Pronab Das

Tragedy

3  

Pronab Das

Tragedy

বিসর্জন

বিসর্জন

4 mins
678


সজল আর মিতালি একসময় ছিল আমাদের স্কুলের চর্চার বিষয়। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে দুজনের মধ্যে যেমন ছিল বন্ধুত্ব আর তেমনি ছিল প্রতিযোগিতা। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান এই দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে সজল ও মিতালী ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মিতালীর বাবা এলাকার একজন মান্য গন্য ব্যক্তি হলেও সজল কিন্তু এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তার বাবা বড়বাজারে মুদিখানার দোকানে খাতালেখে, টুকিটাকি ফাই ফরমাশ খাটে। বার দুয়েক মাইল্ড হার্ট এট্যাকের পর কার্যত বসে গেছেন। ধারবাকী করে কোন মতে তাদের সংসারের চাকা গোড়াচ্ছে। এহেন অসম দুই অর্থনৈতিক পরিবারের দু জন যে এক ছাদনাতলায় পৌঁছতে পারবে তার কোন সন্মভাবনা সজলের নজরে পড়ছে না। কিন্তু ভালবাসা যে বড়ই একরোখা রোগ। একবার ধরলে মুশকিল। সামনেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। স্কুলে যদ্দিন ছাত্র ছাত্রী হিসেবে আছে তদ্দিন ঠিক আছে। কিন্তু স্কুল অর্থাৎ পড়াশোনা ছাড়লে মিতালীর সাথে নিশ্চিতরূপে দুরত্ব অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু সংসারের যা হাল তা না ধরে সুবোধ বালকের মত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা এই পরিবারে মানায় না, একটা নির্লজ্যের মত কাজ হয়ে যাবে। অসুস্থ বাবা আর রুগ্ন মায়ের ছল ছল চোখের দিকে তাকিয়ে তা কোন মতেই সম্ভব নয়।


স্কুল ফাইনালের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরল। যা আশা করা হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশী ঈর্ষনীয় নম্বরে সজল পাশ করল। বরং মিতালীর সে তুলনায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। বিকেলে দুজনে তাদের এক প্রিয় স্যারের বাড়ি থেকে ফেরার পথে গঙ্গার ঘটে খানিকক্ষণ বসল। খোসাথেকে চীনেবাদাম ছাড়াতে ছাড়াতে সজল বাড়ীর কঠিন পরিস্থিতিটা খুব সহজভাবে মিতালীর কাছে পাড়ল। মিতালী সজলের বাড়ির পরিস্থিতি অনুধাবন না করতে পারলেও সজল যে শীঘ্রই কোন চাকরীতে জয়েন করবে বলে মনস্থির করেছে জেনে খুব খুশি হল।


মাস তিনেকের মধ্যেই সজল সেনাবাহিনীতে চাকরী পেয়ে যায়। বাবা, মা মিতালী সবাই বেশ খুশি। আনন্দের অশ্রু, আশীর্বাদ ও ভালবাসা নিয়ে সজল চলল দেশ রক্ষার কাজে। মিতালীর সাথে কাটানো সেইসব সোনালী দিনগুলি আজ তার দিন কাটানোর বড় রসদ।বছরে এক দুবার সে বাড়িতে আসে কিছুদিনের জন্য। আগে চিঠিপত্র ও বর্তমানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ চলে। এভাবেই বছর চারেক কেটে যায়। 


মিতালী এখন স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকেছে। অনেক বন্ধু হয়েছে তার। অনেকটা সময় তাদের জন্য ধার্য থাকে। দিনের বেশির ভাগ সময় মিতালী মোবাইল ফোনে ডুবে থাকে। বিষয় টা সজলের কাছে দিন কে দিন অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। মনে মনে সজল এনিয়ে একটু শঙ্কিত হয়। মিতালীকে কয়েকবার এব্যাপারে কথা বললে কথা ঘুরিয়ে দিতে থাকে সুচারুভাবে। সাজলের কয়েকজন বন্ধু বান্ধব সরাসরি ভাবে না বললেও পরক্ষ ভাবে মিতালীর এই চোখে লাগা বন্ধুপ্রীতির কথা শোনায় নি তা নয় কিন্তু সম্প্রতি মিতালীর ব্যাবহারে তাদের বলা কথাগুলি কেন জানিনা সজলের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।


দুর্গা পুজোর আর পনের দিন বাকি। অনেক কষ্টে সজল তার সাহেবকে মানিয়ে পুজোর সময় মাস দেড়েকের ছুটি মঞ্জুর করে নিয়েছে। মনে মনে সজল বেজায় খুশি। অনেক বছর পর পুজোতে সে বাড়ি থাকবে। সবার সাথে সময় কাটাবে। ভেবেই সে আনন্দে শিহরিত।


চতুর্থীর দিন সজল বাড়ি এল। সবার জন্য পুজোর জামাকাপড় কিনে এনেছে। অনেক বার ফোন করে মিতালী কে পাওয়া গেলেও বাড়িতে বিশেষ কাজ আছে বলে ফোনটা কেটে দেয়। পর দিন বিকেলে সেই গঙ্গার ঘটে মিতালীর সাথে দেখাকরে।ও যেন কেমন বদলে গেছে। সে মিতালী আর আজকের মিতালীর মধ্যে বিস্তর ফারাক। যে উপহার সামগ্রী সজল মিতালীর সামনে রেখেছে সেগুলি দেখার থেকেও এই মূহুর্তে সে তার মোবাইলে মেসেজ চেক করা বেশি প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। কার সাথে মিতালী এত জড়িয়ে পড়েছে। উত্তর সংগ্রহ করতে সজলের বিশেষ বেগ পেতে হয় নি। বিশ্বস্তসূত্রে সে জানতে পারে এই তিন বছরে সে একাধিক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এখনো ওর কলেজের এক সহপাঠীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।


আজ সপ্তমী। সজল মিতালীর হাত ধরে অনেক ঠাকুর দেখেছে। মনে হচ্ছে সে যেন সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে গেছে। নিজেকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বলে মনে হচ্ছে। সজল মিতালীকে আগামীকালও বেরনোর কথা বলায় সে জানায় আগামীকাল সে বাবা মা ও পরদিন অর্থাৎ নবমীতে তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবে বলে প্লান করা আছে। তবে দশমীতে সজলের সাথে সময় কাটাবে বলে এক প্রকার রাজি হয়েছে।


আজ দশমী, মিতালীর সাথে দেখা হবে। মণ্ডপের পেছন দিকে ক্লাবের ঠেকে সকাল থেকে সজল আকন্ঠ মদ খেয়ে চলেছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। পড়ার ঠাকুর আজ বিসর্জন হবে। বরণের পর মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। অদ্ভূত এক করুন বিদায়ের রেশ যেন মেখে আছে মায়ের মুখমণ্ডল জুড়ে। সতটা নাগাদ সজল মিতালীর কে ফোন করে ডেকে নেয় সেই পরিচিত গঙ্গার ঘাটে। আর একটু পরেই এ ঘাটেই মায়ের বিসর্জন হবে। কার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে দুলে দুলে হেটে এদিকে আসছে সে। রূপ যেন আজ তার ফেটে বেরোচ্ছে। শাড়ীতে যে বরাবরই ওকে অসম্ভব সুন্দরী লাগে। কাছে আসতেই নিজের নাকে শাড়ীর আঁচল চাপা দেয়। ভ্রু কুঁচকে বলে,.....


----তুমি মদ খেয়েছ?

----তোমাকে কিছু দেখানোর ছিল মিতালী।

সজল তার মোবাইল ফোন থেকে মিতালী ও তার সহপাঠী র কয়েকটি ঘনিষ্ঠ ছবি তাকে দেখায়।

----এগুলির মনে কি মিতালী?

শুধু ওই ছেলেটির সঙ্গে ই নয় আরো দুজন ছেলের সাথে থাকা পার্কে ঘনিষ্ঠ ছবি দেখানোর পর মিতালী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খানিক চুপ থেকে সে সজলের সাথে এঁড়ে তর্ক জুড়ে দেয়। সজলকে মাতাল ও তার দরিদ্র পরিবার সম্পর্কে নানা রকম কুরুচিপূর্ণ কথা বলে তাকে দমানোর বৃথা চেস্টা করে।

সজল থাকতে না পেরে তার বলিষ্ঠ দুহাতে মিতালীর গলা চেপে ধরে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ছটপট করতে করতে শান্ত হয়ে নীচে ঢলে পড়ে মিতালীর তুলতুলে নরম নিথর দেহটা।


ওদিকে থেকে ঢাকের শব্দ কানে আসছে। মাকে বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত। সজল মিতালীর শরীরটা চোখের জলে ধীরে ধীরে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে কয়েকটা ডুব দিয়ে উঠে আসছে।   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy