Rinki Banik Mondal

Inspirational Others

3  

Rinki Banik Mondal

Inspirational Others

ঘুণপোকা

ঘুণপোকা

7 mins
367


----------"খোকা রে জানিস, আমার ঘরের কাঠের আলমারিটাতে ঘুণপোকা ধরেছে। ওটা একটু ঠিক করতে হবে। তোর বাবা থাকতে তো তিন-চার বছর অন্তর তাও কাঠের ঐ আসবাবপত্রগুলোকে বার্নিশ করাতো। কত বছর হয়ে গেল সেই সব তো হয় না। ঐ কাঠের দোকানের মিস্ত্রিকে একটু খবর দিয়ে দিস। সব ঠিকঠাক করে রঙ আর পালিশটাও করে দেবে।"

---------"মা, এবার ওটা বাদ দাও। নতুন একটা খাট আর আলমারি কিনে নিচ্ছি তোমার জন্য। ঐ পুরোনো জিনিসের প্রতি কিসের যে তোমার এত মায়া, বুঝিনা আমি।"

--------"তুই আর কি বুঝবি রে খোকা, সে আমার বিয়ের আলমারি ওটা। তোর দাদু শখ করে দিয়েছিল। তখনকার দিনের কাঠ, বুঝলি কিনা! তাই তো এতদিন কিছু হয়নি। আমিও তো মুছে-সুছে কত যত্ন করে রেখেছি। কিন্তু হঠাৎ যে এই ঘুণপোকার আবির্ভাব কি করে হলো কে জানে। আচ্ছা, তুই অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নে এখন। আমি রান্নাঘরে যাই। বৌমা আবার একা রয়েছে রান্নাঘরে। ঔ তো অফিসে যাবে। যাই আমি।"


সোহম আর বিপাশার বিয়ে হয়েছে মাত্র দুমাস। নতুন সংসার, নতুন জীবন বেশ ভালোভাবেই গুছিয়ে নিচ্ছে ওরা। নয়নতারাদেবী'ও মা- ছেলের এই ছোট্ট সংসারে তাঁর বৌমা বিপাশাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। তাঁর শুধু একটাই আপসোস যদি সোহমের বাবা অমলেশ রায় ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে পারতেন; কিন্তু বিধাতার বোধহয় সে ইচ্ছে ছিল না। দশ'বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অমলেশবাবু মারা যান। তখন সোহমের পড়াশোনাও শেষ হয়নি আর চাকরিও পায়নি ও। চার বছর হল ও একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। ততদিন নয়নতারাদেবী'ই এই সংসারটা চালিয়েছেন। যদিও অমলেশবাবু একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী ছিলেন। বেশ কিছু টাকা-পয়সাও জমিয়ে রেখে গিয়েছেন। কিন্তু বসে খেলে যে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়! তাই নয়নতারাদেবী তার সেলাই-ফুরাইয়ের কাজ আবার নতুন করে শুরু করেছিলেন। শাড়িতে ফলস্, পিকো করতেন। তাতে যতটুকু টাকা আসতো, তা মিলিয়ে আর ব্যঙ্কের থেকে কিছু টাকা তুলে মা-ছেলের ছোট্ট সংসার চলে যেত। তবে তিনি ছেলেকে উনার কষ্ট বুঝতে দেননি, এমনকি ছেলেকে চাকরি খোঁজার জন্য জোরও করেননি। তারপরে সোহম পড়াশোনা শেষ করে নিজের চেষ্টাতেই চাকরিটা পায়। সংসারের ভালো সময় আবার ফিরে আসে। সোহম নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। নয়নতারাদেবীও তাঁর ছেলের কথায় সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাছাড়া নয়নতারাদেবী এখন বয়সের ভারে জর্জরিত। আজ এটা, কাল সেটা লেগেই আছে। চোখেরও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

-------"বাহ্! আলমারিটা খুব সুন্দর হয়েছে তো বৌমা।"

--------"আমি কিনেছি বলে কথা!"

