইয়েছে নৃপেনবাবুর বেডরুমে । বিদেশের মাথা অপরাজিতা দেবীর কোলে , অঝোরে কাঁদছেন তিনিজে ড্রাইভ করেই তড়িঘড়ি নৃপেনবাবুর বাড়িতে হাজির হন উৎপল ডাক্তার । ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে বিদেশের বুকে ঠেকাতেই তিনি বুঝে যান , বিদেশ আর নেই । ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে তিনি বলেন --- " নৃপেনদা ,আমি আসার প্রায় আধঘন্টা আগেই দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ছেলেটার" কী বলছিস কী তুই ! যেখানে আমার যাওয়ার কথা ….সেখানে বিদেশ ? আমিই হাঁপালাম না আর ওর দম আটকে যাবে ? ইয়ার্কি করছিস তুই ? দেখ ভালো করে ! " --- বিধ্বস্ত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন নৃপেনবাবু ---- " দেখো , এই ব্যাপারটা শুধু বয়সের ওপর নির্ভর করে না । অনেক সময় ফুসফুসের কোনো শিরা বা উপশিরায় জন্মগত ব্লকেজও এই ধরনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় । আমাকে ক্ষমা করো নৃপেনদা । আমি আসার আগেই সব শেষ হয়ে গেছে । " --- দীর্ঘশ্বাসে ঘর ছাড়েন ডাক্তার উৎপল সেপৌরসভার শববাহী গাড়ি বিদেশকে নিয়ে পৌঁছল শ্মশানে । সামনে নৃপেনবাবু আর সাথে গুটিকয়েক প্রতিবেশী ও পার্টিকর্মী । সকলের মুখেই কালবৈশাখীর গুমোটতা । মুখাগ্নি করলেন নৃপেনবাবু নিজেই । এই প্রথম নৃপেনবাবুর চোখে জল দেখলেন প্রগতিকর্মীরা । দাহকার্য শেষ করে বাড়ি ফিরতে রাত দশটা হয়ে গেল । নৃপেনবাবুর পায়ে কে যেন এক অদৃশ্য বেড়ি পড়িয়ে দিযবাড়িতে অপরাজিতাদেবীও পরিণত হয়েছেন এক কাষ্ঠমূর্তিতে । আজ টানা তিনদিন তিনি পুরোপুরি নীরব , খাবার তো দূরের কথা , স্পর্শ করেননি জলও; বিছানাই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র অবলম্বন । এলাকার বিশিষ্ট মন চিকিৎসক রমেন সান্যালকে তাই ডেকে পাঠিয়েছেন নৃপেনবাবু । নৃপেনবাবু নিজেও এবার ভেঙে পড়েছেন প্রচন্ড । রাতুল বাইরে পড়তে যাওয়ার পর থেকে শিক্ষকতা ও রাজনীতি নিয়েই মেতেছিলেন তিনি । অবসরের পর প্রগতিই হয়ে ওঠে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান । পরোপকারে মগ্ন নৃপেনবাবু নিজের অসুস্থ স্ত্রী , সংসার নিয়েছিলেন যারপরনাই উদাসীন । কিন্তু বিদেশ আসার পর থেকেই বদলাতে থাকে পরিস্থিতি । কলকাতার স্বনামধন্য মনোরোগ বিষেশজ্ঞরাও যেখানে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন , সেখানে বিদেশের উপস্থিতিই আবারও সুস্থ করে তোলে হতাশাদীর্ণ অঞ্জলিদেবীকে । বাড়িতে ছোট্ট ছেলেটার আগমন , পত্নীর আরোগ্যলাভ --- সবমিলিয়ে বেশ প্রাঞ্জল হয়ে উঠছিলেন নৃপেনবাবু । দলীয় কাজের ফাঁকে অবসর বের করে আজকাল পরিবারকেও সময় দিতেন তিনি । কিন্তু বিদেশের আকস্মিক মৃত্যু বাহাত্তর ঘণ্টায় গোটা পরিস্থিতিটাকেই পুরো বদলে দিয়েছে , আবারও ছন্নছাড়া দেখতে দেখতে কেটে গেল ছয়মাস । অঞ্জলিদেবী এখনও শয্যাশায়ী । স্নান করানো থেকে খাওয়ানো সবেতেই ভরসা আয়ামাসি রানি । রাত-দিন , সুবিধা-অসুবিধা ভুলে মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া বিধায়ক নৃপেনবাবুও একরকম গৃহবন্দি এখন । পার্টির দু-একটা মিটিং মিছিল ছাড়া তাকে আর সেরকম বাইরে বেরোতে দেখা যায় না , নিয়মিত জনসংযোগে নিজেকে ব্যস্ত রাখা সেই সদাহাস্য মানুষটাই আজ স্বেচ্ছায় জনবিচ্ছিন্ন। মুখের চিরাচরিত উজ্জ্বল হাসিটাও কোথায় বিলীন হয়ে গেছে । একটা মৃত্যু যেন ফণির মতো তছনছ করে দিয়ে চলে গেছে গোটা পরিবিগত এক বছরে স্বর্গ থেকে যমপুরীতে পরিণত হওয়া সিংহভিলার বেজে ওঠা টেলিফোনে হঠাৎই এল এক বহুকাঙ্ক্ষিত সুখবর । নির্ধারিত সময়ের একবছর আগেই পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরছে রাতুল । আহ্লাদিত নৃপেনবাবু ফোন রেখেই ছুটলেন অঞ্জলিদেবীর ঘরে , হাসতে হাসতে জানালেন ছেলের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ । বিদেশের মৃত্যুর পর সেই যে মুখ বুঝেছেন অঞ্জলিদেবী , তারপর থেকে আর একটি শব্দও শোনা যায়নি তার মুখে । আজও তার অন্যথা হল না । তীব্র মানসিক আঘাত হয়তো ছিনিয়ে নিয়েছে তার বাকশক্তি --- এমনটাই অনুমান ডাক্তারদেরদমদম বিমানবন্দর হয়ে নবদ্বীপে ফিরলেন ডাক্তার রাতুল সিংহ । ছেলের প্রত্যাবর্তনে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন নৃপেনবাবু । শেষ এক বছরের স্থবিরতা ভেঙে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লেন দলের কাজে । নিজেদের প্রাণচঞ্চল , কর্মপ্রাণ বিধায়ককে স্বমহিমায় ফিরে পেয়ে নবদ্বীপবাসীও বেজায় খুশি । বিলেত ফেরত ডাক্তারপুত্রের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাকশক্তি ফিরে পেলেন রত্নগর্ভা অঞ্জলিদেবী । ফিরে পেলেন তার পুরোনো জোশ --- ঠিক যেমনটা তিনি পেয়েছিলেন বিদেশ আসার পর । সব মিলিয়ে সিংহভিলায় আবারও ফিরে এল দীপাবলীর রোশদেশে ফেরার সাথেসাথেই জেলার স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম চুক্তি সেরে ফেলল রাতুলের সাথে । চিকিৎসাব্যবস্থায় পিছনের সারিতে থাকা এই জেলার নার্সিংহোমগুলোর কাছে রাতুল যেন পরশপাথর । তবে বাবার একান্ত অনুরোধে সপ্তাহের দুটো দিন সে রাখল এলাকার গরিব মানুষজনের চিকিৎসাব্রতে । জনদরদি বিধায়কের যোগ্য পুত্রের গুণগান সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মুখে মুখে     

                " রোগব্যধিতে নেইকো ভয় ,                  রাতুল দাদাই করবে জয় । "


বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে বিয়ের টোপর পরে ফেলতে বাধ্য হল বিধায়ক-পুত্র । কৃষ্ণনগর নিবাসী প্রখ্যাত স্বর্ণব্যবসায়ী দিলীপ মিত্রের একমাত্র কন্যা ,অধ্যাপিকা স্বাতী সেনের সাথে এক পুণ্যলগ্নে সাত পাকে বাঁধা পড়ল সে । দেখতে দেখতে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনও এল ঘনিয়ে । নৃপেনবাবুর নিজস্ব জনপ্রিয়তা তো ছিলই , তার ওপর ছেলে রাতুলের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রদান --- সব মিলিয়ে বিরোধীদের মনোবল এবার রীতিমতো তলানিতে । নির্বাচনী প্রচারে তেমন কাঠখড় না পুড়িয়েই , অনায়াসে আগের বারের তুলনায় বেশি মার্জিনে জয়ী হলেন বিদায়ী বিধায়ক ন            



ছয়বারের বিজয়ী বিধায়ক স্বামী , চিকিৎসক পুত্র এবং অধ্যাপিকা পুত্রবধূকে নিয়ে অঞ্জলিদেবী গড়ে তুলেছেন এক সোনার সংসার । বছর দেড়েক আগে হাসতে ভুলে-যাওয়া এই মানুষটার মুখেই আজ যেন বাঁধ না মানা ফাগুনী পূর্ণিমার আলো । সেই হাসির দীপ্তিকে আরও উজ্জ্বল করতে সোনার সংসারমাঝে স্থাপিত হল প্লাটিনাম --- নৃপেনবাবুর নির্বাচনে জয়লাভের এক বছরের মধ্যেই রাতুল ও স্বাতীর কোল আলো করে এল তার একমাত্র নাতি । সুখবর যেন আজকাল সিংহভিলার পিছু ছাড়তেই নারাক্যালেন্ডারের পাতার ওলটপালট আর পৃথিবীর বার্ষিক গতির সাথে পাল্লা দিয়ে পেরিয়ে গেল প্রায় চারটে বছর । নদীয়া ছাড়িয়ে রাতুলের সুখ্যাতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে সুদূর কলকাতায় । ও.টি. করতে প্রায়ই উডল্যান্ড বা আমরি ছুটতে হচ্ছে এই বিলেতফেরত নিউরোসার্জেনকে । রাতুলের ছেলে অনমিত্রও গতকাল পা দিল চারে । দাদুর হাত ধরেই সে এখন স্কুলে যায় রোজ । বিকেলে বাগানে একসাথে ক্রিকেটও খেলে দু'জন । ইতিমধ্যেই নৃপেনবাবু অনমিত্রকে একটি ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছেন ; মধ্য সত্তরে দাঁড়িয়েও নিজে স্কুটার চালিয়ে নাতিকে পৌঁছে দেন সেখানে । নাতির আবদার আর খুনসুটিতে বিধায়ক মশায় যেন খুঁজে পান রাতুলের অনমিত্রকে বহির্জগতের সঙ্গে পরিচিত করার দায়িত্ব যেমন নৃপেনবাবু তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে , তেমনি বাড়িতেও আছে তার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী , আদরের চাদরে মুড়ে রাখা অতি প্রিয় ঠাম্মি , অঞ্জলিদেবী । তাদের আন্তরিক স্নেহ-যত্নের কারণেই বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততাজনিত সময়াভাব আজও ছুঁতে পারেনি অনমিত্রকে । দাদু-ঠাম্মির অকৃত্রিম ভালোবাসায় বেড়ে উঠছে সে ; রাতুল আর স্বাতীও নিজেদের কেরিয়ারে জুড়ে চলেছে একের পর এক নতু২০১৯ এর বিধানসভা নির্বাচন কড়া নাড়ছে শিয়োরে । বয়সজনিত কারণে এবারই শেষবারের মতো প্রগতির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছেন টানা ছয় বারের বিজয়ী বিধায়ক নৃপেন সিংহ । ভোটের দিন ঘোষণা হতে তখনও দিন দুই বাকি । অন্যান্য দিনের মতোই বিকেলে নাতি অনমিত্রের সাথে বাড়ির বাগানে ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত বিধায়কবাবু । তবে অনমিত্র আজ বেশ চুপচাপ । দশটি কথার উত্তরে ব্যয় করছে বড় জোর দু-একটি শব্দ । স্কুলে কিছু ঘটেছে কিনা জিজ্ঞাসা করেও তেমন কোনো সাড়া পেলেন না নৃপেনবাবু । অগত্যা খেলাতেই মনোনিবেশ করলেন তিনি । কিন্তু নাতিকে বল করতে যেতেই হঠাৎ সে