Rinki Banik Mondal

Drama Tragedy

3  

Rinki Banik Mondal

Drama Tragedy

সাংসারিক রাজনীতি

সাংসারিক রাজনীতি

5 mins
374


---------"দিদি, তোমাকে তো বললাম আমিই রাতের রান্নাটা করে নেব। মা আমার হাতের পরোটা খেতে ভালোবাসেন। কে বলল তোমাকে রুটি করতে?"


---------"কেন রে ছোট, আমি কি তাহলে খারাপ রান্না করি তুই বলতে চাইছিস? এতদিন যখন তুই এ বাড়িতে আসিসনি, তখন কি মা আমার হাতের রান্না খেত না?"


মিত্তির বাড়িতে এই হয়েছে এক রোজকার ঝামেলা। দুই জায়ের মধ্যে এইটা সেইটা নিয়ে খুটুর খাটুর লেগেই আছে। ওদের স্বামীরা অবশ্য সংসারে এইসব মেয়েলী ঝামেলায় নিজেদেরকে জড়ায় না। যতটা পারে এড়িয়ে চলে। তারা তাদের মত সারাক্ষণ ব্যবসাপাতি নিয়ে ব্যস্ত।


বিনি এই বাড়ির বড় বৌ। বারো বছর ধরে এ বাড়িতে সংসার করছে। স্বামী, সন্তান, শাশুড়িমা, ঠাকুরপোকে নিয়ে বেশ ভালোভাবেই গুছিয়ে সংসার করছিল ও এতদিন কিন্তু একবছর হল এখন ঠাকুরপো বিয়ে করেছে। ছোট জা টিয়াকে, বিনি ওর নিজের বোনের মতই ভালোবাসে। টিয়াও বিনিকে বড় দিদির মত শ্রদ্ধা করতো, বিনির হাতে হাতে সংসারের কাজ এগিয়ে দিত। দুজনে একসাথে বাজারে যাওয়া, শাড়ি কেনা, গল্পগুজব লেগেই থাকতো। কিন্তু ইদানিং বিনি ওর ছোট জা টিয়ার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। টিয়া যেন সংসারের সব ব্যাপারেই ওর আগে আসতে চায়। যদিও দুই জা'ই সংসারে সব কাজ করার ব্যাপারে বেশ মনোযোগী। তবুও ইদানিং টিয়া যেন একটু বেশিই সব ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে। কে কি খাবে সকালে এমনকি কে কোন জামাকাপড় পরবে বাড়িতে সব টিয়াই ঠিক করে দিচ্ছে। বিশেষ করে ও ওর শাশুড়িমা হরিপ্রিয়াদেবীর প্রতি খুবই খেয়াল রাখতে শুরু করেছে।


হরিপ্রিয়াদেবী কিন্তু তাঁর এই দুই বৌ আর সংসার নিয়ে বেশ খুশি। সারাক্ষণ শাড়ির আঁচলে তাঁর আলমারির চাবিখানা বেঁধে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে আলমারি খানা সেই চাবি দিয়ে খুলে দেখছেন। কিন্তু বাড়িতে আর কারোর সুযোগ নেই তাঁর আলমারির ভেতর খানা দেখার। হরিপ্রিয়াদেবীকে বাড়িতে কোনো কাজই করতে হয় না। করতে হয় না বললে ভুল, বৌমারা তাঁকে কোনো কাজ করতে দেয় না। উল্টে তাঁর যত্ন নিতে বৌমারা সদাই ব্যস্ত।


বিনি একটু রাগ করেই আজ ও ওর শাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে টিয়ার এই পরিবর্তনের কথা জানায়। শাশুড়িমা বিনিকে বুঝিয়ে বলেন টিয়ার নাকি বুদ্ধিসুদ্ধি কম তাই এরকম করছে, সংসারের নিজের জায়গাটা বুঝে নিতে চাইছে। তাই উনি বিনিকেও সংসারে নিজের জায়গাটা শক্ত করে ধরতে বলেন, তা নাহলে নাকি এই সংসারে টিয়ারই আধিপত্য জমে উঠবে।


বিনিও ওর শাশুড়িমায়ের কথামত সংসারে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। আর তাতেই শুরু হয় আরো অশান্তি। এমনকি এদের দুই জায়ের মধ্যে ঝগড়া অশান্তি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, কেউ কারো মুখদর্শন পর্যন্ত করতে চায় না। ওদের মধুর সম্পর্কের সমীকরণটা যেন ধীরে ধীরে জটিল হয়ে চলেছে। অথচ সংসারে কোনো কাজে ওদের কোনো ত্রুটি নেই। দুজনেই শাশুড়ির মন জয় করার জন্য সব সময় তৈরি।


এমনকি এখন বিনি আর টিয়ার মনে গেঁথে গেছে যে, ওদের মধ্যে যে বেশি শাশুড়ি মায়ের মন যুগিয়ে চলতে পারবে তাকেই হয়তো শাশুড়িমা সম্পত্তির বেশিরভাগ অ়ংশ লিখে দেবেন।


অবশেষে একদিন এই সমস্যার সমাধান হয়। হরিপ্রিয়াদেবী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হন। তাঁর দুই বৌ তাঁর সেবা যত্নের কোনো খামতি রাখেনি। কিন্তু তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই প্রাণত্যাগ করলেন।


বিনি আর টিয়ার মধ্যে কেউ আর শাশুড়িমায়ের রাখা সম্পত্তির কেউ কারোর চেয়ে বেশি অংশ পেলো না। দুই ছেলের মধ্যে সম্পত্তির সমান ভাগ হয়েছে। এরই মধ্যে জানা যায়, টিয়া মা হতে চলেছে। বিনি আর টিয়ার মধ্যে আর আগের মত রেষারেষি নেই, নেই কোনো অশান্তি। ওরা কেরকম শান্ত হয়ে গেছে। ইদানিং দুই ভাইও খুব অবাক হয় ওদের স্ত্রী'দের আচরণ দেখে। পোয়াতি অবস্থার টিয়া কোনো কাজ না করতে পারলে বিনি এখন আবার এগিয়ে আসে ওকে সাহায্য করতে। সেদিন শাশুড়িমায়ের আলমারি খুলে দেখার সময় বিনি কাপড়ের ভাঁজে একটি চিঠি পায়। বিনি চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে দেখে চিঠিতে লেখা হাতের লেখাটা ওর খুব চেনা, যেন কোনো বাচ্চার হাতের লেখা। তারপরে চিঠিটা পড়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ!


"শোনো বৌমারা, প্রথমেই বলি আমায় ক্ষমা করো। তোমাদের দুই জায়ের মধ্যে আমিই ইচ্ছে করে এতদিন অশান্তি বাঁধিয়ে রেখেছিলাম। বড় বৌকে বলেছি সে যেন সংসারের হাল না ছাড়ে আবার আরেকদিকে ছোটবৌকে বলেছি যে আমায় বৃদ্ধবয়সে দেখবে তাকে একটু বেশি সম্পত্তিই দিয়ে যাব। আসলে আমার তো সেরকম কিছু ছিলই না। তোমাদেরকে মিছেই গল্প করেছিলাম আমার অনেক বাসনপত্র, গয়না আলমারিতে রাখা আছে বলে। আমি জানি তোমরাও সেই মোহেই শেষ বয়সেও আমায় এত যত্ন করেছ। আসলে আমার এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই নেই গো। তোমাদের দুই জায়ের মধ্যে যদি বেশি ভাব জমে উঠতো তাহলে তো তোমরা আমার চালাকি ধরে ফেলতে এমনকি দুজনে মতলব এঁটে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেও তো পাঠিয়ে দিতে পারতে! তাই খুব ভয় হত গো মায়েরা। আর তাতেই আমি দিনের পর দিন মিথ্যে কথা বলে তোমাদেরকে আলাদা করে রেখেছিলাম। আসলে এ হল সংসারের রাজনীতি। এই রাজনীতির খাতায় আমিও নাম লিখিয়েছিলাম গো। ক্ষমা করো আমায় তোমরা। আমি চলে গেলে এই চিঠিটা যদি কোনোদিন তোমরা হাতে পাও তাহলে আমায় ক্ষমা করো আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ মিটিয়ে নিও মায়েরা। আর এই চিঠিটা আমি বিল্টুকে দিয়ে লিখিয়েছি। ও চিঠিটা লিখে অনেকটাই বুঝেছে আমার মনের কথা। ওর বয়সটা মাত্র দশ হলে কি হবে জানো, ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি। ও আমাকে কথা দিয়েছিল এই চিঠির ব্যাপারে ও কাউকে কিছু বলবে না এমনকি ও আমার কথাও কাওকে বলবে না। ভালো থেকো তোমরা, আর এই পরিবারটা আগলে রেখো।"


বিনি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো সত্যিই এটা বিল্টুর হাতের লেখা‌। বিনি তড়িঘড়ি চিঠিটা নিয়ে টিয়াকে গিয়ে পড়ায়। চিঠিটা পড়ে টিয়ারও মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। ও ভাবে, এও কি সম্ভব! সত্যিই এতদিনে একটা জটিল সমস্যার সমাধান হল। নাহলে হয়তো ওদের মধুর সম্পর্কগুলো আরো তিক্ত হয়ে উঠতো, আরো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতো। টিয়া ওর শাশুড়িমায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠে-


-------"আমরা দুই জা তোমাকে এমনিতেই ভালোবেসে সেবাযত্ন করতাম, তারজন্য এগুলোর প্রয়োজন ছিল না মা। তবে জানিনা মা, আমাদের মতিভ্রম হতেও পারতো,নাহলে কি আর গয়নায় লোভে পড়তাম? তা যা করেছ ভালোই করেছ। তবে এইবার তুমি এই রাজনীতির খেলায় আমাদের হারিয়ে চলে যেতে পেরেছ, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তুমি আমার মেয়ে হয়ে আবার আমার কোলে ফিরে এসো। তখন আমরা দুই জা মিলে তোমাকে এই সাংসারিক রাজনীতিতে হারাবো তবে ঝগড়া অশান্তি দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে।"


কথাটা শেষ করেই টিয়া ওর বড় জা বিনিকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। বিনিরও চোখে জল।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama