বিকেলের রোদ
বিকেলের রোদ
ধীর পায়ে রেস্তোরাঁর ফাঁকা টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। বুকটা বড় দুরুদুরু করছে। শকুন্তলা কথা দিয়েছে আজ আমার সঙ্গে দেখা করবে।মনটা ভীষণ আনচান করছে। কিভাবে আমি ওকে কথাটা উপস্থাপন করবো ও যদি রেগে যায় আমার কথায়? না! ও অমন মেয়েই নই। ওকে পাঁচ বছর ধরে দেখেছি স্নিগ্ধ, শান্ত নদীর মত, মিষ্টভাষী প্রশান্ত মুখ,মনে হয় মুখে কতো ছবি আঁকা। ও অফিসে কাজে যোগদানের পরেই ওকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়।আমি ঠিক করি ওকে আমার পার্সোনাল সেক্রেটারীর দায়িত্ত্ব দেই।যেমনি কথা তেমনি কাজ,আমার সব কথা মাথা পেতে নেয়।আমি বহু কঠিন কাজের দায়িত্ব দিয়ে দেখেছি,সে সব কাজ গুলো ভালোভাবে করেছে।রোজ অফিসে এসে দেখতাম,আমার টেবিল, আলমারি,সব সাজানো গোছানো।অনেকদিন ওকে বলেছি,এসব কাজ তোমার নয়।এসব কাজ করার জন্য অফিসে অনেক লোক আছে। ও শুধু শুনত আর চুপ করে নিজের কাজে চলে যেআমি বহুদিন ওর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনদিন ওর পরিবার সম্পর্কে কিছুই আমাকে বলে নি।ওর ব্যাক্তিত্ব ভালোবাসা মাখা মায়াবী মুখটি দেখে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। বহুবার কথায় কথায় ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টাও করেছি।সে বার বার কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে আমাকে বলত,"স্যার এবার একটি ভালোমেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন"।আমি কখনো নিজেকে অপমানিত বোধ করেছি।অনেকদিন দরকারী কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলিনি। ও কিন্তু আপন গতিতে চলতো,বুঝতে দিত না। এ নিয়ে অফিসে সবার মধ্যে কানাঘুষো কম হয়নি।আমি ওসবে পাত্তা দিইনি। শকুন্তলার কাজে দক্ষতা এবং সবাইকে আপন করে নেওয়ার জন্যে সবাই তাকে ভালোবাসতো।কদিন পর হঠাৎ ও আমার ঘরে এসে একটি দরখাস্ত নিয়ে বললো,স্যার আমাকে দুই মাস ছুটি দিতে হবে।আমি ওর দরখাস্ত হাতে নিয়ে বললাম ছুটি টা কি খুবই জরুরী? ও আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি বললাম কি সমস্যা আমাকে বলো,আমি যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারি? ও বললো ছুটি টা দিলেই আমার উপকার হবে, অন্যকোনো সাহায্যের দরকার হলে আপনাকে জানাবো।ছুটিটা আমার অত্যন্ত জরুরী।
অনিচ্ছা সত্বেও আমি ওর ছুটি মঞ্জুর করলাম।আমাকে ও ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে গেলো।আমি ভাবতে থাকলাম কেনো ও ছুটি নিলো?কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। অফিসে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম,শেফালী নামে এক কলিগ বললো, শকুন্তলা আর ওর মার দুজনের সংসার। শুনেছি ওর মা খুব অসুস্থ।এর থেকে বেশি কিছুই জানি না।
তারপর দুমাস কেটে গেলেও অফিসে আসেনি শকুন্তলা।এই দু মাস আমি আমার মনে কি যে যন্ত্রনা নিয়ে কাটিয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছি এর নাম কি বিরহ?না। আমিতো ওকে অন্ধের মত ভালোবাসি কিন্তু ও তো ভালবাসেনা।তবে কেনো ওর কথা ভেবে ভেবে আমি এত কষ্ট পাবো? ওতো আমার অফিসের একজন কর্মচারী,এরকম কর্মচারী তো অনেকেই আছে তাদের জন্যে তো কষ্ট হয় না।
তারপর একদিন অফিসে এসে দেখি শকুন্তলা এসেছে।আমার মনে খুব আনন্দ হলো।কতদিন হয় ওকে দেখিনি,মনটা আনচান করছে ওকে দেখার জন্যে।আমি ওকে ডাকলাম, ও আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ সেই শকুন্তলা নয়। উস্কখুস্ক চুল, বিদ্ধস্ত চেহারা,চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে।মনে হলো কতো ঝড় ঝাপটা ওর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।আমি ওকে বললাম,তুমি ঠিক আছো তো? কোথায় গিয়েছিলে? সে অনেক কষ্ঠে নিজেকে সম্বরণ করে বললো মা খুব অসুস্থ,চিকিৎসার জন্যে মুম্বাই গিয়েছিলাম।আমি বললাম এখন কেমন আছেন তোমার মা? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো এখন ভালো আছেন।এখন আসি স্যার,বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।এরকম কিছুদিন চলতে থাকলো।আমি লক্ষ্য করলাম,অফিসে সে মাঝেমাঝে আসছে না।একদিন ওকে ডেকে বললাম,কি হয়েছে শকুন্তলা?মাঝেমাঝে অফিসে আসছো না,কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলছো না,এমনকি আমার সাথেও না। ও কোনো কথা না বলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।আমি আবার বললাম তোমার অফিস বস আমি,তোমার অসুবিধার সব কথা আমাকে জানতে হবে।যদি কিছু না বলো আমি কিভাবে বুঝবো তোমার সমস্যা। শোনো শকুন্তলা আজ তোমাকে না বলে পারছি না,আমি তোমাকে ভালোবাসি।পাগলের মত তোমাকে ভালোবাসি।আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে।তোমার কি সমস্যা আজ আমায় সব কথা বলতেই হবে।এই বলে ওর হাত দুটো চেপে ধরি। ও হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো আমি সব জানি স্যার।কিন্তু আমি নিরূপায়,আপনার কথা রাখতে পারবোনা বলেই আপনার থেকে দূরে দূরে থাকি। আমি কি তোমার কাছে অযোগ্য? অন্যকারো সঙ্গে কি তোমার বিয়ের কথা চলছে? ও বললো না স্যার কোনোটিই নয়। একদিন সব কথা আপনাকে বলবো - না আজই তোমাকে বলতে হবে। ও বললো না স্যার আজ নয় অন্যদিন।এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি অবাক দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর সেদিন হঠাৎ ও একটি আবেদনপত্র নিয়ে আমার ঘরে ঢোকে।কাগজটি আমার সামনে রেখে বললো দেখুন স্যার,আমি বললাম এটা কিসের আবেদন?তুমি কি আবার ছুটি নিতে চাও? ও বললো আমি চাকরি ছেড়ে দেবো।আমি বিষ্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু ধমকের সুরে বললাম কি বলছো পাগলের মত,চাকরি ছেড়ে দেবে?তোমার কি সমস্যা আমাকে সব খুলে বলো আমি আমার সাধ্যঅনুযায়ী চেষ্টা করবো।কিন্তু তুমি চাকরি ছাড়ার কথা বলবে না।তোমার আবেদনপত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাও,আমি গ্রহণ করবো না।সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল না স্যার আমার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়।আমাকে কাজের থেকে অব্যাহতি দিন স্যার,এই বলে চেয়ার ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।ওকে থামিয়ে বললাম শোনো শকুন্তলা,আমি তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারি কিন্তু তার আগে তোমার সব কথা বলতে হবে এবং আমার সব কথা শুনতে হবে। শকুন্তলা বললো ঠিক আছে স্যার,এসব কথা আমি এখানে বলতে পারবো না।আমি বললাম ঠিকআছে আজ বিকেল ৪ টেতে সোনার বাংলা রেস্টুরেন্টে আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো। তুমি রাজি তো! ও মাথা নেড়ে সায় দিলো।আমি বললাম তোমার পত্রটি নিয়ে এবার যাও.... ও চলে গেলো।আমি ওর দিকে ঠায়...তাকিয়ে থাকলাম।আমার বুকে যেনো কে পাথর চাপা দিয়েছে।বুকের ভেতর কান্না জমাট বাঁধছে কিন্তু কাঁদতে পাচ্ছি না। বার বার নিজের কাছে প্রশ্ন করলাম কেনো এমন হলো।কি এমন কারণ আছে ও চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছে? নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বোবা কান্না নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পরলাম।ওই সময় ঘড়ির দিকে তাকালাম দেখি ৪ টে বাজতে ২ মিনিট বাকি। ভাবলাম এখনি শকুন্তলা এসে পড়বে আবার ভাবলাম হয়ত আবার আসবেও না আবার ভাবি মিথ্যে বলার মতো মেয়ে তো নয়। ও আসবেই ভাবতে ভাবতে দেখি শকুন্তলা এসে গেছে।আমার পাশে চেয়ারে ওকে বসতে বললাম,দেখি উস্কো খুস্কো চুল,কালচে মুখ। ও পাশে বসে চুপ করে থাকলো।আমি কথা তুললাম কিছু খাবে?চা - কফি, ও বললো না কিছুই খাবো না শুধু জল খাবো।সামনে জলের গ্লাসে জল ঢেলে সম্পূর্ণ জল ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
অনেক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থেকে আমি শুরু করলাম শোনো শকুন্তলা,আমার কিছু কথা - জানতো আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।তোমাকে আমার জীবনের সাথী করতে চাই।আমার মাকে রাজি করিয়েছি।তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।শুনেছি তোমার ঘরে তোমার মা অসুস্থ,তুমি কোনো চিন্তা করো না।তোমার মাকে আমি চিকিৎসা করিয়ে সারিয়ে তুলবো।তুমি কি কোনোদিনও বুঝতে পারোনি আমার মনের আকুতি?আমি কিছুতেই তোমাকে হারাতে চাই না তার জন্যে সব কিছু করতে রাজি।তুমি চাইলে চাকরি ছেড়ে দিতে পারো আমার ছোট্ট সংসার আগলে থাকবে।তোমাকে এসব কথা বলার সুযোগ দাও নি,আজ তোমাকে বলতেই হবে আমার কথা তুমি রাখবে।তোমার সব কথা আমি শুনবো।আমি তোমাকে শেষ বারের মত বলছি তোমাকে না পেলে আমি প্রাণে বাঁচবো না।
আমার কথা গুলো শকুন্তলা মন দিয়ে শুনছিল আর আঁচল দিয়ে বার বার চোখ মুচছিল কিন্তু কোনো কথার উত্তর দিচ্ছিল না। ও শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল,আমি ওকে আবার বললাম চুপ করো। দুঃখ, কষ্ট জীবনে সবারই থাকবে কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কিছুটা জল খেয়ে বললো, সবই বলবো,তাই এসেছি।আপনাকে কথাগুলি না বললে আপনিও আমাকে ভুল বুঝবেন এবং আমিও মোরেও শান্তি পাবো না।এতদিন যা বলেছি সব মিথ্যে কথা।আমি জানি আমাকে খুব ভালোবাসেন আমিও আপনাকে ভালোবাসি,শ্রদ্ধা করি।মাস ছয়েক আগে একমাত্র আপনজন মা মারা গেছেন।আপন বলতে কেউ নেই আমি খুব অসহায়া। ওকে থামিয়ে বললাম তোমার মা মারা গেলেও আমরা দুজনে ছোট একটা সংসার পেতে তোমাকে সুখী করবো।একথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো না! তা হয় না তা আর হবেও না।আমার কপালে এ সুখ নেই।আপনি চাইলেও আপনাকে বিয়ে করে আমি ঠকাতে পারবো না।আমি বললাম কেনো?তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? শকুন্তলা বললো,না স্যার, ও কথা বলবেন না।আজ যখন বলতে বসেছি সব সত্যি বলবো।আমি ক্যানসারের রুগী। ব্রেস্ট ক্যানসার,ডানপাশের ব্রেস্টটি কেটে বাদ দিয়েছে।তাতেও এই দূ্রারোগ আমার সমস্ত শরীরে ছেয়ে গেছে। ডাক্তার বাবু বলেছেন আমার বেঁচে থাকা আর মাত্র ৬ মাস।আমি হাল ছাড়িনি, আজই রাতের ট্রেনে মুম্বাই চলে যাবো।আমি এ অবস্থায় আপনার ভালোবাসার কি দাম দিতে পারি?আমাকে নিয়ে ঘড় বাঁধতে চান কিন্তু আমি নিঃস্ব, রিক্ত।এসব কি বলছো? কোনদিন তো আমাকে এসব বলনি,তবে কেনো বলনি।বললে মনে বড়ো আঘাত পেতেন।আরো বেশি ভালোবেসে ফেলতেন তাই আপনাকে আমি বলিনি।এই বলে শকুন্তলা কাঁদতে থাকলো অঝোরে, আমি নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।আমার যেনো মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়লো।এসব কি শুনলাম?তাহলে আমার শকুন্তলা .........
ও সেই দরখাস্ত ব্যাগ থেকে বের করে আমাকে বললো,এটা রাখুন আর পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন।এই বলে বেরিয়ে গেলো,আমি পেছনে ডাকলাম কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।দেখি হনহন করে যাচ্ছে।
দোকানে সাজানো প্লাস্টিকের প্রাণহীন মূর্তি গুলি সুন্দর পোশাক পড়িয়ে সাজানো তার মাঝে মিলিয়ে গেলো শকুন্তলা।।আমি যেনো দেখলাম আমার সামনে প্রাণহীন হাজারো প্লাস্টিকের শকুন্তলা। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু ওর চলে যাওয়াই দেখলাম।