বৃষ্টিস্নান
বৃষ্টিস্নান
বৃষ্টিস্নান
"আমার এই স্বেচ্ছা একাকীত্ব,এই একলা যাপন আমার বিলাসিতা,এ শুধু তোমায় নিয়ে কাল কাটানোর অভীপ্সা। জীবনে সকল কিছু হারিয়েও এই একলা থাকাটা সম্বল করেই আমার সকল পাওয়া। তোমায় নিয়ে তোমার সাথে যে স্বপ্ন ডানা মেলেছিল তা আজ পুড়ে ছাই,একবুক তৃষ্ণা নিয়ে তোমার পথ চেয়ে থেকেছি কত কতদিন,থাকব সারাজীবন। তোমার পথ চেয়ে অপেক্ষায় কাটিয়ে দিতে পারি কয়েকটা জন্ম,এ অনন্ত অপেক্ষার সবে তো শুরু এই জন্মে।" বারান্দায় অন্ধকারে একলা বসে জয়া, বাইরে ঝড় উঠেছে,অন্ধকার চারিধার, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই বন্ধ রেখেছে বোধহয় ঝড়ের জন্য। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি।
জয়া আর মীরের ভালবাসা দু'বাড়ীর কেউই ভাল চোখে দেখেনি,এ নিয়ে অশান্তিও কম হয়নি,এমনকি সেই ২১বছর বয়সে জয়াকে বাবার হাতে মারও খেতে হয়েছে,তাকে বাড়ীতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে ভালবাসা কমা তো দূর অস্ত বরং আরো বেড়েছে দিনেদিনে।মীর ছটফট করেছে জয়াকে ঐ অবস্থা থেকে বার করতে,পারে নি। জয়ার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়েছে,বন্ধুদের প্রবেশ নিষেধ। নিষেধের বেড়াজালে বন্দী সে আজ। কেবল বি.এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে,মেধাবী ছাত্রী জয়া অনেক পড়াশুনা করতে চায় কিন্তু মীরকে ভালবাসার অপরাধে সে সুযোগ হয়ত সে পাবে না।
মীরকে সে শুধু ভালই বাসে না,সে মীরের গুণমুগ্ধ। মীর ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট তো ছিলই এছাড়া দারুণ কবিতা লিখত সে,আবৃত্তি,গান সবেতেই চৌকস,কিন্তু ঐ যে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ। মুখে ভাই ভাই বলি আমরা কিন্তু সেভাবে মিলেমিশে আর এক হতে পারলাম কই। কিন্তু ভালবাসা যে জাত ধর্ম মানে না আর তাই হিন্দু জয়া ভালবাসল মুসলমান মীরকে।
কলেজে নবীনবরণ উৎসবে মীর যখন তার উদাত্ত স্বরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'যখন বৃষ্টি নামল' কবিতাটি আবৃত্তি করছিল জয়া মোহাবিষ্টের মত শুনছিল বসে,যখন শেষ লাইনটা বলছে মীর "....... ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের ভেতর ঝরে" জয়ার ভেতর যেন কি হয়ে গেল। স্টেজ থেকে মীর নেমে সামনে এলে ওর শান্ত,স্নিগ্ধ চোখে চোখ রেখে জয়া নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ওর মাঝে সেই প্রথম দিনেই,ওর চোখ থেকে জয়া তার চোখ ফেরাতে পারছিল না। মীরও বোধহয় প্রথম দর্শনেই জয়ার প্
রেমে পড়ে গিয়েছিল তাই বেশ কিছু মূহুর্ত ওরা চোখের পলক না ফেলে একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল। আশপাশে বন্ধুদের সম্মিলিত হাসিতে ওরা সচকিত হয়,লজ্জা পায়। সেই শুরু,ধীরেধীরে প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে,পরে সব জানাজানি হলে জয়া ঘরবন্দী। মীর পাগলের মত ছটফট করেছে কিন্তু কিছু করতে পারেনি। তিনমাস পর রেজাল্ট বেরলে মীর বাংলায় রেকর্ড মার্কস পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয় এবং ইউনিভার্সিটি থেকে গোল্ড মেডেলের জন্য নমিনেটেড হয়। জয়ার ইংলিশ,সে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি তবে ভাল মার্কসই পেয়েছে। কিন্তু গোল্ড মেডেলের অনুষ্ঠানে মীরকে দেখা যায় না,তাকে আর কোনো দিনই দেখা যায় না এরপর।
মীরের নিরুদ্দেশের খবরে জয়ার মুক্তি হল। সে এম.এ তে ভর্তি হল,গোপনে চলল তার মীরকে খুঁজে পাবার বৃথা চেষ্টা।স্বেচ্ছায় কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁপি.এইচ.ডি করে, এখন সে কলেজে পড়ায়। চাকরী পাবার পর জয়া বাড়ীর প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে লেডিস হোস্টেলে থাকা শুরু করে। বাড়ী থেকে ফেরার জন্য জোরাজুরি করলে ও ট্রান্সফার নিয়ে দূরে চলে যায় কাউকে না জানিয়ে,ঠিকানা না রেখে। সেই থেকে শুরু তার একলা চলা,শুরু অপেক্ষা, কাগজে বিজ্ঞাপন,থানা পুলিশ,কিন্তু সবই বিফল হল। এই একাকীত্বকেই ভালবাসে সে এখন। কলেজ থেকে ফিরে সে মীরের পছন্দের কবিতাগুলি পড়ে,আবৃত্তি করে। এছাড়া মীরের লেখা কিছু কবিতা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে যেগুলি বেরিয়েছিল,সেগুলি সংগ্রহ করে সে,সেগুলিও আবৃত্তি করে আবেগ ভরে। সে একলা নয়,সারাক্ষণ সে মীরের সাথেই বসবাস করে। ভারী উপভোগ করে ও।
"কিন্তু আজ এই ঝড়ের রাতে মনটা আমার কেন এত উতলা! কেন আজ এতদিন পর মীরের জন্য বুকের ভেতর উথালপাতাল,কেন চোখ ভরে যায় জলে?" ভাবে জয়া অন্ধকারে বসে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জনমানবশূন্য পথঘাট,জয়া গলা খুলে আবৃত্তি করে ".............ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের ভেতর ঝরে"। সহসা ওর মনে হয় ওর সাথে গলা মিলিয়ে কেউ যেন আবৃত্তি করছে "..........ভারী ব্যাপক বৃষ্টি........"। জয়া চিৎকার করে 'মীর মীর' করে ডাকতে শুরু করে,ওর মনে হয় মীর এসেছে বুঝি এতদিন পরে ফিরে ওর কাছে। কড়কড় করে মেঘ ডেকে উঠল বিদ্যুতের ঝলকানি নিয়ে,দূরে কোথাও বাজ পড়ল। কেউ নেই,কেউ নেই। যে আছে সে ওর বুকের ভেতর বৃষ্টিস্নান করছে।