বিজয়িনী
বিজয়িনী
অফিসে ঢোকার মুখেই দেখতে পেলাম মেয়েটি গেটের পাশে দেবদারু গাছটার নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে। গায়ে তাঁর আটপৌরে একটা পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি সেরকমই রংচটা ব্লাউজ। উসকোখুসকো মাথার চুল, তেল পড়ে না হয়তো অনেকদিন। চোখমুখ বসা রোগা ক্লান্ত চেহারা। গায়ের রং কুচকুচে কালো না হলেও বেশ কালো। না সে নিশ্চয়ই কোনও পাগলী নয়!
পাটকাঁটির মতো রোগা হাড় জিরজিরে একটা বাচ্চাও তার কোলে। বাচ্চাটিরও গায়ের রং তার মতোই কালো। খালি গা, কাঁদছে ঘ্যানঘ্যানিয়ে। বাচ্চাটি ছেলে না মেয়ে বোঝা দায়।
মেয়েটি অফিসে কার কাছে এসেছে আর কেন এসেছে জানি না। আমাদের অফিসে এরকম অনেকেই আসে। এই অফিস তো গ্রাম আর গরিবের জন্যেই। ব্লক ডেভেলাপম্যান্ট তথা পঞায়েত সমিতির অফিস। যিনি ব্লকের বিডিও তিনিই পঞায়েত সমিতির ইও। গ্রামের লোক অতসব ধাঁধাঁ বোঝে না। তবে বিডিও উচ্চারণটা সহজে হয়। এটাওটা আবেদন নিয়ে গেলে পাওয়াও যায়। সভাপতির মতো অত মিনিস্টার মিনিস্টার ভাব দেখান না।
তবে মুশকিল বিডিওরা প্রত্যেক দুতিন বছর অন্তর পালটে যান। কখনও তো বছরও ঘোরে না আবারও এক নতুন বিডিও, চেয়ারে।
আগের বিডিও সাহেব চশমা পরতেন, মুখটাও ছিল হাসি হাসি। রাশভারী এই নতুন সাহেব বা কেমন? দুদিন যেতে না যেতেই দরজায় ঢাউস এক পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছেন। মেঝেতে নতুন নরম তুলতুলে কার্পেট। কার্পেটের ওপরে ধুলোমাখা চটি পায়ে ঢুকতেও যেন কেমন বাধো বাধো ঠেকে। সাহেব নতুন নিয়মও একটা চালু করে দিয়েছেন। আরদালির হাতে স্লিপ দিয়ে অনুমতি নেওয়ার পরে ঢুকতে হয় তাঁর চেম্বারে।
বারোটা প্রায় বাজে! মেয়েটি গেটের সামনে সেই দেবদারুটার নিচে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে! বাচ্চাটার কান্না তখনও থামাতে পারছিল না বলে বারবার খুলে দিচ্ছিল স্তন। ক্ষুধার্ত শিশু ছিবড়ে বুক মুখে নিয়েও দিচ্ছিল
ছেড়ে।
সহকর্মী বন্ধু সুদীপ্তর আবার এসব একেবারেই সয় না। কিজানি হয়তো একটু বেশিই তাঁর দয়ামায়া। খইনি ডলছিল সে দরজায় দাঁড়িয়ে। মেয়েটিকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল সে। জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে? কার কাছে এসেছিস, কী দরকার?
মেয়েটি বাচ্চাটাকে ডান কাঁখে আকড়ে ধরে বাঁ হাতে তিনভাঁজ একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিল। বলল, জিআর-এর(গভর্নম্যান্ট রিলিফ- নগদ এক ইউনিট একশোকুড়ি টাকা ) জন্যে একটা দরখাস্ত লিখ্যে দিবি স্যার? ই বাচ্চার বাপটা হাসপাতেলে ভরতি, পেট্টে ঘা, কিচ্ছু খাইতে পারে না! ডাক্তারবাবু বইল্লেন অবস্থা নাকি ভাল না, ওষুধ লিখ্যে দিলেন, তারলাগ্যিই-!
মুদির দোকানের ফর্দের মতো টুকরো একটা প্রেসকিপশনও সে বের করল শাড়ির আঁচলের গিঁট খুলে।
সুদীপ্ত সেই ফর্দের দিকে কিছুক্ষণ থ হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কত টাকার ওষুধ, কত টাকা লাগিবে, ডাক্তার কিছু বলেছে?
‘ডাক্তারবাবু বইল্লেন চারিশো টাকার মতো নাকি লাগিবে?’
‘ও .. তবে আয় আমার সঙ্গে’, সুদীপ্ত ওকে নিয়ে এল অফিস ঘরে। ওর দেওয়া আধাস্কেপ কাগজটার ওপরেই একটা দরখাস্ত লিখে জিজ্ঞেস করল, সই করতে পারিস?
মাথা নাড়ল সে। না, সই করতে সে পারে না।
অগত্যা টিপসই।
কাঁখে বাচ্চা, হাতে দরখাস্ত, এগিয়ে গেল সে বিডিও’র চেম্বারের সামনে লাইনে দাঁড়াবে বলে। আজ সেখানে ছাত্রছাত্রীদের বড় ভিড়, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফর্মে বিডিওর সই নিতে হবে যে!
কিন্তু বিডিও সাহেব আজ বড় ব্যস্ত। মন্ত্রী আসবেন! এলাকার আদিবাসী উন্নয়ন নিয়ে তাঁদের জরুরি মিটিং। তাছাড়া আগামী মাসেই আদিবাসী সংস্কৃতি উৎসব। সেই ব্যাপারেও মন্ত্রী নীতি নির্দেশিকা দিয়ে যাবেন কিছু।
আধিকারিকদের নিয়ে তাই বিডিও সাহেবের চলছে শেষ পর্যায়ের ঘষামাজা। গাদা গাদা ফাইল কাগজপত্র তাঁর টেবিলের ওপরে। সময় নেই তাঁর মুখ তুলে তাকানোর।
ওদিকে বাইরে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ঠেলাঠেলি, কার আগে কে ঢুকবে? অনেকক্ষণ বাদে বাদে দু-একজনের ভাগ্যে শিকেও যে ছিঁড়ছে না তা নয়। তবে আদিবাসী সেই মেয়েটির সাধ্য নেই সেই ভিড়ের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। অগত্যা হাল ছেড়ে আবারও সে গিয়ে দাঁড়াল সেই দেবদারুটার নিচে। বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বসল উবু হয়ে। বাচ্চার পেচ্ছাপে ভেঁজা তার ডান কাঁখ শাড়ির আঁচল টেনে টেনে নিচ্ছিল মুছে।
কোল ছাড়া হতেই বাচ্চা ফের কান্না শুরু করে দিল নতুন উদ্যমে। মেয়েটিও আর সইতে না পেরে ঠাস ঠাস কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল তার গালে। হতচকিত অবোধ শিশু দম বন্ধের মতো হয়ে গিয়ে আবারও কেঁদে উঠল দ্বিগুণ চিৎকারে।
দৌড়ে গেল সুদীপ্ত, ওকে কেন মারলি? ও..সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে পারলি না বলে যত রাগ এখন বাচ্চাটার ওপরে?
বলেই সুদীপ্ত বড় বড় পা ফেলে ফিরে এল অফিস বারান্দায়। হাতের খইনি দ্রুত ঠোঁটে চালান করে হাঁক দিয়ে ডাকল সাহেবের আরদালিকে। গেটের দিকে আঙুল তুলে মেয়েটিকে দেখিয়ে ঝাঁজালো গলায় জিজ্ঞেস করল, ওই যে মেয়েটি একটা দরখাস্ত হাতে নিয়ে সেই তখন থেকে ওখানে দাঁড়িয়ে, পারলে না সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করিয়ে দিতে? তুমি জানো মেয়েটির স্বামী সিরিয়াস, হাসপাতালে ভরতি! ওষুধ কেনার পর্যন্ত টাকা নেই!
সুদীপ্ত’র পাগলাটেভাব মহসিনের অজানা নয়। শান্ত গলায় সে জানাল, সুদীপ্তদা আমি তো ওকে নিয়েই গেছিলাম সাহেবের কাছে। সাহেব বললেন তিনি আজ খুব ব্যস্ত, তাই একটু পরে -
‘দেশি সাহেব তো, কায়দা একটু বেশি। দেব না যেদিন শালাকে!’, বিড়বিড় করে উঠল সুদীপ্ত।
আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম সুদীপ্তর দিকে, সেদিনের মতো আবার আরও একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড না ঘটিয়ে বসে? চেয়ার ছেড়ে উঠেও গেলাম ওর কাছে, অযথা মাথা গরম করো না তো সুদীপ্ত। বিডিও স্যার সময় হলেই তো ডাকবেন। মন্ত্রী আসছেন তাই হয়তো তিনি আজ একটু ব্যস্ত?
মাথা ঠান্ডা রাখার মতো তো ছেলে নয় সুদীপ্ত। চেঁচিয়ে উঠল, কেন মন্ত্রীরা কি কলির জ্যান্ত ভগবান? তিনি আসবেন বলে গরিবের সময়ের কোনও দাম নেই?
হাল ছাড়র পাত্র নই আমিও। বললাম, তুমি না সব ব্যাপারেই কেন যে এত তাড়াতাড়ি মাথা গরম করে ফেলো বুঝি না? এতে তো তোমার নিজেরও ক্ষতি, ক্ষতি বাড়ির লোকেরও!
‘হাঁ ক্ষতি তো হয়ই, অশান্তিও হয়!’ সুদীপ্তও যেন মেনে নিল আমার কথাটা।
আর ও যত মেনে নেয় ততই আমার স্বস্তি।
মহসিন মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে এসে ফের দাঁড় করিয়ে দিল লাইনে। লম্বা লাইন ততক্ষণে কিছুটা হলেও হয়ে এসেছে ছোট, তবুও সাত-আট জন তো বটেই!
বেয়াড়া বাচ্চা তখনও কেঁদেই যাচ্ছিল একনাগাড়ে। কিছুতেই থামাতে পারছিল না তার মা তাকে। তটস্থ হয়ে উঠল সারা বিডিও অফিস তার কান্নার চিৎকারে।
বিডিও সাহেব তো বিরক্তিতে বেরিয়েও এলেন তাঁর নিজের চেম্বার থেকে, কী হয়েছে কী? এত কান্নাকাটি কীসের?
তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলেন, তখনই তো তোমাকে বললাম একটু পরে এসো! এটা তো একটা অফিস নাকি, আঁতুড়ঘর তো নয়?
লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল মেয়েটি । জড়সড় সে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আবারও গিয়ে দাঁড়াল সেই দেবদারুটার নীচে। বাচ্চাটাকে কোল থেকে প্রায় আছড়ে ফেলার মতো নামিয়ে মার শুরু করে দিল নির্দয় হাতে।
বিডিও সাহেব মহসিনকে ডেকে খানিক রুষ্ট হয়েই বললেন, তুমি কি আমার কথা বোঝো না মহসিন? আমি তো তখনি তোমাকে বললাম আজ আর কারও সঙ্গে দেখা নয়! যদি কারও খুবই দরকার, বিকেল চারটের পর আসতে বলো!
সুদীপ্তর আগুনে চোখ তখন শুধু দাউদাউ করে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়। আমি যে আজও ভুলতে পারি না সেদিনের সেই হঠাৎ ওর মারমুখী হয়ে ওঠার ঘটনাটা! আগের বিডিও’র সঙ্গে কি না হাতাহাতিতই হয়ে গেছিল প্রায়!
বিডিও অফিসের কর্মীদের ওপরে এমনিতেই অফুরন্ত কাজ। তারওপর বছরভর নির্বাচনী কাজের ঝক্কি ঝামেলা। শনি-রবিবার নেই পুজো-পার্বণ নেই অফিসে এসে কাজ করতে হয়। ইলেকশন আরজেন্ট নামে এ যেন এক ধরণের শারীরিক ও মানসিক উৎপীড়ন, অশান্তিও।
বেঁকে বসেছিল একদিন সুদীপ্ত। উদ্ধত গলায় বলে দিয়েছিল, ছুটির দিনে সে কাজে আসবে না। ফালতু নির্বাচনী কাজের চেয়ে শুয়োর প্রতিপালন অনেক ভাল।
ব্যস একদুই কথায় বেঁধে গেল তর্কাতর্কি। অবাঙালি অফিসার তাঁদের দেশীয় ভাষায় দিয়ে বসলেন এক অশ্রাব্য গালি। সুদীপ্তও খিস্তি আওড়ে চালিয়ে দিল সাঁইসাঁই দুই-তিন ঘুসি।
হুমড়ি খেয়ে পড়লেন অফিসার নিজের টেবিলের ওপরে। ব্যথা পেলেন মাথায় গলায়, কালসিটে দাগ পড়ে গেল চোয়ালে। বড়সড় কোনও বিপত্তি ঘটেনি এই যা রক্ষে!
তারপর জল হয়তো অনেকদূর গড়াত, তবুও গড়ায়নি! দোষটা যে বেশি সুদীপ্তরই সেটা সে ক্ষমা চেয়ে মেনে নিয়েছিল বলেই বোধহয়? আসলে ধর্মকে আফিম বলা সুদীপ্ত শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারীর ওখানে যাতায়াত করার পর থেকেই কেমন পালটে গিয়েছিল তারপর! আর শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছে ওকে নিয়ে গেছিলাম আমিই!
তবুও শঙ্কা আজও আমার যায়নি, কিজানি আবার কখনও যদি সে আগের মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে?
আলতো চাপ দিলাম ওর হাতে। কি বলতে চাই আমি সেটা সে হয়তো বুঝতে পেরে ফিরে গেল সে নিজের চেয়ারে। তবুও তারমধ্যেও গজগজ করে উঠল অদ্ভুত সুরে, একটা অভুক্ত বাচ্চা কোলে সেই সকাল থেকে মেয়েটি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে! মুমূর্ষু স্বামী হাসপাতালে ভরতি, ওষুধ কেনার পর্যন্ত টাকা নেই! শালা ডাক্তার পারত না ওষুধক’টা জোগাড় করে দিতে? আর শালা বিডিও ? গুলি করে মারা উচিত সবকটাকে!
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমাদেরও তো মাসের শেষ, নইলে আমরাই দিয়ে দিতাম?
আমার কথায় যেন আরও ফুঁসে উঠল সে। টেবিল চাপড়ে বলে উঠল, আমরা পারলেও কেন দেব? সরকারি ব্যবস্থা থাকতে ও কেন পাবে না? সরকার তবে কীসের জন্যে? বা.....(অশ্রাব্য) ছেঁড়ার জন্যে?
গলা আবারও চড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ফের একটু নামিয়ে আবার বলল, আমরা দিলেও কত দেব বলো তো, দশ বিশ ত্রিশ, এর বেশি তো নিশ্চয়ই নয়? কিন্ত ওর তো কমেও দরকার পাঁচশোটি টাকার? তাই নগদ দুই ইউনিট ( দুশো চল্লিশ টাকা ) জিআর পেয়ে গেলে, বাকি ও এদিক-ওদিক থেকে হয়তো জোগাড় করে নিয়ে নিতে পারত?
এমন সময়েই বাইরে বিপুল সাইরেনের শব্দ। মন্ত্রী মহাশয়ের কনভয় আকাশে বাতাসে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে সাঁইসাঁই বেগে ঢুকে পড়ল অফিসের সামনে খোলা চত্বরে।
মন্ত্রীর সঙ্গে এসেছেন আধিকারিকরাও। সবার জন্যে আলাদা আলাদা গাড়ি, যেন গাড়ির বাজার। চত্বরে আর জায়গা নেই কোথাও। দেবদারু গাছের নিচের চিলতে ফাঁকা জায়গাটুকু সেটাও চলে গেল গাড়িওয়ালাদের দখলে। পুলিশের ধমক খেয়ে মেয়েটিকেও তাই চলে যেতে হল অফিস চত্বরের সীমানার বাইরে।
মন্ত্রী-মহাশয় গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হয়ে গেল স্থানীয় নেতা-আমলাদের মধ্যে আনুগত্য দেখানোর হুড়োহুড়ি। যেন শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা পদলেহনে কে কত পটু। দূরদূরান্ত থেকে আসা দলের লোকজনের মধ্যেও রাজাবৎসল রাজাবৎসল একটা ভাব । পুলিশরা গা নাড়ছিল চাবি দেওয়া পুতুলের মতো।
মন্ত্রী তাঁর পারিষদদের নিয়ে ঢুকে পড়লেন মিটিং হলে। চলল টানা দুঘন্টা। সরকারের মূল লক্ষই এখন আদিবাসী উন্নয়ন। কাঁরিকাঁরি টাকা লাগে তো দেবে রাজ্য সরকার। কেন্দ্র দিক বা না দিক, কুছ পরোয়া নেই, রাজ্য তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই চালিয়ে যাবে আদিবাসী উন্নয়নের কাজ।
মিটিং শেষে মন্ত্রী সাইরেনের বিজয়বাদ্য বাজিয়ে ফিরে গেলেন রাজধানীর পথে। যে চাপা উত্তেজনায় টানটান ছিল সবাই এতক্ষণ তা এখন অনেক স্তিমিত। উচ্চ বেতনভোগী আমলাদের চওড়া হসির মুখে সরকারি চাকরি করার সুখসুখ একটা ভাব। কারও হাতে মিষ্টির প্যাকেট কারও হাতে ফাইল। কেউ বা আধ খাওয়া প্যাকেট ছুঁড়ে মারছিল জানালার বাইরে। আর বাইরে থেকে ভেসে আসছিল উচ্ছিষ্টের দখল নিতে আসা কুকুরদলের লড়াইয়ের চিৎকার।
হাসি মুখে বিডিও ফিরে এলেন নিজের চেয়ারে । মন্ত্রী তাঁর রিপোর্টিং-এ খুশি।
ততক্ষণে সেই মেয়েটিও এসে আবারও দাঁড়িয়ে গেল চেম্বারের সামনে। ডাক্তার তাঁকে ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন সেই সকাল দশটায়! আর এখন বাজে চার ! এবার সে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ঢুকতে গেল ভেতরে । বাধ্য হয়ে মহসিনকেও যেতে হল সঙ্গে।
বিডিও তখন কথা বলছিলেন ল্যান্ডফোনে। হাতের ইশারায় বললেন দাঁড়াতে।
কিন্তু কথা তো আর শেষ হয় না সাহেবের! পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট...দশ মিনিট!.. ক্ষুধার্ত শিশু নিজের হাতের ছোট্ট বুড়ো আঙুলটাই ঠোঁটে নিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। বার দুই হিক্কা তোলার মতো ফুঁপিয়েও উঠল সে। সাহেব ঠোঁটের ওপর তর্জণী তুলে বড়বড় চোখে বিরক্তি ছুঁড়ে দিতেই অপ্রস্তুত মা নির্বোধ ভৃত্যের মতো রইল দাঁড়িয়ে।
শেষে শেষ হল সাহেবের কথা। রিসিভার রেখে প্রশ্ন করলেন গুরুগম্ভীর সুরে, হাঁ কী ব্যাপার, কীসের দরখাস্ত?
জবাবও দিতে হল মহসিনকেই, স্যার মেয়েটার স্বামী মেডিক্যালে ভরতি...
ব্যসএইটুকুই, বাকিটুকু শোনার আর ধৈর্য নেই স্যারের। সঙ্গে সঙ্গে ছোঁ মেরে দরখাস্তটা হাতে নিয়ে ‘অ্যালাউড’ নামের একটা শব্দ লিখে দিয়ে দিলেন তাঁর সই।
এবার সেই দরখাস্ত নিয়ে যাবার পালা ব্লক রিলিফ অফিসারের কাছে।
এই রে রিলিফ অফিসারকে তো দেখা যাচ্ছে না? আরে এই মাত্রই না তিনি ছিলেন? সদরে ওনার বাড়ি। তাই আজ বাড়ি যাবেন বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাননি তো? আরে না না, ওই তো আসছেন! বোধহয় টয়েলেটে গিয়েছিলেন? রুমালে হাত মুছতে মুছতে নাকে নস্যি নিয়ে এসে বসলেন চেয়ারে। দরখাস্তের ওপর চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কয় ইউনিট, একটা না দুটো?
এই যা, স্যার সেটা লিখে দেননি? সঙ্গে সঙ্গে মহসিনকে আবার দৌড়ে স্যারের ওখানে।
অভাগার কপাল আর কাকে বলে! সাহেব নেই তাঁর চেয়ারে! তবে সাধের ল্যাপটপটা তখনও খোলা টেবিলের ওপরে। তাহলে হয়তো তিনি গেছেন তাঁর কোয়ার্টারে। মিটিং মিটিং করে সারাদিন তকিছুই খাওয়া হয়নি যে তাঁর!
খেয়েদেয়ে এসে যখন তিনি বসলেন চেয়ারে তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটাপাঁচে। মহসিন মেয়েটিকে নিয়ে ফের চেম্বারে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন অবাক সুরে, আবার কী, এই না করে দিলাম সই?
‘রিলিফের সাহেব বললেন কয় ইউনিট জিআর সেটা তো আপনি লিখে দেননি, তাই?’..
‘ওহো! সেটা লিখে দেইনি?’, দরখাস্তটা হাতে নিয়ে, সবাইকেই তো খুশি করতে হয়, গরিবের তো আর অভাব নেই! - বলতে বলতে খসখস করে অ্যালাউডের পাশেই লিখে দিলেন ওয়ান।
সেটা নিয়ে মহসিন আবার দৌড়ে রিলিফ অফিসারের ওখানে। অফিসার ততক্ষণে গুছিয়ে ফেলেছেন। অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আর সময় পেলি না, এই শেষ বেলায়?
বলে দরখাস্ত তো নয় যেন বিষ মাখানো একটা কাগজ হাতে নিয়ে, পর্যাপ্ত রিলিফের টাকা আছে কিনা দেখে দিয়ে দিলেন তাঁর বিশাল নামের ছোট্ট একখানা রসগোল্লার মতো সই।
এঘর ওঘর করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিল বৃদ্ধ মহসিন। তবুও যার শেষ ভাল তার সব ভাল। এবার তাঁকে দৌড়তে হল ক্যাশিয়ারের ঘরে। পেছনে পেছনে বাচ্চা কোলে সেই মেয়েটিকেও।
ক্যাশিয়ার ক্যাশ বন্ধ করে দিলেও একশোকুড়ি টাকা না দেওয়ার মতো অবিবেচক হয়তো তিনি নন। দিয়ে দিলেন সেই টাকা একটা কঙ্কালসার হাতের টিপছাপ নিয়ে।
যেন এই প্রথম একশোর বেশি টাকা মেয়েটি দেখতে পেল তার চোখের সামনে। আবেগে চোখের জলে প্রায় প্রণাম করে ফেলল ক্যাশিয়ার আর মহসিনকে। ছুটে যাচ্ছিল সুদীপ্তর দিকেও। সুদীপ্ত ধমক দিতেই তাড়াতাড়ি সে অফিসঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মিশে গেল দিনঢলা রাস্তার বাঁকে।
একটু বাদে আমরাও যে যার বাড়ির দিকে। কালের নিয়মেই আবারও একটা রাত, আরেকটা সকাল। আবার বাজার আবার অফিস। সংসারের নিয়মেই ভুলে গেলাম হতদরিদ্র নগণ্য রুগ্ণ সেই আদিবাসী মেয়েটিকে।
পাঁচছয়দিন বাদে হঠাৎ আবারও আগের মতোই দেবদারু গাছটার নিচে সে সেরকমই ঠায় দাঁড়িয়ে। সেরকমই বাচ্চা কোলে নোংরা ছেঁড়া শাড়ি পরনে, বিধ্বস্ত চেহারায়।
মনে মনে বলে উঠলাম, আমরা যতই এদের জন্য করি না কেন, এরা প্রশ্রয় পেলেই পেলেই মাথায় চড়ে। আর গতর না খেটেই অনেককিছু চায়।
অনেকক্ষণ বাদে সুদীপ্ত যখন আজ আর এলই না, সেরকমই একটা সাদা কাগজ হাতে নিয়ে এল সে আমার কাছে। তাচ্ছিল্যে যেই না ওর দিকে তাকিয়েছি আর প্রায় বলতেই যাচ্ছি আজ তোর কোন স্বামী হাসপাতালে ভরতি, ওমনি সে তিনভাঁজের সাদা কাগজটার সঙ্গে একশোকুড়ি টাকা টেবিলের ওপর রেখে বলল, একটা দরখাস্ত লিখ্যে দিবি স্যার, ই টাকাটা সরকারের ঘরে জমা করি দিব?
পৃথিবীর আশ্চর্য তখন আমার চোখের সামনে। আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
‘সিদিন অনেক দেরি হয়ে গিছিল স্যার! বাঁচাতে পারিনি আর উকে, তাই...! টাকাটা মুর তো কুনও কাজেই লাগিল না, যদি অন্য কারুকে লাগে?’
যেন একটা বিষাক্ত তির বিঁধিয়ে দিল সে আমার বেদরদী বুকে! যে বেদরদী বুক থেকে সান্ত্বনার কোনও ভাষাও আর উথলে উঠতে পারবে না। আরও তো আরও ওই একশোকুড়ি টাকা সরকারের ঘরে জমা না নিয়ে এই আদিবাসী মেয়েটিকে ছোট করার মতো স্পর্ধাও আমার আর রইল না।
একশোকুড়ি কোটির ভারতের ধনকুবেরদের যত টাকা গচ্ছিত আছে সুইস ব্যাঙ্কে, সরকারের যত টাকা খরচ হয় একটা নির্বাচন সম্পন্ন করতে গিয়ে, যত টাকার কেলেঙ্কারি ঘটে সরকারি দপ্তর সমূহে... এই একশোকুড়ি টাকা যেন তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভারী মূল্য আর গুণমাণে!
প্রশ্ন অমূল্য এই টাকাটা সরকারি কোষাগারে আমি জমা করব কত নম্বর চালানে? সেরকম কোনও চালান তো সরকার তৈরি করে দেননি আমাকে! তাই সরকারি কোষাগারে টাকাটা জমা পরুক বা না পরুক এই দয়ার এই ভিক্ষার আর যে প্রয়োজন নেই ওই বিজয়িনীর!
