Rinki Banik Mondal

Abstract Inspirational Others

3  

Rinki Banik Mondal

Abstract Inspirational Others

ভাত কাপড়

ভাত কাপড়

4 mins
179


"আসো গো, কত বেলা হয়ে গেল। আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের?"

সুরবালার গম্ভীর গলার আওয়াজ পেয়েই ওর জা আর দুই ননদ তাড়াতাড়ি বৌয়ের কাছে গেল। বিয়েবাড়ি মানেই সব একেবারে গল্পে মশগুল, অনুষ্ঠানের নিয়মনীতির সময় অথচ পেরিয়ে যাচ্ছে!

সুরবালার একমাত্র সন্তান দিব্যর সাথে রাশির বিয়ে হয়েছে। আজ দুপুরে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান। সুরবালা সব দিক সামলাতে সামলাতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে।

সাজানো ভাতের থালাখানা এবার দিব্য রাশির হাতে তুলে দেবে। দূরে দাঁড়িয়ে সুরবালা তার দুচোখ বন্ধ করে শুধু ঠাকুরকে ডাকছে। ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ওর সাথে ঘটা পুরোনো কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।

*******************

সুরবালা ছিল গরীব ঘরের মেয়ে।দেখতে শুনতেও অত ভালো ছিল না। তবে মনের দিক দিয়ে খুব ভালো মানুষ ও। সুরবালার শ্বশুরমশাই প্রায়ই সুরবালার বাপেরবাড়ির কাছে আসতেন জমি দেখাশোনার কাজে। সেখান থেকেই পরিচয়। সুরবালার মা বাবাও রাজি হয়ে যান মেয়ের বিয়ে দিতে। সুরবালারও কোনো আপত্তি থাকে না। আর থাকলেও বা কে এই গ্রাম্য, অসুন্দরী, অশিক্ষিত মেয়ের কথায় তোয়াক্কা করতো! সবই ঠিক ছিল কিন্তু এই বিয়েতে নিজের ছেলের মতামত সুরবালার শ্বশুরমশাই হয়তো নেননি। সেইজন্য রাগে গজগজ করতে করতে বিয়েটা সারলেও বৌভাতের দিন দুপুর বেলাতেই আসল মূর্তিটা তার প্রকাশ পেল। ভাত কাপড়ের থালাটা যেই না তার হাতে দিয়ে নিয়ম পালনের কথা বলা হয়েছে উনি রেগে তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। সুরবালার মনের মধ্যে তখন যে কি চলছিল তা হয়তো ও আজও বলে বোঝাতে পারবে না।

সুরবালার স্বামী কোনোদিনই সুরবালাকে ভালোবাসতে পারেনি। তার স্বামী যে অন্য কাউকে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা তো আর হয়নি। নেশা করে করে সে তাই তার জীবনটাকে একেবারে শেষই করে ফেলে। সুরবালার শাশুড়িমা এর জন্য সুরবালাকেই দোষ দিয়েছিলেন। স্বামী হারানোর পর সুরবালা ওর শ্বশুরমশাইয়ের কথায় সেই ভিটেতেই শাশুড়ি, জা আর ননদদের অনেক অত্যাচার সহ্য করেও পড়ে ছিল। কিন্তু শ্বশুরমশাই গত হতে ও আর সহ্য করতে পারেনি। বাপেরবাড়িতে ফিরে এসেছিল। সেখানে এসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড়ি বিক্রি করে, কিছু সেলাই ফুরাই করে নিজের খরচ জোগাড় করে। সেখানেই হঠাৎ একদিন ভোরবেলা কল পাড়ের সামনে একটি সদ্যজাত শিশুকে কুড়িয়ে পায় সুরবালা। পুলিশ কাচারি করেও সেই শিশুটির বাবা মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুরবালাই সেই শিশুটিকে মানুষ করতে চায়। পাড়ার ক্লাবের সহায়তায় শিশটিকে সুরবালা দত্তক নিয়ে নেয়। সুরবালার মা বাবার অবশ্য এই বিষয়ে ঘোর আপত্তি ছিল।

সুরবালা শিশুটিকে কোলে পিঠে মানুষ করে। বাচ্চাটি একটু বড় হতেই সুরবালা জানতে পারে, বাচ্চাটি দুটো পায়েই জোর পায় না। ও বিকলাঙ্গ শিশু। সুরবালার মা বাবা সুরবালাকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। সুরবালা মুখ বুজে সব কথা সহ্য করে তবুও শিশুটিকে কষ্ট পেতে দেয় না। বাচ্চাটি গ্রামেরই একটি স্কুলে ভর্তি হয়। কথায় আছে না, ভগবান সব দিক দিয়ে মারে না! না, শিশুটিকেও সব দিক দিয়ে কষ্ট দেয়নি ভগবান। শিশুটি খুব মেধাবী হয়। শিক্ষকেরা ওকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন। একে একে সুরবালার মা বাবা গত হয়। ছেলেকে নিয়ে সুরবালা একদম একা হয়ে পড়ে। ছেলেটি ধীরে ধীরে বড় হয়। মাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করে। প্রথম দশজনের তালিকায় সুরবালার ছেলের নাম ওঠে। পাড়ার ক্লাব ও শিক্ষকদের সহায়তায় সুরবালা ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে। সুরবালা লোকের বাড়ি কাজ করে, একটা বস্তিতে ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করে। যতটা সহজ করে সুরবালার আর ওর ছেলের কষ্টটা কলমে উঠে আসে, বাস্তব কিন্তু ততটাই কঠিন ছিল।

সুরবালার ছেলে উচ্চমাধ্যমিকও ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে। হুইলচেয়ারে ভর করে ওর জীবন এগিয়ে চলে। নিজে টিউশন শুরু করে। সকলে ওর উচ্চশিক্ষার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সুরবালা যে সব বাড়িতে কাজ করেছে তারাও ওর ছেলেকে প্রচুর সাহায্য করেছে।

*****************

----"কিরে সুরবালা, তুই এইভাবে ঘামছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?"

বড় জায়ের কথায় সুরবালার সম্বিত ফেরে।

--------" না না। কিছুনা। তুমি যাও। ওদিকটা সামলাও।"

যে জা, যে ননদেরা সুরবালার সাথে একদিন নির্মম ভাবে অত্যাচার করেছে, তারাই আজ সুরবালার ছেলের বিয়েতে উপস্থিত। সুরবালা ওদের ডাকতেও চায়নি। ওরা নিজেরাই যোগাযোগ করেছে সুরবালাদের সাথে। তবে তাদের স্বভাব কিন্তু এখনো বদলায়নি। সুরবালার বৌমার কানে গিয়ে খবরটা দিয়ে দিয়েছে যে, " দিব্য সুরবালার রক্তের সন্তান নয়।" এ খবর তো দিব্যও জানে না। কিন্তু এবার কি হবে!

দিব্য আর রাশি দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। দিব্য পঙ্গু জেনেও রাশি ওকে স্বামীর মর্যাদা দিয়েছে। "দিব্যর নিজের মা বাবার পরিচয় অজানা"-এটা শুনে যদি রাশি এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাইত, সেই ভয়েই সুরবালা রাশিকে কিছু জানাতে চায়নি। তাছাড়া দিব্য'ই তো এইসব ব্যাপারে কিছু জানে না। সুরবালা সহজ সরল মানুষ। তার মন এটাই ঠিক বলে মনে করেছে। সুরবালার এখন একটাই ভয়, রাশি রাগ করে ভাত কাপড়ের থালাখানা ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তো! বিয়ের এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে চলে যাবে না তো!

---- "কিরে দিব্য বৌকে বল, আজ থেকে তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম। বল?"

দিব্য ভাত কাপড়ের থালাটা হাতে ধরে। রাশিও থালাতে হাত দেয়। দুজন একসাথে বলে- "আজ থেকে আমরা দুজন দুজনের ভালোমন্দের সঙ্গী হলাম।"

সুরবালার মুখে হাসি ফুটল। রাশি থালাটা রেখে ধীর পায়ে সুরবালার কাছে এসে বলল- " তুমি চিন্তা করো না মা। আজ থেকে আমি তোমারও বন্ধু হলাম। যে মা জন্ম না দিয়েও তার সন্তানকে এত সুন্দর করে বড় করে তুলেছে, সে মা কখনও খারাপ হতে পারে না। সে যখন কোনো কথা তার সন্তানের থেকে গোপন করেছে, নিশ্চয়ই তার সন্তানের ভালো চেয়েই করেছে। একথা আমি কোনোদিনও তোমার ছেলেকে বলবো না। তবে ও অন্য কোথাও থেকে যদি জানতেও পারে তখন আমি ওকে বুঝিয়ে বলব, তুমিও ওকে বুঝিয়ে বলবে। একটা কথা বলতে পারি, জীবনে এই সত্যিটার মুখোমুখি হলে ও কষ্ট পাবে না মা। আমি তোমার পাশে থাকব সব সময়। এবার চোখের জল মুছে ফেলো দেখি। তুমি না ডক্টর দিব্যেন্দু শাহু'র মা!"

সুরবালা রাশিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। শত কষ্ট জমিয়ে রাখা সুরবালার গুমোট মনটা আজ অঝোরে ঝরিয়ে দিচ্ছে বুকের মাঝে জমে থাকা দুঃখ যন্ত্রণা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract