বর্ষবরণের রাতে-৩
বর্ষবরণের রাতে-৩
বর্ষবরণের রাতে-৩
ডিসেম্বরের শেষ রাত। বর্ষবরণ চারিধার। উল্লাসে মেতেছে এ শহর। এ শহর আনন্দের শহর,এ শহর উৎসবের,এ শহর উষ্ণতার,এ শহর কলকাতা, তিলোত্তমা কলকাতা। সর্বধর্ম সমন্বয় এখানে,কিবা হিন্দু কিবা মুসলিম,কিবা খৃষ্টান,সব ধর্মের উৎসবে মাতে সবাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে।
কলকাতা শহর ঝলমল করছে আলোয়,উৎসব সর্বত্র,যেন আলোর মেলা। পার্কস্ট্রিটে ফুটপাত জুড়ে সারি সারি অস্থায়ী দোকান। ডিসেম্বরের শেষ দশ দিন এমনই থাকে এ অঞ্চল,রাস্তার ওপর দিয়ে আলোর চাঁদোয়া, রেস্তোরাঁগুলো সেজে উঠেছে ঝলমলে আলোয়,উপচে পড়ছে ভিড়,রাস্তায় লোকের মেলা,গাড়ি নিষিদ্ধ, only walk zone এই কদিন। যে কোনো উৎসব উপলক্ষ করে এ শহর হাসতে জানে,নাচতে জানে,মাততে জানে,এ শহর কলকাতা,তিলোত্তমা কলকাতা।
এ শহরের আরও সবার সাথে হুল্লোড়ে মেতেছে তিন্নি,মেতেছিল ওর ভাই তিতাস সন্ধ্যে থেকেই। যে যার বন্ধুদের সঙ্গে পার্কস্ট্রিটে ছিল ওরা। খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-ফূর্তি,গান বাজনায় বর্ষবরণে মেতেছিল ওরা। কাঁটায় কাঁটায় রাত ১২টা,গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে ১২টা ঘন্টা পড়ল,গোটা পার্কস্ট্রীট সমস্বরে যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল, "হ্যাপি নিউ ইয়ার"। চলল কিছুক্ষণ, অনেকেই বেসামাল তবু সে দিনের জন্য সব মার্জনা। বন্ধুরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আদর করে এক এক করে বাড়ির পথে পা বাড়াল। খানিকটা পথ একসাথে চলার পর যে যার রাস্তায়। একা হয়ে গেলে তিন্নি ফোন করে ভাইকে,বারবার মোবাইল বেজে যায় ভাইয়ের সাড়া নেই,তিন্নি আর কতক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকবে,তাই পায়ে পায়ে এগোতে থাকে,মোটামুটি জানে ভাই কোথায় থাকতে পারে।
খানিক এগোবার পর কিছুটা নির্জন জায়গায় গিয়ে পড়তেই বুঝতে পারে ঠিক করেনি সে। কিছু ছেলে তার পিছু নিল,জড়ানো কণ্ঠস্বর,পা পড়ছে না ঠিকমত। তিন্নি পা চালালো জোরে,তারাও জোরে পা চালিয়ে চারপাশ থেকে এসে ঘিরে ধরল ওকে। মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে অঙ্গভঙ্গি,রসিকতা শুরু করল। মুখ দিয়ে তাদের তীব্র কটু মদের গন্ধ বেরোচ্ছে,তিন্নির সহ্য হচ্ছে না,ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গ
েছে,এগোতে পারছে না সে। কেউ একজন তাদের মধ্যে হাত টেনে ধরল ওর,ছাড়াতে পারছে না কিছুতে। হঠাৎ তিন্নি দূর থেকে দেখতে পেল ভাইকে, বন্ধুরা বাইক নিয়ে চলে গেলে ভাই এদিকেই আসছে। ভাইকে দেখতে পেয়ে 'ভাই ভাই' করে ডাকতে থাকল সে। ভাই দৌড়ে এসে দেখে দিদি বিপদে পড়েছে, দিদিকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ,কিন্তু একা সে পাঁচ জনের সঙ্গে পারবে কেন,তার ওপর তিতাস মাত্র ১৯ আর এরা সব ২৬-২৭ হবে। তিতাসকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে তিন্নিকে কাছে টেনে একজন বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। তিতাস ঝেড়ে মেরে উঠে ওদের সাথে হাতাহাতি শুরু করে দিদিকে বলে, "দিদি তুই পালা,আমি দেখছি"। তিন্নি পারে না,বলে, "নারে ভাই,আমরা একসাথেই বাড়ি ফিরব"। ইতিমধ্যে একটি ছেলে তিন্নির দিকে এগিয়ে এলে তিন্নি দৌড়াতে শুরু করে,তার এক পায়ের চটি খুলে যায়,অন্য পায়ের চটি খুলে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন পৌঁছে গেছে বাড়ি,দেখে বাবা-মা জেগে বসে আছেন।"ভাই কোথায়" জানতে চাইলে তিন্নি কেঁদেই চলে,রাত তখন ২টো,পাড়া শুনশান,কি করবে,কাকে ডাকবে।
ওদিকে তিতাস একা পাঁচজনের সঙ্গে পেরে ওঠে না,ওকে মাটিতে ফেলে সবাই মিলে লাথি মারতে থাকে।হঠাৎ একজন পথের ধারে পড়ে থাকা একটা পাথরখন্ড কুড়িয়ে পেয়ে সেটা দিয়ে তিতাসের মাথায় আঘাত করলে তিতাস 'মাগো' করে জ্ঞান হারায়। মত্ত ছেলেগুলোর আক্রোশ কমে না। হাতের নাগাল থেকে শিকার ফসকে বেরিয়ে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত তারা,পাথর দিয়ে থেঁতো করতে থাকে রাস্তায় পড়ে থাকা তিতাসের মাথা। হাতময় রক্ত মেখে পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে টলতে টলতে চলার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তিনজন, দুইজন দৌড়ে পালায় তবে বেশি দূর যেতে পারে না,ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
সারারাত সকলেই জেগে তিতাসের প্রতীক্ষায়। নববর্ষের প্রথম ভোরে একসময় তিন্নির ফোন বেজে ওঠে। তিতাসের মোবাইলে পুলিশ দেখে তিন্নির ১১টা মিসড কল,তাই সন্দেহের তালিকায় তিন্নি,আর তাই ফোন। পুলিশ জানতে পারল তিন্নি তিতাসের দিদি। তাকেই তার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ দিল তারা,মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য ডেকে পাঠালো।
বিচারের প্রহসন আজও চলেছে।