বিশ্বাস ঘাতক
বিশ্বাস ঘাতক
লাবণ্য বার তিনেক ফোন করে যখন অপু কে পেল না তখন রাগ করে ফোনটা খাটের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল
"আজ বাড়ি আসুক ওর এই রোজের নাটক আমার আর ভালো লাগছে না"
তারপর রান্নাঘরে গিয়ে কিছু বাকি কাজ সেরে নব কে স্কুল থেকে আনতে চলে গেল। এটা লাবণ্যর সংসারে নতুন কিছু নয়। আসলে অপু ফিরলেই রোজ একতরফা লাবণ্য ই বলে যায় কিন্তু খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে অপু। চুপ করে নিজের কাজ করে যায়, কোন কথার উত্তর দেয় না আর এতেই লাবণ্যের রাগ হু হু করে বেড়ে যায়
"আমাকে কি পাগল ভেবেছো ? এত কথা বলছি একটার উত্তর দিচ্ছ না কেন?"
অপু মুচকি হেসে লাবণ্যকে কাছে টেনে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে,
"তুমি যা বলছ সব ঠিক কারণ আমি অফিসে গিয়ে তোমার ফোন ধরতে পারি না, তাই কোন কথার উত্তর আমার কাছে নেই"
"কেন পারো না? তোমার অফিসের বন্ধুরা সারাদিন ধরে বউয়ের সাথে গল্প করে, আর তুমি একজন যে বউয়ের ফোন অ্যাটেন্ড করতে পারে না। আজকে তোমায় বলতেই হবে এর কারণটা কি?"
এবার অপু হেসে লাবণ্য কে ওর পাশে বসায়
"দেখো লাবণ্য তুমি তো জানো আমার অফিসের কাজের চাপ কতটা, আর ভালো কাজ করতে পারলে তোমাকে আমি আরো সুখে রাখতে পারব। একটা কথা বলো তো আমি তো রোজ তোমার কাছে আসি কলকাতায় থাকলে তবু তুমি এত ফোন কেন করো ? তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?"
এবার লাবণ্য যেন একটু ইতস্তত করে
"কি সব বলছ ? তোমাকে সন্দেহ করব কেন ? শুধু আর একটু বেশি সময় চাইছি তোমার কাছে"
এবার অপু লাবণ্যকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে
"তোমাকে ব্যস্ত রাখার জন্যই তো নব কে দিয়েছি"
লাবণ্য যেন এবার একটু লজ্জা পায়
"ছাড়ো এবার খাবে চলো"
তিন বছর হলো লাবণ্য আর অপুর বিয়ে হয়েছে। ওদের প্রেমের বিয়ে। তবু লাবণ্যের বাবা যতটা সম্ভব লাবণ্যকে সাজিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছেন। অপু মা লাবণ্য কে মেয়ের মতই ভালবাসেন । এখন উনি খুব অসুস্থ হওয়ায় লাবণ্য কে খুব একটা কাজে সাহায্য করতে পারেন না ।বেশিরভাগ সময়ই শুয়ে থাকেন ।চিকিৎসাও চলছে তবে বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি সেরে ওঠা টা বোধহয় অসম্ভব। এই তিন বছর বিবাহিত জীবনে লাবণ্যের সাথে অপুর কোন ঝগড়া হয়নি ।আসলে লাবণ্য একতরফা ঝগড়া করে অপু কোনদিন লাবণ্য কোন কথায় উত্তর দেয়নি কারণ অপু জানে লাবণ্যের মাথা গরম হয়ে গেলে ও অনেক কিছু বলে আবার পরে নিজের ভুল বুঝে ঠিক হয়ে যায। লাবণ্য অপুর কাছে স্বীকার না করলেও জানে অপুর মত স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি হলেও ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখেনি অপু। লাবণ্যের ইওকোন ইচ্ছা অপু কষ্ট হলেও পূরণ করার খুব চেষ্টা করে।
সেদিন অফিস থেকে ফিরেই অপু বলল
"কাল আমাকে তিন দিনের জন্য পাটনা যেতে হবে তুমি সাবধানে থেকো আর নব কে সাবধানে রেখো"
লাবণ্যর মনটা খারাপ হয়ে গেল বলল
"আবার বাইরে যেতে হবে ? শোনো সেই বারের মত হবে নাতো? সেইবার তুমি তিনদিন বলে দেড় সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরে ছিলে"
"না না এবারে তিনদিনের মধ্যেই ফিরতে পারব মনে হয়"
অপু পরের দিন অফিস বেরুনোর সময় জানিয়ে গেল ওর ফোনটা একটু প্রবলেম করছে তাই যখন দরকার হবে ওই লাবণ্যকে ফোন করে নেবে আর যদি খুব দরকার হয় তার জন্য অন্য একটা নম্বর দিল। লাবণ্যের মন এমনিতেই খারাপ অপু তিন দিনের জন্য চলে যাচ্ছে তাই এসব কথায় খুব
একটা কর্ণপাত না করে বলল
"তুমি সাবধানে থেকো আর ঠান্ডা লাগার ওষুধ খেও"
সেই আগের বারের মত প্রায় দিন পনেরো পর ফিরল অপু । লাবণ্য এর মধ্যে আর খুব একটা ফোন করেনি কারণ অপুর মা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তবে এবারে অপুকে দেখে লাবণ্যের যেন একটু পরিবর্তন হয়েছে মনে হল। অপু এমনিতেই খুব একটা বেশি কথার মানুষ নয়, তাও এবারে বাড়িতে প্রায় কথা বলছে না বললেই হয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে অন্য ঘরে চলে যাচ্ছে। লাবণ্য ভাবলো হয়তো মায়ের শরীর খারাপ এ ওর মনটা খুব খারাপ আছে। সংসারের নানা কাজ আর নবর দেখাশোনা করার পরে আর খুব একটা সময় বাঁচে না লাবণ্যের । তাও সেদিন একটা ব্লাউজ কিনবে বলে বেরিয়েছিল। হঠাৎ দেখা হল গগনের সাথে। গগন অপুর ছোটবেলাকার বন্ধু। তিন-চারটে বাড়ির পাশেই থাকে। লাবণ্যকে দেখেই গগন বলে
"লাবণ্য তুমি একটু আমার বাড়ি যেতে পারবে?"
"কেন কিছু দরকার আছে গগন দা?"
"হ্যাঁ তোমার সাথে কিছু কথা আছে যদি কিছু না মনে করো তো বলব"
লাবণ্য সেদিন গগনের সাথে ওর বাড়ি গিয়ে এমন কিছু শুনলো যা ওর জীবনের মোড় টাকেই ঘুরিয়ে দিল। অপু বেশ কিছুদিন ধরে ওর অফিসের এক সহকর্মীর সাথে সময় কাটাচ্ছে । শুধু তাই নয় তাকে নিয়ে বাইরে ও যাচ্ছে। আর খুব তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ে করে অন্য জায়গায় রাখার কথাও চলছে। গগনের আর অপুর একজন কমন ফ্রেন্ডের থেকে এই কথা গগন জেনেছে। কারণ অপু জানে গগনকে এইসব কথা বললে লাবণ্য ঠিক জেনে যাবে। লাবণ্যর জগৎটাই পাল্টে গেল। যে মানুষটাকে এত বিশ্বাস করে তার সাথে ঘর বেধেছে সেই আজ ওর বিশ্বাসকে ঘাত করল। জীবনে আর কাউকে লাবণ্য হয়তো বিশ্বাস করতে পারবে না। তবু মনটা কেমন যেন দোনোমোনো করতে লাগল ভাবলো যদি খবরটা ভুল হয় তাহলে ওর মত খুশি কেউ হবে না । তাই যাচাই করার জন্য অপুর অফিসের এক বন্ধুর বাড়িতে লাবণ্য গেল।
সেখরের মুখেও একই কথা শুনল। আরো কিছু নতুন কথা ও এখানে ও শুনতে পেল।
পরেরদিন বাড়িতে ঢুকেই অপু দেখল মা একা পাশের ঘরে শুয়ে। মা বলল
"বৌমা নব কে নিয়ে কোথাও বেরিয়েছে তুই ঘরে গিয়ে বস আমি আস্তে আস্তে একটু চা করে নিয়ে আসতে পারবো"
"না তোমাকে চা করতে হবে না তুমি শুয়ে পড়ো আমি ঠিক করে নেব" আবার একটু থেমে মাকে জিজ্ঞেস করল
"লাবণ্য নব কে নিয়ে কোথায় গেছে তোমাকে বলে যায়নি?"
"না কোথায় গেছে বলেনি তবে আসতে দেরি হবে এটা বলেছে"
অপু এক কাপ চা করে নিয়ে টেবিলে বসেই নজরে পড়লো টেবিলের ওপর রাখা একটা চিঠি তার ওপরে অপুর নাম লেখা আর হাতের লেখাটা লাবণ্যের তা অপু ভালো করেই জানে। চিঠিতে লেখা ছিল
আমার বিশ্বাস ঘাতক স্বামী,
তোমাকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতাম। তাই আজ যে কষ্ট পাচ্ছি তার জন্য আমি নিজেই দায়ী। তুমি যদি একবার আমাকে বলতে যে আমাকে তোমার আর ভালো লাগছে না, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো, বিশ্বাস করো আমি এক কথাতেই তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতাম । তোমার ভালবাসার অভিনয় কে আমি সত্যি ধরে নিয়েছি, তাই এটা আমার নিজের দোষ। ডিভোর্স ফাইল করে খবর দেবো। তুমি তোমার মনের মানুষকে নিয়ে ভালো থেকো আর নবর জন্য চিন্তা করো না, তোমার মত বিশ্বাসঘাতকের কাছে আমি আমার ছেলেকে রাখতে চাইনা। ওকে আমি ঠিক মানুষ করে তুলবো।
ইতি
লাবণ্য।