--------"হ্যাঁ রে মা, মেয়েদের চাকরি করার তো এই সুবিধে, নিজের ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করতে পারে। জানিস আমি খোকাকে সেদিন বললাম আমার ঘরের আলমারিটা'য় ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। একটু কাঠের দোকানের ছেলেটাকে খবর দিতে, সে আর দেয়নি।"

----------"একটা নতুন আলমারি তোমার ঘরে কিনে নিলেই তো হয় মা।"

---------"নাহ্ রে না, তুইও তো দেখি খোকার মত কথা বলিস। ঐ আলমারি আমি বদলাবো না। ওর সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।"

---------"আচ্ছা আমি বলে দেব তোমার ছেলেকে। তোমার ছেলের কাছে শুনলাম তোমার নাকি কোন বোন আসবে আজ বিকেলে।"

----------"হ্যাঁ রে, আমার এক মাস্তুত বোন। পাশেই থাকে। সেই তো তোদের বিয়েতে এসেছিল। তাই ফোন করেছিল, বলল-আজ আসবে। তুই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আছিস আজ একটু।"

--------"চেষ্টা করবো মা। কারণ অফিসে এখন খুব কাজের চাপ। ইয়ার এন্ডিয়ের মাস। আর বসকে আগে থাকতে বলাও নেই। তাই চেষ্টা করবো। আমি হোটেল থেকে খাবার অর্ডার করিয়ে দেব বিকেলে ওদের জন্য। তোমায় কিছু করতে হবে না।"

---------"নাহ্ রে না। হোটেল থেকে আর খাবার আনাতে হবে না। আমি সব সামলে নেব। বাড়িতে তো বাজার সব আছেই। আর বোন একাই তো আসবে বলল।"

---------"কি রে নয়ন, তোর বৌমা এখনো তো বাড়ি ফিরলো না,এত রাত হয়ে গেল। তুই বলে কিছু বলিস না। এতটা মাথায় তোলা ভালো নয়। একটু শাসনে রাখতে শেখ বৌমাকে।"

---------"নাহ্ রে, এখন ওদের অফিসে খুব চাপ। চলে আসবে এক্ষুনি। তাছাড়া খোকাও তো এখনো ঘরে ফেরেনি। ওর'ও রাত হয়।"

---------"এত ভোলা হোসনা নয়ন। খোকার কথা বাদ দে। ও তো ছেলে। আর বিপাশা ঘরের বৌ। বুঝলি? সব কিছু কিন্তু হাত ছাড়া হবে বলে দিলাম।"

---------"আমার আছেই বা কি, তো হাতছাড়া হওয়ার ভয়ও নেই।"

---------"তোর বয়সটা হয়েছেই সার, মাথায় এখনো বুদ্ধিটা খোলেনি। দেখেছিস, তোর ছেলের ঘরে কত দামি দামি আসবাবপত্র। আর তোর ঘরের আসবাবপত্রগুলো দেখ্। তোর ঘরের খাট-আলমারিটাও তো নতুন করে বানাতে পারতো। ওদের কি চোখ নেই?"

----------"কি বলছিস এইসব? ওরা আমায় অনেকবার বলেছিল পুরোনো আসবাবপত্রগুলো বদলানোর জন্য। আমিই রাজি হইনি। শুধু বলেছিলাম কাঠের আলমারিটায় ঘুণপোকা ধরেছে, ওটা একটু মিস্ত্রিকে ডেকে ঠিক করিয়ে নিতে।"

---------"তুই আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকিস না তো। তা যদি তুই ওদের মিস্ত্রি ডাকতেই বলিস, ওরা কি মিস্ত্রি ডেকেছে?"

---------"নাহ্ রে, ওরা কেউ সময় পায়নি। আমিও এই পায়ে ব্যাথায় যেতে পারিনা, চোখেও দেখি কম। আর কাঠের দোকানে খবরও দেওয়া হচ্ছে না।"

---------"ও আর হবেও না। দেখবি তোর আলমারি সমেত সব আসবাবপত্রই ঘুণপোকায় কেটে ছাড়খার করে দিয়েছে, এ আমি বলে দিলাম। শোন্, অনেক রাত হল। আমি চললাম এখন। নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমার ছেলে আবার আমার খুব যত্ন নেয়। ঠিক সময়মত গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আমার জন্য। জানে তো, মা একা যেতে পারবে না। চলি রে। আবার পরে আসবো একদিন।"


শুভাদেবী তো চলে গেলেন তাঁর কথা বলে কিন্তু তাঁর সেই কথা বলা বাক্যগুলোর মধ্যে অবস্থিত শব্দের কীটগুলো যেন নয়নতারাদেবীকে খুব সহজেই আক্রান্ত করে দিয়েছে। আসবাবপত্রের ঘুণপোকার মত তাঁর মনেও যেন ঘুণপোকা বাসা বাঁধলো আজ থেকে। যেগুলো তাঁর নরম মনটাকে ঠুকড়ে খেতে শুরু করেছে। তাঁর অহেতুক চিন্তাগুলো প্রশ্ন চিহ্নের রূপ ধারণ করেছে। তাঁর এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই কি তাহলে ছেলে আর বৌমা ইচ্ছে করেই কাঠের দোকানের ছেলেটাকে ডাকতে চায়নি? না কি ঐ ঘুণপোকা ধরা আসবাবপত্রগুলোর সাথে তারা তাদের মাকেও ফেলে দিতে চাইবে কোনোদিন?


----------"কি রে খোকা, কাঠের দোকানের ছেলেটাকে খবর দিয়েছিল?"

----------"ইস্! একদম ভুলে গেছি মা। আমি আজ এখনই অফিস যাওয়ার পথে খবর দিয়ে যাচ্ছি মা। তুমি রাগ করো না। কাজের চাপে মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিল।"

---------"বাজে কথা রাখ্ তো। তোদের ঘরে নতুন জিনিসপত্র আনার বেলা তো খুব মনে থাকে। আমার বেলা কেন মনে থাকে না বলতো? নিজেদের ইচ্ছেগুলো বলেই ফেল এবার। আমায় এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি তোরা তাড়াতে পারিস ততই তো ভালো বল? বুঝি রে, আমি বুঝি। বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার দিন আমার এগিয়ে আসছে।"

----------"মা, এইসব তুমি কি বলছ? এইভাবে কথা বলতে তো তোমায় কখনো দেখিনি। এত উত্তেজিত হয়ে গেছ কেন? একটু শান্ত হোও।


মা,,,,মা,,,,,ও মা,  কি হোলো? এই বিপাশা একটু এদিকে এসো তাড়াতাড়ি। মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।"

আর মনের ব্যথা দমিয়ে রাখতে পারেননি নয়নতারা দেবী। কদিনে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে রেখে না খেয়ে দেয়ে শুধু ঘরে বসে কেঁদেছেন। তাঁর বোনের বোঝানো কথাগুলোকে শুধু নিজের জীবনের খাপে বসানোর চেষ্টা করে গেছেন। তারপরে একসময় আর পারেননি। ছেলের কাছে ‌ক্ষোভ উগ্রে দিয়েছেন। নিজের শরীরের প্রতি করা এত দিনের অত্যাচারের মাশুল এবার তাকে শরীর দিয়েই দিতে হবে যে। উত্তেজিত হয়ে তাই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। বিপাশা বা সোহম কেউই অত খেয়াল করেনি যে ওদের মা তিন-চারদিন ধরে একদমই খাওয়া দাওয়া করেননি। এমনকি বিপাশা যখন অফিস থেকে ফিরে রাত্রিবেলা নয়নতারাদেবীকে খাওয়ার কথা বলেছে, তখন উনি যে কোনোভাবে কথাটা এড়িয়ে গেছেন। কখনো বলেছেন, খেয়ে নিয়েছেন আবার কখনো খাওয়ার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েও সেটা আর খাননি, পরের দিন ময়লার বালতিতে ফেলে দিয়েছেন। বিপাশাও অত খেয়াল করেনি। আসলে বিপাশা বা সোহম বুঝতেই পারেনি যে, এরকম কিছু হতে পারে।

আজ এই বাড়িটা বড়ই শান্ত। সকালবেলা ডাক্তারবাবু এসে নয়নতারাদেবীকে দেখে গেছেন। তাঁর জ্ঞানও ফিরে গেছে তখন। কিন্তু কারোর সাথে কোনো কথা বলছেন না। কিছু মুখেও তুলছেন না। তাই কিছু সময়ের জন্য বাড়িতেই তাঁকে সেলাইন দেওয়া হয়েছিল। তারপর সোহম আর বিপাশার অনেক জোরাজুরিতে দুটো বিস্কুট আর জল মুখে দিয়েছেন।

সোহম ওর নিজের ভুল বুঝতে পারছে, বিপাশাও অনুতপ্ত। একটা স্তব্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে আজ ঘরের আনাচে কানাচে। সন্ধ্যে হতেই সেটা যানো আরো বেশি বোঝা যাচ্ছে। কেবল নয়নতারাদেবীর ঘরে পুরোনো আলমারিতে ধরা ঘুণপোকার মৃদু কটরর কটরর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

পরেরদিন সকাল হতেই কাঠের মিস্ত্রি এসে নয়নতারাদেবীর ঘরের কাঠের আলমারিটাতে হাত দিয়েছেন। মিস্ত্রিটি ঠিক করেছেন, কাঠের আলমারিটার ক্ষতিগ্রস্থ অংশটি কেটে সেখানে নতুন কাঠ লাগাবেন। সোহম'ই মিস্ত্রিকে ডেকে এনেছে। সোহম আর বিপাশা দুজনেই আজ অফিস যায়নি। যদিও গতকালও মায়ের অসুস্থতার কারণে ওরা দুজনের মধ্যে কেউই অফিস যায়নি। নয়নতারা দেবী তখনো চুপ। হয়তো অভিমানের বিশাল বড় পাহাড়টা এখনো তার বুকের থেকে সরেনি। বিপাশা যেই তাঁর বিছানায় বসে তাঁকে একটু সুপ খাওয়াতে গেছে অমনি বোধহয় তাঁর চোখের জল বাঁধ ভাঙ্গল। তিনি ঐ মিস্ত্রিটির সামনেই ছেলে আর বৌমাকে বললেন-

---------"আমায় ক্ষমা কর তোরা। আসলে সেদিন শুভা যেভাবে আমায় কথাগুলো বলে গেল,,,,,,"

পুরো কথাটা শেষ না করেই আবার নয়নাতারাদেবী কাঁদতে থাকলেন। এই দেখে সোহম মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে বলতে থাকে-

----------"আমি জানতাম। এ আমার মায়ের মনের কথা নয়। আমার মা কখনো এরকম হতেই পারে না। তবে ভুল তো আমাদেরও ছিল। আমরা তোমার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। আমাকে শাস্তি দাও এর জন্য। মারো আমাকে। তবে তুমি রাগ করে এরকম না খেয়ে দেয়ে নিজেকে কোনোদিন কষ্ট দিও না মা।"

মা,ছেলেতে আজ নিজেদের সুখ দুঃখগুলোকে ভাগ করে নিচ্ছে আবার অনেকদিন পর। বিপাশার চোখেও জল। ভাগ্যিস সোহম আর বিপাশা সময় থাকতেই কাঠে আর মনে বাসা বাঁধা -এই দু ধরণের ঘুণপোকা'রই নিষ্পত্তি করতে পেরেছে। নাহলে হয়তো এই ঘুণপোকা আসবাবপত্রের সাথে সাথে এত মধুর সম্পর্কগুলোকেও কেটে শেষ করে দিত।

কিছুক্ষণে কাঠের মিস্ত্রিটিও কিছু একটা আন্দাজ করে নয়নতারাদেবীকে বলে উঠলেন-

---------"বুঝলেন মা জননী, এই ছোট মুখে একটা বড় কথা বলছি, কিছু মনে করবেন না। এই আসবাবপত্রগুলিতে ছয় মাস পর পর নিম তেল স্প্রে করে দেবেন কিঙবা নারিকেল তেলের সাথে কর্পূর মিশিয়ে আসাবপত্রের কোণায় দিয়ে দেবেন। দেখবেন আর ঘুণপোকার বাসা হবে না। সেরকমই আমাদের সম্পর্কগুলোকেও কিন্তু ভালোভাবে পরিচর্যা করে যেতে হবে। তাহলে সেগুলোও টিকে থাকবে, মজবুত হবে। তাতে ঘুণপোকা বাসা বাঁধবে না। আমি যা বলতে চাইলাম আশা করি সকলেই বুঝলেন। কি বলেন?"

আর যাই হোক, নয়নতারা দেবী আজ এইটুকুনি তো বুঝেই নিয়েছেন যে, আসবাবপত্রের মত নিজের বা পরিবারের কারো হৃদয়েই আর ঘুণপোকার বাসা বাঁধতে দেওয়া যাবে না।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational