Rinki Banik Mondal

Abstract

3  

Rinki Banik Mondal

Abstract

বৃদ্ধাশ্রমে ফিরে পাওয়া স্মৃতি

বৃদ্ধাশ্রমে ফিরে পাওয়া স্মৃতি

4 mins
583


গৃহস্থবাড়ির এক বুধবারের সকালবেলা। সবাই কাজে কর্মে ব্যস্ত। কিন্তু অমরেশবাবুর আজকের দিনটা অন্য দিনগুলোর থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম। তাকে আজ রোজকার মত বাজারে যেতে হয়নি। অমরেশবাবুর ছেলে বাপান আজ বাবার পছন্দ মত অনেক বাজার করেছে। বাপান আজ অফিসও ছুটি নিয়েছে। বৌমাও অমরেশবাবুর মনের মত অনেক রান্না করেছে। অমরেশবাবুর ছেলে বলেছে পিসির খোঁজ পাওয়া গেছে। তাই অমরেশবাবুকে আজ বিকেলে পিসির সাথে মানে অমরেশবাবুর দিদির সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবে।

 ------"চলো বাবা, তৈরী হয়ে নাও। আমি গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করি।"

অমরেশবাবুর তো খুশিতে মন ভরে উঠেছে। তার দু'চোখে হাজার তারাবাতির ঝলক! কতযুগ দিদিকে দেখেননি। কয়েক বছর আগে অমরেশবাবু নিজেই তার একমাত্র দিদিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। সংসারে বৌমার অকথ্য গালিগালাজ, ছেলের উদাসীনতা, বিরক্তি সহ্য করেই পড়ে রয়েছেন। পুরোনো ভাবনা চিন্তা নিয়েই ছেলের সাথে গাড়িতে চেপে উঠলেন বাবা। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অমরেশবাবুর মনে এল পুরানো সেই দিনের কথা........

অমরেশবাবুর দিদি সরলাদেবী ছিলেন খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর সরলাদেবীই তার একমাত্র ছোট ভাইকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিলেন। নিজে না খেয়েও ভাইকে খাইয়েছিলেন। ভাইকে দেখাশোনার জন্য তার আর নিজের সংসারটা করে ওঠা হয়নি, পরিবারের গুরুজনেরাও তার বিয়ের ব্যাপারে আর কোন চেষ্টা করেনি। শখ করে ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের যত কাজকর্ম, রান্না সবই তিনি ভাইয়ের বউকে শিখিয়ে ছিলেন। তারপর তাদের যখন সন্তান হল সেই সন্তানকে তিনিই আদর-যত্নে বড় করেছিলেন। অমরেশবাবুর ছেলে বাপানের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি তার জমানো সব টাকা আর সোনার গয়নাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাপানের চাকরি হওয়ার কিছুদিন পরেই অমরেশবাবুর স্ত্রী মারা যান। তখন সরলাদেবীই আবার পুরো সংসারটার হাল ধরেছিলেন। প্রত্যেক রাখীর দিন সকালবেলা সরলাদেবী ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন তার ভাই অমরেশকে। নতুন পাঞ্জাবি পাজামা কিনে দিতেন। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন ভাইকে। বাপানের বিয়ের পরও তো এই নিয়মিই চলতো প্রত্যেক রাখীতে। কিন্তু একদিন....

------"বাবা, তুমি পিসিকে এখান থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দাও। আমাদের এখন নতুন বিয়ে হয়েছে। তোমার বৌমার ইচ্ছে বাড়িটাকে নতুন করে ফার্নিস করার, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও আসে, ঘরের দরকার। আর তা যদি না পারো আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।"

সেদিনকের এই কঠিন কথাগুলো কানে গিয়েছিল সরলাদেবীর। দরজার বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছিল ছেলে আর বৌমার সাথে অমরেশবাবুর চিৎকার চেঁচামেচির কথা। ঘরের দরজাটা খুলতেই অমরেশবাবু দেখেছিল সরলাদেবীর চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। তাও ছেলে হারানোর ভয়ে অমরেশবাবু সরলাদেবীকে বলেছিলেন-"আমি কিছু টাকা দিচ্ছি। তুই না হয় দেশের বাড়ি...."

সেদিন দাদার পুরো কথা না শুনেই পরের দিন ভোরবেলা একটি চিঠি লিখে সরলাদেবী কোথায় চলে গেলেন। কেউ জানে না। চিঠিতে কিছু ঠিকানা লিখে যাননি। শুধু এটাই লেখা ছিল-"তোরা ভালো থাকিস।" অমরেশবাবু অনেক খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো খবর পাননি। অমরেশবাবুর স্মৃতি রোমন্থনের পর্বেই গাড়িটা হঠাৎ করে ব্রেক কষে।

 ------"বাবা চলে এসেছি। এবার গাড়ি থেকে নামতে হবে।"

 ------"এখানেই কি? এখানে তো একটা স্টেশন মনে হচ্ছে। কত লোকের ভিড়।"

 ------"হ্যাঁ বাবা। এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে।"

গাড়ি থেকে নামার পর অমরেশবাবু কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারেননি ছেলে বাপান কখন চলে গেছে। অমরেশবাবু পেছনে তাকিয়ে ছেলেকে না দেখতে পাওয়ায় তিনি রাস্তায় বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। অত লোকের ভিড়ের মধ্যে উনি ছেলেকে খুঁজে বের করতে পারেন না। সন্ধ্যে পার হয়ে ধীরে ধীরে রাত হয়ে যায়। অমরেশবাবু বুঝতে পারেন যে, তিনি ছেলের কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। হঠাৎই অমরেশবাবু অসুস্থবোধ করতে থাকেন। তখন স্থানীয় কিছু এলাকাবাসী শলা পরামর্শ করে অমরেশবাবুকে পাশের একটি 'আনন্দ আশ্রম' নামে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যান।

'আনন্দ আশ্রম' আজ রঙিন ফুলের মালায় সেজে উঠেছে। কাল তো রাখী পূর্ণিমা। তারই প্রস্তুতি চলছে। বৃদ্ধাশ্রমে পা রাখতেই এ কাকে দেখছেন অমরেশবাবু! তার দিদি সরলাদেবী সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সরলাদেবীও তার ভাইকে দেখে অবাক। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন অমরেশবাবু।

 -----"আমায় ক্ষমা করে দে দিদি। আমার পাপের শাস্তি তো আমি ভোগ করছি। আর আমায় শাস্তি দিস না রে দিদি।"

 -----"তোর কি দোষ রে? যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারের চিন্তা যেদিন থেকে মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেদিন থেকেই পরিবারের ভেতর ভাঙ্গন ধরা শুরু হয়েছে। আর এই ভাঙ্গনে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো। প্রয়োজন, অভাব ,চাহিদা এগুলো যেন বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে। আর মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা, বিবেক ,নৈতিকতা এই মানবিক শব্দগুলো কেঁদে মরছে একা একা।"

 -----"তোকে কত খুঁজেছি রে দিদি। আমায় ক্ষমা কর।"

 -----"আমায় বলতো দেখি, তুই এখানে কি করে এলি?"

ভাই বোনের সুখ-দুঃখের কথোপকথন যেন আবার নতুন করে শুরু হলো। পুলিশ সূত্রে খবর পাওয়া যায় অমরেশবাবুর ছেলে বাপান বলেছে যে, তার বাবা নিজেই ঘর ছেড়ে চলে এসেছেন। এইসব কথা শুনে অমরেশবাবুও পুলিশের কাছে আর কোন পাল্টা অভিযোগ করেননি। তিনি তাই'ই মেনে নেন। কারণ তিনি তার আপন দিদিকে খুঁজে পেয়ে গেছেন এতদিন পর। আর নিজের ছেলের কথা লোককে জানিয়েও বা কি হবে।

রাখীর দিন সকালবেলা...

 -----"হাতটা দে তো দেখি।"

অমরেশবাবুর হাতটা নিয়ে সরলাদেবী একটা লাল-হলুদ সুতোর রাখী পরিয়ে দিলেন তার হাতে। আর বললেন-

 -----"আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক তো চিরন্তন। তাকে আরো দৃঢ় করলো এই শেষবেলার রাখীর বন্ধন।"

 -----"তুই আমার হাতে রাখী পরালি, কিন্তু আজ তোকে দেওয়ার জন্য আমার কাছে আর কিছুই নেই রে দিদি।"

 -----"কে বলেছে নেই ? তোর গলার গান তো আছে। প্রত্যেকবার রাখীতে আমার জন্য যে গানটা গাইতিস, একবার গা তো দেখি।"

 " রাখী পূর্ণিমা যে, আজ পুণ্য তিথি,

 বোন ভাইয়ের হাতে বাঁধবে যে রাখী।"

এই শেষবেলায় বৃদ্ধাশ্রমে এসে দুই ভাই বোন আবার তাদের পুরোনো স্মৃতিগুলোকে নতুন করে অভ্যর্থনা জানালো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract