বঙ্কুর শহর যাত্রা
বঙ্কুর শহর যাত্রা
গোবিন্দপুর গ্রামের অতি সাধারন ছেলে বঙ্কু। বঙ্কু তার এই দীর্ঘ আঠেরো বছরের জীবনে গ্রামের বাইরে কখনও পা রাখেনি। তাছাড়া বঙ্কু একা একা চলাফেরা করতে খুব ভয় পায়। আসলে ছোট্ট বেলায় মায়ের সাথে মামার বাড়ি যেতে গিয়ে বঙ্কু হারিয়ে গিয়েছিল একবার । তারপর একবার মকর সংক্রান্তির মেলায় গঙ্গা সাগর গিয়ে মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছিল বঙ্কু। বহু কষ্টে বাবা,মা কে খুঁজে পেয়ে ছিল। ছোট থেকে এই সব ঘটনার জন্য বঙ্কুর খুব ভয় জমে আছে মনের মধ্যে। কিন্তু কিছু করার নেই বঙ্কু উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করায় কোলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে তাই বঙ্কুকে কোলকাতা যেতে হবে। তবে বঙ্কুর গ্রামের কোন বন্ধুরা চান্স পায়নি। তারপর বঙ্কুর বাবার শরীর খারাপ তাই অগত্যা বঙ্কুকে একাই যেতে হবে।
বুকের ভীতরে সাহস সঞ্চয় করে বঙ্কু দূর্গা... দূর্গা.... করে বেড়িয়ে পড়ল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে এসে দেখল ওর দুটো বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। বঙ্কুকে দেখে ওর বন্ধুরা বলল শিয়ালদহ স্টেশনে খুব ভীড় হয় মানুষের সাবধানে ব্যাগপত্র সামলে রাখবি। আর কলকাতার রাস্তা চিন্তে অসুবিধা হলে মোবাইলে গুগল ম্যাপ দেখে নিবি। কোন অসুবিধা হবে না স্টেশন থেকে বেড়িয়ে ট্যাক্সি করে নিবি। গুগল ম্যাপে যে রকম দেখাবে ঠিক সেই রকম রাস্তা দিয়ে যাবি অন্য কোন রাস্তা দিয়ে নয়।
বঙ্কু বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে বসল। কিছু ক্ষনের মধ্যে ট্রেন হুইসেল দিতে দিতে আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ঘন্টা চারেক জার্নি করে সকাল দশটা নাগাদ বঙ্কু শিয়ালদহ স্টেশনে নামল। সপ্তাহের প্রথম দিন তার ওপর অফিস টাইম শিয়ালদহ স্টেশনে ভীড় যেন উপচে পড়ছে। এত মানুষ দেখে বঙ্কুর মাথা যেন ঘুরে যাচ্ছে। নিজের ব্যাগ সামলে বঙ্কু এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। হঠাৎ করে বঙ্কু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভীড়ের মধ্যে পড়ে গেল। কোন রকমে ভীড় ঠেলে বঙ্কু শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে বেড়িয়ে এল।
তারপর বন্ধুদের কথা মত ট্যাক্সি ভাড়া করে গুগল ম্যাপ অন করে বসে পড়ল। কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর ট্যাক্সি ডাইভার বলল আপনিকি শেয়ারে যাবেন তাহলে ভাড়া কম পড়বে। বঙ্কু পয়সা কম হবে বলে রাজি হয়ে গেল। কিছু রাস্তা যেতেই আরও দুটো লোক উঠল ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গুগল ম্যাপের ডিরেকসন অনুযায়ী গাড়ি লেফ্টে যাওয়ার কথা কিন্তু রাইটে টার্ন নিয়েছে ব্যাস বঙ্কু চিৎকার করে ওঠে গাড়ি থামান এক্ষুনি, গাড়ি থামান বলছি! ট্রাক্সি ডাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয়। বঙ্কু বলে ওঠে আপনি অন্য রাস্তা ধরলেন কেন? এই রাস্তা গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছেনা?
ডাইভার বলল ওহ..... এই ব্যাপার আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম! এই সামনে এনাদের নামিয়ে দিয়ে আপনার রাস্তায় যাব।
বঙ্কু কিছুতেই ডাইভারের কথা মানতে নারাজ,কারন ওর বন্ধুরা ওকে বলেছে গুগল ম্যাপে যা দেখাবে সেইমত চললে কোন ভুল হবেনা।
ট্যাক্সি ডাইভারও বঙ্কুকে বোঝাতে অক্ষম। অনেকক্ষন ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে সবাই যখন ব্যার্থ হল তখন অগ্যতা বিরক্ত হয়ে ট্যাক্সি ডাইভার বঙ্কুকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে ভাড়া না নিয়েই ফুল স্পিডে ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে চলে যায়। আর বঙ্কু কিছুক্ষন বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে,তারপর গুগল ম্যাপ অনুযায়ী হাঁটা শুরু করে। অনেকটা রাস্তা হাঁটার পর বঙ্কু হাঁপিয়ে ওঠে। তারপর সব সময় গাড়ি, বাস চলতেই আছে রাস্তায় তাই বঙ্কুর হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু জল খায় বঙ্কু। তখন একজন বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাদবপুর যাদবপুর। বঙ্কু তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা দাদা বাসটা যাদবপুর যাবে? এখান থেকে যাদবপুর কতটা রাস্তা?
লোকটা বলে হ্যাঁ.... যাবে আর অনেকটা রাস্তা। বঙ্কু আর হাঁটতে পারছেনা তাই তাড়াতাড়ি করে বাসে উঠে পড়ে। ভীড় বাস কোন রকমে দরজার এক সাইডে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু। মোবাইল টাকে কোন রকমে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। কিছু রাস্তা যায় আর বাস দাঁড়ায়, লোক নামে যত তার থেকে ওঠে বেশি আর দরজায় দাঁড়িয়ে লোকটা বিভিন্ন নাম বলে চিৎকার করতে থাকে।প্রাই আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট পার হয়ে যাবার পর লোকটা চিৎকার করতে থাকে যাদবপুর, যাদবপুর।
বঙ্কু মুখ উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে দাদা...... যাদবপুর এসে গেছে কি......?
কনডাক্টার বলে ওঠে তুমি কি...... এতক্ষন ঘুমাচ্ছিলে? কখন থেকে চিৎকার করছি শুনতে পাচ্ছোনা।
বঙ্কু তাড়াতাড়ি করে বাস থেকে নেমে পড়ে জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা কলেজটা কতদূর। কনডাক্টার বলল দশ মিনিটের হাঁটা পথ।
বঙ্কু কিছু বলার আগেই বাস ছেড়ে দিল। বঙ্কু পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বার করতে গিয়ে দেখল মোবাইল নেই। বঙ্কু মাথায় হাত দিয়ে বলল যা চুরি হয়ে গেল! বঙ্কু মনে মনে বলতে লাগল বন্ধুরা বার বার সাবধান করেছিল আমাকে। যা এবার কি হবে? কি করে ম্যাপ দেখব!!! আশে পাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে কলেজে পৌছাল বঙ্কু।
কলেজের সমস্ত কাজ সেরে আবার বাড়ি ফেরার পথে রওনা দিল। তবে এবার আর বঙ্কুর কোন সমস্যা হলোনা কারন মোবাইল নেই, গুগল ম্যাপও নেই। যে পথ দিয়ে বাস নিয়ে যাচ্ছে সেই পথেই চলল বঙ্কু। শিয়ালদহ স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে যখন বাড়ি পৌছাল তখন রাত্রি দশটা।
পরেরদিন সকালে বন্ধুদের সাথে এবং সবার সাথে দেখা করে তার প্রথম দিনের কলেজ এবং প্রথম শহরে একা যাওয়ার বর্ননা দিতে লাগল। সবাই মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল। কেউ কেউ বঙ্কুর ট্যাক্সির ঘটনায় হাসতে লাগল আবার কেউ কেউ মোবাইল চুরির জন্য সমবেদনা জানাল আবার কেউ কেউ অনেক রকমের উপদেশ দিতে লাগল। আর বঙ্কু অবাক হয়ে সবকিছু শুনতে লাগল এবং এর পরের বার কলকাতা গেলে কি করবে আর কি করবেনা ঠিক করে নিল।