Rinki Banik Mondal

Inspirational

3.4  

Rinki Banik Mondal

Inspirational

লাল রঙ

লাল রঙ

6 mins
237



------"বৌমা তোমাকে কতবার বললাম তুলিকাকে ঐ লাল রঙের ফ্রকটা পরিও না,,,,এত লোকজন এসেছে বাড়িতে,,,, নজর লেগে যাবে, তাড়াতাড়ি ঐ ফ্রকটা বদলে অন্য জামা পরাও।"


মা বৌদিকে বলল তুলিকাকে লাল রঙের জামা পরাতে না অথচ দেখো আমাকে একটা কটকটে লাল রঙের শাড়ি দিয়ে গেছে এখন সবার সামনে পরে বসার জন্য। মেহেন্দি পরানোর দিদিও চলে আসবে কিছুক্ষণ পর। শাড়ি পরে কি আর এইসব মেহেন্দি পরতে ভালো লাগে!


ধুর! মাকে কতবার বললাম আমার এত গাঢ় রঙের কিছু পরতে ভালো লাগে না আর শাড়ির এই লাল রঙটা তো পছন্দই হচ্ছে না, কিন্তু কে শোনে কার কথা! কবে যে এই শাড়ি কিনেছে দেখলামই না। যার জন্য আমি বিয়ের বেনারসীটাও হালকা রঙের নিলাম কিন্তু মা ঠিক এইসব শাড়ি কিনে আগে পরের অনুষ্ঠানে পরার জন্য রেখে দিয়েছে।


আমি রাহি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হল সবে। এম.এ করার ইচ্ছে থাকলেও বাবা মায়ের আর ইচ্ছে নেই আমি বেশি পড়াশোনা করি। কারণ মা বাবা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর তাই'ই হচ্ছে। কাল আমার বিয়ে। বাবাকে অনেবার বলেছিলাম এম.এ টা পড়ার ব্যাপারে। বাবা বলে ছেলের বাড়িতে কথা বলে নিয়েছে আমাকে পড়ানোর জন্য। এ আবার হয় নাকি? বাপেরবাড়ির লোকই বুঝল না আমার ইচ্ছের কথা, আবার নাকি শ্বশুরবাড়ির লোক বুঝবে! হাস্যকর!


বিয়েটা আমার দেখাশোনা করেই হচ্ছে। বাবার এক বন্ধুর ছেলে, মানিক রায়, রেলে চাকরি করে। আজকাল সব মেয়েরাই দেখি দেখাশোনার বিয়ে হলেও বিয়ের আগেই বরের সাথে ভাব জমিয়ে নেয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমিও বেশি আগ্রহী ছিলাম না এই বিষয়ে আর মানিকও তো দেখি এরকম। তবে বিয়ের পাকা কথা হওয়ার পর একবার ওর পাঞ্জাবী আর জামা প্যান্ট কেনার জন্য বৌদির সাথে গেছিলাম, ও'ও এসেছিল। তবে আমার সাথে কথা বলতে, ও শুধু হাসিটুকুই যা বজায় রেখেছিল ওর মুখে। আমিও তাই। বাধ্য হয়ে বৌদিই শুধু ওর সাথে কথা বলেছিল। ব্যস্ এইটুকুনিই। এবার কাল আবার ছাদনাতলায় দেখা হবে বরমশাইয়ের সাথে।


আমরা তিন ভাই বোন। দাদাভাই বড়। আমি মেজ, আর বোন আছে। দাদাভাইয়ের বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় চার বছর হতে চলল। ওর মেয়ে হয়েছে। সবে ছয়মাস হল। ঐ যে তুলিকা। আমার মিষ্টিরাণী। তাকেই তো মা লাল ফ্রক পরাতে বারণ করলো। আর আমার বোন উচ্চমাধ্যমিক দেবে।


--------"কৈ রে রাহি মা,,,,,একটু এদিক আয় দেখি,,,,কেরম লাগছে দেখি,,,,"


ঐ তো রাঙা ঠাম্মি এসে গেছে। সম্পর্কে উনি আমার বাবার মামী হয়, পাশেই থাকে।


-------"এই তো ঠাম্মি, কেমন আছ?"


-------"ওমা! এ তো একেবারে লক্ষী ঠাকুর। এবার মাথায় সিঁদুর খানা দিলেই হয়!


------ধুর! কি যে বল না! বিয়েটা আগে হোক, তারপর,,


------বাবহা! লক্ষীর যে দেখি আর তস সইছে না।"


আমি এক গাল হাসি দিয়ে পালিয়ে এলাম। রাঙা ঠাম্মি আমাদের বড় ভালো মানুষ। রাঙা ঠাম্মির হাতের সেই আচাড়,,,ওহ! দারুণ। কিন্তু ইদানীং রাঙা ঠাম্মি কেরকম যেন মনমরা হয়ে গেছে। রাঙা দাদু গত বছর মারা যাওয়ার পর থেকেই রাঙা ঠাম্মি মনের দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। মানুষটা যে ভেতরে ভেতরে কত কষ্ট পাচ্ছে তা রাঙা ঠাম্মির মুখের দিকে তাকালে বোঝাই যায়। তার ছেলেটাও তো একটা অপদার্থ যাকে বলে। একটা নেশাখোর। মাকে তো কথায় কথায় গালিগালাজ করে। কেরকম যেন হয়ে গেছে রাঙা ঠাম্মি এখন। আগে কত সুন্দর করে সেজে গুজে থাকতো। বয়স'ও যেন রাঙা ঠাম্মির রূপে মূর্ছা যেত। শরীরের গঠনে যেমন উঁচু, তেমনি ফর্সা গায়ের রঙ। সব সময় লাল পেরে শাড়ি, মাথার চুলগুলো সাদা হলেও তাতে খোঁপা খানা বেশ যত্ন করে বাঁধা থাকতো, আর ঐ সেই কপালের সিঁদুর,, বড় লাল টিপ,,,আহা! যেন দুর্গা প্রতিমার রূপ। কিন্তু সেই দুর্গা প্রতিমাকে যে আজ বড় এলোমেলো লাগছে। না আছে পরনে সেই লাল পার শাড়ি, না আছে যত্নের খোঁপা আর না আছে সেই লাল টিপ। না না, এইভাবে রাঙা ঠাম্মিকে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। যাই,,অন্তত কপালে একখানা টিপ পরিয়ে দিয়ে আসি।




---------"দিদিভাই,, তুই করিস কি?"


রাঙা ঠাম্মি তো এই বলে শান্ত হল কিন্তু আমার মা শান্ত হয়নি। আমার হাতটা ধরে টানতে টানতে ভেতরের ঘরে নিয়ে এলো। ব্যস শুরু হল পাঁচালি,,


--------"বলি তোর বুদ্ধি সুদ্ধি কি কোনোদিন'ও হবে না? তুই পরেরবাড়ি গিয়ে তো কথা শুনবি এবার। উনি একজন বিধবা মানুষ, তারে তুই লাল টিপ পরাচ্ছিস, তাও আবার তোর কপালের টিপটা খুলে দেওয়ার কি ছিল? বলি শুভ অশুভ তোর কি কোনো জ্ঞান নেই?"


উফ্ আমার মাও না পারে বটে। লাল রঙের এত রকমারি! আমার এগুলো আগাগোড়া মানতে ইচ্ছে করেনা, মানতে চাই না। যতটুকু করি লোক দেখানো। বিশেষ করে মাকে দেখানো। ঐ মানুষটাকে আমি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনা। ঐ তো দিদি মেহেন্দি পরাতে চলে এসেছে। যাই ঐ ঘরে যাই।


সবাইকে দেখছি, মা কোথায় গেল? এই তো গঙ্গা নিমন্ত্রণ করতে যাবে বলে মা এত তাড়াহুড়ো করছিল এখন সে কোথায়, তাকে তো দেখতে পারছি না। পিসিমণিকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলে মা নাকি যাবে না। কি হল ব্যাপারটা। একবার গিয়ে দেখি তো।


-------"কি হল মা, তুমি এখানে চুপ করে বসে আছ কেন? এই তো বললে গঙ্গা নিমন্ত্রন করতে যাবে। সবাই তো তৈরি, যাও।"


-------"না আমি যাব না।"


-------"কেন, কি হল? রাগ হল নাকি আবার কারোর ওপর?"


-------"শরীর খারাপ হয়ে গেছে, তাই আর শুভ কাজে হাত দেব না।"

-------"বাহ্ রে বা! আমাকে কপালে লাল টিপ, পরনে লাল শাড়ি, পায়ে লাল আলতা পরিয়ে তোমার মনের মত করে সাজালে, নিজেও শাখাপলা সিঁদুর আর লাল পেরে শাড়িতে নিজেকে সাজিয়েছ। এখন বলছ তুমি যাবে না?

-------"আহ্ পাগলামি করিস না। আমি যাব না।

------"আমি নই, তুমি এবার পাগলের মত কথা বলছ। লাল রঙ যদি এই পলা,শাড়ি,আলতা পরে এত শুভ হয়, তাহলে এই তোমার মাসিকটাও তো লাল। ঐটার জন্যই আমরা নারী। আমরা ধারণ করতে পারি। নতুনের সৃষ্টি করতে পারি। তাহলে আজ সেই লাল রঙকেই অচ্ছুত বানিয়ে দিলে?"



-------"তুই রাখ তো তোর জ্ঞানের কথা।"

-------"তুমি খুব ভালো করেই জানো মা, আমি জ্ঞান দিচ্ছিনা, সঠিক কথা বলছি মাত্র। শোনো মা একটা কথা বলি, তুমি রাগ কর না। স্বামী না থাকলে যে নারীর সিঁদুরের অধিকার চলে যাওয়া উচিত এটা কিন্তু তোমাদের ভুল ধারণা, আর লাল রঙের প্রত্যেক মাসের এই সামান্য বিষয়টাকে নিয়ে নিজেকে অচ্ছুত করে রাখাও তোমাদের একটা ভুল ধারণা। দেখো তোমার শরীরে কি হয়েছে সেটা বাইরের লোক বুঝবে না বা দেখতেও পাবে না। তুমি শুধু তোমার মনের ধারণাটাকে বদলাও, দেখো সমাজ ঠিক বদলে যাবে। কিন্তু শুরু তো তোমায় করতে হবে মা।

চলো যাও,গঙ্গা নিমন্ত্রন করতে।

-------"না, আমার মেয়ের এই শুভ কাজে কিছু খারাপ হোক আমি চাই না।"

-------"ব্যস্! আবার শুরু করলে? মা কখনো কোনো অবস্থায় সন্তানের খারাপ চায় না। মায়ের থেকে বড় শুভাঙ্খাক্ষী একজন সন্তানের কাছে আর হয় না। তুমি তৈরি হয়ে যাও। আর যদি তুমি না যাও তাহলে,,,, আমি কাল বিয়েটাই করবো না।"

-------"বাজে কথা রাখ। আমি যাচ্ছি শুধু তোর কথা শুনে, তোকে আমি খুশি দেখতে চাই রে সব সময়। তবে আমি কিছু ছোঁবো না।"

-------"তুমি যদি এই আচার গুলো নিজের হাতে আমার জন্য করো, আমি তাতে খুব খুশি হব। এইটুকুনিই বলতে পারি। বাকিটা তোমার ব্যাপার। একটা কথা কি বলতো, আমি যখন ছোট্টবেলায় খিদে পেলে কেঁদে উঠতাম তখন কিন্তু তুমি শত কষ্ট নিয়েও, এমনকি মাসিক অবস্থাতেও আমায় তোমার বুকের দুধ খাওয়িয়েছ। তাতে কিন্তু আমার খারাপ হয়নি মা।

-------"কেন কাঁদিয়ে দিলি বল তো আমায়?"

-------"আমি তোমায় কাঁদাতে চায়নি মা, বোঝাতে চেয়েছি। আর মা আমার আরেকটা কথা তুমি রেখো। রাঙা ঠাম্মিকে আঘাত দিয়ে কোনোকিছু বলো না। সেও কিন্তু একজন মা। আমাদের মতই একজন নারী। তাকে তার মনের ইচ্ছে, শখ থেকে বঞ্চিত করলে আমরাই পাপ করবো।"



খুব কেঁদেছি আজকে আমি আর মা দুজন দুজনকে জড়িয়ে। একে তো আমি চলে যাব দেখে মায়ের মনে একটা দুঃখ জমাট বেঁধেই আছে। তারমধ্যে আবার আজকে আমি যেন মায়ের চেনা বাঁধন গুলোকে আলগা করতে গিয়ে আরো কাঁদিয়ে দিলাম। আমারও যে খুব কষ্ট হয়। আমিও যে নারী। তাই হয়তো বুঝি আরেক নারীর কষ্ট।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational