অপবিত্র গঙ্গা
অপবিত্র গঙ্গা
উফ্! আর কতদিন এইভাবে চুপচাপ বসে থাকতে হবে নয়না বুঝতেই পারছে না। ওর রান্নাঘরে যাওয়া বারণ, ঠাকুরঘরে যাওয়া বারণ, আবার ঘরের মধ্যে এটা সেটা ছোঁয়াও বারণ। ছোট্ট সোনাটাকে নিয়ে সারাক্ষণ ঐ কোণার ঘরটার মধ্যে বসে আছে। বাথরুম ছাড়া ও আর ঘরের কোথাও যেতে পারছে না।
দেড় মাস হল নয়না এখন একটি কন্যা সন্তানের মা। বাপের বাড়িতেই থাকে ও। একমাসে আঁতুড় উঠেও গেছে। ঠাকুরমশাই দিয়ে বাড়িতে পুজো হয়েছে। শান্তির জল ছিটানো হয়েছে। তবুও নাকি আবার গঙ্গাস্নান সেরে ওকে শুদ্ধ হতে হবে। নয়না ওর মাকে অনেকবার বলেছে যে এখন ওর সেলাইটা কাঁচা, কিছু সংক্রমণ ছড়াতেই পারে কিন্তু উনি শুনবেন না। উল্টে গঙ্গা জলে স্নান করলে এখন সংক্রমণ ছড়াতে পারে এই কথাটা উনি মোটেও মেনে নিতে পারেননি। বাচ্চাটাকেও নাকি গঙ্গায় স্নান করাতে হবে। নয়নার আর মোটেও এইসব ভালো লাগছে না। কাওকে কিছু বলারও তো উপায় নেই।
নয়না যখন দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন ও জানতে পারে ওর স্বামী অভিরাজ তার বিধবা বৌদির সাথে সম্পর্কে জড়িত এবং সে সম্পর্ক এতই গভীর যে একদিন নয়না ওর স্বামী আর বৌদিকে একসাথে এক বিছানাতে যৌন খেলায় মাততেও দেখেছে। নয়না আর একটুও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এসেছিল ও বাড়ি থেকে। অভিরাজ অবশ্য ওকে বারবার বিশ্বাসের নামে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ও থাকেনি। অভিরাজ তো বিচ্ছেদটাও এখনো পর্যন্ত দিতে চাইছে না তবে নয়না আর ওর সাথে থাকবে না। বিচ্ছেদ ও নেবেই।
নয়না যেহেতু উচ্চপদস্থ একটা সরকারি চাকরি করে তাই ওর আর্থিক দিক দিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। আর ঐ জন্যই অভিরাজ নয়নার সাথে অন্যায় করলেও ওকে বিচ্ছেদ দিতে রাজি হয়নি। এমনকি নয়নার বাপেরবাড়ির অবস্থাও ভালো তবে তারা এখনো পুরনো ধ্যানধারণাতেই বিশ্বাসী। তাদের মতে নয়নাকে অন্যায় সহ্য করে মানিয়ে নেওয়াই উচিত ছিল। নয়নার মা,বাবা, দাদা,বৌদি কেউই নয়নার কষ্টটাকে বোঝেনি। আসলে বোঝেনি বলা ভুল, বুঝতে চায়নি। এমনকি নয়না লক্ষ্য করেছে ওর দাদা-বৌদি ওদের পাঁচ বছরের মেয়েটাকে পর্যন্ত ওর কাছে আসতে দিতে আটকায়। কানাঘুষয় নয়না শুনেছে ওরা আলোচনা করে নয়না নাকি খারাপ মেয়ে হয়ে গেছে, যে মেয়ে স্বামীর ঘর করতে পারে না সেই মেয়ের নাকি চরিত্রের দোষ আছে, তাছাড়া ওর নাকি চাকরি করে অহঙ্কার বেড়েছে। তবে এবার নয়না ঠিক করে নিয়েছে এই বাপেরবাড়িতে আর বেশিদিন ও থাকবে না। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বা ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে আলাদা থাকবে। সেখানে বাচ্চাটাকে সামলানোর জন্য দেখেশুনে একটা ভালো লোক রেখে দেবে ও। কারণ অফিস তো যেতে হবে ওকে। আর অফিস না গেলে সংসার চলবে কি করে!
ভাগ্যিস বিয়ের আগেই ওর কপালে ভালো একটা সরকারি চাকরি জুটে গিয়েছিল নাহলে ওর পথটা আরো কঠিন হয়ে যেত। যদিও নয়নার বাবার একটা বড় ব্যবসা আছে, দাদাও সরকারি স্কুলের শিক্ষক, তবুও,,,। পরের ওপর ভরসা করার নমুনা ও জেনে গেছে।
***********
আজ অফিস ফেরার পথে বাজার করতে গিয়ে নয়নার বাড়ি ফিরতে মনে হয় অনেকটাই দেরী হয়ে যাবে। তারমধ্যে আবার গঙ্গাজল আর গঙ্গামাটি নেওয়া এখনো বাকি। শ্যামবাজার থেকে গুছিয়ে বাজারটা সেরেই নয়না গঙ্গার ঘাটের দিকে পা বাড়ালো। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে নয়না একটা পরিষ্কার সিঁড়ি দেখে বাজারের ব্যাগগুলো রেখে একটা ছোট কৌটো'য় গঙ্গাজল আর নামমাত্র একটু গঙ্গামাটি একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে নিলো। তারপর তাড়াতাড়ি করে নয়না গঙ্গার ঘাট থেকে বেরিয়েই পাঁচ মাথার মোড়ের বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। একটাও বাস নেই, একটা যাও বা এলো তাতে যা ভিড় অত গুলো ব্যাগ নিয়ে আর ওঠার মত অবস্থা নেই নয়নার। এদিকে বাজার হাট সব উঠে যাচ্ছে, দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাস স্ট্যান্ডে মানুষজনের সংখ্যাও হাতে গোনা। সত্যিই আজকে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। ঐদিকে ছোট্ট দুধের শিশুটার জন্যও নয়নার মন বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও যে আর ছিল না। কাল নয়না নতুন বাড়িতে ছোট করে একটু পুজো করবে। বাপেরবাড়িতে আর কতদিন! তাই ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, সেই বাড়ির'ই গৃহপ্রবেশ। তাই কালকের জন্য ফলমূল, সব্জি, দশকর্মার জিনিস সব বাজারহাটই করতে হয়েছে। কে আর ওকে সাহায্য করবে, সবাই যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাও বাচ্চাটাকে যে রেখে আসতে পারছে ঐ বাড়িতে নিশ্চিন্তে এটাই রক্ষা।
না, আর কেষ্টপুর যাওয়ার বাস একটাও চোখে পড়ছে না নয়নার। তাই বাধ্য হয়েই নয়না একটা স্যাটেল গাড়ি পেয়ে তাতে উঠে পড়ে। ঐ দিকে আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টিও নেমে পড়েছে। গাড়িতে শুধু একটা অবাঙালী লোকই বসে আছে আর ড্রাইভার। বাড়ির রাস্তা খুব বেশীক্ষণের নয় তবুও আজ যেন নয়নার মনটা বড়ই কু ডাকছে মাঝে মাঝে। হঠাৎ করেই গাড়িটা জোরে ব্রেক কষায় নয়নার যেন বুকটা ভয়ে ছ্যাৎ করে ওঠে। একটা ছেলে গাড়ির কাঁচের জানালাটা দিয়ে দুটো মদের বোতল গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। ফোনে আগেই মনে হয় ছেলেটাকে বলা ছিল। যাইহোক, তারপর গাড়ি আবার স্টার্ট দিল। গাড়ির ড্রাইভারটা কেরকম লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে মাঝেমাঝেই তাকাচ্ছে, এমনকি পাশে থাকা ভদ্র মানুষের মুখোশ পরা অবাঙালী লোকটাও নয়নার একেবারে গা ঘেঁষে এসেছে, নয়না খেয়ালই করেনি। গাড়িতে তো আর কেউ নেই। নয়নার এখন কি করা উচিৎ নয়নার মাথাতেই আসছে না। পাশে থাকা লোকটা হঠাৎ নয়নার হাত দুটো ধরে বলে ওঠে-
-------"আজকের রাতটার জন্য কত নেবে?"
-------"ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়। সরে যান বলছি। এই ড্রাইভার গাড়ি থামান, এক্ষুনি গাড়ি থামান। অসভ্য লোকজন।"
এই বলে নয়না চিৎকার করতে থাকে। ছোট ছোট জিনিসপত্রে কাঁধের ব্যাগটা এতটাই ভর্তি, ফোনটা যে ব্যাগ থেকে বের করবে তার উপায়ও নেই নয়নার কাছে। পাশে বসে থাকা ঐ লোকটা নয়নার হাতদুটো জোরে চেপে ধরেছে। তারপরেই শুরু হয় ওর সাথে জোর জবরদস্তি। নয়নার কুর্তির হাতাটা এমনভাবে ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ে গেছে যে ভেতরের ব্রায়ের স্ট্রিপটাও দেখা যাচ্ছে। কোনোরকমে লোকটাকে পা দিয়ে লাথি মেরে সরিয়ে নয়না গাড়ির মাঝের জায়গাটা দিয়ে গলে গিয়ে ড্রাইভারের সামনের সিটে গিয়ে বসে। গাড়ির সামনের কাঁচটার মধ্যে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে চেঁচাতে শুরু করে ও। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা একজন পুলিশের নজরে পড়ে যায়। নয়নার এই কান্ডে ড্রাইভার দুর্ঘটনা ঘটার ভয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। গাড়িটা থামিয়েই ড্রাইভার নয়নাকে খুব মারধর শুরু করে। নয়নাকে মারধর করে একটু শান্ত করে ড্রাইভার আবার গাড়ি নিয়ে চলে যাবে ভেবেছিল কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ এসে ওদের হাতে নাতে ধরে।
পুজোর জন্য বাজার করা সব জিনিসগুলো গাড়ির মধ্যে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কোনোরকমে সেগুলো গুছিয়ে পুলিশ তাদের ভ্যানে করে নয়নাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে যায়।
পাড়াপ্রতিবেশীরা বাড়ির সামনে পুলিশ ভ্যান আর নয়নার আলুথালু বেশ দেখে তাদের কূটকচালি শুরু করে দিয়েছে। মেয়েকে দেখে আর পুলিশের মুখে সব কথা শুনে নয়নার মা বাবার মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। দাদা বৌদিও যা নয় তাই ভাষায় নয়নাকেই গালমন্দ করতে শুরু করেছে। নয়না নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। ও নাকি সমাজে মুখ দেখানোর যোগ্য নয়। নয়না ওদের কথাগুলো শোনার পর আর কিছু বলতে পারেনি। বাজারের ব্যাগগুলো মাটিতে ফেলেই চোখের জল মুছতে মুছতে ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে।
***********
-------"নয়না শোন্"
গঙ্গায় জল ভরতে এসে নয়নার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন নয়নার মা। কালকের ঐ ঘটনায় গাড়িটা থেকে গঙ্গাজল আর মাটিটাই নেওয়া হয়নি নয়নার। তাই আজ ভোর হতেই মা মেয়ে গঙ্গায় এসেছে, আর তাছাড়া অনেক জিনিস আবার নতুন করে কিনতে হবে, ওগুলোও হয়তো গাড়িটাতেই পড়ে রয়েছে। ছোট মেয়েটা ওর বৌদির কাছেই রয়েছে।
-------হ্যাঁ মা বলো, কি বলবে?"
-------"দেখ বাড়িতে সবার সামনে কাল জিজ্ঞেস করতে পারিনি। কালকে যা ঘটেছিল,,,,মানে,,,ওরা তোকে এমন কিছু,,,,,"
-------"বুঝতে পেরেছি। তুমি জানতে চাইছ আমি নষ্ট হয়ে যায়নি তো? না মা। আমি তো নষ্ট হইনি। তবে ওই লোকটা জানো আমায় একেবারে জাপটে,,,,,,"
-------"জাপটে কি বল? দেখ্ আমায় কোনো কথা লুকোস না।"
-------"না মা লুকাচ্ছি না। আমি সত্যিটাই বলেছি। জানি এখনো তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তখন বৌদিও তো কত কথা বলল-আমি নাকি ধর্ষিতা, আমি নাকি পাপী, অপবিত্র হয়ে গেছি আমি।"
কথাগুলো বলতে বলতেই নয়না ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে হঠাৎ নীচে নেমে যায়।
-------"কোথায় যাচ্ছিস নয়না? পাগল হলি নাকি? বাচ্চাটার কথা চিন্তা করবি না একবারও?"
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নয়নার মা মেয়েকে আটকাতে ছুটলেন। ততক্ষণে নয়না গঙ্গায় নেমে পড়েছে। হঠাৎ করেই জলে এক ডুব দিয়ে উঠে ও মাকে বলে-
-------"ভয় পেও না মা, আমি নিজের কোনো ক্ষতি করবো না। মনে পড়ে, সেদিন আতুঁড় ওঠানোর জন্য আমায় গঙ্গা স্নান করে তুমি শুদ্ধ হতে বলেছিলে, এমনকি আমার ঐটুকু ছোট বাচ্চাটাও গঙ্গায় স্নান করে নিজেকে শুদ্ধ করেছিল। আজ আমি আবার গঙ্গায় ডুব দিয়ে স্নান করলাম। আমার সাথে যাই হয়ে যাক মা, তোমার কাছে আমার তো তাহলে শুদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিৎ। তাই না মা? গঙ্গা তো একজন নারী। তার বুক দিয়ে এত ময়লা বয়ে গেলেও সে কিন্তু অপবিত্র হয় না মা। তাহলে আমি কেন? আমার মত অন্য মেয়েরাও বা কেন? কেন অপবিত্র হয় মা? কেন? আমি যদি অপবিত্র হয়ে থাকি তাহলে সেই অপবিত্রতা আজ গঙ্গায় স্নান করে তাকে দিয়ে গেলাম, সেও হল আজ থেকে অপবিত্র। সেও হল অপবিত্র গঙ্গা।"
এই বলে নয়না কাঁদতে কাঁদতে আবার জল থেকে উপরে উঠে আসে। নয়নার মায়ের চোখেও আজ জল। গঙ্গার ঐ পারে কয়েকজন পুরোহিত গঙ্গা পুজো করতে জলে নেমেছেন। গঙ্গাকে প্রণাম করে মন্ত্র পাঠ করছেন। এই পারেও ভেসে আসছে সেই মন্ত্র-
"সদ্যঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যোদুঃখবিনাশিনী।
সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতিঃ।।"