Chiranjit Saha

Tragedy

4.0  

Chiranjit Saha

Tragedy

সেটাই সত্যি

সেটাই সত্যি

14 mins
1.3K


" শালা, বেশ্যাটা এবারও হায়েস্ট পেয়ে গেল।" "শুধু কি হায়েস্ট? দুটো সেমেই ৮৫%। যাই বলিস রণিত, মালটা কিন্তু জিনিয়াস। তোকে পুরো হোয়াইট হাউস করে ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে ।" হাসতে থাকে শুভ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল রণিত -- "শুভ, কথাটা হোয়াইট হাউস নয়, হোয়াইট ওয়াশ। স্কটিশের মতো কলেজে নিউটন, আইনস্টাইন তুল্য মেধাদের ধূলিসাৎ করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গোল্ড মেডেলটা আমি নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি, কোনো কুত্তার বাচ্চা এসে দিয়ে যায়নি। রণিত রায় ইজ আ ট্রু চ্যাম্প। আমি কখনো হারিনি, হারবো না। নেভার। ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। পরের দুটো সেম এখনও বাকি। বাদশা এস আর কে-এর ভাষায়, ছবি এখনও অসমাপ্ত বন্ধু। সো জাস্ট এনজয় দ্য শো, এনজয় দ্য কামব্যাক অফ..." ক্ষণিকের স্তব্ধতা ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টদের আড্ডায়। সবাই ওরা থার্ড সেম, বোটানি মাস্টার্স। রণিতের বন্ধুরা আগে কখনও ওকে এতটা উত্তেজিত হতে দেখেনি। রণিত রায়, কলকাতার বিখ্যাত 'ব্লু প্যারাডাইস' রেস্তোঁরার কর্ণধার রাজীব রায়ের একমাত্র সন্তান। রেস্তোরাঁর পাশাপশি মন্দারমণি, চাঁদিপুর এমনকি গোয়াতেও রাজীববাবুর নিজস্ব রিসর্ট আছে। এক কথায় বিজনেস টাইফুন না হলেও, 'বিত্তশালী', 'ধনবান' প্রভৃতি শব্দগুলোর যথার্থ উদাহরণ রাজীববাবু তো বটে এই অবধি পড়ে একটি বারের জন্যও যদি মনে হয়ে থাকে যে, রণিত 'বড়লোক বাপের বাউন্ডুলে বালক', তাহলে আপনার মস্তিষ্কে সার দেওয়াটা নিতান্তই আবশ্যক। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ২০১৬ গ্রাজুয়েশন ব্যাচের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছাত্র এই রণিত রায়। তার প্রাপ্ত ৮২% স্কটিশের ইতিহাসেও এক নতুন ল্যান্ডমার্ক। কিন্তু সেই রণিতই গত এগারো মাসে পরপর দুটি সেমে রীতিমতো ধরাশায়ী। বিজয়ী সারণ্যা সেন। মাস্টার্সের প্রথম দুটো সেমের পর দ্বিতীয় স্থানে থাকা রণিতের সাথে তার নম্বরের ব্যবধান অনেকটাই. "ভাই,তুই এত চাপ নিস না। কাল কে.এস .স্যারের বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল আছে, থার্ড সেমের প্রথম ক্লাসেই ঐ দেমাগিকে ঘোমটা খুলে খ্যামটা নাচাবো। তুই শুধু কালকের সুপার রিয়েল রিয়েলিটি শোটা দেখ।" --আবিরের ডান হাতের আশ্বস্ত চাপড় রণিতের পিঠে "কালকের খবর কাল হবে। আকাশের হাল বেহাল। সাইক্লোন আক্রান্ত রণিতের মনে যে কোনো মুহূর্তে প্রকৃতির সাইক্লোন আছড়ে পড়বে। বাড়ি চল। রণিত বাড়ি গিয়ে বাথরুমে বসে মোমবাতি নিয়ে শোকসভা পালন করুক। বেস্ট অফ ফাক।" -- চোখ টিপলো শুভ। ভেঙে গেল আড্ডা। শুভ,রণিত,শৌভিক,আবির --- দিনের শেষে ক্লান্ত পাখির মতোই সবাই সওয়ার হল বাড়ির রণিতের মন আজ সত্যিই ভালো নেই। ছেলেবেলা থেকে ক্লাসে প্রথম হয়ে আসা ছেলেটি চরমতম দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে মাস্টার্সে এমন ন্যক্কারজনক পরাজয়ের শিকার তাকে হতে হবে। এমনটা হওয়ার কথাও ছিল না। গ্রাজুয়েশনের রেজাল্ট রণিতের পূর্বের সব সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছিল। আকাশচুম্বী এক প্রত্যাশা গ্রাস করেছিল তার অবচেতন মনকে। মাস্টার্সের স্বর্ণপদক আর রণিত রায়ের ব্যবধান মাত্র ২২মাস। দিন গুনছিল সে। কিন্তু সারণ্যা নামটাই সব ওলটপালট করে দিলো। এস.ডি. স্যারের প্যাথলজির প্রশ্নপত্র যা কিনা সাউথ আফ্রিকার বাউন্সি পিচকেও হার মানায়, সেখানেও সারোণ্যা ৯৪% ! আত্মবিশ্বাসের কাঠামোটাই নড়ে গেছে রণিতের. এদিকে রণিতের একটা প্রেমের গল্পও আছে... ডিপার্টমেন্টেরই ছাত্রী, শহর নবদ্বীপের কুয়াশা সুন্দরী তনুপ্রিয়া সিনহা, মাস্টার্সের ক্লাসমেট সে। কুয়াশাকে যেমন দেখা যায় না বা ধরা যায় না, কেবলই চোখের পাতায় বা মনের গহনে আলতোভাবে মেখে নিতে হয়, তনুপ্রিয়াও তাই। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথার ওপর যখন সূর্যের প্রথম আলোটা এসে পরে, তখন যে সোনালি হৃদয়স্পর্শী বিচ্ছুরণের সৃষ্টি হয়, তা যেন তনুপ্রিয়ার গাত্রবর্ণেরই বৃহৎ সংস্করণ। মায়াময় চোখদুটি যেন পাথুরে জমির কোনো এক শৃঙ্খলিত স্বপ্ন. এই তনুপ্রিয়াই রণিতের আকস্মিক বিপর্যয়ের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি। প্রাণোচ্ছ্বল, সদাহাস্য মেয়েটির চাহনি, হাসিতে বিদ্ধ রণিত। পড়াশোনায় আহামরি না হলেও তনুর রূপে, লাবণ্যে রণিত ক্লিন বোল্ড। বইপত্রে মুখ গুঁজে তিন বছর ধরে শৈবাল, ছত্রাকের প্রেমে মগ্ন থাকা রণিতকে শেষ পাঁচ-ছয় মাস দিনে তিন চার ঘন্টা হোয়াটস অ্যাপে অন দেখা যায়। ফেসবুকে সাড়ে সাতান্নবার চিরুনি তল্লাশি চালায় তনুপ্রিয়ার প্রোফাইলে। উদ্দেশ্য, তনুর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সম্পর্কে সূর্যোদয়ের মতো নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু ক্লাসে কেবলই পড়াশোনাকেন্দ্রিক আর এর বাইরে নিজেকে জাহির করার অভিপ্রায়ে সোশ্যাল সাইটে বেশ কিছু খেজুরে আলাপ --- কথার গাড়ি এর বেশি এগোতে পারেনি রণিত; বরং বারবার উপলব্ধি করেছে, পোস্টারহাসি বহনকারিণী, পোস্টকার্ড সুন্দরী এই নারী কথপোকথনে যেন বড়োই  সাদামাটা --"হয়তো তনুর বয়ফ্রেন্ড আছে। হয়তো বা আমাকে ক্লাসমেটের বেশি ভাবেই না।" নিজের মনকে বোঝায় রণিত। তবুও ক্যারিয়ার সর্বস্ব জীবনে প্রথম ভালো লাগা, একটা গভীর রেখাপাত তো করেই যায়। সেই হাতছানি এড়াতে পারল না রণিতও। তনুর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস জানার নানা ফন্দিফিকির এবং সেটি সিঙ্গেল জানার পর রণিতের এই স্পেশাল কেয়ার বা দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস বেড়ে যায় বহুগুণ। ফলস্বরূপ, ভাগ বসে পুস্তকপ্রেমে আর ভরাডুবি পরপর দুটো পরীক্ষায়। বোটানি সম্পর্কে অগাধ নির্ভুল কনসেপ্টও তার মনোসংযোগের অপ্রতুলতাকে ঢেকে দিতে পারেনি.

পৈতৃক সম্পত্তি বা পরিবারিক ঐতিহ্যের তুলনায় মেধাই যে তনুর কাছে সম্মানপ্রাপ্তির একমাত্র চাবিকাঠি, তা সামান্য মেলামেশাতেই উপলব্ধি করেছিল রণিত। পর্যদুস্ত রণিতের সাথে রেজাল্ট নিয়ে একটা কথাও আজ সোশ্যাল সাইটে তনু বলেনি। নিজে থেকে কথা বলার মুখ রণিতের নিজেরও নেই।সব মিলিয়ে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া।--" সব দুর্ঘটনা, প্রেমরোগ মন থেকে মুছে বাকি দুটো সেমে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতেই হবে। কাল নতুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই ফিরে আসার লড়াই শুরু হবে পুরোনো রণিত রায়ের। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, জেনেটিক্স, প্যাথলজির মতো কঠিন পেপারে যে মেয়ে ৯০% এর ওপর পায়, সে সত্যিই আগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেক বেশি ক্ষুরধার। লড়াই এবার সেয়ানে সেয়ানে। " মনে মনে ভাবে রণিত এক আশায় বুক বাঁধে যে, চতুর্থ সেমের রেজাল্টের দিন একবারে ডাবল গোল্ড মেডেল নিয়ে, সবার সামনে হাঁটু মুড়ে প্রোপোজ করে চমকে দেবে তনুকে। তার আগে এই ক'দিন বরং বইপত্রের সাথে বাড়িয়ে নেওয়া যাক নিজের সখ্যতা--"রোল নম্বর ৫১”

--“ইয়েস স্যার। "--"৫২?”

--“প্রেজেন্ট প্লিস। "

--"রোল নম্বর ৫৩?”

--“অ্যাবসেন্ট।"

"কাল বিকেলে ইউনিভার্সিটির সাইটে রেজাল্ট আশা করি দেখে নিয়েছো সবাই । সারণ্যাকে নিয়ে আমি যথেষ্টই উচ্ছ্বসিত, শি হ্যাজ ডান আ স্প্লেনডিড জব। এত সমস্যা নিয়েও ওর এই সাফল্য রূপকথাকেও হার মানায়। ইউ, স্টুডেন্টস, ট্রাই টু ফলো দ্য প্যাশন। আমাদের সৌভাগ্য যে সারণ্যার মতো একজনকে আমরা ছাত্রী হিসেবে পেয়েছি। নাও, এবার সবাই বায়োকেম ল্যাবে যাও। সূরজ ওয়েট করছে।"- বিভাগীয় সিরাজুল ইসলাম সদম্ভে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন।

নিঃশব্দে ক্লাস ত্যাগ করলো সবাই।

সারণ্যা সেন, গোটা ইউনিভর্সিটি জুড়েই তার জয়জয়কার। বি.এস.সি তে অতি সাধারণ নম্বরপ্রাপ্তা সারোণ্যা ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির এম.এস.সি এণ্ট্রাণ্সে ৯৫ % মার্কস তুলে অ্যাডমিশন নেয়। পরীক্ষার খাতাতেই তার প্রতিভার ছাপ ছিল স্পষ্ট । কিন্তু বড্ড বেশি মুখচোরা মেয়েটি দুটি সেম অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও, সহপাঠী তো বটেই, টিচারদের সাথেও বিশেষ কথা বলে উঠতে পারেনি। প্রথম এক-আধদিন সকলের কাছে ব্যাপারটা সন্দেহের ঠেকলেও, পরবর্তীতে সমস্তটা জানার পর তারা অনুমান করে, হয়তো একজন অ্যাসিড ভিকটিম হওয়ার কারণেই সারণ্যার এই নীরবতা.         

হ্যাঁ, সারণ্যা একজন অ্যাসিড ভিকটিম। মুখের বেশিরভাগটাই কালো কাপড়ে ঢাকা। ইতিউতি শোনা যায়, কলেজ জীবনে গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন, বিচ্ছেদের পর, তার প্রাক্তন প্রেমিক কোনো এক ফাঁকা রাস্তায় তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। ঘটনাটা বছর দুয়েক আগের। এখানে সবটা জানাজানির পর কয়েকদিন সারণ্যাকে টুকটাক টোন-টিটকিরি শুনতে হলেও, তার পাথরসুলভ মৌনতা বিদ্রুপকারীদের উৎসাহে জল ঢেলে দে বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে কাজ শুরু হলো। স্ক্যালপেল দিয়ে আলুর পাতলা স্লাইড কাটতে হবে। আবিরের টেবিল সারণ্যার টেবিলের ঠিক পাশেই। স্পেসিমেন আনতে যাওয়ার অছিলায় সারণ্যাকে হালকা ধাক্কা দিল আবির, যেন তাড়াহুড়োর বশে ধাক্কাটা জাস্ট লেগে গেছে। প্র্যাকটিকালে গভীরভাবে মগ্ন সারণ্যা ধাক্কাটা সামলে নিতে ব্যর্থ হয় । ধারালো সার্জিক্যাল নাইফ আলুর বদলে তর্জনীর ওপর চালিয়ে ফেলে ম

"স্যা- আ -আ -আ- র।" চেঁচিয়ে ওঠে সারণ্যা। তার মুখে এতটা জোরালো আওয়াজ কেউ কখনও শোনেনি আগে। 

স্যার সাথে সাথেই ছুটে আসেন এবং  কেমিক্যাল স্ট্যান্ড থেকে ১০০% অ্যালকোহল লাগানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু অ্যালকোহল লাগাতেই যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়ে সারণ্যা। ঘরময় ছড়ায় এক বিকট গন্ধ। কাঁদতে থাকে সারণ্যা.

"সূরজ, তুমি এ কী করেছো? অ্যালকোহলের বোতলে ফরমালিন ভরে রেখেছো তুমি? আই ক্যানট ইমাজিন! পনেরো বছর কাজ করার পরও এততো ইরেস্পোন্সিবল হও কী করে ? ডিসগাস্টিং। ইমিডিয়েটলি ফ্রিজ থেকে বরফ এনে দাও। ইসস্, মেয়েটার ইনফেকশন না হয়ে যায়।"--ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে বেরিয়ে যান কে.এস.স্যা

ততক্ষণে অনেক দূরের টেবিল থেকে এগিয়ে এসেছে তনু। নিজের বায়োবক্স থেকে তুলো বের করে অ্যালকোহল দিয়ে ড্রেসিং করে দেয় সারোণ্যার ক্ষতস্থান, ব্যান্ডেজ করে নিজের ওড়না ছিঁড়ে। গোটা ক্লাস মুগ্ধ হয়ে যায় তনুর এহেন মানবিক আচরণে। সারণ্যাও বিস্মিত। তনুর মনের কোমলতা সকলের কাছে পরিচিত হলেও,এত যত্ন , মমতা নিয়ে সারণ্যার শুশ্রূষা মুগ্ধ করে গোটা ক্লাস.  

   যদিও পুরো ঘটনাটাই ছিলো সূরজদার ইচ্ছাকৃত। সারণ্যার সাথে যেহেতু পরীক্ষায় পেরে উঠছে না রণিত, তাই রণিতের মতো রণিতের বেস্টফ্রেন্ড আবিরও যথেষ্টই ঈর্ষান্বিত। সেই ঈর্ষা থেকেই আবির সারণ্যার টেবিলে, অ্যালকোহলের বোতলে ফরমালিন রাখতে দু'হাজার টাকা দেয় সূরজদাকে এবং প্র্যাকটিকাল ক্লাসে প্ল্যানমাফিক মারে ধাক্কা। সূরজদাও ক্লাস শুরুর আগেই বোতলের মেটেরিয়াল বদলে রেখেছিল। ফলস্বরূপ, রক্তাক্ত হয় সারোণ্যা। আবির ভেবেছিল, রণিত হয়তো এই ঘটনায় দুর্দান্ত খুশি হবে। কিন্তু পরিস্থিতি গেল ১৮০ ডিগ্রি উলটে। নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি তনুর অমায়িক মায়া দেখে রণিতের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল লঙ্কাবাঁটার মতোই। কিন্তু বিধি বাম! স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার অভিপ্রায়ে অতীব স্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য হল সে এবং নিজের খরচেই সামনের মেডিসিন শপ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক এনে তুলে দিল সারণ্যার হাতে। অসাধারণ রেজাল্টের জন্য তাকে অভিনন্দিতও করল। সারণ্যা মৃদু হেসে 'ধন্যবাদ' বলেই চুপ হয়ে গেল। মোহিত তনুও ওষুধের কারণে কৃতজ্ঞতা জানাল রণিতকে। রণিতের আনন্দ আর বাঁধ মানে না.

সেদিনের মতো সময়ের অভাবে বাতিল হল ক্লাস। প্রথমবারের জন্য সারণ্যার সাথে তার সহপাঠীদের দু'একটি বাক্য বিনিময় ঘটল। অধিকাংশই মেকি সহানুভূতি দেখালেও নরম মনের মেয়ে তনুর আচরণে আন্তরিকতার ছাপ ছিল স্পষ্ট. রণিত আর সেদিন ছুটির পর কলেজে থাকল না। নিজের প্রতিজ্ঞানুযায়ী, অহেতুক সময় অপচয় বাঁচাতে ক্যান্টিনেও যায়নি। ক্লাস বাতিল হতেই বাড়ির পথ ধরে সোজা ডুব বইয়ের স্রোতে.

পরদিন সকাল ১০টা৩০। শুরু হলো দময়ন্তী ম্যামের মাইক্রোবায়োলজি ক্লাস। গতদিনের ঘটনা যেন কারো স্মৃতিতেই নেই। সকলে বড়ো বেশিই আত্মকেন্দ্রিক -- মনে মনে ভাবলো সারণ্যা। দু'একজন এসে আঙুলের খোঁজ নিল বটে, তবে তা যে কেবল নিয়মরক্ষা, তা তাদের অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। ব্যতিক্রম কেবল তনু। আলতো আদরে দীর্ঘক্ষণ সারণ্যার ক্ষতে হাত বোলায় সে, যথোপযুক্ত সাহায্য করে ক্লাসের কাজ করতে.    

দেখতে দেখতে দরজায় হাজির তৃতীয় সেম। সময় এগোলেও তনু ছাড়া কারো সাথেই সারোণ্যার তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। মনখোলা খেয়ালি আড্ডা না হলেও মাঝেমধ্যেই দুজন মজে যায় গল

হিংসার বশবর্তী হয়েই হোক বা শারীরিক বিকৃতির কারণে, সবার কাছেই সারোণ্যা যেন চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে আসা বিশেষ জন্তু। কেবল তনুপ্রিয়াই সেখানে ব্যতিক্রম, অনেক বেশি আন্তরিক ও প্রকৃত সমব্যথী সে।  

রেজাল্ট আউট হলো তৃতীয় সেমের। সারোণ্যা ৯০%পেয়ে আবার টপ করলেও, পিছিয়ে নেই এবার রণিতও। ৮৮% মার্কস নিয়ে দ্বিতীয়স্থানে সে। এমনকি একটা পেপারে তো সারণ্যার থেকে দশ বেশিও পেয়ে গেছে। রণিত পেল এক বাড়তি অক্সিজেন। সারণ্যাকে শেষ সেমে হারানোর নেশায় ডুবে গেল একনিষ্ঠ সাধনায়। খোঁচা খাওয়া বাঘ যেন রক্তের স্বাদ "আজ আমাদের শেষ ক্লাস রে সারোণ্যা। কাল ফেয়ারওয়েল। কাল প্লিস অ্যাবসেন্ট করিস না। তুই তো আবার 'একলা চলো' গানটাকে বাস্তব রূপ দিতে বেশ পারদর্শী।" --ছদ্ম অভিমানী সুরে বলে তনু। "কেন গো ?আমি আবার কী করলাম সোনা?"--মৃদুহাসে সারণ্যা।

"মানছি, তোর ফোন বা সোশ্যাল সাইট নেই। কিন্তু তা বলে কী দু'বছরে বন্ধুর সাথে একদিন আউটিং-এও যাওয়া যায় না? নিজের মুখে যে বলবো, সে সাহসও হয় না। তুই নিজে থেকে আমার সাথে যেটুকু কথা বলিস, তাতে ছোটোবেলার ইংরেজি পরীক্ষার সামারি সেকশনের কথা মনে পড়ে যায়। "--বেশ গম্ভীর দেখায় তনুপ্রিয়া--

“রাগ করে না বাবু , চল, আজ ক্লাস ছুটির পর আমরা গাছতলায় বসে অনেকক্ষণ গল্প করবো। আসলে আমি তো তোদের সবার থেকে আলাদা, তাই আর কী ! কে কিভাবে নেবে ! তার চেয়ে নিজেকে নিজের গন্ডিতে, নিজের মতো করে বেঁধেই খুশি থাকি।"--মুখভার সারণ্যার ।--"চুপ। একদম চুপ। বন্ধুত্ব কোনোদিন কোনোকিছুর ওপর নির্ভর করে না। তুই যদি সত্যিই আমাকে বন্ধু ভেবে থাকিস, আর কোনোদিন এসব কথা বলবি না। আজ ছুটির পর আমার সাথে কফিশপে যাবি তুই। আমার বেস্টফ্রেন্ড তিনটে সেমে টপ করেছে,আমি ট্রিট দেবো। ওকে?" -- এক দমে বলে যায় তনু। "যথা আজ্ঞা, মহারানি। তবে কফিশপ নয়। বড্ড বেশি হইচই, কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা সেখানে । আমরা প্রিন্সেপ ঘাট যাবো, মেঘের সামিয়ানা ছিঁড়ে গঙ্গার বুকে সিঁদুরে রোদের খেয়ালি বিচরণ দেখবো। "--সারণ্যাকে বেশ উৎসাহিত দেখায়।

সম্মতিসুচক হালকা ঘাড় নাড়ে তনুও এবং ছুটির ঘন্টা বাজতেই ওরা রওনা দেয় প্রিন্সেপ ঘাটের পথে "কিরে,তনু, তোর শরীর খারাপ? এত চুপচাপ থাকার মেয়ে তো তুই নয়।" --- বিস্মিত সারোণ্যা।---"না। ঠিক আছে। সব ফাইন। "

---“না,না । আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, কফিশপটাই বেটার হতো। প্রিন্সেপ ঘাটটা তোর ঠিক মনে ধরেনি। তাই না ?" কিছুটা ইতস্ততবোধ করে সারণ্যা।

---"না রে,পাগলি। আসলে তোর এই প্রকৃতির বর্ণনা পুরোনো কিছু ঘটনাকে চোখের সামনে কেমন যেন ভাসিয়ে তুললো। বাদ দে ওসব। চল গোলা খাই।" আলতো হাসে তনুপ্রিয়া।

---"ঠিক আছে। বলিস না বাবা। কী এমন কথা রে যা কিনা বেস্টফ্রেন্ডকেও বলা যায় না? যা, বলতে হবে না।" মুখ বাঁকায় সারণ্যা ।        চোখের কোলে হালকা জল তনুর। "তখন আমি ক্লাস টুয়েলভ। আমার সাথে একই টিউশন ব্যাচে ফিজিক্স আর বায়োলজি পড়ত পাশের বয়েজ স্কুলের থার্ড বয় যুধাজিৎ। কেন জানি না,ওকে আমার বেশ আলাদা লাগতো। ওর ব্যক্তিত্ব, সততা আমায় টানতো খুব। সেই থেকে আসতে আসতে শুরু হল বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। ভর্তি হলাম কৃষ্ণনগরে একই কলেজে। দুজনেরই পছন্দের বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা। শুধু পড়াশোনাই না, আবৃত্তি, ক্যুইজ সবেতেই যুধা ছিলো ডিস্ট্রিক্ট টপার। তুলির টানে যে কোনো ছবিকে অনায়াসে করে তুলতো জীবন্ত । আমাদের সম্পর্কের কথা ও নিজের বাড়িতে বেমালুম চেপে গেলেও, আমি কিন্তু আমার বাড়িতে ঝুঁকি নিয়েও জানিয়ে দিই সবকিছু। শোনার পর বকাঝকা থেকে মারধর --- কোনোকিছুই বাকি রাখেনি বাবা। তাও আমি জোর দিয়ে বলি, যুধা সবার সেরা। পড়া শেষ করেই দারুণ একটা জব পেয়ে ও আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে গেল সেই বিপর্যয়। স্ট্রোক হয়ে মারা গেল ওর বাবা। একদিকে সংসার আর অন্যদিকে বিধ্বস্ত কাকিমাকে সামলানো। হয়তো ও পেরে উঠছিলো না। বদলাতে শুরু করে যুধা। যে ছেলেটা একবেলা আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারতো না, সে অনায়াসেই একটাও মেসেজ করে কাটিয়ে দিচ্ছিল দু-তিনদিন। ওর সব দুঃখ-কষ্টকে নিজের অলংকার করে নিতে চেয়েছিলাম আমি। কুঁড়েঘর বা একমুঠো পান্তা --- কোনোকিছুতেই নারাজ ছিলাম না। কিন্তু দিন এগোনোর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চললো ওর খারাপ ব্যবহার। ভালোবাসার কথা বললেই অশ্রাব্য গালাগাল, সাথে নতুন ছেলে খুঁজে নেওয়ার নির্মম আকুতি। দিনের পর দিন চোখের জলই ছিল আমার সঙ্গী। নিজের প্রিয়তমের কাছে আমি যেন বোঝা। সরে গেলাম ওর জীবন থেকে। কিন্তু আমি ছেড়ে আসার পর যুধা হয়তো কোনো শূন্যতা অনুভব করে। নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে আমার সাথে। রাস্তায় পা ধরে ক্ষমাও চায়। কিন্তু ততদিনে আমি বীতশ্রদ্ধ। মন আমার ভুলতে পারেনি ওর দুর্ব্যবহারগুলো। প্রতিবারই যথেচ্ছ অপমান করে বিতাড়িত করি ওকে। এক ক্লাসে থাকলেও আর ফিরেও তাকাইনি কোনোদিন। এখনও খোঁজ নেওয়ার কোনোরকম চেষ্টা করি না।" --- এক নিমেষে কথা গুলো শেষ করেই তনু ছুটে গিয়ে ট্যাক্সি ধরে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে রওনা দেয় বাড়ির দিকে। সারণ্যা প্রাণপণ ছুঁটেও নাগাল পায় না।


    আজ ফেয়ারওয়েলে সবাই এলেও তনু অনুপস্থিত। আহেলী কে.এস.স্যারকে জানায়--"আসার আগে আমি তনু কে ফোন করেছিলাম, স্যার। ওর রুমমেট ফোন ধরেছিল। তনুর খুব জ্বর। কাল কলেজ থেকে ফিরেই সোজা বিছানায়। আজ সকালে ওর মেসের কাকিমা প্যারাসিটামল এনে দিয়েছ" সব শুনেও না শোনার ভান করে সারণ্যা।


       চতুর্থ সেম শেষ। রেজাল্ট বেরোতে আর মাত্র কয়েকদিন। বন্ধুত্বলোতেও কেমন যেন বিচ্ছেদের সুর। সেদিন ওইভাবে একা ফেলে চলে আসার পর তনু পরীক্ষা চলাকালীনই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সারণ্যার কাছে। সে সব মনে রাখার মেয়ে সারণ্যা নিজেও নয়। বন্ধুত্বই তার কাছে সবথেকে দামি।      এর মাঝে হঠাৎই একদিন বিকেলে বেজে উঠল তনুপ্রিয়ার মোবাইল। সারোণ্যার ফোন। তনুকে আমন্ত্রণ জানায় নিজের বাড়িতে। বাড়ি বলতে ঝুপড়ি। হ্যাঁ,কলকাতার এক ঝুপড়িতেই ভাড়া থাকে সারণ্যা। সারণ্যা নতুন ফোন কিনেছে শুনে আহ্লাদিত তনু, তৎক্ষণাৎ হাজির হয় ওর বাড়ি। আসলে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে ওদের দুজনের আর দেখাই হয়নি। মনটা হাঁসফাস করছিল তনুর হাতে ক্যাডবেরির প্যাকেট নিয়ে, খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই মেরুদণ্ডে যেন হিমেল স্রোত বয়ে গেল তনুর। থমকে গেল হৃদস্পন্দন। ঘরে সারোণ্যার কোনো চিহ্নমাত্র নেই। ঘরময় ছড়িয়ে কেবল তনুর ছবি আর তারই মাঝে এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে যুধা

"এ কী! তুই?" চিৎকার করে ওঠে তনুপ্রিয়া। "ভয় পাস না তনু। টেবিলের ওপর জলের বোতল রাখা আছে। খেয়ে শান্ত হ। আজ তোকে একটা গল্প শোনাবো রে পাগলি। এক পাগল প্রেমিকের গল্প।"---অট্টহাসি যুধাজিতের। স্তব্ধ তনু।

"সারণ্যা বলে এতদিন যাকে তুই জেনে এসেছিস, সে আসলে আমি। তোর প্রাক্তন। তোর যুধা। হাজার কান্নার পরও যখন তুই আমাকে ক্ষমা করলি না, তোকে ছাড়া যখন জীবনের প্রতিটা দিন বেরঙিন; ঠিক সেই সময়ে পেপারে দেখলাম, চাপড়ায় একটি মেয়ে অ্যাসিড আক্রমণের স্বীকার। মেয়েটিও বোটানি অনার্সের ছাত্রী । নাম সারণ্যা সেন । আমাদের ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট বেরোতে তখনও মাস দুই বাকি। ছুটে গেলাম ওর বাড়ি। ওর চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিতে চাইলাম আর বিনিময়ে দাবি করলাম ওর পরিচয়। অর্থাৎ ওর নাম নিয়েই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবো আমি । চিকিৎসার খরচ টানার সামর্থ্য সরণ্যার বাড়ির লোকের ছিল না। ওরা রাজি হয়ে গেল আমার প্রস্তাবে । আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তুই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হবি। কিন্তু আসল যুধাজিতকে যে তুই কিছুতেই ক্ষমা করবি না, সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই সারণ্যার পরিচয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম তোরই সাথে মাস্টার্সে। মেয়েটার মুখের ৬০%-ই পুড়ে গেছিলো প্রাক্তনের ছোঁড়া অ্যাসিডে। তাই ছবি ভেরিফিকেশনেও তেমন কোনো সমস্যা হল না। আর ফিঙ্গার প্রিন্ট ভেরিফিকেশনের দিন হাজির হয় সারণ্যা নিজেই। ওর মুখের বেশিরভাগটাই ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা। ব্যাস, এভাবেই মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গেল সারণ্যা রূপী যুধাজিৎ। নিখুঁত মেকআপে নিজেকে অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়ে সাজাতে আমার যে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়, তা তুই ভালোভাবেই জানিস। আর ছোটো থেকে থিয়েটার করার পর মেয়েদের গলা নকল করাটাও নেহাত মামুলিই ঠেকেছিল। তবে আমার এই ছদ্মবেশ, শুধু তোকে একটা কথাই জানান দিতে যে --- ভালো আমি তোকে সত্যিই বাসতাম, বাসিও। কিন্তু চাইনি, আমার অনিশ্চিত জীবনে ঢুকে তুই নিজেও শেষ হয়ে যা। তাই সেই দুর্ব্যবহার। রেজাল্ট বেরোতে হয়তো আর একটা সপ্তাহ বাকি । জানি, গোল্ড মেডেলটা আমি-ই পাব। আমার চ্যালেঞ্জ ছিল দুটো। এক, সবাইকে আরও একবার বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি-ই সেরার সেরা আর দুই, তোর প্রতি আমার অসীম, অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা গোটা পৃথিবীকে জানানো। দুটো কাজই প্রায় শেষ। মা ও আর বেঁচে নেই। এসবের খরচ তুলতে গিয়ে নবদ্বীপের বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। তাই …….আই লাভ ইউ তনু । ভালো থাকিস। চলি রে। গুড বাই।"---এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করেই নিজের গলায় বিষমাখরক্তে লাল হয়ে গেছে মেঝে। যুধার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে তনুপ্রিয়া । যুধাজিতের সাদা পাঞ্জাবিতে নিজের হাতে আঁকা ফেব্রিক-  “যদি এক মুহূর্তের জন্যও তোমায় চাই, সেটাই সত্যি॥”          


বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। এক পশলা রোম্যান্টিকতায় আলতো গা ভিজিয়ে অলিতে গলিতে রচিত হচ্ছে --- পরিণতিহীন, নিষ্পাপ হাজার প্রেম কাহিনির প্রচ্ছদ ।


Rate this content
Log in