উইসেন বোল্টের গতিতে ব্যাট হাতে ছুটে এল দাদুর দিকে, নৃপেনবাবুর মাথায় বারংবার আঘাত করল সজোরে --- গায়ে যেন এক পৈশাচিক শক্তি । কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রবল আর্তনাদ করে বিধায়ক মশায় লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে । আর্তনাদ শুনে তৎক্ষণাৎ অন্দরমহল থেকে বাগানে ছুটে এসেছেন অঞ্জলিদেবী , কিন্তু নাতির নিক্ষিপ্ত ব্যাটের আঘাতে প্রাণ চিতাসুলভ ক্ষিপ্রতায় বাড়ির কাজের লোকদের সব প্রয়াস ব্যর্থ করে মেইন গেট টপকে অনমিত্র চলে গেল রাস্তায় । বুলেট বেগে প্রবেশ করল প্রগতির নবদ্বীপ শহরের মূল অফিসে । সন্ধ্যে তখন নামছে সবে । রোজকার মতোই পার্টি অফিসে কর্মী-সমর্থকদের ঠাসা ভিড় । নৃপেনবাবুর নাতি হওয়ার সুবাদে অনমিত্র পার্টির সকলের কাছেই বেশ সুপরিচিত । কিন্তু চার বছরের বাচ্চার এমন রক্তবর্ণ আঁখি ,দানবীয় অস্থিরতা ও মুখে ছিটকে আসা তাজা রক্ত দেখে স্তম্ভিত উপস্থিত সকলেই । তাদের হৃদস্পন্দন পুরোপুরি স্তব্ধ করে গমগমে স্বরে বলতে শুরু করল অনমিত্র --- “ ঘটনাটা আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগের । তারিখটাও আজকের মতোই একুশে মার্চ । সেবারও দরজায় কড়া নাড়ছে বিধানসভা নির্বাচন । একাধিক দুর্নীতিতে নাম জড়ানোর কারণে বিদায়ী বিধায়ক নৃপেন সিংহকে টিকিট দিতে নারাজ প্রগতির একাংশ । বদলে তাদের পছন্দ দলেরই তেইশ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর , নবদ্বীপ কলেজের অধ্যাপক গৌর রায় । পড়াশোনা ও গবেষণায় ব্যস্ত থাকা গৌরবাবুর জনসংযোগ দুর্বল হলেও তার সততা ও ভাবমূর্তির স্বচ্ছতা ছিল প্রশ্নাতীত । আর জনসংযোগের ঘাটতিটুকুও ক্রমশ মিটতে শুরু করেছিল তার ছায়াসঙ্গী, পোলিং এজেন্ট , পেশায় ভাগচাষি শ্যামলের সৌজন্যে । শেষমেষ হাইকম্যান্ডের আশীর্বাদে মনোনয়ন পেয়ে গেলেও দলে যে তার দিন ক্রমে ঘনিয়ে আসছে --- তা অনুভব করতে পারছিলেন নৃপেনবাবু নিজেই । তাছাড়া গৌর-শ্যামল যুগলবন্দিই ভবিষ্যতে পার্টির মুখ হয়ে উঠতে চলেছে শহরে,সেই দেয়াল লিখনও হয়ে উঠছিল প্রথম সূর্যের আলোর মতোই স্পষ্ট । অর্থাৎ সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও পতনের সুনিশ্চিত বার্তা আন্দোলিত করছিল নৃপেনবাবুর অবচেতন মনকে । দক্ষ রাজনীতিক তাই চেলে ফেললেন মোক্ষম চাল । ঠিক তেইশ নম্বর ওয়ার্ডেই একতার নির্বাচনী মিছিলে গন্ডগোল পাকানোর দায়িত্ব দিলেন ছত্তিশগড় থেকে ভাড়া করে আনা সুপারি কিলারের ওপর । পরিকল্পনা সফল হলেও পেল না পরিপূর্ণতা । ভিড়ের মাঝে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল সুপারিকিলারের গুলি , গৌরবাবুর বদলে তা বিঁধে গেল শ্যামলের বুকে । কিন্তু ঠান্ডা মাথার পাকা খিলড়ি নৃপেনবাবু এই মিসহিটকেই রূপান্তরিত করলেন পারফেক্ট শটে । শ্যামলের ছেলে বিদেশের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে জিতে নিলেন নবদ্বীপবাসীর মন । সাহিত্যপ্রেমী অধ্যাপক গৌর রায় কোনোদিনই সুদক্ষ রাজনৈতিক নেতা হতে চাননি , জনকল্যাণই ছিল তার একমাত্র ব্রত । নিজের আত্মার আত্মীয় শ্যামলের মৃত্যু বিধ্বস্ত অধ্যাপককে ঠেলে দিল রাজনৈতিক সন্ন্যাসের দিকে । ওদিকে নৃপেনবাবুর বাড়িতে রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় বড়ো হতে থাকল বিদেশ । কিন্তু এরই মাঝে ঘটে গেল এক অবাঞ্ছিত ঘটনা । একদিন বিকেলে বিদেশের সাথে খেলার মাঝেই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসে নৃপেনবাবুর ল্যান্ডলাইনে , অন্দরমহলে ছুটে যান তিনি । ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে অধৈর্য্য বিদেশ ডাকতে যায় তাকে এবং শুনে ফেলে ফোনের গোপন কথোপকথন । তার বাবা শ্যামলের হত্যাকারী যে নৃপেনবাবুই --- ফোনের কথাবার্তা শোনার পর তা আর বুঝতে বাকি থাকে না বছর বারোর ছেলেটার । উত্তেজিত বিদেশ তৎক্ষণাৎ নৃপেনবাবুকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে এবং মাতৃরূপী অঞ্জলিদেবীকে সব জানানোর জন্য দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে । নৃপেনবাবু তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলতে সক্ষম হয় এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করে । হাতুড়ে ডাক্তার উৎপল সেনের অধীত বিদ্যা এই খুনকে ধরার জন্য যথোপযুক্ত ছিল না , ফলস্বরূপ ডেথ সার্টিফিকেটে খুনটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবেই লেখেন তিনি । পার পেয়ে যান খুনি বিধায়ক । আমিই হলাম সেদিনের সেই অসহায় মৃত বালক বিদেশ । তখন থেকেই আমার অতৃপ্ত আত্মা মত্ত প্রতিশোধের নেশায় । অবশেষে রাতুল বাবুর বিবাহের পর মিলে গেল সেই বহুপ্রতীক্ষিত সোনার সুযোগ , প্রবেশ করলাম স্বাতীদেবীর গর্ভস্থ ভ্রূণে । তারপর গোটা সিংহপরিবারকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে হঠাৎ কেড়ে নিলাম সব । আজ আমি তৃপ্ত । একটু পরেই আসতে চলেছে আরেকটি মৃত্যুসংবাদ । আমার বাবার খুনের বদলা নিতে পেরেছি আমি । আজ আমি ধন্য । " --- বলেই পার্টি অফিসের দোতলার বারান্দা থেক নিউজ চ্যানেলে দৃশ্যায়মান --- " কৃষ্ণনগর যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত প্রখ্যাত ডাক্তার তথা নবদ্বীপের বিধায়ক-পুত্র রাতুল সিংহ । " সকালবেলা বাড়ির গ্যারেজে সুনিপুণভাবে রাতুলের গাড়ির ব্রেক কেটে রাখার কৃতিত্বটাও আদতে অনমিত্ররূপী বিদেশেরই । বাইরে প্রবল বৃষ্টি নেমেছে, ঠিক যেমনটা নেমেছিল দশ বছর আগে শ্যামলের মৃত্যুর দিনদেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর । একসময়ের রাজপ্রাসাদ এখন পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে বাড়িতে । দূর থেকে ভেসে আসছে গান

       " রাজার মুকুট রাজার সাজ , অন্য কেউ তা পরবে আজ ; এক পুরোনো মসজিদে , গান ধরেছে মুরশিদে । "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller