প্রতিবন্ধী
প্রতিবন্ধী
-------"দিদিভাই একটু উঠবেন? আসলে বুঝতেই পারছেন এই অবস্থায় এত ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।"
-------"আমি পরের স্টপেজেই নেমে যাব। আচ্ছা এরকম পোয়াতি অবস্থায় বাসে উঠেছেন কেন? ট্যাক্সি করে গেলেই তো পারেন! শুধু শুধু লোককে বিরক্ত করেন। যত্তসব বিশ্রী ব্যপার!"
বুঝতে পারলাম, আবার সেই এক অবস্থা! একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বাসে উঠেছেন অথচ তাকে কেউ বসার জায়গা দিতে চাইছেন না। পুরুষ তো নয়ই, এমনকি বাসে উপস্থিত মহিলারাও নয়। এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করি কে জানে! মাঝে মাঝে বড্ড লজ্জা হয় মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে। না, আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম-
-------"এখানে বসুন।"
পোয়াতি ভদ্রমহিলা কোনোরকমে একটা বসার জায়গা পেয়ে আমায় ধন্যবাদ জানালেন। আমি একটু হাসলাম। বুঝতে পারলাম, উনার খুব কষ্ট হচ্ছিল দাঁড়িয়ে থাকতে। মানুষ হয়ে যদি মানুষের কাজেই না লাগতে পারলাম তাহলে এ মানুষ জন্মই বৃথা হয়ে গেল যে! হঠাৎ করে পাশের একটি লোক আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠলেন-
------"আপনি নিজেই তো প্রতিবন্ধী, অন্যকে দরদ দেখিয়ে আর ভালো সাজতে হবে না।"
উনার কথাটা শোনামাত্রই আমার সারা শরীরটা যেন হঠাৎ ছিটকে আসা একটা আগুনের গোলায় ঝলসে গেল। তবুও চুপ করে একহাতে লাঠি আর আরেক হাতে বাসের হাতলটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তবে সেই পোয়াতি ভদ্রমহিলাটি বাসে বসে থাকা সকলের উদ্দেশ্যেই জবাব দিয়েছেন।
-----"উনি প্রতিবন্ধী হয়ে যে কাজটা এত সহজে করে ফেললেন, আপনারা প্রতিবন্ধী না হয়েও সেই কাজটা করতে পারলেন না। কেন বলুন তো?"
ভদ্র মহিলার কথা শুনে মনটা একটু শান্ত হল। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার টুকরো কিছু ঘটনা।
আমি অপরাজিতা সান্যাল। পেশায় একজন শিক্ষিকা। জন্ম থেকেই চোখে দেখতে পাইনা। প্রতিবন্ধী বলে সবাই আমাকে। তবে জানেন, আমার মা কোনোদিনও আমার অক্ষমতাকে বড় করে দেখেননি। বরঞ্চ আমার এই ছোট্ট প্রতিবন্ধটাকে কাজে লাগিয়ে আমাকে অনেক বেশি সাহসী করে তুলেছেন। খুব ভালো আছি আমি। ছোট থেকে নিজে নিজেই যা
তায়াত করি সব জায়গায়। এখন ব্যাঙ্কে যাচ্ছিলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের এই জীবনে মনের চোখ দিয়ে আমি অনেক কিছু দেখলাম। এখনো দেখছি। জানেন, আমি ছোট থাকতে মায়ের একবার খুব জ্বর হয়েছিল। মায়ের জন্য আমি রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গিয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম উনুন পাড়ে যাওয়া। মাও আপত্তি করেননি। দুধ গরম করতে গিয়ে পাত্র ধরার কাপড়টায় আগুন ধরে গিয়েছিল। আরেকটু হলে আমার জামায় আগুন লেগে যেত। ভাগ্যিস আমার মা তখন রান্নাঘরে এসেছিলেন! হয়তো কিছু আন্দাজ করেছিলেন। তা নাহলে হয়তো আমি আজ আর এখানে থাকতাম না। তবে সেদিন আমার মা রান্নাঘরে আসার পর, আমাকে "বাবা-সোনা" করার পরিবর্তে বলেছিল- "ইস্! আমার বাসন ধরার এত ভালো কাপড়টা পুড়িয়ে ফেললি?" - এইভাবেই আমার মা আমাকে সাবলম্বী করে তুলেছিলেন। জানি এত সহজ করে কথাটা মা আমার মনে সাহস জোগানোর জন্যই সেদিন বলেছিলেন। তারপর থেকে এরকম কত বিপদ এসেছে,গেছে। তবে আমি বেশিরভাগ বিপদ থেকে নিজের চেষ্টাতেই রক্ষা পেয়েছি আর ভগবান তো সাথে আছেই। আমি নিজের কাজ নিজে করতে পারি। সব থেকে বড় কথা- আমার মা আমার মধ্যে মানবিক গুণগুলোকে খুব যত্নে লালন করেছেন। তাই হয়তো আমি অন্ধ হয়েও আজকের এই কাজটা করতে পারলাম, যেটা কিনা অন্য কেউ পারলেন না। আমি অহঙ্কার করছি বলে ভুল বুঝবেন না। তবে সত্যিই আমার কাছে আমি নিজেই গর্বের। এই কাজটা করতে পেরে আমি নিজে খুশি হয়েছি। আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনিও খুব খুশি হতেন।
আমি প্রতিবন্ধী বলে আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমার মা আমাকে একাই মানুষ করেছেন। বিয়ের জন্য কত সম্বন্ধ আমার ফিরে গেছে জানেন! তবে আমার মা তাতে দুঃখ করেননি। আমিও না। তারপরে চাকরি পাওয়ার পর আমাকে আমার মত করে মেনে নিয়েই বিয়ে করেছেন আমার এক কলিগ। পাঁচ বছরের বৈবাহিক সম্পর্কে আমি সত্যিই খুব খুশি। আমার দুই বছরের একটি ছোট্ট মেয়েও আছে। নিজেকে আদপেই প্রতিবন্ধীদের দলে ফেলা উচিৎ বা অনুচিৎ?- এইসব নিয়ে কোনোদিনও ভাবিনি। প্রতিবন্ধী হিসেবে আমি কোনো সুযোগ সুবিধেও চাইনি। তবে আজকের এই স্বার্থপর সমাজের চিন্তাধারা, প্রতিবন্ধকতা আমাকে সত্যিই ভাবাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, সত্যিই কি আমি প্রতিবন্ধী?