MANIK CHANDRA GOSWAMI

Tragedy Others

4.4  

MANIK CHANDRA GOSWAMI

Tragedy Others

বিভ্রান্ত

বিভ্রান্ত

5 mins
279



আমি অনামিকা | পশ্চিম বাংলার এক প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ে থাকি | হ্যারিকেন আর প্রদীপের আলোতে পড়াশোনা করে স্কুলের গন্ডিটা পার হয়েছি | এখন অবশ্য বৈদ্যুতিক আলোও এসেছে আর গ্রামে আসার রাস্তাটাও পাকা হয়েছে | একটু বড় হতেই মন যখন ঘরের গন্ডির বাইরে এসে নতুন জগৎকে উপলব্ধি করতে শেখে, মনে নানা রঙের কল্পনাগুলো রামধনু এঁকে যায়, পরিচিত মানুষগুলোকেও নতুন চোখে দেখতে শুরু করে, আমারও মন বসন্তের সেই মৃদু বায়ে দুলতে থাকা গাছের পাতার মতো অন্তরের অন্তঃস্থলে দোলা অনুভব করতে থাকে | মন দিয়ে বসি কল্লোলে | কল্লোল আমাদের গ্রামেরই ছেলে, মা-বাবার একমাত্র সন্তান | সে কিন্তু বাউন্ডুলে না হয়ে, অসৎ সঙ্গে উচ্ছন্নে না গিয়ে নিজের চেষ্টায় খুব ভালোভাবে স্কুলের এবং পরে কলেজের গন্ডিও সাফল্যের সঙ্গে পার হয়ে এসে বাবা-মায়ের মুখ তো উজ্জ্বল করেছেই, আমাদের গ্রামের সম্মানও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে | ধীরে ধীরে কল্লোলের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলাম আমি | কল্লোল যেমন আমাকে না দেখে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না, আমার অবস্থাও তেমনি | কল্লোল আমার জীবনের আনন্দ, আমার পথের সাথী, আমার খুনসুঁটির পাত্র, আমার ভালোবাসা | দুটি মন যখন একে অন্যকে মেনে নেয়, বিপদে নিজেকে সহযোগী মনে করে, তখন মন পরস্পরের এতো নিকটে পৌঁছে যেতে পারে যে সেই তৃপ্তির ধারে কাছেও আসতে পারে না অন্যান্য বাহ্যিক বিষয়গুলো | আমরা একসাথে পথ চলেছিলাম রূপকথার মতো নীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে | কল্লোল মোটামুটি একটা ভালো চাকুরী পেয়ে গেলো কলকাতায় | এতদূর থেকে প্রতিদিন কলকাতায় গিয়ে চাকুরী করা সম্ভব নয় জেনেই একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করলো | মাসে মাসে বাবা-মাকে পাঠানো টাকায় তাদেরও সংসার মোটামুটি সচ্ছলভাবেই চলতে থাকলো | জেঠুকে (কল্লোলের বাবা) দেখতাম সংসার চালানোর জন্য কি কঠোর পরিশ্রম করতে | দিনমজুর, মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতেন |দিনের শেষে যা রোজগার করতেন তাতেই সংসারটা কোনোমতে চালিয়ে নিতেন | তার ওপর ছিল কল্লোলের পড়াশোনার খরচ | তাই জেঠু অত্যধিক পরিশ্রম করতেন যাতে দুটো পয়সা বেশি পাওয়া যায় | কল্লোল তার বাবার পরিশ্রমের যথার্থ মর্য্যাদা দিয়েছে | ভালো পড়াশোনা করেছে আর এখন ভালো চাকুরী করছে | বাবাকে আর পরিশ্রম করতে দিচ্ছে না | নিজেই তুলে নিয়েছে সংসারের দায়িত্ব | কিন্তু দিনমজুরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই জেঠুর শরীরটা ভাঙতে শুরু করলো | বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বৃদ্ধ বলে মনে হতে লাগলো | সপ্তাহান্তে কল্লোল গ্রামের বাড়িতে আসে, আর আমি বুঝতে পারি কিছুদিন দূরে থাকাটা মানুষের হৃদয়ের টান কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয় |


আমরা আমাদের অকৃত্তিম ভালোবাসার টানে একে অন্যকে একেবারে নিজের মানুষ, কাছের মানুষ, মনের মানুষ হিসেবেই মানতে লাগলাম | একদিন শুভ দিনক্ষণ দেখে আমাদের বিয়েও হয়ে গেলো - অবশ্যই সমস্ত প্রথা মেনেই | আমি এসে পড়লাম নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন সংসারে - যে সংসারটা আমার অতি পরিচিত, আমার মনের মতো |

দুবছর হয়ে গিয়েছে বিয়ে হয়েছে আমাদের | ভবিষ্যতের স্বপ্ন গুলোকে বাস্তব করার ইচ্ছে নিয়ে দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিলো | জীবনের সব কিছু পেয়ে যাওয়ার মতো একটা মুগ্ধতার মধ্যে দিয়েই, একটা আবেগের মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিলো দিন | কিন্তু দিনগুলি সত্যিই সোনার খাঁচায় বন্ধ থাকে না | হঠাৎই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে গেলো করোনা মহামারী | এই ভাইরাস কখন নিঃশব্দে শরীরের মধ্যে ঢুকে মানব জীবনকে শেষ করে দেবার জন্য তার রক্তচক্ষু যেভাবে দেখিয়ে যাচ্ছে তাতে আমাদের মতো সাধারন মানুষে তো বটেই, উচ্চবিত্ত বা উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত মানুষেও আতংকিত হয়ে পড়েছে | কাজকর্ম সব বন্ধ হতে চলেছে | কল্লোলের অফিস থেকেও জানিয়ে দেওয়া হলো যে সে ঘরের থেকেও কাজ করতে পারবে | লকডাউন একটু আলগা হতেই দেশের বাড়িতে ফিরে এলো সে | ঘরের থেকেই কাজ করতে লাগলো | করোনা আবহে ভয়ে ভয়েই দিন কাটতে লাগলো | বয়স এবং ক্লান্তির ভারে ভেঙে পড়া বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে চিন্তাটা আরো বেশি | তবে সকলে একসাথে থাকার আনন্দই আলাদা | আমরা দুজনেই আরো বেশি কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছি | পেয়েছি পুরোনো দিনগুলোর মতো আনন্দঘন মুহূর্তকে | সংসার গুছিয়ে নিয়ে, ভবিষ্যতের দিনগুলিকে আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধিময় করে তোলার স্বপ্নকে সঙ্গী করে মাত্রাহীন খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলাম | হঠাৎই একদিন কল্লোলের অফিস থেকে ফোন এলো যে আর ঘরে বসে কাজ করলে চলবে না, কলকাতার অফিসে উপস্থিত থেকেই কাজ করতে হবে |


কিন্তু কলকাতার করোনা পরিস্থিতির যা সংবাদ পাচ্ছি তাতে তো এখন কলকাতায় গিয়ে চাকুরী করা বেশ বিপদ সংকুল বলেই মনে হতে লাগলো | বাবা-মার কথামতো কল্লোল অফিসে কথা বলে আরো কিছুদিন পরে জয়েন করার কথা বলতেই হুঁশিয়ারি এলো, 'হয় কলকাতার অফিসে ইমিডিয়েটলি জয়েন করো, না হলে আর চাকুরী থাকবে না'| একেবারে মুষড়ে পড়লো কল্লোল | এই অবস্থায় এখনই কলকাতায় যেতে চাইছে না, আবার না গেলেও চাকুরী হারাতে হবে | চাকুরী না থাকলে সংসারটা চলবে কি করে | এই চিন্তাতেই কল্লোল ভেতরে ভেতরে একদম শেষ হয়ে যেতে থাকলো |অবশেষে কলকাতায় যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লো | যাবার আগে আমার হাত দুটো ধরে বললো সাবধানে থাকার কথা, মা-বাবাকে সাবধানে রাখার কথা | কলকাতায় যাবার দিন পনেরোর মধ্যেই খবর এলো যে কল্লোল অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করেছে অফিসেরই সহকর্মীরা | প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে | আমাকে কলকাতায় যেতেই হবে, কিন্তু বাবা-মা ও কিছুতেই ঘরে থাকতে রাজি হলেন না | অগত্যা তিনজনেই গিয়ে পৌছালাম কলকাতায় |


কিন্তু আমাদের তো রোগীকে দেখতেই দিচ্ছে না, সেবা শুশ্রুষা করার চিন্তা তো বাতুলতা মাত্র | হাত পা গুটিয়ে, মনকে শক্ত রেখে শুধু ভগবানকে ডাকা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজই নেই | অবশেষে তিনদিন - হ্যা, মাত্র তিনদিন পরেই আকাশরূপী ছাদটা ভেঙে পড়লো আমাদের এই ছোট্ট পরিবারে | সবাইকে অন্ধকারের অতলে ডুবিয়ে রেখে কল্লোল চলে গেলো এই সংসারের মায়া কাটিয়ে | কিচ্ছুটি করতে পারলাম না | ঠুঁঠো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকেই শুনলাম কল্লোলের চলে যাওয়ার খবর | কত অসহায়, ক্ষমতাহীন, অক্ষম লাগছিলো নিজেকে | মৃতদেহও দেখতে দিলো না, রাতের অন্ধকারেই দাহ করে দিলো | বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তান শোকে পাথর হয়ে গেছেন - চলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন | আমি আমার মনটাকে শক্ত করে বন্ধ রেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম - সংসারটা চলবে কি করে, কি ভাবে বাঁচিয়ে রাখবো মানুষ দুটিকে | একমাত্র উপার্জনকারীকেই তো ভগবান নিয়ে গেলেন | বাবা-মাকে সান্ত্বনাই বা দেব কি করে, কি তুলে দেব তাদের মুখে | প্রতিবেশীরা হয়তো দুদিন দেখবে, খাওয়া পড়ার ব্যবস্থাও করবে - কিন্তু তারপর ? উদারপন্থী এই সমাজের কাছে একটা প্রশ্ন আমার রাখতে ইচ্ছে করছে | সন্তানশোকে বাবা-মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়, এ সমাজ আমাকে বাঁচতে দেবে তো ? সমাজের কিছু নিম্ন মানসিকতার লোলুপ শ্বাপদগুলো তাদের নখ-দাঁত বার করে আমাকে শরীরে এবং মনে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে না তো ? কোনো ভরসা কি দিতে পারবে এই সমাজ |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy